ধারাবাহিক।পর্ব৫
ফা-হিয়েন
ফা-হিয়েনের ভ্রমণ
ষষ্ঠদশ অধ্যায়
আবার চলা শুরু। এবার দক্ষিণ-পূর্ব দিক ধরে। আশি ইউ ইয়েন-এর কিছু কম পথ অতিক্রমকালে তীর্থযাত্রীদল অনেক মঠ, অনেক মন্দির পার করে এলেন। আর পার করে এলেন সে-সব মঠের দশ সহস্র সন্ন্যাসী-সঙ্গ। এই সমস্ত স্থান পেরিয়ে অবশেষে তাঁরা এসে পৌঁছোলেন মথুরা রাজ্যে। এ-স্থানে পৌঁছাতে অতিক্রম করতে হল যমুনা নদী আর তার দুই তীরের কুড়িটি মঠ আর মঠের তিন সহস্র সন্ন্যাসী। বৌদ্ধধর্ম ক্রমেই জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করল। সিন্ধু নদের পশ্চিম তীরবর্তী ভারতীয় উপমহাদেশের ছোটো বড়ো সমস্ত রাজ্যে সকল রাজার রয়েছে বৌদ্ধধর্মে দৃঢ় বিশ্বাস। সন্ন্যাসীদের প্রতি অর্ঘ্য নিবেদনকালে রাজাগণ প্রত্যেকেই খুলে রাখেন রাজমুকুট। এর পর রাজপরিবারের সকল সদস্য আর মন্ত্রীরা নিজেদের হাতে সন্ন্যাসীদের খাইয়ে দেন। আহার পর্ব সমাধা হলে সন্ন্যাসীদের মূল আসনের বিপরীতে মাটিতেই বেছানো হয় কার্পেট আর সেখানেই সকলে উপবেশিত হন। সন্ন্যাসীদের উপস্থিতিতে কেউই বসার জন্য বিশেষ আসন ব্যবহার করেন না। বুদ্ধের জীবদ্দশাতেই এইসকল রাজাদের মধ্যে পূজার আচরণ বিধির চল শুরু হয়। এর দক্ষিণে আছে আর এক দেশ, নাম তার মধ্য রাজ্য। এখানে আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। বরফবিহীন এ-রাজ্যের মানুষ সচ্ছল, সুখী। নিষেধহীন জীবন। যারা রাজার জমি চাষ করে তারা যথেষ্ট পারিশ্রমিক পায়। এ-রাজ্য ছেড়ে কেউ চলে যেতে চাইলে যেতে পারে, ইচ্ছে হলে থাকতেও পারে। কোনো বিধিনিষেধ নেই। এ-রাজার শাসনব্যবস্থা শোষণহীন। অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী কেবলমাত্র অপরাধীর জরিমানার বিধান রয়েছে। এমনকী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বারংবার বিদ্রোহের শাস্তি, ডান হাত কেটে নেওয়া। রাজার দেহরক্ষীদের জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট বেতন। রাজ্যজুড়ে কেউ প্রাণ হত্যা করে না। পেঁয়াজ, রসুন ভক্ষণ বা মদ্যপান কোনোটাই করে না এ-রাজ্যের মানুষ।
এ-সকল আলোর মাঝেও রয়েছে একটি অন্ধকার। চণ্ডাল জাতির মানুষদের এখানে অচ্ছুৎ করে রাখা হয়। জনসমাজ থেকে এরা দূরে বাস করে। মূল নগরে বা বাজারে এলে এরা নিজেদেরকে আলাদা করে চিহ্নিত করতে একটি কাঠের টুকরো দিয়ে নিজেদেরই শরীরে আঘাত করতে থাকে। এতে সবাই চিনে নেয় তাদের আর ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে দূরে দূরে থাকে। এ-দেশে শূকর বা পক্ষী জাতীয় প্রাণী পালন করে না কেউ। গবাদিপশুর বিষয়ে কারো কোনো আগ্রহ নেই। বাজারে না আছে কোনো মাংসের বিপণি, না কোনো ভাটিখানা। কেনাবেচা চলে কড়ির বিনিময়ে। কেবলমাত্র চণ্ডাল জাতির মানুষরাই শিকার করে এবং মাংস কেনাবেচা করে।
বুদ্ধের নির্বাণলাভের সময় থেকেই এইসকল দেশগুলির রাজা, বয়োজ্যেষ্ঠগণ, এবং মধ্যবিত্ত ভদ্রজনেরা নিজ নিজ স্থানে বিগ্রহ স্থাপনা করেন। উদ্দেশ্য ছিল সন্ন্যাসীগণের প্রতি অর্ঘ্য নিবেদন, গৃহ, ভূমি, বাগিচা ইত্যাদি দান করা। আর দেওয়া হত কর্মক্ষম ব্যক্তি ও বৃষ, চাষাবাদ করার জন্যে। এসবের স্বত্বাধিকারের দলিল লেখা হত এবং রাজাগণ পুরুষানুক্রমে তাঁর পরবর্তী রাজাকে এই দলিল সঁপে যেতেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম একইভাবে থেকে যেত এগুলি। এই দলিল ধ্বংস করার কথা ভাবে এমন দুঃসাহস হত না কারো। সন্ন্যাসীগণ যেখানেই যাক না কেন বাসগৃহ, শয্যা সামগ্রী, আহার্য, পোশাক কোনো কিছুরই অভাব হত না। তাঁরা ধর্মীয় দান ধ্যানের বদান্যতায়, অথবা ধ্যান-মগ্ন হয়ে এসবের দখল অনায়াসে পেয়ে যেতেন। কোনো আগন্তুক সন্ন্যাসী সহসা এসে উপস্থিত হলে, পুরাতন আবাসিক সন্ন্যাসীগণ তার সঙ্গে এসে সাক্ষাৎ করতেন। ভিতর ঘরে বহন করে নিয়ে যেতেন তাঁর পোশাকআশাক আর ভিক্ষাপাত্র। পা ধোয়ার জল এবং প্রলেপ দেওয়ার জন্য তেল এনে দেওয়া হত এরপর। আর দেওয়া হত সন্ন্যাসীদের জন্য নির্ধারিত পরিমিত আহার্যের চেয়ে কিছু বেশি আহার-পানীয়। অচিরেই অতিথি সন্ন্যাসী যখন বিশ্রাম কক্ষে আসতেন, তাঁরা তাঁর বয়স আর সন্ন্যাস লাভের ক্ষণটি জানতে চান। এরপর কর্তৃপক্ষের নির্দেশমতো সকল শয্যা দ্রব্যাদি-সহ তাঁকে একটি কক্ষ দেওয়া হয়।
এই সন্ন্যাসীদের বাসস্থানগুলির নিকটেই সারিপুত্র, মোগালান আর আনন্দের উদ্দেশে প্যাগোডা স্থাপন করা হয়। অভি ধর্ম, পঞ্চ শীল আর বৌদ্ধ সূত্রাবলীর সম্মানে গড়ে তোলা হত মিনার। মাসাধিক কাল একই স্থানে বসত করলে, ধর্মভুক্ত সকল পরিবারগুলি মিলে ঐ সন্নাসীর স্বীকৃতি দান ও পূজা নিবেদনের আয়োজন করতেন। তাঁরা ভোজনের বন্দোবস্ত করতেন আর সকল সন্ন্যাসীগণ সমবেত হয়ে বুদ্ধের শৃঙখলাগুলি ব্যাখ্যা করতেন। সব সমাধা হলে তাঁরা সারিপুত্রের প্যাগোডায় এসে বিচিত্র সব সুগন্ধি ধূপ আর ফুলের অর্ঘ্য নিবেদন করতেন। নিশিভোর জ্বালিয়ে রাখা হত দ্বীপ। এতে সকলের পূজায় যোগদানের পথ প্রশস্ত হয়। সারিপুত্র আদতে ছিলেন এক ব্রাহ্মণ সন্তান। একদা বুদ্ধের সাক্ষাৎ পেয়ে সন্ন্যাস গ্রহণ করতে চেয়ে কাতর মিনতি জানান। মোগালান আর কাশ্যপ, তাঁরাও একইভাবে বুদ্ধের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। অধিকাংশ মহিলা ভিক্ষুগণ আনন্দের প্যাগোডাতে গিয়ে নিজেদের পূজা নিবেদন করতেন, কারণ, আনন্দই বুদ্ধের কাছে প্রার্থনা জানিয়ে, মহিলাদের সন্ন্যাস গ্রহণের অনুমতি
আদায় করেন। আর নবীন ব্রতী যাঁরা ছিলেন, তাঁরা মূলত আরহতের পূজা করতেন। অভি ধর্মের গুরু যাঁরা ছিলেন তাঁরা অভিধর্মের পূজা করতেন। শৃঙ্খলার গুরু পূজা করতেন শৃঙ্খলাকে। এই পূজা বছরে একবারই করা হত। প্রত্যেকের জন্য নিজস্ব একটি দিন ধার্য্য করা থাকত।
মহাযান মতে প্রজ্ঞাপারমিতা, মঞ্জুশ্রী, অবলোকিতেশ্বরের পূজা করা হত। সন্ন্যাসীরা যখন ফসল ঘরে তুলত, অগ্রজ, মধ্যবিত্ত, ব্রাহ্মণ, সকলেই বিভিন্ন উপচার, যেমন বস্ত্র ইত্যাদি সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন। শমনগণ সার দিয়ে দাঁড়িয়ে একে-অন্যের হাতে উপহারগুলি তুলে দিতেন। বুদ্ধের নির্বাণ লাভের সময় থেকেই, পবিত্র ভ্রাতৃত্ব বোধের প্রতি এই মহান শিষ্টাচারগুলি চলতে থাকে অনিবার। সিন তো নদীর অগভীর অংশ থেকে দক্ষিণ সাগর দিয়ে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ হাজার লি পথ অতিক্রম করলে পরে এসে পড়বে দক্ষিণ ভারতের সীমানায়। এ-দেশ একেবারে সমতল। পর্বত গাত্র চিরে বেরিয়ে আসা সুগভীর ধারা স্রোত নেই এখানে, আছে কেবল ক্ষুদ্রকায় কিছু নদী।
অনুবাদক: সঙ্গীতা দাস
শৈশব ও বেড়ে ওঠা উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার চাঁদপাড়া। অত এক দশকের বেশি সময় ধরে গ্রামের স্কুলে ইংরেজি ভাষার শিক্ষকতার পেশায় নিযুক্ত। অন্তর্মুখী জীবন নিয়ে একা একা লোফালুফি খেলেন। অনুবাদ, লেখালেখি, পাঠ এ সবই নীরব কুয়াশায় আচ্ছন্ন। এই অনুবাদ, এ তাঁরই জীবনের অংশ, তাই বাঙ্ময় হয়ে ওঠে।

ফা-হিয়েন
ফা-হিয়েন (৩৩৭-৪২২ খ্রিস্টাব্দ) একজন চীনা বৌদ্ধ সাধু এবং অনুবাদক ছিলেন। তিনি ৩৯৯-৪১২ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে পদব্রজে চীন থেকে ভারত পর্যন্ত এসেছিলেন এবং বৌদ্ধ লিপি সংগ্রহ করার জন্য মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ পীঠস্থানগুলো ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি এইসব ভ্রমণ বৃত্তান্ত ‘এ রেকর্ড অব বুদ্ধিস্ট কিংডমস্’ বইতে লিখেছেন।