কবিতা
নির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
ছায়ামানুষের খেলনাগাড়ি
১৮
ত্যক্ত কারখানার লাশ
পড়ে আছে জলে ও আগুনে
গা বেয়ে গড়িয়ে রক্ত মাটিতে জমাট
জানলা হাট করে খোলা; পাল্লা একদিকে কাত হয়ে
ভিতরে লোহার কান্না, স্প্রিঙের ফিসফিস
পাখি ঢুকে পড়ে রোজ
কেউ কেউ বেরিয়েও আসে
কখনো গভীর রাত্রে বেহেডউন্মাদভবঘুরে
অজ্ঞান মাংসের চাবি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকে খোলে
চরাচর ঢেকে যায় মরচেলাগা পালকে পালকে
১৯
ধ্বনিসমূহের মধ্যে কে যেন নীরবে ঢুকে গেছে
পাখির গলায় চোরাবালি
পায়ের তলার জমি ওলটপালট করে
আড় ভাঙছে মাটির ফোয়ারা
জল কেটে বসে যাচ্ছে মর্মরিত আলোর চাবুক
আকাশে বৃংহণ আর রক্তমাখা তুলোর গোঙানি
দৃশ্যের ভিতরপর্দা ছিন্ন করে উঠে আসছে
অদৃষ্টিমোহন সাঁকো—
পবিত্র, পিছল
২০
সকরুণ স্ট্রিটলাইট বুঁদ
তলায় পা ফাঁক করে শুয়ে আছে গলি
ঝাপসা হয়ে আসা নাম অক্ষর পারছে না কিছুতেই
ভিতরে শিসের শব্দ
বিস্মৃতমেরুন পর্দা গাঢ় হতে হতে হদ্দ খাঁ-খাঁ
লোক ঢুকছে, বেরোচ্ছে পালক
বিজন মাংসের ছাঁট মুখে নিয়ে নিবিষ্ট কুকুর
ঠিকানা হারানো শোক আয়নার বাজার পার করে
গলিটার সামনে এসে বাঁশি হয়ে যাচ্ছে একা একা
২১
ক্লান্ত পোড়োবাড়ি ধীরে গাছের মুঠোয় ঢুকে গেছে
কাজ বলতে তার শুধু দিনভর ঝিমোনো
স্বপ্ন বলতে ছায়া চেটে খাওয়া
ভিতরে বাতাস ঘোরে
দক্ষিণের জানলা থেকে ঝাঁপ দেয় যুবতীর হাসি
মেঝেয় লুটানো ম্লান জাফরিকাটা আলোর পাঁজরে
ঝুঁকে আসে পাথরের ফণা
নোনা ঝুলবারান্দা শুধু চুপিসাড়ে মুঠো থেকে খুলে
ভাঙতে ভাঙতে উড়ে যায় ক্যালাইডোস্কোপের ফুটো দিয়ে
২২
দুপুরের রোদে বসে পাথরের ছায়া ভাঙে গান
তালে তালে সোমত্ত হাতুড়ি
ঘাম ঝরে
মুখে মুখে ফিরে আসা কলির শেষপ্রান্ত ধরে
দিন ক্রমে ঢলে পড়ে অনাবিল হাসির পারদে
একটু দূরে ত্রিপলের তাঁবু
হাওয়ার সংসার আগলে নিভু উনোনের পাশে শুয়ে
উঁচুনীচু রাস্তাগুলো খেলাচ্ছলে ডিঙোতে ডিঙোতে
রাতের খোরাকি নিয়ে উঠে আসে আলোর ঝরোকা
২৩
ঘোলাটে আকাশ ভেঙে গাছের গোড়ালি ডুবুডুবু
পাতায় পাতায় মিহি জলপিয়ানো
রিডের প্রলাপ
সামান্য উঁচুতে মাঠ দিগন্তে উপুড়
পিঠভরতি এলোমেলো চাবুকের ক্ষত চুয়ে চুয়ে
নরম মাংসের রেণু গুলে যায় জলে
ডুবে যাওয়া ইঁদুরের গর্ত থেকে উঠে আসে
ভাঙা দাঁত; বালকবেলার
ভেজা কাকতাড়ুয়া শুধু ফাঁকা মাঠে একপায়ে দাঁড়িয়ে
এ-পাশ ও-পাশ দোলে— যেন অনন্তের
পিয়ানোবাদক; যার হাতের আঙুলগুলো কাটা
২৪
ঝুরো পাথরের গান খরজে নেমেছে
আবছা আলো-অন্ধকারে ফণা তুলে দুলছে বুনোঘাস
বেলেপাথরের পিঠ, ছোপ ছোপ লোহার কালসিটে
শরীর বেঁকিয়ে যেন বহুকাল গুঁড়ি মেরে বসে
তলায় অনেক নীচে
দহে হাবুডুবু খাওয়া বাতাসের ছিন্নভিন্ন হাসি
আকাশ এলিয়ে আছে, শশীচুর ঝরে পড়ছে বনে
দস্তার নূপুর খুলে রেখে
বুকে হেঁটে উঠে আসছে কাটা জিভ; সুরসবিতার

নির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
২০০০ সাল থেকে লেখালেখি শুরু। প্রথম বই ‘এই জন্ম, জাদুপ্রবণতা’ (২০১১)। দ্বিতীয় বই ‘মাংসাশী মেধার ট্রাপিজ’ (২০১৩)। দ্বিতীয় বইয়ের জন্য ২০১৫ সালে কৃত্তিবাস পুরস্কার পেয়েছেন।