লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কবিতা

রণজিৎ অধিকারী

সময়

সময়ের অস্তিত্ব নেই না?
দীর্ঘ নীরবতার পর সময় আড়মোড়া ভাঙে আর বৃষ্টিপাতের শব্দ এসে তোমার জানালায় ধাক্কা দেয়।
তুমি তো জানোই না, এই এখানে আসার পর, তুমি
ঠিক কোনখানটায় আছ, দেখানোর ভঙ্গিতে
তোমার আঙুল বের করে হাওয়ায় ঘুরিয়ে আবার অন্যমনস্কভাবে মুড়ে রাখো মুঠোয়।

লিফ্‌টের শব্দ, হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ছে কিছু,
যেন সময়ের বিপরীতে নীচের রাস্তায় অত গাড়ির
জট পড়েছে,— কোথায় যাবে ওরা?
যা-ই দেখ তুমি জানালা দিয়েই দেখ, তোমার জন্য ছাঁচে কাটা জানালা, তুমি এখানে আসার অনেক আগে বানানো — মাঝে মাঝে তুমি ক্ষেপে ওঠো
এই ভেবে,
যেন কোনো কিছুরই কোনো অস্তিত্ব নেই!

তবু শেষমেষ যা পাও— একটা পাতার খসে পড়া,
সমুদ্র থেকে পাঠানো একটা জাহাজের ডাক, কিংবা কোথাও ভারী কিছু ঘষটানোর শব্দে… তোমার
মনে হয়, এই সবই সময়ের খুব বাজে অনুবাদ!

বিছানা

দুটো সমুদ্র যেখানে এসে মিশছে, যেন সবার অলক্ষ্যে
সেখানে একটা বিছানা পাতা, তারা প্রায়ই এসে
গড়াগড়ি খায় আর যখন তারা একে-অন্যের শরীরে
ঢুকে পড়ে তখনই বিশাল ঢেউগুলো এসে ঢেকে দেয়
তাদের সংগমস্থানটাকে।
দুটো সমুদ্র যেখানে এসে মিশছে, সেখানে
মাঝে মাঝেই এক-একটা জাহাজ তলিয়ে যায়,
হয়তো নাবিক আবিষ্কার করে ফেলেছিল সেই বিছানা,
কিংবা উথাল-পাথাল সেই সংগমদৃশ্য!

সেইসব জাহাজের আর্তচিৎকার অত জলের তলায়
চাপা পড়ে আছে বহুকাল ধরে;
দুটো সমুদ্র যেখানে এসে মিশছে সেখানের আকাশে
ভারী ভারী মেঘগুলো এখনও দানবের মতো ঘুরে বেড়ায় আর গর্জন করে
কেবল সমুদ্রের শীৎকারধ্বনিকে চাপা দেওয়ার জন্য।

একটি সকাল

কিছুদিন রোগভোগ করে সকালের নরম রোদের সামনে এসে দুর্বল দাঁড়িয়ে বলি— ধন্যবাদ। যেন ফিরে এলাম আর সারা জগৎ দুশ্চিন্তা করেছে খুব
এ-ক-দিন, যেন আমি-হীন জগৎ সহ্য হবে না কারুর,

যেন কী কাঁপতে কাঁপতে এসে দুর্বলভাবে থেমে গেল
এবারের মতো…

এখন এই সপ্তাহপরের ভালোবাসার রোদ
পায়ের ওপর এবং আমি বলি— ধন্যবাদ।

আকাশে ভাঙা ভাঙা মেঘগুলো শ্রাবণের চিহ্ন বহন করছে না, জুলাইয়েরও না বরং ওরা এখন আমার
ভালো লাগার চিহ্ন গায়ে মেখে আছে। এবং
ওই সাদা শরীরের ইউক্যালিপটাস— যার মাথা থেকে
অনেকটা পৃথিবী দেখা যায়— ও আমাকে জানাল,
অনেক দূর দিয়ে চাকাগুলো খুব ধীরে আবার
গড়াতে শুরু করেছে…

আমি তক্ষুনি ওকে আর সেই দূর চাকাগুলোকে
ধন্যবাদ দিই

নির্ণয়

শেষে এমন হয় যে,
তুমি তিনটে দিন কোনোমতে পার করে দিতে চাইলে,
কিন্তু দুটো দিন পরই আটকে গেল,
একটা দিন দিগন্তের অনড় মেঘটার মতোই
ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল বুকের বাঁ-দিকে, কখনো

গলার একটু নীচে।
আসলে সবসময়ই জরুরি হল,
নিজের অবস্থানটাকে নির্ণয় করতে পারা।
তুমি কোথায় আর কখন সেটা ঘটছে।

যখনই খুঁজলে যেন দেখতে পাও, তুমি
এই বিশ্বের মাঝখানে, তোমাকেই ঘিরে এই
পাহাড় আর সমুদ্র, শব্দ আর নৈঃশব্দ্য,
তাপপ্রবাহ আর তুষারপাত…!

কিন্তু একদিন ঘড়ির কাঁটা কোনো একটা দিক
ইঙ্গিত করে থেমে যায়, তোমার গা থেকে রোদ
মুছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তুমি হয়তো টেরই পেলে না,
ওই ঘষটানো দাগটাই তোমার সীমা, হয়তো

উঁচু ওই পাহাড়ের ওপাশে আটকে পড়েছে
তোমার দিনগুলো, বরফে চারপাশ ঢেকে যাচ্ছে
এবং তুমি এই বিশ্বের মাঝখানে বিচ্ছিন্ন…

Facebook Comments

পছন্দের বই