লেখক নয় , লেখাই মূলধন

লোকজ উৎসব

সঞ্চিতা টোটো

টোটোদের ‘অউচু’

ভারতের আদিম লুপ্তপ্রায় ও উপজাতি টোটো। সম্ভবত খুব কম সংখ্যক জনসংখ্যার জনগোষ্ঠী। এয়ার মাদারীহাট বীরপাড়া ব্লকের টোটোপাড়া গ্রামে বসবাস করে। অন্যান্য উপজাতিদের মতোই টোটোদেরও নিজস্ব উৎসব-পার্বণ আছে। নিজেদের মতো পালন করে। আদিম. অর্থাৎ, প্রকৃতিকে এরা বিশ্বাস করে। এদের উৎসবগুলো হয় প্রকৃতিকেন্দ্রিক।

টোটোদের সবচেয়ে বড়ো পার্বণ হল ‘অউচু’। অউচু একটি উৎসবের ছাতার মতো। এর মধ্যে অনেকগুলো উৎসব পালিত হয়। কয়েকদিন ধরে এই উৎসব চলতে থাকে। ঠিক দুর্গা পূজার মতো। এক-একদিন এক-এক ধরনের উৎসব হয়। অনুষ্ঠানের ধরনও আলাদা আলাদা। উৎসবগুলোতে সবাই মিলিত হয়—

যেমন—

১) দিনাং-দি-ওয়াও

২) গোরো-য়া,

৩) মান্‌কা।

তবে শুরুটা হয় লাঠি-জাং-ওয়া দিয়ে। লা-জাং-ওয়া হল কোনো কিছু পার্বণ শুরু করার আগে সবাইকে নিয়ে ‘দেমসা’ (Gathering place for any religion/social event Or issue related to society) জড়ো হয়ে পার্বণের দিনকাল নির্ধারণ করার দিন। এইদিন কাইজিগন্নু-সহ গ্রামের সব গোত্রের লোকেদের নিয়ে আলাপ-আলোচনা করে ‘অউচু’-র দিনগুলো ঠিক করা হয়। অনুষ্ঠানে লাচিজাং-ওয়াক কে হবে সেটা সেই দিন গোত্রের লোকেদের মাধ্যমে গ্রামবাসীদের জানানো হয়। এর পর শুরু হয় আসল অনুষ্ঠান।

গ্রামে বর্ষা আসার আগে থেকে সকলেই মাঠের কাজ প্রায় সেরে নেয়। যেমন— রান্নার খড়ি জোগাড় করা, সুপারি গাছ লাগানো, গাছে সার দেওয়া, ভুট্টা লাগানো, ফসল কাটা, মারুয়া বোনা ইত্যাদি।

বর্ষাকালে মনে হয় যেন আমাদের এই গ্রামে বৃষ্টি একটু বেশিই পড়ে। নদীনালা সবসময় ভরে থাকে। গ্রামের বাইরে বেরোনোর রাস্তা বন্ধ হয়ে যায় বললেই হয়। তখন টোটোদের দুর্দশার শেষ থাকে না।

আং রো

লাচিজাং-ওয়া-র সাত দিনের মধ্যেই দিনাং-দি-ওয়ার উৎসবের দিন ঠিক হয়। এইদিন সকালের দিকে নিজেরা বাড়ি থেকে দেমসার দিকে রওনা হয়। প্রত্যেকের হাতে থাকে কাস্তে। তারপর সকলের জমায়েত হলে পরিষ্কারের কাজগুলো শুরু হয়। আশেপাশের জঙ্গল পরিষ্কার করে। অনেকে নিজেদের বাড়ির আশেপাশেও পরিষ্কার করে। এই কাজ সমবেতভাবে হয়। টোটোরা দলবদ্ধভাবে এরকম অনেক কাজ করতে থাকে নিজেদের হিতের জন্য।

এই দিন থেকে সাত অথবা নয় দিন পর ঠিক হয় ‘গোরো-য়া’ পূজার দিন। ‘গোরো-য়া’ পূজা খুব ধুমধাম করে বয়। এতে একটা মোরগ লাগে। সেই মোরগ বলি দিয়ে পূজা করা হয়।

এই পূজাতে পুরোহিত গোত্র অনুযায়ী মন্ত্রপাঠ করতে থাকে। এবং একসঙ্গে প্রায় একগোত্রের অনেক বাড়ির পূজা করেন একের পর এক একইভাবে।

এইদিন ‘গোরো-য়া’ পূজার পাশাপাশি অন্য দেবতাদের নামেও পূজা হয়। যেমন— তাদেংতি (নদীর নাম), যইপতি (?) ইত্যাদি।

পুজো শেষ না হওয়া অবদি পুরোহিত খালি পেট থাকে। উপবাস করে। টোটোদের বিশ্বাস তাতে এই সমাজের ভালো হয়। এইসব পুজো করা হয় দেবতাদের খুশি করার উদ্দেশ্যে। যাতে সেই দেবতার রাগ না হয়। কোনো পরিবারের উপর সেই রাগ অভিশাপ হয়ে না পড়ে এই বিশ্বাসে।

মুরগি-মোরগ বলি দেওয়া হয় দেবতার চাহিদা অনুযায়ী। সেটা পুরোহিতই বলে দেয় কোন দেবতার জন্য কোন ধরনের মুরগী বলি দেওয়া হবে। সে বলে দেওয়ার পর সেই মতো মুরগি দেওয়া হয়। মুরগি বলি দিয়ে সেটিকে রীতিমতো পরিষ্কার করে কয়লার আগুনে পোড়ানো হয়। দেবতার জন্য এই খাবার তৈরি করে কলাপাতা করে উৎসর্গ করা হয়। উৎসর্গকৃত সেই মাংস আমাদের কাছে পুজোর প্রসাদের মতো। একে বলা হয় নাং-সা (Nag-Sa)। এর পর সেই মাংস প্রসাদ হিসেবে টোটোরা গ্রহণ করে।

টোটোর প্রতি বছরের কোনো না কোনো সময়ে পারিবারিক পুজো করে থাকে। এই পূজাকে ‘গোরো-য়া’ বলে। গোরো-য়া পুজো খুব জাঁকজমক করে উদ্‌যাপন হয়। ‘অউচু’ উৎসবেরই একটা বিশেষ দিনে এই পূজা করা হয়। ‘গোরো-য়া’-কে অনুসরণ করে ঠিক তিন দিনের মাথায় পালন করা হয় ‘মানকা’ (Manka) উৎসব।

গারোয়া

‘মানকা’ পূজা করা হয় বিশেষ করে মেয়ের বাপের বাড়ির লোকেদের জন্য। এই দিন বিবাহিত মেয়েরা, তার বাবা আর দাদা-ভাইদের জন্য ভাত দিয়ে আসবে। বেশ আনন্দের সঙ্গে অনুষ্ঠান হয়। রান্না করা ভাত আর মাংসের টুকরো কলাপাতায় মুড়ে বাপ ও ভাইয়ের বাড়ি দিয়ে আসে। মানকা প্রতি বাড়িতেই হয়। এতে সবাই যোগ দেয়।

ভাত আর মাংসের টুকরো কলাপাতায় মোড়াকে বলে অঙ-রো (Ong-ro)। ‘অঙ-রো’-র সংখ্যা বাবা ও ভাইয়ের বাড়ির পুরুষের সংখ্যার উপর নির্ভর করে। আসলে এই দিন মেয়েরা বাবা আর ভাইদের প্রতি ভালোবাসা ও সম্মান প্রদর্শন করে ‘অঙ-রো’ দিয়ে আসার মাধ্যমে।

মায়েরা ভোরবেলাতে উঠেই ঘরে আলো জ্বালিয়ে রান্না শুরু করে। সকাল হতেই ‘অঙ-রো’ দিয়ে আসার পার্বণ চালু হয়ে যায়। মায়েরা বিশেষত ঘরে বসে অঙ-রোলং-ওয়ার বা কলাপাতায় ভাত মোড়ার কাজটা করে। বাড়ির ছেলে-মেয়েরা সেগুলো নিয়ে মায়ের কথা মতো মামার বাড়িতে দিয়ে আসে কাপড়ে মুড়ে। টোটোদের কাছে এই দিনগুলো খুবই আনন্দের হয়।

তারা তাদের প্রতিদিনের কর্মরত জীবন থেকে একটু বিরতি পায় এবং আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে বাড়িতে একসঙ্গে সময় কাটায়। উপভোগ করে। মান্‌কার আগে অনেক আয়োজন করতে হয়। যেমন— বড়ো উনুন তৈরি করা, হাঁড়ি জোগাড় করা, কলাপাতা কেটে নিয়ে আসা, পরিষ্কার করে উনুনের উপর রাখাই ত্যাদি।

অবশেষে এই দিনটিতে সেই কলাপাতায় কিছু সেদ্ধভাত আর কিছু রান্না মাংসের টুকরো মুড়ে দিয়ে আসতে হয়। সকালের মধ্যেই এই দেওয়া নেওয়া সমাপ্ত হয়ে যায়। কাজ গুটিয়ে নিয়ে। দুপুরটা বিশ্রাম নেয়। সন্ধ্যায় আবার দেমসায় জড়ো হতে হয়।

কিছু ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা হয়। নির্দিষ্ট গোত্রের লোকেদের দিয়ে। তারপর গান-নাচের পর্ব শুরু হয়। এইভাবে আমাদের আউচু শেষ হয়ে যায় সে-বছরের মতো।

পরের বছরের জন্য আবার অপেক্ষা করতে থাকি…

সঞ্চিতা টোটো

সঞ্চিতা টোটো। ইংরেজি বিষয়ে স্নাতক। বেসরকারি সংস্থায় সহায়ককর্মীর কাজ করে।

পছন্দের বই