কবিতা
সাফওয়ান আমিন
কালিসন্ধ্যার মিহি ডাক
১
গাঢ় জোছনার সাধ নেই, সে তো বহুদূর, বহু কথার বিনিদ্র যাপন তত্ত্ব— এখন তো খাচ্ছিই খুঁটে খুঁটে গাঢ় অমাবস্যার রং!
আজ শুধু ওটুকুই হোক, আপসে তোমাকে ভাবার চিরন্তন ও নির্জন পথের খাঁসা বুঁদরোদন— প্রেমের ঊর্ধ্বে গিয়ে দেখা যায় কি, কালিসন্ধ্যার মিহিমিহি ডাক? তবে আমার কালিসন্ধ্যাটা ফিরে আসুক; আমি নৃত্য করি তাঁর মায়াবুকে—
আজ শুধু ওটুকুই হোক, সারল্য নন্দন যেভাবে আমাকে গেঁথে নিয়ে হাঁটে, নিগূঢ় রহস্যে, নির্জন পথের সাথে—কলাপাতার আবছায়ায় মর্মর যে-ধ্বনি পাও, তা কি চন্দনের, নাকি পৃথিবী মাতানো খোশবুবক্সের? (আফিমের মতো মনে হল) প্রেয়সীর আঁচলের বাউলি ঝাপ্টা কিনা! আমাকে ওটা দাও, গাঢ় জোছনা চাই না।
২
বহু বৃষ্টি ভেজার সন্ধ্যায়, তুমি ভেতরে আমি জানালায়— বেদানা-রঙা চোখের কানা-কুয়া উড়ে গেল যবনের হাওয়ায়, জীবনের ভেতর— ভাবছি যদি ফিরে আসে প্যারাফিন নিয়ে, তবে কুমকুমে ভরে যাবে করপুট!
জানি, নখের যৌবন এলে ছেঁটে দিতে হয়; এসেছে কষ্টের যৌবন, সুযোগেই কাটব, চিন্তার কিছু নাই। সাক্ষী রাখো এই কালো মিহি রং, সকল কল্যাণ খেলা করবে তোমাকে ঘিরে— তুমি আশা পেলে, আমি বর্ষার সমস্ত বৃষ্টির কোলে, শুধু তোমারই নাম লিখে দিলাম!
অসময়ে একদিন ঘুমঘোর থেকে জেগে দেখি, সানাই বাজে, তোমার পায়ে আলতা, গায়ে লাল টুকটুকে শাড়ি… আমার কেবল দেরি হয়ে যায়!
আজ সারাদিন বিষ্যুদবার; তোমার দিকে চেয়ে আছে—
৩
দাপুটে সুখের দিন খুব গতিতেই নেমে যায় নীচে— বাতাসে যে-প্রেম বেজেছিল বাঁশের কঞ্চির পরশে পরশে, তা কি ক্ষয়ে গেল এত সহজে? ভেবেছি, দারুচিনি বিদিত করবে তোমার সন্ধ্যাবাটির সালুন সহযোগে— অথচ মেলেনি বহুকাল গাঢ় জোছনার দেখা। আকস্মিক বিপর্যয় ভেবে নেই ফড়িঙের, ইঁদুরের মৃত্যুকে আর তোমার প্রস্থানের স্বর!
যেন যে-ফড়িং দোয়েলের, যে-ইঁদুর চিলের তাতে নেই কারো অনুযোগ— কিন্তু ইঁদুর, ফড়িঙের তো ঠিকই আছে ঘোরবিরোধ। ভাবি আমারও কি?
৪
যদি জলের শরৎ ঘনার দিনে শীত আসে, তবে নিয়ম ভেঙে যায়, মনে হয় অলৌকিক কোনো ধাঁধার পর্ব মেতেছে কোনো পথিকের সাথে— তোমার জানালার পথ থেকে যতদূর গ্যাছে পথ, আমি সে-পথে হেঁটেই হয়েছি পথিক। চুড়ির শব্দ, কুমকুমের ঘ্রাণই আমার পথ নির্দেশক; আমি হেঁটে যাই সে-সবের ইশারায়… কোনো এক ঘোরভেদী সন্ধ্যায় তোমার জানালায় গিয়ে টের পাই; এক সহজ সত্য!
‘তুমি সূর্য মেনে, আমি গাছ হয়ে প্রত্যহ হেলে যাই— কিন্তু গাছ তুমি মালিক বদলিয়েছ!’
৫
যেদিন তোমায় প্রথম দেখি, পরনে ছিল বাসন্তী রাঙা শাড়ি। যতটুকু আস্ফালন ও ডাকাডাকিতে ডাহুকের সর্বনাশ হয়, আমারও তাই হল— আর প্রেম প্রবেশিকার প্রথম পর্বে প্যাঁচার স্বরে চমকে গেলাম দু-জন, মিহি কাজল রঙের সন্ধ্যা ছিল তখন! সেই সাঁজে পাখিরা কি ফেরেনি গান গেয়ে? উঠানের সেই লাল শবরি গাছটা, তোমার তিলের রাখত যে খোঁজ, তার সাথে কি হয়নি দেখা আমার হররোজ—? আশ্চর্য যে-কল্পতরু তোমার খোঁপায় গাঁথা, তার কি আর মনে আছে, সকল সন্ধ্যে কথা?
ডাঙার ভয় মাছের চিরকালীন; আমার প্রেমের— তাই যত গতিকের আহাজারি। আর ফেলেই তো রেখেছি সমস্ত ভোঁতা অলোকরোদন, বিষণ্ণ মিনজিরি! আফসোস শুধু, তেঁতুলতলায় দাঁড়িয়ে থাকাটুকুন, কালিসন্ধ্যার নামে দলিল হয়ে গ্যাছে—
৬
পুরো তিথিঙ্ক ভেবে নেবার পর, ভেবেছিলাম তোমার চাঁদবদনের সুকৌশল নিয়ে— নেশার মতো পরে থাকত আমার চোখ ওদিকেই। দিন পেরুচ্ছে, রাত আসছে; তুমি দাড়িয়ে ঠায়, উঠানটায়, আমি মোহগ্রস্ত তখন তাকিয়ে থাকতেই! সেইসব শিরিষ-কাগজে ঢেলে আজ কেমন মুছে দিতে গিয়ে, ক্ষত হয়ে যায়, হৃদয়—!
৭
জানি, জীবন সহজ ও বিশুদ্ধতা চায়! তাই তোমার অধরখানি শত অভিমান চেপে বসে আছে আমার দিকে—
অথচ আমি রাজহংস; পালক আছে, উড়তে পারি না।
নামে রাজ; কামে বেভুল সরাজ— কেন এই বেঁচে থাকা?
আহত সুরের পাঠ চলছে যেখানে প্রতিনিয়তই—
স্নো-কুমকুম, জরির চুমকির যে-আদিকাব্য, তার মূলে আছে আলেখ্য এক প্রেম! জানো তো ঠিকই, শুকনো পাতার মর্মর আমাদের দুশমন— তোমার বাপে সহসাই টের পায়, আমাদের প্রেম সেদিনের মতো শেষ হয়ে যায়! এই সমস্ত আদিকথা তো ফুরিয়েছে কবেই, ভাবি আজ কোনো এক ধীবরের কথা;
যে কিনা স্বপ্নে এঁকেছিল এক সোনালি উজ্জ্বল মাছ
অথচ তা ভেসে গ্যাছে সূর্যের পিছু পিছু অন্তের দিকে—
৮
মেঘ যে কেন এতদূর থেকে ডাকে, কাছে এসে ভিজিয়ে দিলেই পারে— দীর্ঘমেয়াদি এই মনখারাপের মওসুমে
‘La Vita E Bella’ উচ্চারণ একপ্রকার মূর্খামি! এ-সত্য জানার পরেও, চুইঝালের ঘ্রাণে কারো সালুনের বাটি মনে পড়ে— রেডিয়ো তরঙ্গে ভাসতে ভাসতে উঠি জরির নকশায়—
এনার্কিজমেও ততটা তেজ নেই, যতটা তরুণ কবির ফুঁসে ওঠায়— এখানে প্রবীণ কবিরা যেন স্পিডব্রেকার, ঠিক তোমার বাবারই মতো! আমি বিদ্রোহের মঞ্চে, বলয় ভাঙার ইচ্ছায়, তোমারে নতুন করে আলিঙ্গনের ভাবনায়…
এনার্কিজমে শিখেছি, “ভাঙলেই কেবল সৃষ্টি হয়”
আসলেই কি ভাঙতে পারতেছি? বহু ক্ষান্ত, সংশয়ে বলতে ইচ্ছা হয়; Bella Ciao! Bella Ciao! Bella Ciao!
৯
‘ফোটালে যে ফুল, সে ফুল শেফালি।’ বিভ্রম তো মোটেও নয়, যা ঘটেছে তা প্রেম। কেয়াবৃক্ষের পরশে যতটুকু আভা পেলে, সবটুকুই সত্য সম্পর্কের দিকে হেঁটে যাওয়া স্বপ্ন—
সে-স্বপ্নের শুঁড়িপথে যে-জাহাজ যাচ্ছে, তার গতি নির্ণয় শেষে বলে দেওয়া যায়, গন্তব্য পাবে কিনা! ভাবি, জাহাজ তো চালাচ্ছ তুমি, তবে গতি কেন এত ধীর? জানলাম সমাজ ধরেছে পাছাড় টেনে, সংশয় তাই গন্তব্য নিয়ে— যাইহোক, কেয়াবৃক্ষের পরশে স্বপ্ন আবার জাগ্রত হোক,
জাহাজঘাটে আমি বসে আছি— শাওনে আসবে বলেছিলে!
১০
আজ সমস্ত সন্ধ্যার মধ্যে জপি শুধু এইটুকুন মন্ত্র— “আবার এলো যে সন্ধ্যা, শুধু দু-জনে…” ভালো লাগে ভাবতে, আমি মোটামুটি জোনাকির রাত, তোমার শিওরে জেগে থাকি, ভিজে যায় মন, মিহি কাজল রং ঘিরে!
আজ কবরফুলে ছড়ায়েছে স্মৃতি ছাতিমফুলের এক্সট্রিম সেন্টের মতো— আমি বসে বসে কালিসন্ধ্যায় সেইসব দেখছি! দ্যাখো, বহু প্রতীক্ষার অবসান শেষে তুমি ঠিক রয়েছ আমার পাশাপাশি। ঝিঁঝিপোকারা করছে নৃত্য, আমাদের মিলন সন্ধিক্ষণে— এসেছে কতিপয় শৃগালও; গাইছে গান বহু সুরে সুরে;
আহা! আজ আমি বহু ঘোরে— এই বীভৎস সুন্দর আজ আমাকে খেতে চাচ্ছে, আমি রাজি; খাও হে বীভৎস, খাও:

সাফওয়ান আমিন
জন্ম: ২৩ মে, ১৯৯৭। শিক্ষা: ইংরেজি সাহিত্যে। সম্পাদনা: ‘নিওর’ পত্রিকার সহযোগী সম্পাদক।