লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গল্প

রাণা রায়চৌধুরী

সীমান্ত এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়

চীনের সৈন্য আবার ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে পড়েছে।

চীনের মেঘ-বাতাস-আলো, ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ে। তাই না? আর সৈন্যগুলোর জন্য সত্যি খারাপ লাগে। বাড়িতে বউ-বাচ্চা-বোন-বউদি এসব আছে, কিন্তু বেটারা ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে মুততে আসে, বিড়ি ফুঁকতে আসে। আসলে কৌশিক শ্যামল বিড়ি ওদের ওখানে পাওয়া যায় না। এই নতুন একটা বিড়ি বেরিয়েছে জানিস?

কী বিড়ি?

পদ্মা বিড়ি।

শিবু ‘পদ্মা বিড়ি’ বলতেই— দেবুর পদ্মাদির কথা মনে পড়ল। আর পদ্মাদির কথা মনে পড়তেই কাছেই কোথাও খুব জোরে বাজ পড়ল। বাজ পড়ার আলোয় দু-জনেই বেশ আলোকিত হয়ে উঠল। এই আলোয় ভাসা আসলে ভয়ের আলোয় ভাসা। ভয়! ভয়েরও আলো আছে, কাছেই আছে সে।

চীনের সৈন্য এবার লাল সুতোর বিড়ি খুঁজতে ঢুকে পড়েছে ভারতীয় ভূখণ্ডে। দেবুর দাঁতের ফাঁকে লাল সুতোর বিড়ি। শিবু সুপ্রিম বিড়ি টানছে। দেবু হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, এই শিবু ভূখণ্ড মানে কী? ভারতীয় ভূখণ্ড? শিবু সুপ্রিম টানছে। ভাবখানা এমন যেন, সুপ্রিম কোর্ট টানছে, ধোঁয়া। শিবু দূরের মাঠ, বর্ডার দেখছে। ওপারে বাংলাদেশ। রাজশাহী। দেবু বলল, না না ওপারে চীন! ওপারে উগান্ডা! ভেবে নে। শিবু ভেবে নিল, ওপারে চীন। ওপারে ওপার আছে, এপারে এপার আছে। সুপ্রিম বিড়ির ধোঁয়া আকাশের দিকে যাচ্ছে।

শিবু দেবুকে দেখাল, ঐ দেখ ভূখণ্ড। বাংলাদেশ ভূখণ্ড। ওইরকম তোর মনেও একটা ভূখণ্ড আছে। আমার মনেও একটা দুক্কু দুক্কু ভূখণ্ড। আমার মা-টা অকালে মরে গেল রে! দেবু শিবুর কথা শুনছে, আবার শুনছেও না। দেবু তারকাঁটার ওপারের ভূখণ্ড দেখছে। পায়ের নীচে তাকাল সে। একই ভূখণ্ড। মাটি। মাটিতে দেবু দেশলাই কাঠি দিয়ে একটা লম্বা দাগ দিল। সে দাগের এইপার ওইপার দেখতে লাগল।

***

ইনডিকেটর দেখাচ্ছে স্ট্রংগ সেল। অর্থাৎ, পুট অপশনে খেলতে হবে। স্ট্রংগ বাই দেখালে বাই অপশনে খেলতে হবে। নান্টু নিফটির ওঠা-নামা দেখছে। এই ওঠা-নামা দেখতে তার ভালো লাগে। জীবনের ওঠা-নামা। আজ বাজার হাই ভোলাটাইল। অস্থির। সে নিজের মধ্যেও অস্থিরতা টের পায়। কাল রাতের রাম-এর হ্যাঙ্গওভার এখনও কাটেনি। রাম! হাসে নান্টু। নিজের মনে বলে— কোন রাম? নিজেই উত্তর দেয় থ্রি এক্স! থ্রি এক্স রাম যেমন হয়, তেমন থ্রি এক্স পানু ছবিও হয়। নিফটি নামছে— নিফটি সামান্য ওপরে উঠল— এখন নান্টুর পজিশনে প্রফিট কমে আড়াইশো। ওয়েট করলে নিফটি নামবে, নান্টুর প্রফিট বাড়বে। নান্টু স্টপলস দিল। লসকে স্টপ করার জন্য সাবধানতা। নিফটি স্টপলস ক্রস করে গেল, ঘুড়ি কেটে গেল। নান্টুর সাড়ে সাতশো লস হল। দেবু আর শিবু হাঁপাতে হাঁপাতে নান্টুর ঘরে ঢুকল। দেবু বলল, ওপারের মেঘ এপারে চলে এসেছে।

নিফটি ওপরে উঠে আবার নীচের দিকে নামতে লাগল। নান্টু ভাবল স্টপলস না দিলেই ভালো হত। তাহলে আর তার ঘুড়ি কাটত না। নান্টু হতাশ। দেবু আর শিবু দাঁড়িয়ে আছে হতাশ নান্টুর মোবাইলের দিকে তাকিয়ে। নান্টু মোবাইল থেকে মাথা তুলে বলল, ওপারের মেঘ এপারে এসেছে? এসেছে তো এসেছে, মেঘ তো এদিক ওদিক করবেই। লাল্টুদাকে দেখ, একবার পদ্ম একবার শিউলি আবার পদ্ম আবার শিউলি। আমরা নিজেরাই খেই পাচ্ছি না, কোন ফুলে বসে মধু খাব। লাল্টুদা যেদিকে আমরাও সেদিকে। লাল্টুদা খালি মঞ্চে উঠে পতাকা বদল করে, ফুল বদল করে।

নান্টু আবার মোবাইলের দিকে তাকায়। নিফটি ওঠা-নামা করছে। নান্টুও তার সঙ্গে উঠছে নামছে। ভোলাটিলিটি জীবনজুড়েই।

দেবু শিবু মেঘের এপারে আসা ভুলে গেছে। ওরা বর্ডারে গাড়ি পাস করাচ্ছিল, কিছু ইনকাম হয়। বিএসএফ ওদের চা বিড়ি সিগারেট দেয়। ওরা লরি ট্রাকের লাইন কন্ট্রোল করে। বিএসএফ মাঝে মাঝে এঁটো ইংলিশও দেয় ওদের, আধখাওয়া। নান্টু নিফটির অনাত্মীয়ের মতো ব্যবহারে খুব দুঃখিত। নান্টু দেবুকে বলে, ‘রাম খাবি! রাম! জয় শিয়া রাম খাবি?’ দেবুর দিনের বেলায় মাল খেতে ভালো লাগে। শিবু মদ খায় না, শিবু গাঁজা, গঞ্জিকা। নান্টু বিল্লাকে ফোন করে। বিল্লা গলির মধ্যে অবৈধ ইংলিশ বিক্রি করে। বিল্লা একটা ছেলেকে দিয়ে আধঘণ্টা বাদে মাল পাঠায়। নান্টুর পাশের ঘরে প্যারালাইসিসে শুয়ে থাকা অসুস্থ মা। ঘুমোচ্ছে।

সীতা ছাড়াই রাম এসে গেছে, এখন বেলা এগারোটা। বাইরে চড়া রোদ। বাইরে চৈত্র মাস। গরম। আকাশে পাখি নেই, পাখিগুলো গরমে ডানা গুটিয়ে কোন কবেকার গাছের পাতার আড়ালে লুকিয়ে আছে। ঘরে ঘ্যারঘ্যার আওয়াজে ফ্যান চলছে, আস্তে। ফ্যানের থেকে একটা মাকড়সা ঝুলসমেত ঝুলে আছে। ফ্যান ঘুরছে, মাকড়সাও ঘুরছে। মাকড়সার দিকে তাকিয়ে ছিল শিবু, মাকড়সা ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে শিবুর চোখ মাথাও ঘুরতে থাকে, অল্প মৃদু। গাঁজা না খেলেও, মাকড়সা আর ফ্যানের সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে তার অল্প নেশা নেশা মতন মনে হয়। তার মনে হয় এ-জীবন সুন্দর। এই অল্প পয়সা, এই একই ময়লা চোস্ত প্যান্ট, সান্যাল স্যারের মেয়েকে দেখা, আহা জীবন সুন্দর! মাকড়সাটা ঝুপ করে ফ্যান থেকে শিবুর গায়ে খসে পড়ল। শিবু, নিষ্পাপ শিবু হয়ে গেল।

শিবুর এখন আটটা পা। শিবু এখন লালা দিয়ে জাল বুনতে পারে। শিবুর জালে পোকা পতঙ্গের সঙ্গে সান্যাল স্যারের মেয়েও আটকে যাবে, যেতে পারে কোনোদিন হয়তো, সেদিন হয়তো মাঘের সকাল হতে পারে, সেদিন হয়তো আষাঢ়ের দুপুর হতে পারে। শিবুর জাল স্বপ্ন বোনে…

নান্টু আর দেবুর ভালো ধরেছে। নান্টুর নেশা ধরলে বকবক করে না, ঝিম মেরে থাকে। অনেক পুরোনো হাসিঠাট্টাগুলো স্মৃতিগুলো পুরোনো প্রাচীন গানগুলো নৌকো বেয়ে আকাশের নীল বেয়ে তার মনের কিনারে ঠেকে। ধাক্কা মারে। নান্টু বুঁদ হয়ে সেই পুরোনো প্রাচীন হাসিঠাট্টা প্রাচীন চোখের জলেদের সঙ্গে দাবা খেলে মনে মনে। ওদিকে দেবু গুনগুন গান গায়। পকেট থেকে কুচো পয়সা বের করে গোনে। কড় গুনে গুনে কড় গুনতে গুনতে সে বহুদূর চলে যায়, বর্ডার পার হয়ে অন্য দেশে চলে যায়। ফিরে আসে।

‘কান্দো কেনে মন পাগলা রে কান্দিয়া কান্দিয়া যাইব তোমারও জীবন রে কান্দো কেনে মন পাগলা রে’— নান্টুর ভেতরটা কাঁদছে। কেন ভেতর কান্দে তার, নান্টু জানে না। ভেতরটা কান্নার জলে ভিজে যাচ্ছে। ভেতরের মাঝি ভাটিয়ালি গাইছে, আর বাইছে তাকে— ‘কান্দো কেনে মন পাগলা রে কান্দিয়া কান্দিয়া যাইব তোমারও জীবন রে কান্দো কেনে মন…’ ওদিকে নান্টুর চোখের জল নিয়েই নিফটি ওপর-নীচ করছে…

ওদিকে শিবু-মাকড়সার জাল বাড়তে বাড়তে বিস্তার পাচ্ছে। জালে কীটপতঙ্গের সঙ্গে সান্যাল স্যারের অন্ধ মেয়ে, জালে আস্তে ধীরে— নদী পুকুর আকাশ মাটি, শিবুর বিপত্নীক বাবা— দিদি, জালে বর্ডারের কাঁটাতার— জালে এপার ওপার আটকে যাচ্ছে।

শিবু জাল বুনতে বুনতে এগোচ্ছে। কিন্তু শিবুর জাল নান্টু দেবু কেউ দেখতে পাচ্ছে না। শিবু নিজেও জালে জড়িয়ে যাচ্ছে, জালে তার আট পা আটকে হুমড়ি খেয়ে পড়ল এক অজানা নিরুদ্দেশের মাটিতে, কাদায়। শিবু কোথায় এখন সে জানে না। মাথার ওপরের ঘড়ঘড়ে বিশ্রী শব্দের ফ্যানটা আর নেই। শিবুর মাথার ওপর তার নিজের লালায় বোনা জাল, পায়ের তলায় জাল, তার নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে জাল দুলছে, জগৎ দুলছে।

স্যানাল স্যারের অন্ধ মেয়েকে মনে পড়ে তার। মেয়েটি হাতড়ে হাতড়ে এগোয়, হাতড়ে হাতড়ে মা বাবার স্নেহ আদরকে কাছে টেনে আনে, হাতড়ে হাতড়ে ছাদে গিয়ে আকাশকে কল্পনা করে। শিবু দেখেছে মেয়েটির আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা। আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু আকাশকে দেখতে পাচ্ছে না অন্ধ মেয়েটি। শিবুর মনে হয়েছিল, নিজের চোখদুটো সান্যাল স্যারের মেয়েকে কিছুক্ষণের জন্য দিয়ে দেয়। কিছুক্ষণের জন্য তো মেয়েটি আকাশ দেখতে পারবে! শিবু মনে মনে নীচ থেকে নিজের চোখদুটো খুলে, ছাদে মেয়েটির দিকে ছুড়ে দিয়েছিল, শিবুর চোখদুটো পাখির মতো ডানা মেলে অন্ধ মেয়েটির চোখের পাপড়িতে গিয়ে বসল। আকাশ ধীরে ধীরে অন্ধ মেয়ের কাছে এগিয়ে আসতে লাগল।

নান্টু নিফটির ওঠা-নামা বন্ধ করে, বা নিফটিকে থামিয়ে স্যুইচড অফ মোবাইলকে বিছানার দিকে ছুড়ে দিল। ইউটিউব-নিফটি-হোয়াট্‌সঅ্যাপ এইসব বুকে নিয়ে নান্টুর মোবাইল ড্রপ খেতে খেতে বিছানার কোণের দিকে গিয়ে আটকে গেল। মোবাইলের হার্টবিট এখন বন্ধ। নান্টুই শ্বাসরোধ করে ফোনের হার্টবিট বন্ধ করে দিয়েছে। নেশা দেবু নান্টু দু-জনেরই একেবারে চূড়ায়। চূড়ায় উঠতে সবাই চায়। দেবু নান্টুও চেয়েছিল, দু-জনে উঠেছে চূড়ায়। মোবাইল ফোনটাকে ওইভাবে গায়ের জোরে শ্বাসরোধ করার জন্য নান্টুর নিজেকে এখন খুনি মনে হচ্ছে। মার্ডারার মনে হচ্ছে নিজেকে। খুনের আসামী। নান্টু চোখ মেলতে পারছে না। তার ঘুম পাচ্ছে। পাশের ঘরের স্তব্ধতা হঠাৎ টিকটিক করে ডেকে উঠল। নান্টুর খেয়াল হল, মা ঘুমোচ্ছে অনেকক্ষণ, কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে নান্টু চূড়া থেকে নেমে এল, পাশের ঘরে গিয়ে দেখল, মা তখনও ঘুমোচ্ছে। নান্টু মায়ের ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ওপর দিকে তাকাল, ওপর দিকে চূড়ায় দেবুও উঠেছে।

দেবু চূড়া থেকে বর্ডার কন্ট্রোল করছে। এপারের লোক ওপারের লোক, এপারের ভাষা ওপারের ভাষা, এপারের নদী ওপারের নদী— দেবু এই এপার-ওপার কন্ট্রোল করছে। দেবু চূড়ার মাথায় খুব ব্যস্ত। তার মাথার ওপর দিয়ে পাখি এরোপ্লেন উড়ে যাচ্ছে। মেঘ উড়ে যাচ্ছে। দেবুও মাঝে মাঝে চূড়ার সিংহাসন ছেড়ে উড়ে যাচ্ছে এদিক-ওদিক, এধার-সেধার। উড়তে উড়তে দূর থেকে দেবু দেখল ছাদে সান্যাল স্যারের অন্ধ মেয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ঘুড়ির লাট খাওয়া ঘুড়ির প্যাঁচ খেলা দেখছে। কী করে দেখছে? মেয়েটা তো চোখে দেখে না! দেবুর নেশা কেটে আবার জুড়ে গেল। দেবু দেখল সান্যাল স্যারের বাড়ির নীচে শিবু দাঁড়ানো, শিবু আট-পা নিয়ে জাল ছড়াচ্ছে— জালে অন্ধ মেয়েটির চোখ দুটো ভাসছে, সাঁতার কাটছে…

***

নান্টু অনেকক্ষণ বাদে আবার মায়ের ঘরে ঢুকে ‘মা মা’ বলে মাকে ডাকল। মা ঘুমোচ্ছে। অনেকক্ষণ ধরে। নান্টু তার মাকে অনেক দূর থেকে ডাকছে। মা শুনতে পাচ্ছে না। আগের যুগ বা তারও আগের যুগ বা হয়তো তার ঠাকুরদার সময় থেকে কিংবা তারও আগের সময়ে দাঁড়িয়ে নান্টু তার মাকে ডাকছে। মাআআ মাআআআআ।

মায়েরা সারাদিন খাটাখাটনির পর সংসারের সব দায়িত্ব পালনের পর ঘুমোলে কারোর ডাক শুনতে পায় না। নান্টুর মাও নান্টুর মা মা ডাক শুনতে পেল না বা পাচ্ছে না। নান্টু তার ঘুমন্ত মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে কী করবে বুঝতে পারছে না!— এরকম অসহায় অবস্থায় সে দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ। আর ভাবছে যে, এখন তো নিফটি সেনসেক্স মার্কেট বন্ধ! মার্কেটের শব্দ— বাজারের অশ্লীল চিৎকার— লোভের চিৎকার— তো এখন নেই! চারিদিক সব চুপ, শান্ত চারিদিক— মায়াবী! তবু নান্টুর মা নান্টুর ডাক শুনতে পাচ্ছে না!

নান্টুর শ্বাসরোধ করে বন্ধ করা মোবাইল ফোনটা তখনও বিছানায় মৃত অবস্থায় পড়ে আছে অথবা ঘুমিয়ে আছে অথবা লাশের ভূমিকায় অভিনয় করছে। নান্টু একবার মায়ের দিকে একবার মোবাইল ফোনের লাশের দিকে তাকাচ্ছে। মোবাইল ফোন বন্ধ। এখন মার্কেট বন্ধ। নান্টুর নিজেকেও বন্ধ কারখানা বন্ধ ঘড়ি বন্ধ টিকটিকি এইসব মনে হয়।

বর্ডারে অনেকদিন বাদে চীনের কয়েকজন সৈন্য এসেছে এপারে চা খেতে, এপারের ভারতীয় বন্ধু সৈনিকদেরকেও দেখতে, গল্প করতে। একসঙ্গে চা খেতে বেকারি বিস্কুট খেতে কৌশিক-বিড়ি লাল-সুতোর বিড়ি খেতে…

বিষ্ণুদার দোকানে চীন-ভারতের তরুণ সৈনিকরা চা খাচ্ছে, হা হা হাসছে। কাঁটাতারের ওপরে নীল আকাশ। দু-একটা পাখি উড়ছে কাঁটাতারের এপারে ওপারে। কাঁটাতারের কাছের গ্রামেই একমাত্র শ্মশান! সীমান্ত ঘেঁষা এই জায়গাটা বা গ্রামটার নাম সুন্দরপুর। সুন্দরপুরের পাশের গ্রাম গোলাপতলাতেই শ্মশান! চীনের সৈন্যরা ভারতীয় কোনো শ্মশান একবার দেখেছিল। ভারতীয় শ্মশান দেখে স্বভাবতই তাদের মন খুব খারাপ হয়েছিল, তাদের মনে উদাসী এক পাখি বাসা বেঁধেছিল।

এটা চৈত্র মাস। বাইরে ভয়ংকর গরম। রোদ অঝোরধারায় বৃষ্টির মতো ঝরছে। রোদ ঠিক নয়, আগুনের বড়ো বড়ো ফোঁটা পড়ছে, মাটিতে পিচের রাস্তায়, জলে, পুকুরে নদীতে গাছের পাতায়— চৈত্র আগুনের ফোঁটা হয়ে ঝরছে— সেই আগুনের ভিতর দিয়েই নান্টু দেবু আর আট পায়ের দৃষ্টিহীন শিবু চলেছে গোলাপতলার শ্মশানে। শিবুর অক্ষিকোটরে অক্ষি নাই, তার অক্ষি— তার নয়ন— সান্যাল স্যারের অন্ধ মেয়েকে সে দিয়েছে আগেই। সান্যাল স্যারের মেয়ে এখন শিবুর চোখ দিয়ে শোককে দেখতে পায়। শোককে দুঃখকে সে-মেয়ে আগে চাক্ষুষ দেখেনি কখনো। এখন শোক দুঃখকে দেখতে পায় সে।

সান্যাল স্যারের সেই মেয়ে দেবযানী, সেও নান্টু দেবু শিবুদের পিছন পিছন, এই প্রথম শ্মশান দেখতে চলেছে। মানুষের দেহের শেষ পরিণতি কীভাবে অগ্নিতে মিলায় তা দেখতে। সে, দেবযানী, সান্যাল স্যারের মেয়ে ওদের পিছু পিছু যাচ্ছে শ্মশানের দিকে। শিবু অবশ্য দেখতে পাবে না শ্মশান, শ্মশানের দাহ, চিতার আগুন। না দেখে অনুভব করতে পারবে। শিবুর চোখহীন কোটর দিয়ে জল গড়াবে, এতেই শিবুর শান্তি। দেবযানীর গায়ের গন্ধ সে পাচ্ছে বাতাসে পথের ধুলোয়।

চৈত্র ঝরছে। চৈত্র ঝরার কোনো বিরাম নেই। নান্টুর মায়ের শবদেহ ওদের সামনে সামনে বয়ে নিয়ে চলেছে ভারতীয় সৈন্যদের সঙ্গে চীনের সৈন্যরাও। মা! মা মারা গেছে। নান্টুর মা। একজন ভারতীয়র মা। এটা যখন চীনের সৈন্যরা বুঝল তাদের চোখও অল্প ঈষৎ অশ্রুতে ভিজে কি যায়নি! তারা এই প্রথম কোনো ভারতীয় নারীর, ভারতীয় মায়ের দেহ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

শব বাহনের কাজে তারাও এগোচ্ছে ভারতীয় সেনাদের সঙ্গে গোলাপতলার শ্মশানের দিকে!

আকাশ পরিষ্কার নীল। মেঘ নেই, পাখি দু-একটা নিরুদ্দেশের পথে উড়ে যাচ্ছে। শোক টপকে দুঃখ টপকে তারা ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে… শ্মশান কাছেই… সীমান্তও এখান থেকে খুব দূরে নয়…

হঠাৎই সামনের শববাহকদের কাঁধে কাঁধে যাওয়া ‘মা’-কে নান্টু ‘মাআআআ’ বলে ডেকে উঠল। কিন্তু নান্টুর মা চুপ। নান্টুর মা, ভারত-চীন সৈন্যদের মৃত মাসিমা, নান্টুর ডাকে কোনো সাড়া দিলেন না। তিনি ঘুমোচ্ছেন। পৃথিবীর সব মায়েরা সংসারের সব কাজ সেরে যখন ঘুমোতে যান, তখন কেউ তাঁদের ডাকলে তাঁরা সেই ডাক শুনতে পান না। তাঁরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে সংসার থেকে কিছুক্ষণের জন্য তখন দূরে চলে যান।

ফলে নান্টুর মা ঘুমোচ্ছেন। ভারত-চীন সৈনিকদের মা ঘুমোচ্ছেন। তাঁর ঘুমের যাতে ব্যাঘাত না হয়, তাই তারা চুপে, নিঃশব্দে শ্মশানের দিকে হেঁটে চলেছে।

সীমান্ত এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। শোকে সীমান্তের কাঁটাতারেও দোল লাগছে, একটা দুটো তিনটে স্তব্ধতা, নিঃশব্দ বাতাসের তানপুরা বাজাচ্ছে কেউ, যেন নান্টু দেবু শিবুদের নতুন উদ্যমের শুরু হল এই, এইখান থেকে…

Facebook Comments

পছন্দের বই