লেখক নয় , লেখাই মূলধন

প্রবন্ধ

রাহুল হালদার

বুড়িবালামের তীরে রচিত হল জাতীয় বীরগাথা

সময়টা বিগত শতকের আট-নয়ের দশক। সরকারি বিদ্যালয়ের কর্মশিক্ষা ক্লাসে শেখানো হত বাঁশপাতা কাগজের খাম তৈরি, দেশের বিখ্যাত মনীষীদের ছবি দিয়ে প্লাস্টার তৈরি, মোমের পুতুল, মোমবাতি তৈরি প্রভৃতি। সেই সঙ্গে আমরা তৈরি করতাম একটি খাতা। যে-খাতাতে দেশের বরণীয় কবি, সাহিত্যিকদের সাথে সাথে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ছবি খাতার বাঁ-দিকের সাদা পৃষ্ঠায় আঠা দিয়ে লাগিয়ে ডান দিকের পৃষ্ঠায় তাঁদের জীবনী লিখতে হত। কে কার কার ছবি, কতগুলি ছবি সংগ্রহ করত সেগুলি বন্ধুদের খাতা নিয়ে একে-অপরেরটা দেখতাম।

সেই সময়ে ছবিতে ছোটো পোস্টকার্ডের মাপের ছবিতে বাঘা যতীনকে দেখি আর হন্যে হয়ে খুঁজতাম কোন ক্লাসের রচনা বইতে তাঁর জীবনী খুঁজে পাওয়া যাবে। সংক্ষিপ্ত জীবনী পড়ে অবাক বিস্ময়ে বুঁদ হয়ে থাকতাম যখন জানলাম তিনি বাঘের সঙ্গে লড়াই করে বাঘ মেরেছিলেন। তাই তিনি বাঘা যতীন নামে পরিচিত ছিলেন।

শুধু স্বাধীনোত্তর সময়ে আমাদের সকলে নয়, স্বাধীনতাপূর্বে ও বাঘা যতীনের সমসাময়িক সময়ে অনেকেই তাঁর বীরত্বে অভিভূত হতেন এবং গর্ববোধ করতেন। যেমন যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায়। তিনি তাঁর ‘বিপ্লবী জীবনের স্মৃতি’ গ্রন্থে লিখেছিলেন— “আমার বাবা আঠারো বছর বয়েসে গোরা ঠেঙিয়েছিলেন। আমার ছোটকাকা গৌরবাবু বাঘের সঙ্গে লড়েছিলেন। এই জন্য নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতাম। মনে মনে একটা গৌরবও ছিল। কিছুদিন বাদে গৌরবের স্থলে জন্ম নিল বিষাদ। মনে হল আগের যুগে বীর জন্মাত, আমার যুগে কই জন্মায়? এমন সময় ১৯০৬ সালে খবরের কাগজে বের হল একজন যুবক একপ্রকার খালি হাতেই একটা ছোরার সাহায্যে একটা বাঘ মেরেছে। গৌরবে বুক দশ হাত হল। কারণ, আমি বীরের যুগের লোক হয়ে গেছি। পরে তিনি কলকাতায় আসেন। তাঁকে সপ্রশংস নয়নে অনেকদিন দেখতাম। নাম যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।”

উনিশ শতকের শেষের দিকের কুষ্টিয়া শহর। পদ্মার গড়ুই নদীর উত্তর পাড়ে ছোটো সুন্দর গ্রাম কয়া। কয়া গ্রামেই সেইসময় নামকরা বাড়ি, চট্টোপাধ্যায়দের। বাড়িতে বিরাট আঙিনা, অনেকটা অংশ নিয়ে বড়ো বড়ো বাড়িঘর, চণ্ডীমণ্ডপের দালান। এই সাবেকি আমলের বাড়িতেই ইংরেজি ১৮৭৯ সালের ৮ই ডিসেম্বর চট্টোপাধ্যায় বাড়ির বড়োমেয়ে শরৎশশী দেবীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়।

যতীন্দ্রনাথের শৈশবের বেশিরভাগ সময় কেটেছে কয়া গ্রামের মামার বাড়িতে। তাঁর পৈতৃক ভিটা যশোর জেলার ঝিনাইদা মহকুমার সাধুহাটি রিসখালি গ্রামে। যতীনের ছোটোমামা ললিতকুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন— “যশোর জেলা। ঝিনাইদা মহকুমার সাধুহাটি রিসখালি গ্রাম। কাছেই নদী নবগঙ্গা। নদীর ধারে সিঁদরে গ্রামে দোর্দণ্ডপ্রতাপ নীলকর সাহেবদের কুঠি।… ঘোড়ায় চড়ে সাহেবরা পথে বার হলে বিনয়ে আনুগত্যে বেঁকে দাঁড়ান প্রতিবেশী সকলেই।… কিন্তু একটি লোক, যুবক ব্রাহ্মণ— কোনোদিন ফিরে তাকান না সাহেবদের দিকে, ভেদ মানেন না কালো সাদার, মাথা তাঁর উঁচু।… আত্মমর্যাদা সম্পন্ন সম্ভ্রান্ত এই তেজস্বী ব্রাহ্মণকে সবাই চেনে। বিঘা কয়েক জমির অধিকারী এই শিক্ষিত ব্রাহ্মণের নাম শ্রী উমেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।” যিনি যতীন্দ্রনাথের পিতা। যখন যতীনের বয়স পাঁচ তখন তাঁর পিতৃবিয়োগ হলে বড়োমামা বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় এসে প্রথমে যতীনকে এবং তার কিছু পরে বোন শরৎশশী এবং যতীনের দিদি বিনোদবালাকে বিনোদবালার পৈতৃক ভিটে থেকে কয়া গ্রামের মামার বাড়িতে নিয়ে আসেন। পরবর্তীকালে আমরা যে-শিক্ষিত ও নির্ভীক পরোপকারী যতীনকে দেখি সেটা যে তাঁর পিতার কাছ থেকে পাওয়া, সেটা মামা ললিতকুমারের দ্বারা যতীনের পিতার পরিচয় থেকেই বুঝতে পারি।

মামার বাড়ির গ্রামের গোপাল পণ্ডিতের পাঠশালাতে যতীনের লেখাপড়া শুরু হয়। ছোটোবেলাতেই গ্রামে পড়াশোনার পাশাপাশি গ্রামের বালকদের সঙ্গে দৌড়ঝাঁপ, সাঁতার, খেলাধূলাতে দক্ষ হতে থাকেন। তাঁর ন’মামা অনাথবন্ধু চট্টোপাধ্যায় ছিলেন নদিয়া রাজবাড়ির সুপারিন্টেনডেন্ট। ভারি শৌখিন মানুষ তিনি।

খেলাধূলা, জিমনাস্টিক, ঘোড়া চড়া, বন্দুক চালানো, মাছধরায় ছিলেন সিদ্ধহস্ত। এই ন’মামার একটি ঘোড়া ছিল যার নাম ‘সুন্দরী’। তখন যতীনের বয়স আট কি নয় বছর, একদিন মামার কাছে আবদার করে বলল, মামা ঘোড়ায় চড়া শিখব। ভাগ্নের শখকে মামা না বলতে পারল না। বাড়ির পাশ দিয়ে জেলা বোর্ডের যে-পাকা সড়ক গিয়েছিল কুষ্টিয়ায় উত্তর দিক পার হয়ে সোজা কুমারখালি পর্যন্ত সেই রাস্তায় কিছুদিন মামার দ্বারা ঘোড়ায় চড়া তালিম চলল। অল্প কিছুদিনেই ঘোড়ায় চড়া আয়ত্ত করে যতীন এরপর একা একাই ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে লাগল। গড়ুই নদীর জলে সাঁতরে পার হত আট-দশ মাইল। এমন করেই যতীন বড়ো হতে লাগল। তাঁর বড়োমামা যতীন আর বাড়ির অন্যান্য ছেলেদের কুস্তি, লাঠিখেলা, ছোরাখেলা, তরোয়াল শেখানোর জন্য বাড়িতে ফেরাজ খান নামে এক ওস্তাদকে মাইনে দিয়ে রেখে দিলেন।

এদিকে যতীনের বড়োমামা বসন্তকুমার আইনের অধ্যয়ন শেষ হলে কৃষ্ণনগরে জেলা বোর্ডের ওকালতিতে নিযুক্ত হলেন। অল্প সময়েই তিনি ওকালতিতে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করলেন। যতীন্দ্রনাথ তখন বারো বছরে পড়েছে। গ্রামের পাঠ শেষ হলে বড়োমামা গ্রামের পণ্ডিতের কথামতো এন্ট্রান্স পড়বার জন্য কৃষ্ণনগরে নিয়ে এসে ভর্তি করিয়ে দেন সেখানকার অ্যাংলো ভার্নেকুলার (এ ভি স্কুল) বিদ্যালয়ে। সেখানে অতি অল্প সময়েই যতীন সকলের প্রিয় হয়ে গেলেন এবং হয়ে উঠলেন তাদের অবিসংবাদী নেতা। তিনি যেহেতু আগে থেকেই সাঁতার, খেলাধূলা, পড়াশোনায় দক্ষ ছিলেন। কৃষ্ণনগরে এসে সেই গুণের সঙ্গে যুক্ত হল পরোপকার আর সমাজসেবা। এইসমস্ত কাজে যতীন সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার ফলে হয়ে উঠলেন সকলের প্রিয় ‘যতীনদা’। এই ‘যতীনদা’ সম্পর্কে মানবেন্দ্র রায় পরবর্তীকালে বলেছিলেন— “আমরা তাঁকে সোজাসুজি দাদা বলেই ডাকতাম। দাদাদের দেশে আর দাদাদের যুগে তিনি ছিলেন অতুলনীয়— তাঁর মতো দ্বিতীয়টি আর কাউকে আমি দেখিনি। আধুনিক শিল্পে যেমন, তেমনি আমাদের রাজনীতির সেই শৈশবকালে দাদাবাদ ছিল একটি যুক্তিহীন মতবাদ। যতীনদা কিন্তু দাদাবাদের ধার ধারতেন না, কিংবা তিনি এর প্রবক্তা ছিলেন না। আর সব দাদাদের দেখেছি অপরকে আকর্ষণ করবার বিদ্যা অভ্যেস করতে; একমাত্র যতীন মুখার্জি ছিলেন এর ব্যতিক্রম।… যে-বিশাল দৈহিকশক্তির তিনি অধিকারী ছিলেন এবং যা পরিণত হয়েছিল একটি কিংবদন্তীতে, সেটা কিন্তু তার আকৃতি দেখলে প্রতীয়মান হত না, যদিও তিনি ছিলেন একজন সুদক্ষ কুস্তিগীর”।

তিনি যে ভীষণই সাহসী আর শক্তিশালী ছিলেন সেটা তাঁর কীর্তি দেখেই বোঝা যেত। একবার তিনি নদিয়া ট্রেডিং কোম্পানি নামে কৃষ্ণনগরের একটি দোকানে যখন পেন্সিল কিনতে গিয়েছিলেন তখন তাঁর কানে এল চিৎকার ‘পালাও পালাও’। কী ব্যাপার দেখতে যখন তিনি রাস্তার দিকে তাকালেন দেখলেন রাজবাড়ির (বারাণসী রায়ের) একটি ঘোড়া বাঁধন ছিঁড়ে রাস্তা দিয়ে ছুটে চলছে এবং ঘোড়াটিকে কেউ ধরবার চেষ্টা না করে সবাই পালাচ্ছে অথচ ঘোড়াটিকে না থামালে যখন-তখন বিপদ ঘটে যেতে পারে। এই ভেবে তিনি নিজের জখম হওয়ার কথা না ভেবে ঘোড়ার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে চলন্ত ঘোড়াটির কপালের কেশর ধরে ঘোড়াটিকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন।

এন্ট্রান্স পাশ করে যতীন কলকাতায় শোভাবাজার চিৎপুর রোডে মেজমামা, এল. এম. এস ডাক্তার হেমন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছে থেকে সেন্ট্রাল কলেজে এফ. এ. পড়েছেন। পড়ার সময় যাতে অর্থোপার্জন করতে পারেন তার জন্য তিনি শিখতে লাগলেন শর্টহ্যান্ড আর টাইপরাইটিং।

একদিন কলকাতা থেকে গ্রামের বাড়িতে এসে শুনলেন কাছের এক গ্রামে বাঘের উপদ্রব হওয়াতে সকালে যতীনের মামাতো ভাই ফণিভূষণ বন্দুক নিয়ে বাঘ মারতে গেছে। কথাটা শুনে যতীন শুধুমাত্র একটি ভোজালি হাতে করে সেখানে গিয়ে দেখলেন যেখানে বাঘ আছে সেই জঙ্গল থেকে বাঘ বেরোলে ফণি বন্দুকের গুলি চালালে বাঘের গায়ে ঘর্ষণ করে বেরিয়ে যায়। তখন বাঘটি তাঁর দিকে এগিয়ে এলে যতীন্দ্রনাথ বাঘটির গলা বাম বগলে চেপে ধরে ভোজালির দ্বারা মাথায় আঘাত করতে লাগলেন। সেই লড়াইয়ে অবশেষে বাঘটি মেরে ফেললেও বাঘের আক্রমণে যতীন্দ্রনাথও প্রায় মৃতপ্রায় হয়ে গেলেন। মেজমামা তখন তাঁকে কলকাতায় বিখ্যাত সার্জন সুরেশপ্রসাদ সর্বাধিকারীকে দিয়ে প্রায় ছয়মাস চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করে তোলেন। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ যতীন্দ্রনাথ তাঁর নবজীবনদাতাকে উপহার দিয়েছিলেন সেই মারা বাঘের চামড়াখানি। এই সময়ে যতীন্দ্রনাথের স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাওয়ায় হৃত স্বাস্থ্য ফিরে পাওয়ার জন্য ছোটোমামা ললিতকুমার কুস্তিগীর ক্ষেত্রনাথ গুহের আখড়ায় ভর্তি করিয়ে দেন।

যতীন্দ্রনাথ শর্টহ্যান্ড আর টাইপরাইটিং শেখবার পর প্রথমে কলকাতার অমহুটি অ্যান্ড কোম্পানি, তারপর মজঃফরপুর এবং শেষে সেখানে চাকরি ছেড়ে শেষে বেঙ্গল সেক্রেটারিয়েটে মি. এ. এইচ. হুইলার নামে একজন আই-সি-এসের অধীনে চাকরিতে নিযুক্ত হন।

বিংশ শতকের সূচনায় এক নব জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল বাংলার বুকে। যতীন্দ্রনাথ তখন বাংলা সরকারের একজন বেতনভুক কর্মচারী। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে স্বদেশ আন্দোলনের সূচনা হয়। বাঙালির কণ্ঠে গর্জন শোনা গেল লর্ড কার্জনের এই ষড়যন্ত্র আমরা রোধ করবই। ১৯০৫ সালের শেষভাগে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হল গুপ্ত সমিতি এবং ১৯০৬ সালে এই সমিতিতে যোগদান করলেন যতীন্দ্রনাথ। যাদুগোপাল মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন— “১৯০৩ সালে যোগেন বিদ্যাভূষণ মহাশয়ের বাড়িতে ভাবী যুগান্তকারীদের এক অপূর্ব সমাবেশ ঘটল। বিদ্যাভূষণ আগে থেকে কেবল বিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে বেড়াতেন।… এঁর বাড়িতে শ্রী অরবিন্দ ও যতীন্দ্রনাথ আসেন। সেখানে ললিতচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং ভাবী কালের ‘বাঘা যতীন’ এঁদের সঙ্গে পরিচিত হন। পরে যতীন্দ্রনাথের কাছে ধরা দিলেন বাঘা যতীন।”

আলিপুর বোমা মামলা আরম্ভ হওয়ার পর থেকে বাঘা যতীনের প্রকৃত বিপ্লবী জীবনের সূত্রপাত হয় বাঙালি দারোগা নন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায় যিনি প্রফুল্ল চাকীকে মোকামা স্টেশনে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করেছিলেন তাঁকে হত্যা করার মধ্যে দিয়ে। দ্বিতীয় ঘটনা আলিপুর বোমা মামলার সরকারি উকিল আশুতোষ নিধন এবং তৃতীয় ঘটনা তৎকালীন কলকাতা পুলিশের একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী ডেপুটি সুপারিন্টেনডেন্ট অব পুলিশ সামশুল নিধনের কর্মকাণ্ড দিয়ে। এই ঘটনার পরে যতীন্দ্রনাথের সরকারি চাকরি চলে গেলে তিনি জেলা বোর্ডের ঠিকাদারি কাজ নিযুক্ত হয়ে বাংলার বিভিন্ন জেলায় গুপ্তসমিতি গঠনের কাজে মনোনিবেশ করলেন।

১৯১৪ সালে জার্মানির সঙ্গে ব্রিটিশ ও অন্যান্যর যুদ্ধ লাগলে জার্মানিতে থাকা ভারতীয়রা ভারতে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে শক্তিশালী বিদ্রোহ করবার জন্য সাহায্য চাইলে জার্মানি অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করবার প্রতিশ্রুতি দেয়। জার্মানির সহায়তায় ১৯১৫ সালে যতীন্দ্রনাথ সমগ্র ভারতবর্ষে বিদ্রোহ জাগিয়ে তুলবার ব্যবস্থা করতে থাকেন। বলা হয়ে থাকে যে, তিনি ফোর্ট উইলিয়ামে যে-সমস্ত ভারতীয় সৈন্য ছিল তাদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন যাতে ফোর্ট উইলিয়াম দখল করা যায় কিন্তু একজন ভারতীয়র বিশ্বাসঘাতকতায় সেই পরিকল্পনাটি ব্যর্থ হয়েছিল।

পরিকল্পনা ব্যর্থ হলেও হাল ছাড়েননি যতীন্দ্রনাথ। এরপর যখন জার্মানদের সহায়তায় ‘এস. এস. ম্যাভারিক’ নামে একটি জাহাজে করে ভারতীয় বিপ্লবীদের জন্য ত্রিশ হাজার রাইফেল, প্রত্যেক রাইফেলের জন্য চারশো করে গুলি আর তার সঙ্গে দু-লক্ষ টাকা আসবে সেইসমস্ত কিছু পূর্ববঙ্গে, কলকাতা আর বালেশ্বর এই তিন জায়গায় পাঠানোর বন্দোবস্ত করবার জন্য যতীন্দ্রনাথ নিজে এবং চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরি, মনোরঞ্জন সেনগুপ্ত, নীরেন্দ্রচন্দ্র দাশগুপ্ত আর জ্যোতিষ পালকে নিয়ে বালেশ্বরের কাপ্তিপোদায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সে-সংবাদ ব্রিটিশের কাছে চলে যায়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কিলবি, পুলিশ সাহেব খোদাবক্স, ডি. আই. জি. ই. বি রাইল্যান্ড সাহেব সমস্ত সশস্ত্র পুলিশ এবং মিলিটারি নিয়ে রদারফোর্ডের নেতৃত্ব চলল যতীন্দ্রনাথদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান। সরকার পক্ষের দুড়ুম দুড়ুম গুলির শব্দে সিপাহিরা এগিয়ে আসতেই দেশের জাতীয় বীরদের তরফ থেকে ব্রিটিশদের ভীত, স্তম্ভিত করে কটাকট কটাকট করে চলতে শুরু করল মসার পিস্তলের গুলি। দেশের বীরদের তরফ থেকে প্রত্যুত্তরে ব্রিটিশ সিপাহি সমেত রদারফোর্ড হতাহত হয়ে পালাতে লাগল, জলকাদা মেখে মাটিতে শুয়ে পড়ল অন্য সিপাহিরা। প্রায় দু-তিন ঘণ্টা যুদ্ধ চলতে লাগল বুড়িবালামের তীরে। এই সময় এক সুবেদারের গুলিতে চিত্তপ্রিয় বীরের মতন মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। যতীন্দ্রনাথ বাঁ-হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলে গুলিবিদ্ধ হয়েও এক হাতে মসার পিস্তল চালাতে লাগলেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে, সেই সময়ে আর একটা গুলি এসে লাগল তাঁর পেটে।

এর পর ৩রা আশ্বিন ১৩৬৫ সালের সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় ডাঃ সত্যেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, যিনি সে-সময়কার বালেশ্বর হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছিলেন, তিনি লিখেছিলেন শহিদ হওয়ার আগে যতীন্দ্রনাথের শেষ বক্তব্য—“এবার আমার পালা ডাক্তার। আজ আমাদের জীবন দেবার শুভ সুযোগ এসেছে। শুরু হলো আবার গুলি বিনিময়-সন্মুখে পিছনে, দক্ষিণে, বাঁয়ে চারিদিক হতে আসছে গুলি— ওই যে আমাদের মধ্যে ব্যবধান কমে আসছে— ঐ জীবন-মরণের সেতু ভেঙ্গে আসছে। তারপর অজ্ঞান হয়ে গেছি। কতক্ষণে জ্ঞান হল জানি না… জানো ডাক্তার আমাদের স্বাধীনতা নিশ্চয় আসবে — পরাধীনতার শিকল ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যাবে।”

যতীন্দ্রনাথদের কাঙ্ক্ষিত দেশের স্বাধীনতা আজ এসেছে। সেই স্বাধীন দেশে আমরা যতীন্দ্রনাথকে কেমন স্মরণে রেখেছি সেই বিষয়ে শ্রীশচীনন্দন চট্টোপাধ্যায় যথার্থই লিখেছেন— “‘বাঘা যতীন’। হায়-রে এর চেয়েও তাঁর দীনতম প্রকাশ কি হতে পারে? গ্যারিবল্ডীর চেয়েও যাঁর দুঃসাহস ছিল বড়, হিটলারের চেয়েও যিনি ছিলেন অধিকতর দুর্বার, বিসমার্কের চেয়েও কুশলী ডিপ্লোম্যাট, সংগঠন শক্তিতে অদ্বিতীয়-সহকর্মী সতীর্থ এবং মানুষ মাত্রেরই প্রতি প্রীতি এবং করুণায় বিগলিত বিশাল হৃদয় তাঁর, দেশের স্বাধীনতার বেদীমূলে তাঁর অভিনব আত্মাহুতি, যার তুলনা বিরল ভারতের ইতিহাসে— সন্মিলিত বিপ্লবী দলের সেই সার্বভৌম সর্বাধিনায়ককে দেশ কতটুকু চিনল, কতটুকু উপলব্ধি করলো?”

এ শুধু শ্রী শচীনন্দন চট্টোপাধ্যায়ের আক্ষেপ নয়, এই আক্ষেপ বর্তমান সময়ে আমাদের সকলের। আজকের দিনে রাজনীতির তরজায় মেতে থাকা জনসংখ্যার বৃহত্তর অংশের বাঙালি কি ক্রমশ নিজেদের অতীত গৌরবকে পিছনে ফেলে দিচ্ছে না?

Facebook Comments

পছন্দের বই