লেখক নয় , লেখাই মূলধন

ধারাবাহিক।পর্ব৬

ফা-হিয়েন

ফা-হিয়েনের ভ্রমণ

সপ্তদশ অধ্যায়

এখান থেকে ভ্রমণ করো দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্ত ধরে। অতিক্রম করো আঠারো ইউ ইয়েন পথ। এসে পড়বে প্রসিদ্ধ সংকশা নগরীতে। বুদ্ধ তিন মাসাধিক কাল ত্রিয়াশত্রিনশাস স্বর্গে কাটিয়েছিলেন। সেখানে তিনি তাঁর মায়ের মঙ্গলার্থে অনুশাসনগুলি প্রচার করেন। কথিত আছে স্বর্গ থেকে যখন তিনি পৃথিবীর পথে নেমে আসেন, প্রথম পা রাখেন এই সংকশা নগরীতে। ঐশ্বরিক ক্ষমতা বলে তিনি স্বর্গারোহণ করেন। আর শিষ্যগণের অগোচরেই রয়ে যায় সে-সব কাহিনি। স্বর্গবাসের মেয়াদ শেষ হবার সাতদিন আগে তিনি তাঁর অদৃশ্যমানতা ত্যাগ করেন।

বুদ্ধের আত্মীয় ভ্রাতা অনিরূদ্ধ ছিলেন প্রবুদ্ধ বা আলোকিত ব্যক্তি। তিনি জ্ঞানচক্ষু মেলে সুদূরে দেখতে পেলেন লোকমান, পরম পূজ্য তথাগতকে। প্রবীণ গুরু মৌদগল্যায়নকে অনিরূদ্ধ বললেন, ‘এবার তুমি যাও, তথাগতকে প্রণাম করো।’ মৌদগল্যায়ন এগিয়ে এসে বুদ্ধের চরণে নিজেকে প্রণত করলেন এবং একে-অপরকে অভিবাদন জানালেন। বুদ্ধ বললেন, ‘মৌদগল্যায়ন, আর সাতদিন পর পৃথিবীর পথে ফিরব আমি।’ এই কথা শুনে ফিরে গেলেন মৌদগল্যায়ন।

ইত্যবসরে আটটি সাম্রাজ্যের সম্রাট, তাদের মন্ত্রী, আমাত্য এবং প্রজাগণ, বুদ্ধের দীর্ঘ অদর্শনে হয়ে পড়ল ভারাক্রান্ত। এবার প্রিয় তথাগতের প্রত্যাবর্তনে সারা দেশজুড়ে সকলে মেঘরাশির মতো ঘনিয়ে এলেন। প্রত্যেকের বাসনা একটিই, পরম পূজ্যের দর্শন। একজন ভিক্ষুণী স্বগোতক্তির মতো হৃদয় নিংড়ে উচ্চারণ করলেন, ‘আজ রাজা, মন্ত্রী, সাধারণ মানুষজন সকলেই গৃহের বাইরে বেরিয়ে এসেছেন বুদ্ধের সন্দর্শনে। আমি একলা ভিক্ষুণী, কীভাবে দেখা পাই তাঁর?’ বুদ্ধ অন্তর্যামী। এই কাতর বাসনা জানতে পেরে তাঁর ঐশ্বরিক ক্ষমতা দিয়ে এক মুহূর্তে সেই মহিলাকে চক্রবর্তী রাজার রূপ দিলেন। এবং তিনিই প্রথম অভিবাদন জানালেন প্রিয় বুদ্ধকে।

স্বর্গ থেকে অবতরণের সময় বুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হল রত্নখচিত ধাপ-সহ তিনটি উড়ান। সপ্তরত্ন, সুবর্ণ, রৌপ্য, বৈদুর্য্য, স্ফটিক, মুক্তা, লোহিতক, মুসরগলভ দিয়ে তৈরি মধ্যবর্তী উড়ানে নেমে এলেন বুদ্ধ। ব্রহ্ম প্রস্তুত করলেন রূপার সিঁড়ি। চামরী গাইয়ের লেজ থেকে তৈরি শ্বেত মার্জনী হাতে তিনি এসে দাঁড়ালেন ডান দিকে। দৈব অধীশ্বর শিহ তৈরি করলেন রক্তবর্ণ সোনার সিঁড়ি। সপ্তরত্নে প্রস্তুত ছাতা হাতে এসে দাঁড়ালেন বাঁ-দিকে। অগণিত আমন্ত্রয়ী ঈশ্বরগণ বুদ্ধের অনুসারী হয়ে নেমে এলেন পৃথিবীতে। বুদ্ধ পৃথিবীর মাটিতে পা রাখতেই তিনটি উড়ানই ভূমিতে বিলীন হল। পড়ে রইল কেবল সপ্তসিঁড়ি।

পরবর্তীতে সম্রাট অশোক সেই সিঁড়ির অন্তঃসন্ধানে খননকার্য শুরু করলেন। খুঁড়তে খুঁড়তে নরকের দ্বার প্রান্তে এসে পৌঁছোলেও কোনো তল পাওয়া গেল না সেই সপ্তসিঁড়ির। আর এর পর থেকেই সম্রাট হয়ে পড়লেন গভীর ধর্মবিশ্বাসী। এই স্থানে নির্মাণ করলেন বৌদ্ধমঠ। মধ্য উড়ানে স্থাপিত হল ষোলো ফুট উচ্চতার বুদ্ধ মূর্তি। মূর্তির পিছনে নির্মিত হল ত্রিশ হাত উচ্চতার একখানি প্রস্তর স্তম্ভ। আর সেই স্তম্ভের শীর্ষে আসীন হল এক সিংহ মূর্তি। আর ভিতর দিকে স্তম্ভ গাত্রে চারপাশে উৎকীর্ণ বুদ্ধের মুখশ্রী। ভিতর-বাহিরে স্তম্ভটি কাচের মতো স্বচ্ছ।

কিছু বিরূদ্ধ মতের গুরু এই স্থান নিয়ে শ্রমণদের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। বাদানুবাদ অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছোয় শ্রমণগণের গুরুত্বপূর্ণ বিবৃতিতে, এ-স্থানে বসবাসের অধিকার যদি কেবল শ্রমণদের থাকে, তবে এখন তার প্রমাণসাপেক্ষে কিছু অলৌকিক ঘটনা ঘটবে। তাঁদের এ-কথা বলবার সঙ্গে সঙ্গে, স্তম্ভ শীর্ষে বসে থাকা সিংহ গর্জন করে উঠল, তাঁদের অধিকারের সমর্থনে। এতে গুরুগণ নিদারুণ ভীত হয়ে পড়েন।

তিন মাসাধিক স্বর্গের ঐশ্বরিক আহার সেবন করে বুদ্ধের গা থেকে স্বর্গীয় সুগন্ধি বেরতে লাগল। তাই তিনি তৎক্ষণাৎ স্নান করতে শুরু করলেন। যে-স্থানে এই ঘটনা ঘটে সেখানে পরবর্তীকালে একটি স্নানাগার তৈরি করা হয়। এই স্নানঘর আজও বর্তমান। যেখানে ভিক্ষুণী, সবার প্রথম বুদ্ধের অভিবাদন করেন, সেখানে একটি প্যাগোডা স্থাপিত হয়। বুদ্ধ যেখানে সর্বসমক্ষে চুল ও নখ কাটেন, সেখানেও তৈরি হয় প্যাগোডা। এ-সকল প্যাগোডা আজও বর্তমান। দৈব অধীশ্বর, শিহ আর ব্রহ্মার উপস্থিতিতে বুদ্ধ যে-স্থানে অবতীর্ণ হন, সেখানেও নির্মিত হয় একটি প্যাগোড। শ্রমণ এবং শ্রমণীগণ মিলে এই বিহারে সহস্রজনের বাস। কিছু জন আছেন মহাযান মতাবলম্বী আর কিছু হীনযান মতাবলম্বী। একটি সর্বজনীন তহবিল থেকে সকলেরই আহারের ব্যবস্থা হয়। এখানে রয়েছে একটি শ্বেত কর্ণ ড্রাগনের বাস। বিহারের শ্রমণগণের রক্ষক যেন সে-ড্রাগন। ভূমি আবাদ রাখে, নির্ধারিত ঋতুতে বৃষ্টি ঝরায়, সকল বিপর্যয় প্রতিহত করে। তাই তো শান্তির আবাস এই বিহার। শ্বেত ড্রাগনের এই সহৃদয়তার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ, স্রমণগণ ড্রাগনের একটি বিগ্রহ স্থাপন করলেন, আর তার শয়নের জন্য স্থান প্রস্তুত করলেন। বিশেষ নৈবেদ্য দেওয়া হয় ড্রাগনের উদ্দেশে। প্রতিদিন শ্রমণদের মধ্যে থেকে তিনজনকে পাঠানো হত ড্রাগনের বিগ্রহের কাছে। সেখানে তাঁরা আহার সম্পন্ন করতেন। প্রতি বছর বর্ষাশেষে ড্রাগন নিজ রূপ বদলে হয়ে যেত সাদা কান বিশিষ্ট ক্ষুদ্রাকায় সাপ। সন্ন্যাসীরা যখন বিষয়টি জানতে পারলেন, ননীভরতি একটি তাম্র পাত্রে ড্রাগনটিকে রেখে দিলেন। প্রতি বছর একবার ঐ পাত্র থেকে বাইরে বেরিয়ে আসত ড্রাগনটি।

এই দেশ সুফলা। সাধারণ মানুষ সুখী-সমৃদ্ধ। তুলনারহিত এই দেশ। বিদেশ থেকে কেউ এলে তাঁরা অতিথি সেবায় মগ্ন থাকে অনিবার।

এই মঠ থেকে পঞ্চাশ ইউইয়েন দূরে আছে আর একখানি মঠ। হুও চিং সেই মঠের নাম। হুও চিং আসলে ছিল এক অশুভ আত্মা। বুদ্ধের সংস্পর্শে এসে এই আত্মার রূপান্তর ঘটে। এই স্থানে পরবর্তীতে একটি বিগ্রহ তৈরি করা হয়। বুদ্ধের শিষ্য অরহত হাত ধোওয়ার জন্য একটু জল নিলেন, আর হাতের ফাঁক গলে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। জলের এই দাগ আজও দেখা যায় এখানে। সে-জলবিন্দু বয়ে যায়নি নিম্নে। এমনকী মুছেও ফেলা যায়নি। এই জায়গাতেই বুদ্ধের আর একটি প্যাগোডা আছে। এক শুভ আত্মা প্রত্যেকদিন জলসিঞ্চন করে পরিষ্কার রাখে এই প্যাগোডা। কোনো মনুষ্য সহায়তা দরকার নেই। গোটা জায়গাটাজুড়ে ‍রয়েছে শতেক ছোটো ছোটো প্যাগোডা। দিনভর ঘুরে গুনে শেষ হয় না এই প্যাগোডাগুলি। যদি গুনতেই চাও, তবে প্রতিটি প্যাগোডার পাশে দাঁড় করিয়ে দাও একজন করে মানুষ। তারপর গুনে নাও ঐ মানুষগুলিকে।

ছয় থেকে সাতশো জন শ্রমণ নিয়ে এখানেই রয়েছে আর একটি বৌদ্ধ বিহার। এই বিহারের একটি স্থানে বুদ্ধ কিছু আহার গ্রহণ করেন এবং সেখানেই তিনি নির্বাণ লাভ করেন। ঐ বিশেষ জায়গাটি গোরুর গাড়ির চাকার আকৃতির। বিহারের সর্বত্র রয়েছে সবুজ গাছপালা। কেবলমাত্র ঐ স্থানটিব্যতীত। বুদ্ধের পোশাক শুকাতে দেওয়া হত যেখানে সেই স্থানটিও সবুজহীন। সে-সব কাপড়ের দাগ এই স্থানে আজও অমলিন।

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

চতুর্থ পর্ব

পঞ্চম পর্ব

Facebook Comments

অনুবাদক: সঙ্গীতা দাস

শৈশব ও বেড়ে ওঠা উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার চাঁদপাড়া। অত এক দশকের বেশি সময় ধরে গ্রামের স্কুলে ইংরেজি ভাষার শিক্ষকতার পেশায় নিযুক্ত। অন্তর্মুখী জীবন নিয়ে একা একা লোফালুফি খেলেন। অনুবাদ, লেখালেখি, পাঠ এ সবই নীরব কুয়াশায় আচ্ছন্ন। এই অনুবাদ, এ তাঁরই জীবনের অংশ, তাই বাঙ্ময় হয়ে ওঠে।

পছন্দের বই