লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অনুবাদ

শাকিলা আজিজ্জাদা

ভাষান্তর: পৌষালী চক্রবর্তী

দূর থেকে দেখি

আবার আমি একা পড়ে গেছি
পেছনে কেউই দাঁড়িয়ে নেই
পায়ের তলার থেকে মাটি টেনে নিয়েছে
এমনকী সূর্যের কাঁধও আমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে

আমার নাভিরজ্জু বাঁধা ছিল
চলে আসা রীতিনীতির আলখাল্লার গিঁটে
আমার কেশগুচ্ছ প্রথমেই কাটা পড়েছিল
লিপির অনুশাসনের বেসিনের উপর
আমার কানের কাছে প্রার্থনার মতো কেউ ফিসফিস করে
‘তোমার পিছনের ও পদতলের মাটি সারাজীবনের মতো নিঃস্ব হয়ে যাক’

সে যাক গে, একটুখানি উপরেই
একখণ্ড ভূমি থেকে যাবে
যে-পবিত্রতর অন্য কোনো ভূমির থেকে
শয়তান যা যাচ্ঞা করতে পারে আমার থেকে

সূর্য আমার কাঁধে হাত রাখলে
আমি বিচ্ছিন্ন করেছি আমার পদযুগল, সহস্র এক বার,
যা কিছু পিছনে ফেলে এসেছি, সেইসব কিছু, থেকে।

নির্জনতা

তোমার হাতের সব রেখার মধ্যে
তারা লিখে রেখেছে সূর্যের ভাগ্য

ওঠো,
তোমার হাতদুটো তোলো—

দীর্ঘ রাত্রি আমার দম বন্ধ করে দেয়

কাবুল
জুন, ১৯৯৪

আমার কণ্ঠস্বর

এক দূরের দেশ থেকে আমি এসেছিলাম
পিঠে এক ভিনদেশি ন্যাপস্যাক নিয়ে
ঠোঁটে নিয়ে নীরবতার গান

যখন আমি আমার জীবনের নদী বেয়ে ভ্রমণ করেছি
আমি দেখেছিলাম আমার কণ্ঠস্বর
(জোনার মতো)
গিলে নিয়েছিল একটি তিমি
মাছ

আর সেই থেকে আমার জীবনটা বেঁচে ছিল আমার স্বরে

কাবুল
ডিসেম্বর, ১৯৮৯

ইয়ালদা

আমার যন্ত্রণা হয়েছিল
যখন একবাটি মাখা ময়দার তালের মধ্যে
তোমার বাহুযুগল মিলিয়ে যেতে দেখেছিলাম

আর দেখছিলাম তুমি
একফালি লম্বা কাপড় ব্যবহার করছ
পাকা আঙুরের মতো তোমার স্তন বেঁধে নিতে

তোমাকে দেখেছি শিশুকে পরিত্যাগ করতে,
তোমার মুখের কোণ ছিঁড়েখুঁড়ে যাচ্ছে
আমি যন্ত্রণা পেয়েছি।

তোমার ছায়ার দিকে ছুড়ে মারা একটি পাথরও
ঠোঁটে রক্ত বার করে আনার জন্য যথেষ্ট
যে পাথর ছুড়েছিল তার মুখে,
অবশিষ্ট লালা দিয়ে, আমি থুতু ছিটিয়েছি।

কথারা শুকিয়ে গেছে তোমার মুখের মধ্যে
ধীরে ধীরে বয়ে যেতে গিয়ে, বছর
হয়ে গেছে ধুলো আর ধোঁয়া

যাওয়ার সময় তারা পা টেনে টেনে হাঁটছিল
কিন্তু তোমার বাপের বাড়ির রাতগুলিকে
ঝুলন্তই ছেড়ে গিয়েছিল।

এপিটাফ

কার নিভে আসা শ্বাস
ঘুমোচ্ছে
তোমার ওই হ্যাজেল গাছের মতো চোখে?

কীরকমভাবে ছোট্ট শিশুর চাউনি
তোমার ট্রিগারের সামনে শূন্য হয়ে যায়?

কীভাবে তোমার হৃৎস্পন্দন চলে
যখন তরুণী মেয়ের হৃদয় তোমার তালুতে ধরা
আর পা-দুটো রক্তাক্ত?

পাহাড়ের মানুষ!
কোন পরিণতিতে তোমার পদতলের
খাড়াই পাহাড় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে?

ধুলোয় ধূসর তোমার কোঁকড়ানো চুলের জন্য,
স্তনবৃন্ত পুড়ে গেলে
কীরকম লাগবে মেয়েদের,
কী ভাববে মা তার ছেলেকে?

বলো,
কার দু-চোখের গভীরে
তোমার নিভন্ত শ্বাস শান্তি খুঁজে পাবে?

ঈশ্বরের নিদর্শনসমূহ

একটি জানালার হৃদয়ে তুমি ফ্রেমের মতো বাঁধা পড়ে আছ

তার কাঁধের উষ্ণতা
তোমার আঙুলডগে জমাট বাঁধে

স্ট্রিটলাইটের নীচে
বৃষ্টি ধুয়ে নিয়ে যায় তার পদচিহ্নগুলি

তোমার নোটবই বন্ধ
কিন্তু তার চিন্তারাশি পিছলে গিয়ে
পুনরায় যোগ দেয় বিলীয়মান রাতের সঙ্গে।

আর সেখানেই, একটি রাতচরা বিড়ালের ছায়া, হারিয়ে যায়।

প্রথম শ্লোকের মতো কার্যকরী
হাফেজকে তুমি
রেখে দাও পিছনের জানালায়।

তোমার হাতকে দৌড় করাও
রেশমি রুমালের ওপর দিয়ে
কোণায় কোণায় গিঁট বেঁধে
মুড়ে নেওয়া হয় বইরূপ আদি জননীকে

একটি রুপোলি শালের নীচে
তোমার কাঁধ, পাঠ্যের নীরব
ছন্দ হেন, কেঁপে যায়।

প্রাচীন শ্লোকের যত মোড়কের নীচে
পচে ওঠে ঈশ্বরের চিহ্নগুলো।

কনের ঘোমটাটি

আমার বিয়ের সাজ আমি টাঙিয়ে রেখেছি
সাদা রঙের স্মৃতির এক হুকে
তার কাঁধের ওপর আমার রেশমতুল্য দৃষ্টিপাত

তার বুকের থেকে আমি ছিঁড়ে নিয়েছি আমার হৃদয়
সেখানে এখনও দুধের গন্ধ

সে হয়তো জেগে যেত
আমার গ্রীবায় তার স্পন্দমান আঙুলেরা
তার বাহুজুড়ে সেই পুরাতন লাস্যের কলকল।

আমার হৃদয় আমি উপড়ে এনেছি
কিন্তু আমার দু-চোখে শুধু সে
তার চওড়া ও উজ্জ্বল পশ্চাদ্দেশ
বরের শালে জড়ানো

আমি নিজেকে আর মনে করাতে চাই না
পরবর্তী শ্বাসেই
সে উড়িয়ে দেবে ঘোমটার আবরণ

আমি আর গুনব না
তার শ্বাসগুলি

ভূমা

পৃথিবী তার উষ্ণ বাহুদু-টি বাড়িয়ে দেয়
আমাকে জড়িয়ে নিতে
পৃথিবী আমার মা
তিনি আমার এলোমেলো ঘুরে বেড়ানোর
দুঃখ বোঝেন।

আমার এই বিচরণ
এক বুড়ো কাকের মতো
যে জয় করেছে
কম্পমান পপলার গাছের সুউচ্চ শাখা
একদিনে একহাজার বার

হয়তো-বা এ-জীবন কাকেরই মতো
যে প্রতিদিন ঊষাকালে
নিজের কালো চঞ্চু ডুবিয়ে নেয়
সূর্যের পবিত্র কুয়োয়

হয়তো-বা এ-জীবন কাকেরই মতো
যে উড়া দেয় শয়তানের ডানা নিয়ে

অথবা জীবন নিজেই এক শয়তান
ধূর্ত লোককে জাগায় হত্যাকাণ্ড ঘটাতে

জীবন যেন-বা বিষাদগ্রস্ত পৃথিবীর মতো
যে তার রক্তাক্ত হাত বাড়িয়ে দিয়েছে আমাকে

আর তাই আমি ধন্যবাদ দিই
‘বিজয়’-এর প্রান্তসীমায়।

পেশোয়ার শহর
জুলাই, ২০০২

একটি পালক

সেপিদেহ্-র জন্য

যেভাবে আমার স্বপ্ন
তোমার পদক্ষেপের শব্দ শোনে
যখন তুমি প্রবেশ করো
ধীরে, ধীরে, আঙুলের ডগায় ভর দিয়ে

পাতের তলায় তুমি হামাগুড়ি দাও
বিড়ালছানার মতো, তোমার দু-চোখ
আমাকে পান করে।

ঘুমন্ত বা জাগ্রত
আমার স্বপ্নের রেশম তুমি ভাঁজ করো।

যে-মুহূর্তে
তোমার হাত আমার গলা জড়িয়ে ধরে
তুমি দ্রুত বালিশের ওপর ঘুমিয়ে পড়ো।

আর আমি, আধো ঘুমে, আধো জেগে থাকি
যে-মুহূর্তে স্বপ্ন নিঃশেষিত হয়
তুমি আমাকে ভরে তোলো, পুনরায়।

অপেক্ষায় থাকা বিড়ালটি

এই শব্দগুচ্ছ
তারা ভালোভাবে নেয়নি

দয়া করে বোলো না যে, স্বর্গের দরজা
আমার ওষ্ঠাধরের মাঝে খোলে।

আমার দুই বুকের মাঝের ফাটলে
ঈশ্বর স্বয়ং হালকা চালে হেঁটে যান

আমি আসব

এবং আবার
তোমার শ্বাস আমার মধ্যে শ্বাস নেবে
তোমার ফুসফুস ভরে উঠবে
আমার সুগন্ধে
তোমার জিভের থেকে
বৃষ্টি, বৃষ্টি, শুধু বৃষ্টি
আবার ঝরবে আমার গায়ে

আমি দিয়ে দেব

এবং এই সময়ে
যখন তুমি আসো, চকচকে চোখে
আর ঝুঁকে পড়ো, আমাকে দু-ফালা করে দিতে

সংশয়ের ছায়ামাত্র থাকবে না তোমার

সেই কালো বিড়ালের মতো, যে
লুকিয়ে থেকে লাফ দেয়
আর আমার পথ বরাবর চলে যায়
তোমার দুয়ারে এসে চড়াই শিকার করে
যতক্ষণ না সে
নিজেকে হতভম্ব আর ফাঁদে পড়া ভাবছে

Facebook Comments

অনুবাদক: পৌষালী চক্রবর্তী

জন্ম:১৯৮৫। পেশা: ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এন্ড ডেপুটি কালেক্টর। প্রকাশিত গ্রন্থ: ‘লিলিথ জন্মেরও আগে’ (কাব্যগ্রন্থ, ২০২০), ‘মানভূম জার্নাল’ (কাব্যগ্রন্থ ২০২১), ‘অথ বলরামপুর কড়চা’ (সম্পাদিত, ২০১৮)।

পছন্দের বই