লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গল্প

পাপড়ি রহমান

উত্তর শিথানের গাছ

মাটি বড়ো নিষ্ঠুর— গোরস্থানের সমতল ভূমির দিকে তাকিয়ে এমনভাবে সে। যারা চলে গেছে তাদের চিহ্ন কিংবা নাম নিশানাও মাটি ধরে রাখে না। কেউ মরে যাওয়ার পর, দিন কয়েক একটা ছোটো উঁচু ঢিবির মতো দেখা যায়। ক্রমে ঝড়-বিষ্টি-বাদলায়, রোদ্দুরে নাকি লু-হাওয়ায়, নাকি বৃক্ষের পাতা ঝরতে ঝরতে অথবা বাউকুড়ানির খপ্পড়ে পড়ে কিংবা হেঁটে যাওয়া পাখি অথবা মানুষের পায়ের ভরে ওই ঢিবি নীচু হতে থাকে। নীচু হতে হতে একসময় মিলিয়ে যায়। তখন বুঝাই মুশকিল ওইখানে কারো গোর ছিল কি ছিল না? গোর ছিল নাকি ছোটো কোনো টিলা ছিল? নাকি কিছুই ছিল না? কোনো কিছুই আর বোঝার উপায় থাকে না।

মাটির কী এমন ঠেকা? কীসের এত দায় তার— সে কেন প্রতিটা মৃত-মানুষের নামধাম কিংবা কবরের নিশানা মনে রাখবে?— আমিনুল এরকম ভাবে। এইসব দায় মানুষেরই হওয়া উচিত। তারাই নিজ গরজে কবরে কবরে নামফলক লাগিয়ে দিক। কবর বাঁধিয়ে দিক। মন চাইলে শ্বেতপাথর দিয়ে বাঁধিয়ে দিক। নিজেদের সমাধিও তারা আগেভাগেই কারুকার্যমণ্ডিত করে রেখে যেতে পারে। সম্রাট শাহজাহান তো তাই করেছিল। মমতাজের নাম করে বানানো তাজমহলে সে আদতে নিজের শেষ বিশ্রামের জায়গা ঠিক করে রেখেছিল। নিজের নামে আগেভাগেই ওরকম সমাধি বানিয়ে রাখলে একটু কীরকম কীরকম দেখায় না? আদতে মমতাজ মহলকে সামনে ঠেলে দিয়ে শাহজাহানের গুপ্ত-ইচ্ছা ছিল ওই জাঁকের-গোর বানানো।

ইউনিভার্সিটির এক্সকারশনে আগ্রায় গিয়ে স্বচক্ষে এমনই তো দেখেছিল আমিনুল। মমতাজের পাশে সম্রাট শাহজাহান শুয়ে আছেন। দুইজন একে অপরের নিবিড় স্পর্শের দূরত্বে শুয়ে আছেন। যেন-বা কত যুগ ধরে গভীর ঘুমে নিমগ্ন তাঁরা! আর কোনো ছাড়াছাড়ি হওয়ার সম্ভাবনা তাঁদের নাই, আর কোনো বিরহবেদনা নাই! ফলত তাঁদের জন্য শচীন কর্তার সেই গানেরও আর প্রয়োজন নাই—
ভালো লাগে/বিরহ বড়ো ভালো লাগে/বিরহের সোহাগিনী রহে মনের ঘরেতে/

তাজমহলের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া যমুনায় আর নাই আগের সেই ছলাচ্ছল-উচ্ছল ঢেউরাশি। বরং কোনোমতে জলচিহ্ন বুকে ধরে সরু একটা জলধারা সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে গেছে বহুদূর!

নদী গতিপথ বদল করে, তার জলও একসময় শুকায় আর মানুষও জন্মায়, জন্ম নিয়ে ফের মরেও যায়— এসবের নিদান নাই। আর কেউ জানুক বা না-জানুক, আমিনুল জানে এইসবের নিদান কিছু নাই।

বাড়ির সম্মুখে ঘাস-জংলায় ছাওয়া গোরস্থানের দিকে তাকিয়ে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বেশ খানিকটা বিস্তৃত জায়গা জুড়ে এই পারিবারিক কবরস্থান। ফল-ফলাদির বড়ো বড়ো বৃক্ষেরা নুয়ে পড়ে কেমন একটা অচেনা ছায়া-ছায়া অদ্ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে। কিন্তু ওই ছায়ার ভিতর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার উপায় নাই। তীব্র ইচ্ছে হলেও উপায় নাই। কবর পাড়িয়ে গেলে গুনাহ্‌ হয়— ছোটোকাল থেকে শুনে আসা এই জপমন্ত্র এড়ানোর সাধ্য তার নাই। নিজের এরকম অপারগতায় আমিনুলের দীর্ঘশ্বাসেরা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়, সেইসঙ্গে কেমন একটা বিজ-বিজে রাগ নাকি বিরক্তি এসে তাকে আক্রান্ত করে ফেলে! এই জীবনের সবকিছুতেই খালি অপচয়। ভিতরে অপচয়, বাইরে অপচয়— অপচয় ছাড়া আর কিছুই যেন নাই আর এই ধরায়! নইলে সেই কোনকালে গত হওয়া, কোন জনমে এই পৃথিবীতে আসা তার বংশের লোকজন মেঘের সাথে নাকি বাতাসের সাথে হাডুডু খেলে-টেলে ফের কিনা তাদের এই পিতৃভিটাতেই দখল নিয়েছে। দখল নিয়ে এমন একটা বিস্তৃত জমিনজুড়ে শুয়ে আছে! কী হত অমন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কবর না দিলে? গাদাগাদি ঠাসাঠাসি করে কবর দিলে আরও খানিকটা জায়গা নিজেদের পালানের জন্য পাওয়া যেত।

আমিনুলের ভাবনা কিছু অমূলক নয়— এতটা জায়গাজুড়ে কবরস্থান না থাকলে আরও কিছু আনাজপাতির চারা অনায়াসে লাগিয়ে দিতে পারত সে। নিজের পালানে ফলানো যেত ঝিঙে-কুমড়ার স্তূপ। ঢেঁড়স আর বেগুনের সবুজ-বেগুনির মিশেলে ভারি একটা রংবাহার খেলে যেত আঙিনাজুড়ে। কিন্তু তা তো আর হওয়ার উপায় নাই। খালি চোখে দেখলে মনে হয় বিস্তৃত কোনো খালি জমিন— কিংবা বেখেয়ালে পড়ে থাকা জমিনের উপর কিছু ফিনফিনে দূর্বাঘাস আর ফার্নের ডগা-মাথার দোল-দোলানি। ওইসব এন্তার সবুজের মাঝে কিছু কিছু শেয়ালমুতার হালকা-বেগুনি ফুলের লজ্জিত হেসে থাকা দেখে যে-কেউ বিভ্রমে পতিত হতে পারে— আহারে! এত্ত সুন্দর খালি জায়গাটারে আবাদি করল না কেউ? কিন্তু দুই-একটা কবরের ঢিবি তখনও অসমান বলে খালি জায়গাটা নিয়েও সন্দেহ ঘুরপাক খায়। ঘুরপাক খেতে খেতে সেই সন্দেহ স্থিরও হয়। সন্দেহ বিষয়টা যেন লাটিমের মতো— ঘুরপাক খেতে খেতে একসময় স্থির হয়। কিন্তু স্থির হওয়ার পূর্বে মাটির-বুকে বেশ খানিকটা খোড়ল রেখে যায়। যায়-ই।

সন্দেহের স্বভাব যে লাটিমের মতো তা আমিনুল ভালো করেই জানে। ঘুরতে ঘুরতে স্থির হওয়া। আর স্থির হওয়ার পূর্বে ধারালো লেজে মাটির বুকে গভীর একটা খোড়ল করে দেয়া। ফলত আমিনুলও সকলকে সন্দেহের চক্ষেই দেখে। এরকম না দেখে সে করবেই-বা কী? অন্যকে সন্দেহ করে চোখে চোখে না রাখলে তার নিজের আসল চেহারাটা বেরিয়ে পড়বার সম্ভাবনা থাকে। অন্যের কাছে ধরা পড়ার পূর্বে সে নিজের আসল চেহারাটা লুকিয়ে রাখতে চায়। গোপন রাখতে চায়। এই যেমন সে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষ করেও কামাই-রোজগারের ধান্ধা তেমন করল না। পড়া শেষ হওয়ার প্রাক্কালে আমিনুল একটা বিয়েও করে ফেলল। আমিনুল যাকে বিয়ে করল তার চেহারা-ছবি তেমন সুবিধার নয়। সুবিধার না হলেও আমিনুলের নিজের যুক্তির কাছে সে কিন্তু দুর্দান্ত রূপসীই বটে! পোলিও রোগে আমিনুলের বউয়ের একটা পা বেঁকে গিয়ে তাকে খানিকটা খোঁড়া করেও রেখে গিয়েছে। আমিনুল এমন মেয়েকে বিয়ে করতে পারে এরকম অন্যেরা কস্মিনকালেও ভাবে নাই। বউ দেখে আমিনুলের মা আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে সেই যে ফিট পড়ল— এর পরে বেচারাকে কিনা ফিটের ব্যামোতেই পেয়ে বসল। এবং এর পর থেকে সংসারে ভজঘট কিছু একটা লাগলেই পারুলবিবির ফিট-পড়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়াল। আমিনুল পারুলবিবিকে কিছু বলল না। বরং সে তার সন্দেহের লাটিমের দিকে দৃষ্টি দিল। মা কি বুঝে ফেলেছে আমিনুলের ভেতরের বাসনা? আফরোজা বেগমের বাপের রেখে যাওয়া কয়েক কানি জমি পাওয়ার আশায় বুক বেঁধে আমিনুল যে এই বিয়েটা করেছে, সেটা কিছুতেই পারুলবিবিকে বুঝতে দেয়া যাবে না! মা হলেই কী আর সন্তান হলেই কী! এ-জগতে কাউকে বিশ্বাস করে সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ রাখার মতো বোকা আমিনুল নয়।

আমিনুলের সন্দেহের তালিকা দীর্ঘ, শুধু দীর্ঘ নয়, বেশ দীর্ঘ। সে-তালিকায় পারুলবিবি যেমন আছে, আফরোজা বেগমও আছে। আমিনুল তার তালিকা থেকে এ-পর্যন্ত কাউকেই বাদ রাখে নাই। আমিনুল জানে, কাউকে বাদ রাখলেই বিপদ। উলটা আমিনুলকেই সন্দেহ করে বসতে পারে!

কিন্তু আমিনুল তা কোনোভাবেই চায় না। চায় না তাকেও কেউ সন্দেহ করে চোর-ছ্যাঁচড়ের লিস্টিতে রাখুক। আমিনুল আদতে চোর হতে চায় না। সে চায় পুলিশ হতে। পুলিশ হয়ে অন্যদের গতিবিধিকে কব্জায় রাখতে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশটাস ইত্যাদিকেও আমিনুল তার পুলিশি নজরদারিতে কাজে লাগায়। যেহেতু পড়া-লেখার বেশ ওজনদার একটা সার্টিফিকেট তার ঝুলিতে তোলা আছে, সেহেতু আমিনুলকে নিয়ে অন্যেরা সন্দেহ প্রকাশ করার অবকাশ পায় না।

সার্টিফিকেটের গুণাগুণ আমিনুলও ভালো করেই জানে। আমিনুল যখন পাশটাস দিয়েও গ্রামেই ফিরে এল, তখন অন্যেরা তার মহানুভবতার কথাই প্রাথমিকভাবে ভেবেছে। যখন সকলেই প্রায় উন্নত জীবনযাপনের আশায় শহরমুখী— সেখানে আমিনুলের ফিরে আসা— এটা এক অর্থে চমকই ছিল বটে অন্যদের কাছে। কিছুটা সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে দেখেছিল তারা দেখেছিল আমিনুলের এই ফিরে আসাকে। আমিনুলও দিব্যি উপভোগ করে যাচ্ছিল তাদের দেয়া সেই মর্যাদাকর অবস্থানকে।

আমিনুলের পরিশ্রম করতে ভালো লাগে না এটা যেমন সত্য ছিল, পাশাপাশি এটাও সত্য ছিল গ্রামের বাড়িতে নিজের অবস্থানকে পোক্ত করা। আত্মীয়-স্বজনেরা বলতে গেলে আধুনিক-জীবনের মোহে পড়ে প্রায় সকলেই শহরাভিমুখী।

আমিনুল এসেছিল গ্রামের বাড়ির ধূলিকণাটিকেও তুলে নিয়ে নিজের ঝোলাতে পুরে রাখার জন্য। পিতামহের রেখে যাওয়া যা-কিছু— সমস্ত কিছুর অধিকর্তা সে না হলে সে-সব অন্য শরিকদের হাতবন্দি হয়ে আর কতক্ষণ?

এই ভয়-ভাবনা-দুর্ভাবনা আমিনুলকে তাড়িয়ে ফিরছিল বলেই সে পিতামহের রেখে যাওয়া এজমালি বাড়িটাতে ঝটাঝট ফিরে এসেছিল।

আমিনুলের পিতামহীর ছিল গাছগাছালি-পাতালতার বেজায় সখ। বাড়ির চারদিকে ঘুরে ঘুরে গাছ-লতা-পাতা বুনে দেয়া, সেইগুলা যাতে নির্বিঘ্নে বাড়তে পারে সেই তদারকিতে বুড়ির দিনদুনিয়ার অন্য কোনো কিছুর খেয়াল তেমন ছিল না। ষড়ঋতুর যে কয়টা ফল সে মুখে দিত, তার বেশিরভাগের বীজই সে পুতে দিত মাটিতে। অতঃপর বীজ থেকে অঙ্কুর, অঙ্কুর থেকে চারাগাছ হওয়া পর্যন্ত তক্কে তক্কে থাকা। কোনো গাছ গা-ঝাড়া দিল কি দিল না, বুড়ির ব্যস্ততা তখন আর দেখে কে? বুড়ি তখন ছুট লাগাত বাঁশঝাড় অভিমুখে। বামহাতি বুড়ি কিছু কঞ্চি আর বাঁশ কেটে ঘিরে দিত সেই চারাগাছকে। যাতে গোরু-ছাগলের পেটে যেতে না পারে। নিয়ম করে নিড়ানি দেয়া, জল ঢালা সবই অক্লান্ত করে যেত। গাছ বড়ো হলে, ফল দিলে বুড়ির পাহাড়াদারির কাজও শেষ হয়ে যেত। চারাগাছের প্রথম ফল মসজিদের মুয়াজ্জিনের হাতে তুলে দিয়ে তবেই না ক্ষান্ত হত সে। এই করে করে বুড়ি বাড়িটাকে গাছগাছালিতে একেবারে ছেয়ে ফেলল। লতাপাতা, অর্কিড আর গাছের ছায়াতে সমস্ত বাড়িটাই ক্রমে হয়ে উঠল জঙ্গলাকীর্ণ।

বাড়ির উত্তর দিকের সীমানা ঘেঁষে বেড়ে উঠল দুই-তিনটা আম, একটা যজ্ঞ-ডুমুর, একটা খর্বাকৃতি পিপুল আর তিতিজামের গাছ। আমিনুলের পিতামহীর কাছে ওইসব নিছক গাছ ছিল না। বুড়ির হাতে লাগানো সমস্ত গাছপালাই ছিল বুড়ির কাছে নিজের পেটের সন্তানের মতো। কোনো চারাগাছ গা-ঝাড়া দিয়ে আশমানের দিকে বাড়বাড়ন্ত হতে শুরু করলেই বুড়ি তার একটা নাম দিয়ে দিত। যেমন উত্তর দিকের গাট্টাগোট্টা আমগাছটা যখন পাতা-ঢেকে-দেয়া বেশুমার ফলে যুবতী হয়ে উঠল, বুড়ি গাছটার নাম দিল— টিয়াটুটি। আমিনুলও বালক থেকে কৈশোরে খানিকটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার পর এই নামটা নিয়ে ভেবেছে—

দাদিজান এমুন একটা নাম ক্যান থুইল এই আমগাছের?

টিয়াটুটি— এই নামের অর্থ কী?

কালচে-সবুজে ছেয়ে থাকা ছোটো-ছোটো আম! আমের বোঁটা ছাড়িয়ে ক্রমান্বয়ে নীচের দিকে নামতে নামতে টিয়াপাখির ঠোঁটের মতো বাঁকিয়ে গেছে! আম নয় যেন কোনো টিয়াপাখির বাঁকানো সবুজ ঠোঁট। আহারে! বুড়ির মনে যে কত কী ছিল? কত দিকে নজর রাখার পরই না আমগাছের এমন কোনো নাম দেয়া যায়?

বুড়ির গাছপালার এইরকম কারিশমা কবরখানাতেও কম দেখা যায় না।

চারটা গাছ একেবারে শঙ্খলাগা সাপের মতো জড়িয়ে-পেঁচিয়ে আন্ধার-করা-সবুজে নুয়ে পড়েছে গোরের দিকে। জ্যৈষ্ঠের হাঁসফাঁস করা গরমে যখন পাকনা-আমের সুবাস নিয়ে হাওয়া থম ধরে থাকে, কাঁঠালের নাকি কাঁঠালিচাঁপার খুশবু নিয়ে উত্তাপ আরও ঝেঁপে নামে মাটিতে— তখন তাকিতাকি করে খুঁজতে হয়— গাছটা কি আমের না কাঁঠালের? নাকি কাঁঠালিচাঁপার? বাদলার দুই-চারটা ফোঁটা ওই আন্ধার-করা-সবুজে পড়া মাত্রই বাতাবিনেবুগুলার হলদেটে আভাও যখন উঁকিঝুঁকি মেরে বসে, তখন ব্যপারটা হয়ে দাঁড়ায়— লও ঠ্যালা! এইবার আন্ধার-করা-সবুজের লগে তুমিও খানিকটা বেসামাল হও। গাছবাকলের ভুলভুলাইয়ায় ঘুরপাক খেতে খেতে তুমার চক্ষেও আন্ধার নামুক।

আমিনুলের বালক ও কিশোরকালজুড়ে এই ভুলভুলাইয়া কম কিছু ছিল না। আজও ওই শঙ্খলাগা গাছগুলির কোনো সুরাহা আমিনুল করতে পারে না। শুধু আমিনুল কেন, ওই বুড়ি ছাড়া আর কারো পক্ষেই বোঝা সম্ভবপর ছিল না কোনটা আমগাছ আর কোনটা কাঁঠালের? কোনটা বাতাবিনেবু আর কোনটা কাঁঠালিচাঁপার?

এরকম আজব-কিসিমের কায়কারবার ওই বুড়ি ছাড়া আর কারো পক্ষেই করা সহজ ছিল না— ফলফলাদির বৃক্ষের সাথে কীভাবেই কাঁঠালচাঁপার ফুলগাছকে কেউ জড়িয়ে যেতে দেয়? তার উপর যখন সকলেই জানে যে, কাঁঠালিচাঁপা ফুলের গন্ধে মাতাল হয়ে সাপেরা কিলবিলাতে থাকে গাছের তলায়। গাছ আর সাপের সহাবস্থানে থাকা— ওই বুড়ি ছাড়া আর কারো মাথা থেকে বেরুনো প্রায় অসম্ভব!

কবরখানার গাছগুলি বুড়ির বিশেষ যত্নে বেড়ে উঠেছিল। ঝেঁকে-আম-ধরা গাছটার নাম বুড়িই রেখেছিল— ঝুনকি। হয়তো ঝোঁপা-ঝোঁপা ঝুলন্ত আমের সৌষ্ঠব দেখেই বুড়ি এই গাছটার নাম দিয়েছিল— ঝুনকি! আহা! নামের কী বাহার! আমিনুলের মাথায় বিজবিজে রাগটা এসে ফের যেন ছুরি চালাতে থাকে। আরেকটা আমগাছ বিশাল হতে হতে সাঁঝ-প্রভাতের সমস্ত আলোকেই শাখাপত্রে গিলে নিতে পারে— দলকচড়া! পাকা আমের খোসার ভেতর গুঁটি বাঁধা মাংসপিণ্ড! বুড়ি কী অকাতরেই না বলত—

দাদাভাই, আরেকটু উপরের ডাইলে যাইতে হইব। সাবধানে ডাইল ধইরা যাইও। ওই যে দ্যাহো, পাতার ভিত্রে লুকাইয়া রইছে সিন্দুইরা-লাল-ধরা-আম।

কথা সত্য! দলকচড়া গাছের আম পেকে গেলে সিন্দুরের মতো টুকটুকে লালবর্ণ ধারণ করত। সামান্য টকের মিশেল হলেও ওই গাছের আমের সোয়াদ অসাধারণ!

আমিনুলের শূন্য-চোখ দাদিজানকে খুঁজে ফেরে। কই তার দাদিজান? কই সেই গোলাপি-আভা-ঠিকরানো দাদিজানের পানপাতার মতো মুখের-ডৌল? গাছলতার জননী— বনবাদাড়ের পেলবতাকে নিজদেহে ধারণ করে রাখা সেই সদা-কর্মঠ-নারী— কই হারিয়ে গেল সে? আমিনুল মাথা খুঁড়লেও তো খুঁজে বের করতে পারবে না দাদিজানের গোর কিংবা গোরের কোনো চিহ্ন! কই আছে তার দাদিজান? কোন বৃক্ষের ছায়াতলে সে নির্ভার শুয়ে আছে? এই কবরস্থানে সবই কেমন সমান! সবই কেমন অকাতরে সবুজ ঘাসের তলায় দীর্ঘ ঘুমে মরে আছে! দাদিজানের গোরের সামান্য ঢিবি হয়ে থাকা মাটির চিহ্নও আজ আর কোথাও অবশিষ্ট নাই।

আমিনুল এমন দেখে বা ভাবেও। কিন্তু পরক্ষণেই কি তার চমক ভাঙে না? দাদিজান রাবেয়া খাতুনের হাড়গোড়ও আজ হয়তো মাটির সাথেই মিশে গেছে। কিন্তু এই যে আন্ধার-করা-ছায়া, এই যে নুয়ে-থাকা-বৃক্ষেরা, এই যে অমোঘ-সবুজ এসবের ভেতরে কি দাদিজানের রুহ্‌ এসে ভর করে না?

অকারণেই আমিনুলের গায়ে কাঁটা দেয়, লোমগুলি জারিয়ে ওঠে—

আমিনুল তো প্রায়ই রাবেয়া খাতুনকে দেখতে পায়। আদুল গায়ে, এক প্যাঁচ দিয়ে ডুরে-শাড়ি পরা দাদিজান— কবরস্থানের ফনফনানো-ঘাস-জংলা না-মাড়িয়ে দিব্যি শূন্যে ভাসতে ভাসতে কোনো গাছের কোটরে ঢুকে পড়ছে! সেই কোটরে হয়তো কোনো টিয়াপক্ষীর বাসা! কোটরের ভেতর সদ্য ফুটানো বাচ্চারা চিঁউচিঁউ করে ডাকছে। আর দাদিজান তাদের আঁচলের কোমল ওমে তুলে নিতে নিতে বলছে—

আহারে! বাচ্চারা কাইন্দো না। কাইন্দো না। মায়ে এক্ষুনি আইয়া পড়ব খাওন নিয়া।

বৈশাখের গা-জ্বালানো-দুপুরে আমিনুল দাদিজানের অপেক্ষায় থেকে থেকে ক্লান্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু গাছের খোড়ল থেকে দাদিজান কিছুতেই বের হয়ে আসে নাই। আমিনুল তো জানেই, দাদিজানের স্বভাবই ওমন। ওমনই। যতক্ষণ মা-পাখি নীড়ে না ফিরবে দাদিজান কিছুতেই ছানাদের ফেলে বের হয়ে আসবে না।

আমিনুল ভেবেছে দাদিজানকে খুঁজে বের করে বলবে—

আইচ্ছা, এত্ত গরমে তো তুমি মইরা যাইবা। চল চল ঘরে চল।

পরক্ষণেই সে হতাশ বোধ করেছে!

ধুর! এতসব গাছপালার ভিড়ে, জলাজংলার আবেষ্টনে আর এতসব পাখপাখালির ডাকে দাদিজানকে খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব!

কোন গাছ থেকে কোন গাছে খুঁজে বেড়াবে সে? কোন কোটর থেকে কোন কোটরে? আমিনুলের জন্য এটা একেবারেই এক অসম্ভব ব্যাপার!

পিতামহী রাবেয়া খাতুনের বড়ো সাধের টিয়াটুটি আমগাছটার দিকেই কিনা প্রথম নজর পড়ল আমিনুলের! এ-দিকটা বাড়ির পেছনের দিক— এতদিনে ঝোঁপ-জংলা তাদের বংশবিস্তার করে ঘন-অরণ্য বানিয়ে ফেলেছে। যগডুমুরের গাছটাও বয়সের ভারে শরীর নেতিয়ে প্রায় পড়ো-পড়ো হয়ে উঠেছে! সামনের কালবৈশাখীতে হয়তো সে ধরাশায়ী হয়ে যাবে। এখন এই জঙ্গল— পড়ো-পড়ো ডুমুরগাছের আড়াল— এখান থেকে কিছু একটা কেটে ফেললে বা সরিয়ে ফেললে সহসা ধরা যাবে না। গাছ ছাড়া শূন্য-ময়দান বড়ো বেশি চোখে লাগে। আমিনুল তাই আগেভাগেই সতর্ক। সে নিজের কোনো কাজের জন্য কাউকে জবাবদিহি করতে চায় না। ফলত গাছ কাটা নিয়ে আমিনুল কথাবার্তাও বলে নাই কারো সাথে।

একদিন ভোরের সূর্য নিস্প্রভ থাকতে থাকতেই করাতিরা এসে হাজির হল। তাদের পিঠে লটকে থাকা কাপড়ের ঝোলায় খাঁজকাটা করাতের অস্তিত্ব জানান দিয়ে যাচ্ছে। করাতের ধারালো খাঁজ বারংবার কুমিরের দাঁতের মতো ঝলসে উঠছে সকালের উত্তাপহীন-রোদ্দুরে। একজন ধাইধাই করে উঠে পড়ল টিয়াটুটির মোটা ডালে। আর দুইজন করাতের দুই দিকের হাতল ধরে মাটির ওপর দাঁড়াল। এই দুইজন নীচে থেকেই করাত টানবে। অন্যজন গাছের ওপর দাঁড়িয়ে। আমিনুল এদিকসেদিক তাকাতাকি করে দেখে নিল কে কে ঘুম থেকে জেগে গেছে, আর কার কার এখনও সকাল ফুটে ওঠে নাই।

করাতিরা টিয়াটুটির ডালে ঘ্যাঁচর ঘ্যাঁচর শব্দে করাতের ছোবল বসাতে শুরু করল। খাঁটি সোনার সাথে খাদ মেশানোর পর যে ম্যাটম্যাটে-হলদে রং ধরে, আমগাছটা থেকে তেমনি রঙের গুঁড়ো-গুঁড়ো কাঠ ঝরে পড়তে শুরু করল। যেন-বা কোনো বিশাল আকাশমনি বৃক্ষ থেকে অবিশ্রাম-ধারায় ঝরে পড়ছে পুস্পরেণু! আমিনুল সেদিকে তাকিয়ে খানিকটা যেন চমকে গেল!

দাদিজান কখন তার পাশে এসে দাঁড়াল? হায় হায়! দাদিজানের পিন্ধনে দেখি কাপড়জামা কিচ্ছু নাই! আমিনুল কী চোখে কুনু ধান্ধা দেখতেছে? আমিনুল চোখ ডলে ফের ভালো করে তাকাল। নাহ্‌! কুনু ভুল নাই, দাদিজান। দাদিজানই। দাদিজানের পরনে একপ্যাঁচের ঘিয়েরঙা-শাড়ি। মলিন হতে হতে ঘিয়েরংটা আর বোঝার উপায় নাই! ওই শাদা আর ঘিয়ের মাঝামাঝি কিছু একটা থুবড়েটুবড়ে উঠে গেছে দাদিজানের আদুল হাতের ওপর দিয়ে।

কাঁচাপাকা, কিরিকিরি-কোঁকড়া চুলের বোঝা উদোম পিঠ ছাপিয়ে কোমরের দিকে নেমে গেছে। যেন-বা পুকুরের থুম-ধরা-জলে বেদিশা হাওয়ার টানে ছোটো-ছোটো ঢেউ উঠেছে। জলের দুলুনিতে ঢেউগুলি একটার পিঠে একটা পলকে হেলে পড়ছে। আমিনুলের কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগল। এক্ষুণি হয়তো দাদিজান তেড়েফুঁড়ে আসবে টিয়াটুটি গাছটার এরকম সর্বনাশ করার জন্য। আমিনুলের একবার মনে হল করাতিদের গাছ কাটতে নিষেধ করে দেয় সে। কিন্তু দাদিজানের কাণ্ডকারখানা দেখে সে নড়তে পর্যন্ত পারল না। আমিনুল দেখল আকাশমনির পুস্পরেণুর তলায় দাদিজান অকাতরে মাথা পেতে দিল। অবিশ্রাম ফুলরেণু ঝরে পড়তে লাগল দাদিজানের কিরিকিরি-কোঁকড়া চুলের গুচ্ছতে। কিন্তু দাদিজান নির্বিকার। ক্রমে দাদিজানকেই আড়াল করে ফেলল ওই রেণুর-ঝরনাধারা। আমিনুল দেখল— পলকেই কেমন নাই হয়ে গেল দাদিজানের আদল! আজব তামশা বটে!

এই বাড়িতে আসা-অব্দি আমিনুলকে নানান চক্করই দেখিয়ে চলেছে রাবেয়া খাতুন। আমিনুল যেদিন দাদাজানের আমলের তামার বড়োসড়ো ডেগটা বিক্রি করে দিল, রাবেয়া খাতুনও যেন সেদিন থেকেই তার পিছু নিল। আমিনুল একলা হলেই সে যেন পেত্নীর মতো কাঁধে চেপে বসে। ব্যাপারটা আমিনুল কাউকে বলতেও পারে না। এরকম কথা অন্যদের বলে-টলে সে জলজ্যান্ত মিথ্যাবাদী হতে চায় না।

এমনকী মা পারুলবিবিকে এ-কথা বললেও সে উলটা উপদেশের ঝুড়ি ঢেলে দিবে—

কী কও এইগুলা বাজান? আয়-রোজগারে নজর নাই বইল্যাই হয়তো এমুন খোয়াব দেহো তুমি।

এরকম কথাবার্তা শুনলেই আমিনুলের মাথার ভেতরটা রাগে বিজবিজ করে। কিন্তু আমিনুল রাগলেই কী আর কাঁদলেই কী? রাবেয়া খাতুন তো তাকে ছেড়ে যাচ্ছে না কিছুতেই।

এই যে খানিক আগেই আকাশমনির পুস্পরেণু গায়ে মেখে কই না কই ডুব দিল সে! এখন রাবেয়া খাতুনের তালাশে আমিনুল যদি সমস্ত বনবাদাড় চষে ফেলে তাও কি তাকে খুঁজে পাবে? না, পাবে না। রাবেয়া খাতুন নিজে এসে ধরা না দিলে আমিনুল তাকে কিছুতেই খুঁজে পাবে না।

দাদিজানের এরকম মতিচ্ছন্নতায় আমিনুল আরও বিরক্ত বোধ করে। বুড়ি মরেও দেখি মরে নাই! দিব্যি এসে সংসারের চাবিকাঠি নাড়তে শুরু করেছে!

করাতিদের ঘ্যাচরঘ্যাচর গাছকাটার শব্দে সকালের রোদ্দুর তার ম্যান্দামারা ভাব কাটিয়ে বেশ চনমনে হয়ে উঠেছে। সূর্যের কিরণ তেরছা ভঙ্গিতে লুটিয়ে পড়েছে কাঠের গুঁড়োর স্তূপের ওপর। বাতাস আমোদিত করে ভেসে বেড়াচ্ছে আমগাছের ভেষজ-মৌতাত। আমিনুলের বড়ো চেনা এই গন্ধ! আমিনুল জানে, আমপাতা হাতের চেটোয় চটকে নিলে এই গন্ধ গাঢ় থেকে আরও গাঢ় হয়ে উঠবে। শুধু কি পাতার? গাছেদের কাণ্ডেরও আলাদা আলাদা গন্ধ রয়েছে। সে-সব গন্ধ ঘাস নাকি ঘাসফুলের মতো, খড় নাকি বিচালির মতো— আমিনুল তা সঠিক নির্ণয় করতে পারে না।

এই যেমন এখন করাতের ধারালো দাঁতের নীচে পড়ে দাদিজানের টিয়াটুটি আমগাছটা লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে। আমের পাতাগুলি কেটেছেটে আলাদা করে রেখেছে করাতিরা। শাখা-ডালের একটা স্তূপ যগডুমুরের গাছটাকে প্রায় আড়াল করে রেখেছে— এখান থেকে আমিনুল কী করেই বা আলাদা করবে ঘেসো-গন্ধ কিংবা খড়বিচালির স্যাঁৎসেঁতে গন্ধ-কে?

আমিনুলের তো অত বোধবুদ্ধি নাই! আমিনুল নিজের ওপরই বিরক্ত হয়— এতসব উদ্ভট চিন্তা তার মাথাতেই খালি চক্কর খায় কেন? জঙ্গলের গন্ধ কেমন তা খুঁজতে খুঁজতেই তার মাথা অন্ধকার হওয়ার যো। ওদিকে দাদিজান যে কাঠের-গুড়ো নাকি আকাশমনির ফুলরেণুর তলায় অদৃশ্য হয়ে গেল তা নিয়েও তো সে গোলকধাঁধাতেই আছে। সূর্যের চড়তা-আলোর উত্তাপে করাতিরা বিনবিনিয়ে ঘামছে— দুই-একবার তারা জল খেতে চেয়েছিল কিনা আমিনুল এখন কিছুতেই মনে করতে পারছে না।

আকাশমনির রেণুর স্তূপ ফুঁড়ে দাদিজান হঠাৎ উদয় হলে আমিনুলের ধন্দ আরও বাড়ে। দাদিজান তার সাথে বেশ একটা রহস্য রহস্য খেলায় মেতে উঠেছে। খানিক আগেই না সে বেপাত্তা হয়ে গেল, এখুনি কী করে সে বজ্রপাতের মতো নাজিল হল ফের?

দাদিজানের পরনে এখন লাল-কালোর ডোরাকাটা-শাড়ি। অথচ তাকে তো শেষবার দেখা গিয়েছিল শাদা-অফহোয়াইট রঙের মাঝামাঝি কোনো অবস্থানে!

দাদিজান বলে ওঠে—

এই গাছডা কাইট্যা ফেলাইলি? আমগুলি বড়োই সোয়াদের আছিল।

আমিনুল দেখে দাদিজান ফাদিজানের ছায়াটাও কোথাও নাই— তার সম্মুখে মা পারুলবিবি দাঁড়িয়ে আছে। পারুলবিবির গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আমিনুলের পনেরো বছরের পুত্র মালেকুল! আমিনুল খানিকটা বিব্রত বোধ করে। সে ভেবেছিল পারুলবিবি ঠাওর করার পূর্বেই মজুরি চুকিয়ে করাতিদের বিদায় করে দেবে। কিন্তু সেটা তো আর হল না।

পারুলবিবি আমিনুলকে ঠান্ডা গলায় বলে—

মুরুব্বিগো হাতের জিনিস এমুন কইরা কাটন নাই, বাজান।

বলেই টিয়াটুটির কাটা ডালপালার স্তূপের দিকে একপলক তাকায় সে। অতঃপর ঘরের দিকে হাঁটা দেয়।

আমিনুল দেখে দাদির পাশপাশি মালেকুলও ঘরে ফিরে যাচ্ছে। ছেলেটাকে আজ এমন বড়োসড়ো দেখাচ্ছে কেন? লম্বা হতে হতে আমিনুলকেও সে হয়তো মাথায় ছাড়িয়ে গিয়েছে।

মধ্যাহ্নের রোদ পড়ে আলোর মেজাজ নরম হয়ে এলে প্রায় বিকেলেই পায়চারি করে আমিনুল। মৃদু-পায়ে হাঁটতে হাঁটতে চারপাশে কী যেন খুঁজে বেড়ায়! খুঁজতে খুঁজতে তার চোখদুটো একসময় সরু হয়ে ওঠে। সরু হয়ে প্রায় বুজে আসতে চায়। কিন্তু না, চোখ বুজলে চলবে কী করে? ফলত আমিনুলের দৃষ্টি কবরখানার সবুজ থই-থই করা বৃক্ষরাজির ওপর স্থির হয়। আমিনুল অবাক হয়ে ভাবে— শাখাপত্রে জড়াজড়ি করে কেমন নিশ্চিন্ত জীবন এই গাছেদের! খাওয়া-পরার চিন্তা নাই। বিছানা-ঘরের চিন্তা নাই। পাতা ছড়িয়ে ঘন-ছায়া বিস্তার করে পাশের ঢালু-জমিনটাকেও নিজেদের আয়ত্বের মাঝে নিয়ে নিয়েছে! আর ওই ছায়াচ্ছন্নতার তলায় যারা চিরঘুমে শুয়ে আছে, তারাও এক অর্থে নিশ্চিন্তই। অবশ্য আমিনুল সঠিক জানে না, তারা সত্যিই নিশ্চিন্ত কিনা? এই একটা বিষয় আমিনুলকে বরাবরই ধাঁধায় ফেলে দেয়— এই যে কত কত আপনজন ওই মাটির তলায় নিজেদের স্থায়ী ঠিকানায় চলে গেল, তারা আদতে কেমন আছে? কেউ তো কোনোদিন ফিরে এসে জানিয়ে গেল না যে মাটির তলায় কেমন মরণে তারা থাকে? বা ওইখানের সুখসুবিধা মাটির ওপরের চাইতেও উত্তম কিনা? অথবা ওইখানেও কী এরকমই চলমান সবকিছু কিনা? আর কিছু না হোক মাটির ওপরে যারা আছে, তাদের খাওয়ার চিন্তাটা তো চলমান। যে যা-ই করুক না কেন খেতে তাকে হয়ই। খেতে হবেই। এই একটা জিনিস থেকে দূরে থাকার কোনোই উপায় নাই। এরকম আজগুবি ভাবনাচিন্তার মাঝেই কবরখানার গাছগুলিকেও কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় আমিনুল।

কবরখানার গাছ বিক্রি করার ব্যাপারটাকে আমিনুল এবার আর গোপন করতে চাইল না। কী দরকার আর এতসব রাখঢাকের? সে তো এসেছেই পিতামহের ওয়ারিশান হিসেবে এই বাড়ির সমস্ত কিছুই ভোগদখল করতে। আমিনুল ভেবে দেখেছে, খামোখাই পারুলবিবিকে পেরেশানির মাঝে ফেলার দরকার কী? কিংবা পারুলবিবি বাধা দিলেই কী? আমিনুল কোন জন্মেই বা মায়ের কোন নিষেধের তোয়াক্কা করেছে?

কিন্তু আমিনুল যা ভেবেছিল সে-সবের কিছুই ঘটল না। অর্থাৎ, পারুলবিবি সব শুনেটুনেও কিছুই বলল না। এমনকী একবার সে ফিটও পড়ল না। ভাবলেশহীন চেহারা করে চুপচাপ শুনে গেল। আমিনুল যা কস্মিনকালেও ভাবে নাই, সেটাই ঘটল! গাছ বিক্রিতে বাধ সেধে বসল কিনা আফরোজা বেগম! এক-পা খোঁড়া আফরোজা বেগমের আপত্তি দেখে আমিনুল খানিকক্ষণ তবদা মেরে বসে রইল। নিজের স্ত্রীর এমন রুদ্রমূর্তি ইতোপূর্বে আমিনুল দেখে নাই।

আফরোজা বেগমের সাফ-কথা—

দেখো, কব্বরখানার গাছগুলান কাটা উচিত হইব না। কত শত বছর আগে কত মুরুব্বিগো গোর এইখানে। গাছ কাটলে হেগো নিদ্রার ব্যাঘাত ঘইট্যা যাইব। হেগো নিদ্রা টুইট্যা যাইতে পারে।

আফরোজা বেগমের এসব কথাবার্তায় একটা অচেনা-ক্রোধ আমিনুলকে গ্রাস করে ফেলতে লাগল। আফরোজা বেগম কি জানে না এইসব কথার নামমাত্র মূল্যও আমিনুলের কাছে নাই? তাহলে কেন সে এসব বলতে শুরু করেছে?

এসব আমিনুলকে বলা আর ফুটো পাত্রে জল ঢালা একই ব্যাপার। আফরোজা বেগম তবু যেন মরিয়া! ফলত সে বলতেই লাগল—

কব্বরখানার গাছের ফলফলাদি কত পক্ষীরাই না খাইয়া যায়। কত জাতের পক্ষীই না আহে এইহানে! এমুন ঘন-ছায়ার তলায় বেবাকতেই কিমুন নিশ্চিন্ত ঘুমাইয়া রইছে। কত পশুপক্ষীই না এইহানে আইস্যা জিরায়। গাছে কুড়ালের কোপ পড়লেই কিন্তুক বেবাকতেই জাইগা উঠব। বেবাকরে জাগাইয়া দেওন কি ঠিক হইব, কইন?

আফরোজা বেগমের এসব আবেগাক্রান্ত কথাবার্তাও আমিনুলের মাঝে কোনো ক্রিয়া-বিক্রিয়া ঘটালো কিনা বুঝা গেল না।

দিন-দুয়েক পরে ভোর-ভোর গাছ কাটার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল আফরোজা বেগমের। ঘুম চোখেই সে প্রায় থালুথালু বেশে দৌড়ে গেল কবরখানার দিকে। ততক্ষণে প্রচণ্ড কোলাহলে পূর্ণ হয়ে উঠেছে চারদিক। পাখপাখালির কিচিরমিচিরে ভোরের নির্জনতা গুঁড়িয়ে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। কাটা গাছের ডালে বসে এক দঙ্গল কাক তারস্বরে চিৎকার করছে। অদূরেই কাকের ভাঙাবাসা থেকে দুইটা ছানা মুখ বাড়িয়ে চিঁ-চিঁ স্বরে অনর্গল ডেকে চলেছে!

আফরোজা বেগমের চোখ থেকেও ঘুমভাব দ্রুত সরতে শুরু করল। চোখ ডলে তাকিয়ে সে দেখতে পেল পারুলবিবি লম্বা ঘোমটা টেনে শঙ্খলাগা গাছগুলির তলায় দাঁড়িয়ে আছে। পারুলবিবির পাশেই মালেকুল দাঁড়ানো। কবরখানার সমস্ত নিস্তব্ধতা উঠে এসে তাদের দুইজনের অবয়বে যেন ভর করে আছে।

বৃক্ষদের শরীরে করাত টানার সঙ্গে সঙ্গে আকাশমণির পুস্পরেণু স্তূপ হয়ে উঠছে। আর হলুদ আবরণের স্রোতে ডুবে যাচ্ছে সবুজ-ঘাসের-গালিচা। আমিনুল ইতিউতি তাকায়। সে আদতে দাদিজানকে তালাশ করে। গাছ কাটার এত শব্দ পেয়ে রাবেয়া খাতুন একবারও উঁকি দেবে না, তা তো হয় না। নিশ্চয়ই সে এসেছে। এসে হয়তো কোনো গাছের কাটা ডালের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে।

দাদিজানের দেখা না পেলেও, দাদিজানের লাগানো আম, কাঁঠাল আর কাঁঠালিচাঁপার ঝোঁপ একইসঙ্গে কাটতে হল। এতটাই আষ্টে-পৃষ্টে বাঁধা ছিল তারা যে, আলাদা করে কাটার কোনো উপায়ই আর রইল না।

গোরস্থানের সমস্ত গাছ কাটা হয়ে গেছে দীর্ঘ সময় পূর্বে। এক্ষণে কবরের ওপর আর কোনো ছায়া নাই। দুপুরের তপ্ত সূর্য অসমতল মাটি ফুঁড়ে চলে যাচ্ছে আরও গভীরে। যেন সে কোনো পাতালপুরীর খোঁজ পেয়েছে। নিশ্চুপ জমিনকে উত্তাপে উত্তাপে সরব না করা পযর্ন্ত সূর্যের যেন শান্তি নাই। মাথার ওপর তাপদাহকে অগ্রাহ্য করে মালেকুলও দাঁড়িয়ে ছিল। পাশে পারুলবিবি। মালেকুল উফ্‌ শব্দ করে বসে পড়লে পারুলবিবির আর্ত-চিৎকারে কবরখানা পুনরায় কোলাহলে ভরে উঠল।

পারুলবিবি দেখল, কালো দড়ির মতো একটা সাপ এঁকেবেঁকে, ঘাসের বুকে ঘসঘস শব্দ তুলে চলে যাচ্ছে দ্রুত। সে চলে যাচ্ছে গোরস্থান লাগোয়া ঢালু জমিনের দিকে।

আর ঠিক ওই মুহূর্তে আমিনুলও কিনা দাদিজানকে দেখল— আদুল গায়ে, এক প্যাঁচ দিয়ে শাদাটে-শাড়ি পরা রাবেয়া খাতুন— হাওয়ায় ভর করে উড়ে চলেছে। কিরি-কিরি-কোঁকড়া চুলের রাবেয়া খাতুনের পিঠে কোনো ডানা নাই। কিন্তু তবুও সে মসৃণ গতিতে উড়ে চলেছে। আমিনুল ধন্ধে পড়ে— পাখনা ছাড়া একডা মানুষ উইড়া যায় কেমনে?

প্রগাঢ়-নির্জনতা এখন ঝেঁপে নেমেছে গোরস্থানে। হাওয়া দ্রুত বইয়ে গেলেও পাতাদের দুলে ওঠার সামান্যতম শব্দও আর শোনা যায় না। বুকের ভেতর ভয় ধরিয়ে দিয়ে কোনো রাতজাগা পাখিও আর অকারণে ডেকে ওঠে না। কবরের উপরের ফনফনানো সবুজ-ঘাস, ফার্ন আর শেয়ালমুতার বেগুনিফুলেরা মরো-মরো দশাপ্রাপ্ত হয়ে আছে।

আমিনুল মুখ আন্ধার করে বসে থাকে। বৃক্ষশূন্য এক বিস্তীর্ণ জমিন তার চোখের সামনে ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে।

বাদামি রঙে ছাওয়া জমিনের এক-কোনায় মাটির ছোট্ট একটা ঢিবি— একরত্তি চরের মতো জেগে আছে। খেজুরগাছের দুই-চারটা কাটা ডাল ওই ঢিবির এক পার্শ্বে গাঁথা। মালেকুলের কবরের উত্তর শিথানে এই কাঁচা-ডাল আমিনুলকেই পুঁতে দিতে হয়েছিল…।

Facebook Comments

পছন্দের বই