লেখক নয় , লেখাই মূলধন

সাক্ষাৎকার

সনাতন রুদ্র পাল

আলাপচারিতায় অরূপ চক্রবর্তী ও জাতিস্মর

[অবিভক্ত বঙ্গদেশে শারদীয় উৎসব বা দেবী দুর্গার আরাধনার প্রচলন হয়েছিল কয়েকশো বছর আগে। মূলত বিভিন্ন রাজপরিবার, জমিদার ও সমাজের ধনী ব্যক্তিদের বাড়িতেই সেই সময়ে দেবী পূজিতা হতেন। কারো বাড়ির নাটমন্দিরে মূর্তি নির্মাণ ক’রে পুজো করা হত আবার কোথাও ঘটপুজো করা হত। বারোয়ারি পূজার প্রচলন শুরু এর আরও অনেক পরে। যদিও কবে কোথায় প্রথম দেবীবন্দন শুরু হয়েছিল তার ইতিহাস আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়। আমাদের আগ্রহ প্রতিমা নির্মাণশৈলীর ধারা নিয়ে। মনের গভীরে থাকা ভাবনাকে বাঁশ, খড়, কাদামাটির সমন্বয়ে একটা মূর্তিতে প্রকাশ। তাকে রং ও নানা ভূষণে অলংকৃত করে দেব-দেবীতে রূপদান যাঁরা করে থাকেন তেমন একজন মৃৎশিল্পীর সঙ্গে আলাপচারিতা ও কিছুটা সময় কাটানোর উদ্দেশ্যে আমরা টিম ‘তবুও প্রয়াস’-এর পক্ষ থেকে হাজির হয়েছিলাম এই সময়ের অন্যতম মৃৎশিল্পী জয়ন্তী আর্ট মিউজিয়ামের কর্ণধার সনাতন রুদ্র পালের স্টুডিয়োতে। বহু পুরস্কারে ভূষিত শিল্পী সাগ্রহে তাঁর কাজের ব্যস্ততার মধ্যেও কিছুটা সময় বের করে আমাদের সঙ্গে কথা বললেন।

সনাতনবাবুর শিল্পীজীবনের অভিজ্ঞতার কথা ও তাঁর স্টুডিয়োতে মূর্তি নির্মাণের কিছু ছবি নিয়ে এই উপস্থাপনা।]

মাতৃ অবয়ব সৃজনে মগ্ন শিল্পী

প্রতিমা নির্মাণশিল্পের সঙ্গে আপনাদের একটা পারিবারিক ঐতিহ্য রয়েছে যা ছোটোবেলা থেকে দেখে আপনারা বেড়ে উঠেছেন। আপনাদের ক-পুরুষ এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত?
আমার পূর্বপুরুষ (ঠাকুরদা) ছিলেন পূর্ববঙ্গের মানুষ। ওনারা প্রতিমা শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিন্তু সেই সময় বারোয়ারি দুর্গাপুজোর এত রমরমা ছিল না। তখন কিছু বর্ধিষ্ণু পরিবারে পুজো হত এবং দেখা যেত সারা গ্রামে হয়তো ওই একটি পরিবারেই পুজো হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রতিমা তাঁদের বাড়িতে গিয়েও নির্মাণ করতে হত। কখনো কখনো আমাদের নিজস্ব শিল্পালয় থেকে তৈরি হয়ে প্রতিমা কারো কারো বাড়ি নিয়ে যাওয়া হত। কিন্তু সেইসময় পুজোর সংখ্যা এতটাই কম ছিল যে, এই জীবিকার উপরে নির্ভর করে সারা বছর সংসার প্রতিপালন করা কঠিন ছিল। সে-জন্য প্রতিমা নির্মাণের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের মাটির তৈজসপত্র তৈরি করা হত। দেশবিভাগের পরে পূর্ববঙ্গ থেকে আমাদের পূর্বপুরুষেরা কলকাতায় চলে আসেন এবং কুমোরটুলি অঞ্চলে তাঁদের স্থায়ী নিবাস হয়। সেইসময় রাখাল চন্দ্র পাল অ্যান্ড ব্রাদার্স-এর সঙ্গেই আমার বাবা ও জ্যাঠামশাইরা একত্রে কাজ করতেন। পরবর্তীতে রাখাল চন্দ্র পাল অ্যান্ড ব্রাদার্স থেকে বেরিয়ে এসে আমার বাবা বিখ্যাত মৃৎশিল্পী মোহনবাঁশি রুদ্র পাল একটি নিজস্ব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এই সময় থেকেই আমাদের বেড়ে ওঠা এবং এই শিল্পের সঙ্গে বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয়গুলো আমাদের মনের মধ্যে জায়গা করে নিচ্ছিল।

আপনি কবে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন? এর জন্য কি আলাদা কোনো আবেগ বা মনের টান অনুভব করেছিলেন?
ঠিক কত বছর বয়স থেকে এই শিল্পের প্রতি ভালোবাসা জন্মেছে সেটা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়।আমরা যখন স্কুলে পড়ি তখন স্কুল-ফেরত প্রতিদিন আমাদের কর্মশালায় আসতাম এবং কিছু না কিছু কাজ সে মাটির হোক বা অন্য যাইহোক করতে হত। এইভাবেই ছোটো ছোটো কাজ শিখলাম। আমাদের বাবা জ্যাঠারা যখন দেখলেন আমরা দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছি এবং করতে পারছি তখন তাঁরাও আমাদের উপর আস্তে আস্তে ভরসা করতে শুরু করলেন এবং দায়িত্বও বাড়িয়ে দিলেন। এইভাবে ছোটো ছোটো দায়িত্বগুলো পালন করতে করতে একসময় নিজেকে এই শিল্পের সঙ্গে একাত্ম করে ফেললাম। একক প্রচেষ্টায় মূর্তি নির্মাণ শুরু করলাম।

যখন এই মৃৎশিল্পকে অন্যতম পেশা বলে গ্রহণ করলেন তখন নিজের সৃষ্টি কি পারিবারিক যে-শিল্পধারা রয়েছে সেই পথেই অগ্রসর হয়েছিল না কি নিজের সৃষ্টিকে পরিবারের অন্যদের থেকে একটু আলাদা করার কথা চিন্তা করেছিলেন?
যখন আমার ৪২ বছর বয়স, তখন আমাদের প্রতিষ্ঠান মোহনবাঁশি রুদ্র পালের থেকে আলাদা হয়ে এসে আমি সনাতন রুদ্র পাল নিজের একটি আলাদা প্রতিষ্ঠান ‘জয়ন্তী আর্ট মিউজিয়াম’ তৈরি করলাম। এবং ২৩ বছর ধরে এই প্রতিষ্ঠান চলে আসছে। আমাদের বাবা জ্যাঠামশাইদের যে-নির্মাণশৈলী চলে আসছিল তারই পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত রূপ আমি আমার নিজের সৃষ্টির মধ্যে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি এবং ভাবনার বিন্যাসে স্বতন্ত্র হবার চেষ্টা করেছি যা এখনও করে চলেছি।

কাঠামো- যার উপর ভিত্তি করে মূর্তি নির্মিত হয়

মূর্তি নির্মাণের ক্ষেত্রেও কি অ্যানাটমি বা শরীরের গঠনগত বৈশিষ্ট্য কাজ করে?
অবশ্যই করে। এবং এটা নির্ভর করে প্রতিমার উচ্চতা অনুযায়ী। ধরুন ১৫ ফুট প্রতিমার ক্ষেত্রে গঠনগত পরিমাপ যা হবে ১০ ফুট বা ১২ ফুট প্রতিমার ক্ষেত্রে সেটা হবে না। এখানে প্রথমেই নীচের কাঠামো বা মূল বেদীর এবং সিংহের উচ্চতার উপরে দেবীর গঠনগত পরিমাপ নির্ভর করে এবং এটা আমাদের কোনো মাপজোক বা এঁকে করতে হয় না। এটা আমাদের এত বছরের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝে যাই যে, শরীরের কোন অংশের পরিমাপ কত হবে এবং এটার জন্য একটি সূক্ষ্ণ নিরীক্ষণের দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন।

বাঁশের কাঠামোর সঙ্গে খড় বেঁধে যে-প্রাথমিক অবয়ব তৈরি করা হয় সেই বাঁশ কি কোনো বিশেষ রকমের এবং কোথা থেকে আনা হয়?
মূর্তি নির্মাণের ক্ষেত্রে যে-বাঁশগুলো ব্যবহার করা হয় অন্যান্য বাঁশের থেকে তার কিছুটা তফাত অবশ্যই রয়েছে। মূলত এই ক্ষেত্রে ফাঁপা বাঁশ ব্যবহার করা হয় এবং যে-বাঁশের গাঁটগুলো ঘন থাকে সেই বাঁশই ব্যবহার করা হয়। তবে আজকাল দেখা যাচ্ছে অনেক সময়ই বাঁশ পরিপক্ক হওয়ার আগেই যোগানদাররা সেগুলি বিক্রি করছেন এবং আমরাও বাধ্য হচ্ছি সেগুলি নিতে। আগে যেখানে একটি বাঁশেই কাঠামো সম্পূর্ণ হয়ে যেত এখন গুণগত মানের তফাতের কারণে একটা কাঠামো তৈরি করতে দুই বা ততোধিক বাঁশের প্রয়োজন হয়। এই বাঁশের যোগানের অধিকাংশই আসে মেদিনীপুরের ঘাটাল অঞ্চল থেকে। এছাড়া মুর্শিদাবাদ থেকেও কিছুটা আসে। এই ব্যাপারে যোগানদারেরা মূলত আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং বিভিন্ন মৃৎশিল্পীদের চাহিদা অনুযায়ী তাঁরা একত্রে এই বাঁশের যোগান দেন যা আমরা বরানগর কিংবা কুমোরটুলি ঘাট থেকে আমরা সংগ্রহ করে নিই।

আজকাল নাকি অনেক শিল্পী বাঁশের বদলে মেটাল স্ট্রাকচারে কাজ করছেন। এই পদ্ধতিতে কাজ করলে কি বিশেষ কোনো সুবিধা হয় বলে আপনার মনে হয়?
আমরা যে-ধরনের কাজ করে থাকি তাতে মেটাল স্ট্রাকচারের প্রয়োজনীয়তা এখনও অনুভব করিনি। তবে আর্ট কলেজ থেকে পাশ করা কিছু শিল্পীরা যে-সমস্ত আর্টের প্রতিমা নির্মাণ করছেন সেগুলোতে মেটাল স্ট্রাকচার ব্যবহার করছেন এবং অনেকসময় দেখা যাচ্ছে সেই মেটাল স্ট্রাকচারই প্রতিমার চালচিত্র হিসাবেও কাজ করছে।

কর্মব্যস্ত স্টুডিও

এখনও কি মূর্তি তৈরির ক্ষেত্রে সনাতনী রীতিনীতি মেনে অর্থাৎ, কোনো বিশেষ দিনে কাঠামো তৈরি করে প্রতিমা নির্মাণের কাজ শুরু হয়? তাহলে যে-সব বিদেশে পাঠানো সেক্ষেত্রে এই রীতি কীভাবে মানা সম্ভব হয়?
বর্তমানে প্রতিযোগিতার যুগে যেখানে আমাদের অনেকগুলি মূর্তি নির্মাণ করতে হয় সেখানে এই তথাকথিত তিথি নক্ষত্র মেনে যেমন ১লা বৈশাখ, অক্ষয় তৃতীয়া বা রথযাত্রা ইত্যাদি দিনে কাজ শুরু করা সম্ভব হয় না। আমরা পঞ্জিকা দেখে দেবীমূর্তি গঠনের কোনো বিশেষ দিনেই কাজ শুরু করে দিই এবং সেটা অনেক আগেই শুরু হয়ে যায়। বিদেশে মূর্তি পাঠানোর ক্ষেত্রে তো এই রীতিনীতি একেবারেই মানা সম্ভব নয়।

বাজেট অনুযায়ী কি প্রতিমার গড়নে হেরফের ঘটে এবং সেটা কি নির্মাণগত তফাত নাকি বহিরঙ্গের সাজসজ্জার তফাত?
প্রতিমা নির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদের একটি নির্দিষ্ট মান আছে যার সাথে আমরা আপোশ করি না। সেক্ষেত্রে বাজেট অনুযায়ী মূর্তির উচ্চতায় তারতম্য ঘটে। সাজসজ্জাতেও এটা প্রযোজ্য— যেমন কাপড়, গয়না, চালচিত্র ইত্যাদিতে কিছুটা তফাত হয়ে যায় এবং অনেকসময় দেখা যায় নিজেদের লোকসান হলেও আমরা নিজেদের কাজের মান বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকি।

প্রতিমা নির্মাণের সময় আপনারা কোন দিকটি বেশি গুরুত্ব দেন, দেবীর মাতৃরূপ নাকি রুদ্ররূপ?
এটি মূলত চাহিদা অনুযায়ী আমাদের রূপদান করতে হয়। তবে আমাদের এত বছরের অভিজ্ঞতায় দেখেছি রুদ্ররূপের তুলনায় দেবীর শান্ত সমাহিত মাতৃরূপের চাহিদা বেশি। হয়তো সকলের মঙ্গল কামনায় যেহেতু মাতৃ আরাধনা করা হয়ে থাকে তাই দেবী মূর্তিতেও মাতৃরূপের চাহিদা বেশি।

আপনাদের সৃষ্টিতে কী কী বৈশিষ্ট্য আছে যা একান্তই আপনার ঘরানার এবং যা দেখে মানুষ সহজেই বুঝতে পারবে এ-সৃষ্টি আপনার?
ভালো প্রশ্ন করেছেন।

আমাদের সৃষ্ট দেব-দেবী মূর্তির চোখ, মুকুট, গয়না ও চালচিত্রের বৈচিত্র্য সবার থেকে আলাদা। এবং আমরা শুনেছি বিভিন্ন মণ্ডপে গিয়ে অনেক দর্শক মূর্তি দেখেই বলে দেন যে, এটি সনাতন রুদ্র পালের সৃষ্টি। তার জন্য আমাদের আলাদা করে কোনো নামফলক ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় না। প্রতিনিয়ত এই ধারাকে ভাঙা গড়ার মাধ্যমে আমরা কাজকে আরো উন্নত ও আকর্ষণীয় করে তোলার কাজে ব্রতী থাকি।

প্রতিমার অঙ্গসজ্জার ভূষণ আপনাদের নিজস্ব স্টুডিয়োতে তৈরি করা হয় কি? মূলত কী ধরনের সামগ্রী ব্যবহার করা হয়?
কিছু কাজ আমাদের নিজস্ব স্টুডিয়োতে অবশ্যই হয় বিশেষত চালচিত্রের। এছাড়া গয়নার বিশেষ ডিজাইন সৃষ্টি করে নিজস্ব কারিগরকে বুঝিয়ে দিই কী চাইছি। গয়না তৈরির ক্ষেত্রে শোলা, জরি, সলমা, চুমকি, মুক্তো, পুঁতি, আর্টিফিশিয়াল স্টোন ব্যবহার করি এবং এগুলো সব বড়োবাজার অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা হয়। এবং একটি মূর্তির গয়না অন্যটির থেকে সামান্য হলেও তফাত রাখার চেষ্টা করি।

প্রতিমার রূপদানে যে-রং ব্যবহার করা হয় সেগুলো কি ভেষজ রং নাকি কেমিক্যাল?
এখন আর ভেষজ রঙের ব্যবহার হয় না। বিভিন্ন নামি দামি কোম্পানি আজকাল এত উন্নত মানের রং সৃষ্টি করছেন যে, মূর্তির রূপদান করার সময় রং নিয়ে বিশেষ চিন্তা করার দরকার পড়ে না। আর উজ্জ্বলতা বাড়ানোর জন্য আমাদের কোনো কৃত্রিম উপায় (বার্নিশ বা তেল) গ্রহণ করতে হয় না।

আপনার স্টুডিয়োতে যাঁরা কাজ করতে আসেন তাঁরা অধিকাংশই কি শিক্ষানবীশরূপে যোগদান করেন নাকি কাজের পূর্ব-অভিজ্ঞতা নিয়ে আসেন?
কিছু মানুষ আসেন একেবারেই শিক্ষানবীশ হিসাবে। এখানে স্টুডিয়োতে এসে ধীরে ধীরে কাঠামো গড়া, খড় বাঁধা, একমেটে, দো-মেটে ইত্যাদি কাজ কোনো অভিজ্ঞ কারিগরের তত্ত্বাবধানে থেকে ধীরে ধীরে শেখেন। এছাড়া আমাদের কাজের ধারা বোঝার জন্য পূর্ব-অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মানুষকেও অন্য কোনো কারিগরের তত্ত্বাবধানে কিছুদিন কাজ শিখতে হয়।

দেবীর মুখাবয়ব

প্রতিমার চক্ষুদান এবং অঙ্গের বিশেষ বিশেষ অংশ তৈরির জন্য কি আলাদা কারিগর রয়েছেন নাকি তাঁরা একাই স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে একটি কাজ করতে পারেন?
কিছু কিছু শিল্পী আছেন যিনি হাতের আঙুল নির্মাণ, চক্ষুদান বা অন্যান্য বিশেষ কোনো কাজে দক্ষ। এবং দক্ষতা অনুযায়ী তেমন কাজই তাঁদের দেওয়া হয় এবং কেউ কেউ আছেন যাঁরা একাই স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে কাজ করতে পারেন। তবে কাজের পুরোটাই আমার তত্ত্বাবধানে হয় এবং ক্ষেত্র বিশেষে আমি নির্দেশ দিয়ে থাকি।

আপনাদের ঘরানার দেবীমূর্তি এতটাই জনপ্রিয় যে, দেখা যায় অনেকেই আপনাদের এই সৃজনশীলতাকে অনুসরণ বা অনুকরণ করে মূর্তি নির্মাণ করছেন। এই ব্যাপারটা আপনারা কীভাবে দেখেন?
প্রথমেই বলি আমাদের নিজস্ব যে-সৃষ্টি তার কোনো পেটেন্ট নেই। কাজেই ভালো কাজের অনুকরণ বা অনুসরণ হবে এটাই স্বাভাবিক এবং আমরাও এই ব্যাপারে সচেতন থাকি। আমাদের যে-ডাইসগুলো থাকে তার উপরে আমরা নিয়মিত পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাই। একটা জিনিস জানবেন যে, শিল্পী নিজেই নিজের কাজের সবথেকে বড়ো সমালোচক। আমরা একটা কাজ করার পরে ভাবি যে, হয়তো দেবীর গালটা একটু ভারী লাগছে, মুখটা একটু বেশি গোল লাগছে সেক্ষেত্রে পরবর্তীকালে আমরা এই জায়গাগুলোর দিকে নজর দিই। চোখ আঁকার ক্ষেত্রেও আমরা পরিবর্তন আনি আর যেটা বিশেষ করে আমরা করে থাকি সেটা হল গয়না, মুকুট এবং চালচিত্রের পরিবর্তন। নানারকম ডিজাইন আমরা নতুনভাবে তৈরি করে আগেরটাকে বাতিল করে দিই। কিন্তু যাঁরা আমাদের কাজের অনুকরণ করছেন তাঁরা কিন্তু সেই একই জায়গায় আটকে থাকেন। আমরা আমাদের নিজেদের কাজে প্রতিনিয়ত যে-সৃষ্টিশীলতা দেখাতে পারি অন্যেরা সেটা করে উঠতে পারেন না, যার জন্য তাঁদের কাজের গ্রহণযোগ্যতা থাকে না।

দুর্গা, লক্ষ্মী, শ্যামা ও সরস্বতী মূর্তি ছাড়া আপনাদের স্টুডিয়োতে আর কী কী কাজ হয়?
দুর্গাপুজোর আগেই আসে গণেশ পুজো। বেশ কিছু গণেশের মূর্তি তৈরি হয় আমাদের এখানে। বিশ্বকর্মা মূর্তি আমরা সেভাবে করি না। এছাড়া শ্যামাপুজার পরে আসে জগদ্ধাত্রী পূজা এবং বছরের প্রায় শেষে আসে সরস্বতী ও বাসন্তী পূজা। তবে বাসন্তী দেবীমূর্তি চাহিদা তুলনায় অনেক কম থাকে। এই মধ্যবর্তী ফাঁকা সময়ে আমরা পরবর্তী বছরের পূজার মূর্তি নির্মাণের পরিকল্পনা এবং তার প্রাথমিক কাজ এগিয়ে রাখি।

মূর্তি নির্মাণের ক্ষেত্রে মাটি ছাড়া অন্য কোনো মিডিয়া (যেমন কাঠ, প্লাইউড, ফাইবার বা শোলা ইত্যাদি) ব্যবহার করেন?
না। আমরা মাটি ছাড়া শুধুমাত্র ফাইবার গ্লাসের কাজ করে থাকি। আসলে মাটি দিয়ে মূর্তি নির্মাণের মধ্যে যে-আনন্দ পেয়ে থাকি সেই তৃপ্তি বা শান্তি অন্য কোনো মিডিয়াতে কাজ করে পাই না।

পূর্ণতা পাবার আগের পর্যায়

বিগত ২০২০ সাল থেকেই করোনা আবহে পুজোর জৌলুস অনেকটাই ম্লান। এর প্রভাব কি আপনাদের জীবিকার উপরে কোনোভাবে প্রতিফলিত হয়েছে?
এই করোনা আবহে যদি কোনো শিল্প সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেটি হল মৃৎশিল্প। পুজোর সংখ্যা কম হবার সাথে সাথে পুজোর বাজেটও কমে যাওয়ায় আমাদের চাহিদামতো আমরা অর্ডার পাচ্ছি না এবং অর্ডার পেলেও সেখানে আমাদের কাজের নিজস্ব মান বজায় রাখার জন্য আমাদের লাভের পরিমাণ অনেকটাই কমে যাচ্ছে। অন্যান্য সামগ্রীর থেকে আমাদের এই কাজটার এতটাই তফাত যে-কোনো একটা বিশেষ উৎসবের পরে অবিক্রিত মুর্তিগুলির কোনো চাহিদা বা মূল্য থাকে না। যেহেতু অনেকরকম কারিগর নিয়ে আমাদের একটা বৃহৎ পরিবার এবং প্রত্যেকেই এই উপার্জনের উপর নির্ভরশীল কাজেই আমাদের প্রত্যেকেরই পরিবার এই পরিস্থিতিতে কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে বর্তমানে সরকার বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষদের নানারকমভাবে সাহায্য করে থাকলেও মৃৎশিল্পীদের ব্যাপারে সেইভাবে এখন কোনো উদ্যোগ নেননি।

আপনাদের পরবর্তী প্রজন্ম কি এই পেশায় আগ্রহী? যাঁরা এই পেশায় আসছেন তাঁরা কি সবাই নিজ আগ্রহে আসছেন নাকি জীবিকার তাগিদে?
আমাদের পরিবারের পরবর্তী প্রজন্মের মৃৎশিল্পের প্রতি সেরকম আগ্রহ বা ভালোবাসা দেখছি না। বরং তাঁরা অন্য পেশায় নিজেদের নিযুক্ত করতে আগ্রহী। আবার বেশ কিছু তরুণ আসছে যারা কাজ শিখে ভালোবেসে এই পেশায় নিজেকে জড়াচ্ছেন যেমন বিভিন্ন কলাশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিখে তারা কাজ করছে। আমি অন্তত এই মুহূর্তে পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে হতাশ হওয়ার মতো কিছু দেখছি না। বরং আমার মনে হয় তারা অনেকাংশে আমাদের থেকে বেশি বুদ্ধিমান বিশেষত ব্যাবসায়িক ক্ষেত্রে।

প্রতিমা নির্মাণের সময় কি সনাতনী রূপ নাকি সময়ের চাহিদা অনুযায়ী মূর্তিসৃজন— কোন ভাবনাকে আপনি প্রাধান্য দিয়ে থাকেন?
সনাতনী রূপ বলতে যেটা আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে তা হল একচালার মূর্তি। প্রতিমার মুখের আদল গোলাকৃতি। মুখের বর্ণ উজ্জ্বল হলুদ। টানা টানা চোখ ও সলমা জরির ডাকের সাজ। এক চালের মধ্যে সন্তান-সহ দেবী এটা কিন্তু যৌথ পরিবারের ইঙ্গিত বহন করে। কিন্তু কালের স্রোতে যৌথ পরিবারের ধারণা হারিয়ে গেছে। কিছু সর্বজনীন পূজা কমিটি তাদের পুজোয় সাবেকীয়ানা বজায় রাখলেও অধিকাংশ পুজোর উদ্যোক্তাদের চাহিদা প্রত্যেকটি মূর্তির পৃথক অবস্থান। আমরা সাধারণত চেষ্টা করি একই চালচিত্রের মাঝে আলাদাভাবে প্রতিটি মূর্তি সৃষ্টিতে। প্রয়োজনে পৃথক পৃথক চালচিত্রও করতে হয়। এছাড়াও আগে এক, তিন বা পাঁচ খন্তার মুকুটের যে-প্রচলন ছিল তাও এখন আর নেই পরিবর্তে মূর্তির গঠনবিন্যাস অনুযায়ী সামঞ্জস্য বজায় রেখে গয়না ও মুকুটের সৃষ্টি করতে হয়। সময়ের পরিবর্তন, রুচিবোধ ও চাহিদার কথা অবশ্যই মাথায় রেখে আমাদের কাজ করতে হয়। কিন্তু সবক্ষেত্রে আপোষ করা সম্ভব হয় না।

সারিবদ্ধ প্রতিমা

একটা প্রতিমা নির্মাণের পিছনে সৃজনশীলতা ও প্রাণের আবেগ মিশে থাকে। প্রতিটা সৃষ্টিই একজন শিল্পীর কাছে সন্তানসম। কিন্তু আপনারা এই সত্যিটাও জানেন মাত্র কয়েকদিন পরেই এই নির্মাণ জলে ভেসে যাবে। এই নির্মম সত্য একজন শিল্পী হিসেবে কীভাবে মেনে নেন?
প্রতিমার কাঠামো নির্মাণের দিন থেকেই প্রতিটা সৃষ্টির প্রতি আমাদের আবেগ, ভালোবাসা বা সৃজনশীলতা মিশে যেতে থাকে এবং দিনে দিনে প্রতিমা যখন পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যায় ভালোবাসা বা আকর্ষণ সেই কাজের প্রতি তত বেড়ে যায়। আমাদের সবথেকে শূন্য বা ব্যথা লাগে যখন দেখি যে, আমাদের এই স্টুডিয়ো থেকে একে একে সমস্ত মূর্তি নিয়ে উদ্যোক্তারা তাঁদের নির্দিষ্ট পুজোমণ্ডপের দিকে রওনা দিচ্ছেন। এই কাঠ কাটার শব্দ, খড়ের স্তূপ, মাটির ও রঙের গন্ধ, বিভিন্ন অঙ্গসজ্জার উপকরণ মিলিয়ে আমাদের স্টুডিয়োতে এই যে মাসাধিককাল ধরে কর্মব্যস্ততা তা ধীরে ধীরে মিলিয়ে আসে এবং পঞ্চমী থেকে স্টুডিয়োর ভিতরে একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ও শূন্যতা বিরাজ করে। তখন থেকে আমাদের ভিতরে একটা চাপা কষ্ট, বিয়োগব্যথা জন্ম নেয়। সেই ক্ষণ থেকেই আমাদের মনে বিজয়া দশমীর বিষাদ জন্ম নেয়। কাজেই দশমী তিথিতে প্রতিমা নিরঞ্জন আর নতুন করে কোনো ব্যথা আনে না।

Facebook Comments

পছন্দের বই