লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কবিতা

নীলাঞ্জন দরিপা

অযুত পাগলামিপুঞ্জ


আমার দু-খানি দুঃখ, যদিও সদ্ভাব নেই, আমাকে নিস্তার দিতে তবু দু-জনেই
পথে নামে, ভিন্ন পথ, কিন্তু শেষে মিলে একই, কজনই-বা হতে পারে দুঃখ নিবারক
এখন দু-জনই থমকে, অনন্ত দু-হাত নিয়ে ম্যাজিক দেখায় মোড়ে ট্রাফিক পুলিশ
কখন সংকেত দেবে সে-আশায় বসে থেকে এত বুদ্ধু ঘুণাক্ষরে চিনতেও পারে না
আমাকে অদ্ভুত বেশে। অতঃপর নিজেরাই হতোদ্যম হয়ে ধরে পরস্পরে হাত
দু-খানি বিচ্ছিন্ন দুঃখ, মুখদেখাদেখিটুকু ছিল না যাদের তারা একত্রে বাসায়
ফিরে এলে পাশবিক হাসি ছাড়ে ঠান্ডা হওয়া তড়কা-রুটির মতো ব্যাচেলর দিন


যা কিছু বলতাম, সব, অদ্ভুত বনজ শব্দে, তাই রেখে এসেছিলে গভীর বাদাড়ে
অথচ সে-ভাষা, ভাবো, জঙ্গলও বোঝেনি মোটে, আসল প্রশ্নের মুখে নিরুত্তর ছায়া
আমার সময় জলে ও জঙ্গলে বইয়ে দিল, এ-সুযোগে শিখেছি সে ফ্যাল-ফ্যাল চোখ
বিচ্ছেদের পড়া ধরলে সেইভাবে চেয়ে থাকি যেন নষ্ট ছেলেবেলা চুটিয়ে ভুলেছি
বোবা বরফের ছন্দে এসব ঝঞ্ঝাট ভাষা ছুঁয়েও দেখবে না স্বভাবত
কারণ এখনও স্পর্শে নামে অন্ধকার সিঁড়ি, ক-ধাপ পেরোচ্ছি সে তো খেয়ালও থাকে না
অথচ আমাকে ত্রস্ত করে এ-অনুচ্চ স্বরে ফোটালে হঠাৎ কেন জান্তব আওয়াজ


বাঁ-হাতে স্বপ্নের ঘড়ি, সময় কেমন যাচ্ছে না জেনেই উড়ে এসে বসেছ ডায়ালে
খামোখা চকচক করছ, আমিও অভ্যেস বশে, কবজি তুলে দেখে নিচ্ছি আয়ু কতক্ষণ
ব্যাস, চোখে চোখ পড়ছে, সারাদিন কী অস্বস্তি, পাশে বন্ধু ঝাপটা দেয় যেন ধুয়ে ফেলবে এই অন্ধের কাজল
বেশি বয়সের মোহ, তোমাকে কীভাবে দেব, অযুত পাগলামিপুঞ্জ, সে তো কম বয়সের কাছে
না কাটা নেশার মতো সুসময়ে দুঃসময়ে মায়াবী খোরাক হয়ে আছে


তুমি তো জানোই আমি এই জল হাওয়া খেয়ে তবুও তোমায় সাজাব না
কখনো ঠগের শব্দে, যা বলার স্পষ্ট বলে যাব।
মাঝে মাঝে তবু জানি নিষ্ঠুর মায়ের মতো, রাতে
লুকিয়েছি কোনো এক নতুন পুরুষ বক্ষে, তোমার ধারণাটিকে মন্দির চাতালে
যখন এসেছি ফেলে, কান্নাকাটি তখনও থামেনি
ভেবেছি এই যে মোহ, কাম, লোভ এই মতে কাটাব জীবন
কিন্তু কী যে হয় কী যে ভয়ানক হয়ে যায় এখনও বুঝি না
চুলের কাঁটাটি তার হৃদয়ে আমূল গেঁথে বিছানায় ফেলে আসি রক্তমাখা লাশ
তোমাকে জুটিয়ে কোলে তবে শান্তি, জেগে ওঠো দুধের কান্নায়
তোমাকে বাজারে আমি বিখ্যাত করব না প্রিয় প্রতারক উচ্চারণে, নির্বোধ তারিফে
অর্ধযৌনসুখী এই স্তন ধরব ওই মুখে, সপাট ভাষায়


এমন অদ্ভুত ছায়া দিলে আর যাওয়াই হল না
রোদের বিস্তারে কোনোদিন। পুরোনো ছবির মতো সাদা সাদা দাগ নিয়ে
দুর্বিপাকে কারো হাতে আসি, এ-পাতা ও-পাতা ঘুরে
নিঃশব্দ দ্বিপ্রহরে মাকে ডেকে যে ফোটায় পৃথিবীর আশ্চর্য জিজ্ঞাসা
একদিন আমিও কি অমন সরল প্রশ্নে থরোথরো বুকে
চৈত্রের রোদ্দুর ভেঙে তোমাকে ডাকিনি


কী থাকে বলার? এত সামান্য কারণে যদি না হও কাতর
এই অভিযোগে মাথা নীচু করি, দেখি কত যত্ন আয়োজন
তোমার আঙুল থেকে ঝরে ঝরে পড়ে, কত শুশ্রূষা শব্দের
না শোনা হুল্লোড় জড়ো করে আছ নিভন্ত অধরে
অপচয়ে ব্যথা জাগে, ভাব ভুল, ভাব ফের অল্পেই জেগেছে
তাই চুপ, তাই সরে আসি
করুণা বিবর্ণ আজ, তোমাকে মলিন করব, সে-সাহসও নেই


যে-জামাটি ছোটো হয়ে গেছে বলে দুঃখ হয় তার কাছে বসি
বয়ঃসন্ধির দুঃখ; সহজে ভাঙে না
রিফুর সূচের মতো ঢুকে পড়ি ছিঁড়ে যাওয়া বোতামের ঘরে
দেখি আজও বিপন্মুক্ত, রোমাঞ্চ চেনেনি। শুধু বুকের পকেট
এখনও হাতের লেখা আছড়ে ফেলে বুকের ভেতরে
ভাঁজে ভাঁজে কেটে গেছে, সেসব অক্ষর টুকরো নিয়ে
এত যে নষ্টামো, সব এক জন্মে শোধ তুলে নেবে
যে-জামাটি ছোটো হয়ে গেছে তাকে চেনাব না দেহের সৌষ্ঠব


আসলে সাহস নেই, নইলে কি কবিতা লিখতাম
নইলে তো তল্লাট হত লণ্ডভণ্ড, কবিতাসদৃশ আমাকেই লেখা হত
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কতো নয়া মহল্লায়, রকে, সভাঘরগুলি
কেঁপে উঠতো স্পর্ধা দেখে, ভাষার দৌরাত্ম্যে কেউ উচ্চারণে সাহস পেত না
আসলে আশঙ্কা, ভয়— কিছু নেই, তাই এত মলিন শব্দেও পারি ভালোবাসা লিখে
নিরীহ অক্ষরবৃত্তে, তোমাকে উচ্ছন্নে নিয়ে যেতে


বহুব্যবহারে, জানি, ক্ষয়ে যাবে মুগ্ধদিন, তবু এ-অস্পষ্ট শ্লোকে সন্দেহের চোখ
তখনও অটুট রাখবে, মেপে নেবে দু-হাতে ঝাঁকিয়ে
জীবনে রহস্যকথা কম নয়, তারও বেশি হতচ্ছাড়া ভাষার প্রশ্রয়
আমি তো লিখিনি বজ্র লিখিনি তো হারে-রেরে-রেরে
আমার সমস্ত কথা মাটির অতীতে সিঁদ কেটে
রেখে আসে কুলুঙ্গীতে পুরোনো বানানরীতি, আমাদের কথার অভ্যেস

১০
তোমাকে বলার জন্য যথাযথ শব্দ খুঁজে ফুরিয়ে ফেলেছি এই প্রিয় শীত, বাংলা ভাষার
অদৃষ্ট তামাশা জানে। এখন উথলে ওঠা বসন্তের ঠোঁটে
অযাচিত বাঙ্ময় করেছে
তুমি তো দূরেই ছিলে, এ-সুযোগে তোমার দুঃখও
মোহ-লালসার দিনে চুপিচুপি সরে গেছে উত্তর না পাওয়া সেই বন্ধুটির মতো
এখন নকল হাতে কীভাবে সাক্ষর রাখি বেহায়া ঋতুতে

১১
বদলি হওয়া প্রতিবেশী চলে যাচ্ছে চোখের আড়ালে
সিঁড়িঘরে সেই সবে কান্না ধরে এসেছে তখন
সন্ধে হব হব রং গালে এসে পড়ে
খুলেছে আলোর গুমটি এতক্ষণে মফস্সল জুড়ে,
সার সার আড্ডা চিরে দিয়ে
ও সাদা এম্বাস্যাডার কেন আসে,
                        কেন-বা কাঁদায়
উনিশশো নব্বই, আমি তোমার কিশোরীটিকে পড়াতে পারব না জানি
আমার কবিতা, তাই দুঃখ হয়, আলোর গুমটি খুঁজে ফিরি
আমাকে ফিরিয়ে দাও তার চোখ, সিঁড়িঘর, পবিত্র কান্নাটি

নীলাঞ্জন দরিপা

জন্ম, বেড়ে ওঠা পুরুলিয়ায়। কলেজ জীবন কেটেছে দুর্গাপুরে। চাকরিসূত্রে কোলকাতার বাসিন্দা আপাতত। প্রকাশিত বই ‘ফিরে গেছি বারান্দার কাছে’ এবং ‘ব্যক্তিগত জাদুকরের কাছে’।

পছন্দের বই