লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কবিতা

রুহুল মাহফুজ জয়

গন্দমোদ্যান


বিলাই ভালো। বিলাইয়ের কামড় আরও ভালো। তারও চেয়ে ভালো বৃক্ষজীবন। ধীরে, অতি ধীরে, চুমুকে চুমুকে শিকড়-ডালপালাসমেত তৃষিতযাপন। বৃক্ষের ধী, বিড়ালের অস্থিরতা নিয়া নিম্ফেট ছোট্ট গর্তে ফুটছে অন্ধকার। অই ব্ল্যাকহোলে ঢুকে প্রথম আবিষ্কার। প্রিয়তমা নারীই যুদ্ধবিমান। বাজারের ব্যাগ হাতে বেরিয়ে অচেনা বারান্দায় বাতাসশোষিত পেটিকোটের ভিতরে হারায়ে গিয়ে যুদ্ধের অই রেতঃপাতে আমি কী করে এলাম!


মনে হল, অন্যমনস্ক হাঁটতে-হাঁটতে একটা বেহেশতে পড়ে গেলাম। যদিও, বেহেশত একটা ধারণামাত্র। যে-ধারণার ভিতরে একটা প্রশান্ত নদী বেয়ে কাগজের নৌকা বয়ে যায়। নৌকার ভিতরে নাকফুলসজ্জিত বউ। ঘোমটা সরায়ে যে ইতিউতি তাকায়। আর পানির গুঞ্জন ছাড়া তাকে অন্য কিছুই বিষাদগ্রস্ত করে না।


অই যে, একদল লোক প্রাচীন সংগীতের স্বরলিপির ভঙ্গিমায় হেঁটে যায়। হাটুরে। নিজেরাই গপ্পের চরিত্র— তাদেরও একটা পিঁপড়াজীবন আছে। মাথায় সদাইয়ের ঝুঁড়িটা লন্ঠনছায়ায় ফারাও সম্রাটদের মুকুটের মতন দেখায়। হতে পারে, ওরাই তুতেনখামেন। মমির অভিশাপ থেকে বেরিয়ে এসে আজ সবজির কারবারি। আর অই যে, স্কুলে কান ধরে খাড়ায়ে থাকা ছেলেটা, যার মনোযোগের নিচেই ওড়ে যত উড়োজাহাজ— পাখিদের বিদ্যালয়ে ওর নামে রোলকল হয়। অই যে, মেয়েটা, সেলাইয়ে কারো নাম লিখতে গিয়ে সুইয়ে ফুটা করেছে আঙুল— ওর অন্যমনস্ক হাসির ভিতরে একটা জানালা ক্রমশ নদী পাড় হয়ে পাহাড়ের দিকে ঘন-অরণ্যে বেঁকে যাচ্ছে। কোনো একদিন ও-ই রূপকথার কাজলরেখা ছিল।


পায়ে যেন মোজা নয়— শৈশবের শালবন এঁটে ঘুমাতে যাই। ঘনছায়া, তেজ খুলে ঘাপটি মেরে বসো। লুকানো মুখের দীর্ঘ শরম তোমার সূর্য হয়। আমার পায়ের মোজায় রাত নেমে এসেছে। দ্যাখো। নিরাকারের মতন পাতাগুলা পতনোন্মুখ। পচনশীল। কে লিখবে সেই অ-প্রশ্রয় অশ্রুর গান?


খননের এই যে বিদীর্ণ চিৎকার— তার ভিতরে অঘোরে তবলা বাজাচ্ছে নীলজ এক লোক। মনমালী রয়ে গেছে ধাঁধা। পাতাসকল হলুদ হয়ে এলো। বুঝি, আবার বাতাসের ঘূর্ণনে আমাদের দেখা হবে। দেখা মানেই বিদায়— অথচ তোমার পায়ের শব্দে তা লেখা নাই।


একটা শিউলি ঝরে গ্যালো জীবনের কিনার ঘেঁষে— কোনো ফুলই ফুটল না আর।


কোথাও আমার আয়ু লাফাচ্ছিল খরগোশের মেজবানে। আর তুমি কেমন দূর্বাদলে বসে গুনছিলা খসে যাওয়া শীতের লোম। আর ভাবছিলা, প্রেমিকটা পুরুষ রয়ে গিয়ে কবি-বনে ফেলে গ্যাছে শব্দের যৌনজীবন। আর আমার আত্মা তোমার আয়ুর ভিতরে পলক ফেলছে— তুমি জন্মের মতন পুরানা সত্য হয়ে যাও।


সুন্দরী। মহিলা অন্যের বউ। মেয়েটা প্রেমিকা। আরেকজনের। উভয়ে উভচর। জাহাজডুবির পর নাভির দিকে তাকায়ে আছে, যেন দ্বীপ। সাঁতরাও, ক্যাপ্টেন!


শাড়ি। পরনে নতুন। কুহু ঘুমায়ে রয়, কুহু ঘোরের ঘুমে রয়। পরনে শাড়ি। নতুন। টুপটাপ। কাদা। পানিভরতি রাস্তা। রাস্তাভরতি নাগরিক অম্বল। কাদা লাগবে, ভিজবে শাড়ি। খিদা-ভয় নিয়া কুহু ঘুমায়ে রয়। পরনে নতুন, জারুলশাড়ি। নৌকা আঁকা— মাছেরা দেখিছে সাঁতার। তারও পরেও, কুহু ঘুমায়ে রয়, কুহু ঘরের ঘুমে রয়।

১০
কারে যেন ডাকছিলাম। কে যেন ডাক দিছিল আমারে। অপরিচয়ের এই ডাক প্যাঁচার দোসর। কেউ না জানি, ভৌতিক সেই শিহরণরিপু কোথা হতে আসে। এমন ডাক ডাকিলাম— কথার জন্ম না হতেই ভাষা মরে যায়। এই ডাক হতে পারত ছবির সামনে দাঁড়ানো আর্ট না বোঝা মুগ্ধ চোখ, সূরার অর্থ না জেনে কুরান মুখস্থ করা হাফেজের দৃঢ় স্বর, কিংবা অন্ধের অনুভূতি— যার স্পর্শের ধ্বনিময়তার নিকটে সকল ভাষা মিছা হয়ে যায়, আঙুলের চোখ দিয়ে যে দ্যাখে গন্দমোদ্যান।

Facebook Comments

পছন্দের বই