লেখক নয় , লেখাই মূলধন

লোকজ উৎসব

সংগীতা এম. সাংমা

 

ওয়ানগালা একটি উৎসব

পাহাড়ের ঢালে ঝুম চাষ করে জীবনযাপন করা গারো জাতি বা সমতলের গারো, যারা কাঁদা-মাটিতে চাষ করে— তাদের উৎসবগুলো অনুষ্ঠিত হয় ফসলকে কেন্দ্র করে। ফসল রোপণ থেকে ঘরে তোলা অবধি বিভিন্ন উৎসব পালন করে গারো জনজাতি।

তার মধ্যে ‘ওয়ানগালা’ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। এটি বর্ষার শেষে এবং শীত শুরু হওয়ার মাঝামাঝি সময়, অর্থাৎ, সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে অক্টোবর মাসের শুরুতে অনুষ্ঠিত হয়। ‘ওয়ান’ শব্দের অর্থ হল নৈবেদ্য বা দেব-দেবীর উদ্দেশে উৎসর্গ করার সামগ্রী এবং ‘গালা শব্দটির অর্থ হল উৎসর্গ করা।

‘সাংসারিক’ ধর্মে বিশ্বাসী এই জাতি দেব-দেবীর স্মরণে ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করবার উদ্দেশ্যেই এই উৎসব ধুমধাম করে পালন করে। গারোরা এই প্রাচীন অনুষ্ঠানের ঐতিহ্য রক্ষা এবং নতুন প্রজন্মকে সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করাবার জন্য একদিনের জন্য হলেও ওয়ানগালা পালন করে থাকে। এই উৎসবের পেছনে রয়েছে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি এবং লোকশ্রুতি।

মনে করা হয় প্রাচীনকালে মানুষ জীবন-ধারণের জন্য আলু, বনকচু, বিভিন্ন ধরনের মূল ইত্যাদিকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করত। ধান, ভুট্টা, গম ও অন্যান্য শস্য তখন মানুষের কাছে অজানা ছিল। সেই যুগে পৃথিবীতে গিসিল বল গিত্তল রিকগে সামল জাফাং মনল (Gisil Bol Gitol Rikge Samol Japhang Monol) নামে এক বিশালাকায় গাছ ছিল। সেই গাছের চব্বিশটি শাখা ছিল। বারোটি শাখা পূর্ব দিকে এবং বাকি বারোটি ছিল পশ্চিম দিকে। প্রতিটি শাখা এক-একধরনের ফলে পরিপূর্ণ ছিল। এক শাখায় ছিল সর্বপ্রকারের মুল্যবান খনিজ যেমন- হিরে, সোনা, রুপো। অন্য শাখায় ছিল বিভিন্ন শস্যাদি যেমন– ধান, তুলো, রেশম-সহ আরও অনেক কিছু। সেই বৃক্ষের অন্য আর একটি শাখায় ছিল আশ্চর্যরকমের বিভিন্ন প্রজাতি আর রঙের ধান— নীল, হলুদ, সবুজ, বেগুনি ইত্যাদি।

আ-জারেকছি জাপা নামের এক জায়গায় এইসব রঙিন ধানের একটি বাগান ছিল যার নাম Gliting Dinge Rane Dingje.

অবাক করার বিষয় হল এই শাখা থেকে কেউ ধান পেড়ে নিতে পারত না। একদিন বাতাসের দেবতা জারু মে-আ জাবাল ফান্তে অখখুয়াংসি জাফাত চংসি (Jaru Me.a Jabal Pante Okkhuangsi Japat-Chongsi) এবং ঝড় ও শিলার দেবতা মিখখা তেম্মা স্তিল রংপা (Mikka Temma Still Rongma) একসঙ্গে শক্তিশালী পায়ের ঝাঁকিতে সেই আশ্চর্য ধানের কিছু বীজ মাটিতে পড়ে যায়। কিন্তু গারোরা ব্যাপারটি খেয়াল করেনি। এদিকে নিউ নিকিসের দেবী, নামছিল আ-নিং নকসিক চিনিং নমিন্দিল আ-নিং ডিপারি চিনিং ডিপারা (Ah-ning Noksik Chining Nomindil Ah-ning Chining Dipera) মাটি থেকে সেই ধানের বীজ তুলে এ নিজের বাগানে রোপণ করে। পরবর্তীকালে মিসি সালজং তার কাছ থেকে বীজ ধার নিয়ে ধান চাষ করে।

ওয়ানগালা নৃত্যের একটি দৃশ্য, ছবি : গুগুল

একদিন মিসি সালজং হাটে যাওয়ার পথে দেখা হয় রাসং (আ-নি-আপিল ফাচিনি গালাফা) নামে এক লোকের সঙ্গে, তার হাতে ছিল একখানি নিড়ানি যা দিয়ে সে মাটি খুঁড়ে বিভিন্ন আলু ও বন্যমূল সংগ্রহ করত। রাসং-কে বেঁচে থাকার জন্য নিত্য পরিশ্রম করতে হত। তার পরনে ছিল গাছের বল্কল। পোশাক ছিল খুবই জীর্ণ ও ধুলো মাটি দিয়ে ঢাকা। রাসং তাই মিসি সালজংকে দেখে লজ্জা পেয়ে পাশের একটা পাথরের পেছনে লুকিয়ে পরে। এরপর মিসি সালজং তাকে বেরিয়ে আসতে বলে। তার সাথে বন্ধুত্ব করে। তারা দুজনে ‘দংক্রেং’ নামক গাছের নিচে দুপুরের খাবার খেতে বসে।

মিসি সালজং ভাত ও মাছ খেত কিন্তু রাসং এসব খাবার সম্পর্কে জানত না। সে শুধু বনের ফল-মূল, আলু এসবই খেত। তাকে দেখে মিসি সালজং খুব দুঃখ পেল এবং তাকে জিজ্ঞেস করল সে ঝুম চাষ করতে জানে কিনা। রাসং বলল বন পুড়িয়ে ঝুম চাষ জানে। ধানচাষ সম্পর্কে জানে না। মিসি সালজং দয়ার বশে বলে যে, তিনি তার জন্য ধানের বীজ পাঠাবে। রোপণ করে ফসল যখন পাবে তখন যেন প্রথম ফসলের কিছু অংশ ভোগ করার পূর্বে তার নামে উৎসর্গ করে। এমনটা যেন প্রতি বছর করা হয়।

মিসি সালজং বাড়ি ফিরে প্রতিশ্রুতিমতো তার চাকর নক খলজসিকসককে দিয়ে ধানের বীজ রাসং-এর জন্য পাঠাল। কিন্তু সেই চাকর হিংসা করে আধা শুকনো বীজ রাসং-কে এনে দিল। এদিকে রাসং খুব উৎসাহ ও আগ্রহের সঙ্গে বীজ রোপণ করে দেখা শুনা শুরু করল কিন্তু কিছুতেই বীজ অঙ্কুরিত হল না। রাসং রেগে গিয়ে মিসি সালজং-এর স্বর্গীয় বার্তাবাহী দূত দিমরে, চুন, বাং শেও বাং দিংকে নিজের কাছে বন্দি করে রাখল। এর পর মিসি সালজং তার দূতদের ছেড়ে দেবার জন্য অনুরোধ করে এবং তার বদলে উত্তম বীজ দেবার প্রতিজ্ঞা করে।

এরপর রাসং আবার আগ্রহের সঙ্গে চাষ করা শুরু করে এবং দক্ষিণা বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে প্রথম বৃষ্টিতে বীজ থেকে চারা গজিয়ে উঠল। এভাবে ধানগাছ যখন পরিপুষ্ট হয়ে উঠল, কিন্তু ধানকাটার সময় Mattengke Mesewal-এর এক শয়তান চাকর ধান চুরি করে কেটে মিসি সালজং-এর কাছে মিথ্যে অভিযোগ জানায়, যে, রাসং ফসল দেবতার জন্য কিছু তো রাখেইনি বরং লুকিয়ে ফসল তুলতে শুরু করেছে। মিসি সালজং এতে ভীষণ রেগে রাসং-সহ তার পুত্র এবং বার্তাবাহকদের বন্দি করল।

রাসং অনুনয় করে সব জানালো কীভাবে তাদের সম্পর্কে মিথ্যে অভিযোগ করা হয়েছে এবং মুক্তি প্রার্থনা করলে। মিসি সালজংকে মুক্তি দিয়ে রাসং-এর সঙ্গে নতুনভাবে সম্পর্ক করল।

বাড়ি ফিরে রাসং ফসল তুলে কিছু অংশ ধূপ ও মদ সহকারে নৈবেদ্য সাজিয়ে মিসি সালজং-এর উদ্দেশে উৎসর্গ করল। এভাবেই রাসং তার আচিক আহ সংয়ের ভূমিতে জন্মানো ফসল উৎসর্গিত করে মিসি সালজংকে সন্তুষ্ট করল। মিসিসালজং আশীর্বাদ করে বলল—

“এইলোক এবং তার বংশধরদের ভূমিতে বেড়ে উঠুক এই শস্য, তার বংশ যেন চির আশীর্বাদ পেয়ে থাকে। প্রতিবছর পৃথিবীতে আমার আগমনের সময় হোক এ নৈবেদ্য উৎসর্গ”।

বর্তমান সময়ে গারোদের বেশিরভাগ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী হওয়ার দরুন নতুন ফসল যিশু খ্রিস্টের উদ্দেশে উৎসর্গ করে। বাইবেল অনুযায়ী, ঈশ্বর ভূমিজাত সবরকম শস্যের দশমাংশ ও অগ্রিমাংশ তাকে নিবেদন করবার কথা বলেছে। কারণ, তিনিই তাদের ফসল উৎপাদনের সামর্থ্য দেয়। তাই বাইবেল এবং পুরোনো ধর্মদুটোকে মিলিয়ে গারো সম্প্রদায় এই উৎসবটি পালন করে।

বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে পরিচিত এই উৎসব। যেমন— ওয়ানমা, রংচয়া, দ্রুয়া, ঘুরে ওয়াতা ইত্যাদি।

কৃষি নির্ভর গারো জাতি বারোমাসই কৃষিতে নিযুক্ত থাকে। শীত বিদায় নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা চাষের স্থান নির্বাচন করে। তখন জুমাং সিআ অনুষ্ঠান পালিত হয়। এরপরে সর্ব প্রকার ফসলের দেবী কিরি রক্ষিমকে মর্ত্যে আসবার জন্য আহ্বান জানানো হয় আসিরকআ অথবা গিচ্ছিপং রকআ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। তৃতীয় অনুষ্ঠানটি হচ্ছে আগালমাকা যার মাধ্যমে গারোরা নকমা কর্তৃক ভাগে পাওয়া চাষের জমির ঝোপঝাড় আগাছা পরিষ্কার করে। চতুর্থ পর্যায়ে বেড়ে ওঠা সবুজ শস্য খেতে পালন করা হয় মি আমুয়া বা মেজাক সিমআ। এর পরে পালিত হয় রংচুগালা, এই অনুষ্ঠানে শুধুমাত্র দেবী কিরি রক্ষিমকেই নয় মিসি সালজং-সহ অন্যান্য দেব-দেবীদেরকেও সন্মান জানায়। ষষ্ঠতম অনুষ্ঠান হল জামেগাপা বা মেদংরাউনা যা ওয়ানগালার প্রাক্কালে পালন করা হয়।

বছরের শেষ এবং প্রধান উৎসব হবার কারণে ওয়ানগালা প্রতি বছর সমষ্টিগতভাবে পালন করা হয়। গ্রামের সকলের খাদ্য শস্য ঘরে তোলা হয়ে গেলে নকমা (গ্রাম প্রধান) সবাইকে ডেকে ওয়ানগালার দিন তারিখ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে। তারিখ ঘোষণার পর থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। হাট-বাজার করা থেকে শুরু করে ঘর বাড়ি গোছানো এবং মেরামত করা, অন্যান্য গ্রাম থেকে নিমন্ত্রিত অতিথিদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা— সবই জোরকদমে শুরু হয়ে যায়। যুবক-যুবতীরারা ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্রগুলো বাজিয়ে নাচ গানের মহরা দেয়। এই উৎসব মূলত তিনটে ধাপে সম্পন্ন হয়—

১. রুগালা— এই অনুষ্ঠানটি সাধারণত ১৫ই কার্তিকে পালন করা হয়। অর্থাৎ, ধান কাটবার পরে। এই দিন ভোরবেলায় নকমা ‘আসিরাক্কা’ বা জমি চাষের আগে পূজা করে মন্দ শক্তি দূর করবার স্থানে গিয়ে সালজং দেবতার পূজা করে। দুপুরে প্রথমেই ‘নক-গাত্তা’ বা ‘ঘরে তোলা’ অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে ধান বা ফসলাদি ঘরে তোলা হয়। এরপর গ্রামবাসী সকলে নকমা বা সমাজ/গ্রাম প্রধানের বাড়িতে সমবেত হয়। নকমা প্রথমে ভাণ্ডার দেবী রংদিক মিৎদে এবং গৃহ দেবতা নকনি মিৎদের পূজা করে এবং মিসি সালজং দেবতার উদ্দেশে নৈবেদ্য উৎসর্গ করে। এর পর একে একে গ্রামের সবার বাড়িতে পর্যায়ক্রমে এই অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।

২. সাসাৎ সওয়া— এই অনুষ্ঠানটি করবার একটি উদ্দেশ্য হল সালজং দেবতার প্রতি ধূপ প্রজ্বলন করা। এই দিন রাজকীয় বেশে নকমা এবং খামালেরা (পুরোহিত) প্রত্যেক বাড়ির উঠোনে নৃত্য-গীতরত লোকেদের মাঝে কৃত্রিম ঘোড়ায় চড়ে নাচ করে। এটিকে ‘গুরে রদিলা’ বলা হয়। পুরোনো বিশ্বাস ‘সাসাৎ সওয়া’ বা ধূপ জ্বালানোর মাধ্যমে পরবর্তী বছর কেমন কাটবে সেটা গণনা করা হয়ে থাকে। যেমন— যখন ধূপ জালানো হয় তখন যদি ধপ করে আগুন জ্বলে ওঠে তাহলে ধরে নেওয়া হয় যে, এ-বছর ভালো কাটবে না। মনে করা হয় সামনে মহাবিপদ। ধূপ জ্বালানোর সময় যদি আগুন না জ্বলে শুধু ধোঁয়া নির্গত হয় তখন ধরে নেওয়া হয় যে, আগামী বাছর খুব ভালো কাটবে।

৩. দামা-গগাতা বা জল ওয়াতা বা রুস্রাতা— এটি অনুষ্ঠানের শেষ দিন এবং দেবতাদের বিদায় দেওয়া বা শেষবারের মতো নৈবেদ্য উৎসর্গ করার দিন। এই দিন সবার বাড়িতে সালজং দেবতা এবং রক্ষিম দেবীর উদ্দেশে মদিরা এবং ধূপ উৎসর্গ করে প্রার্থনা এবং তাঁদের বিদায় জানানো হয়। সন্ধ্যের আগেই যুবকেরা বাদ্যযন্ত্রগুলো নিয়ে নকমার বাড়িতে ফিরে আসে এবং নকমা ওয়ানগালা অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করে। নকমার ঘর থেকেই অনুষ্ঠানের সূচনা এবং সমাপ্তি দুটোই সম্পন্ন হয়।

গারোরা এই ওয়ানগালা আরও দুটো উদ্দেশ্যে পালন করে থাকে। প্রথমত, উৎপাদিত ফসল বিভিন্ন কীটপতঙ্গ, পঙ্গপাল ইত্যাদির আক্রমণ থেকে রক্ষা পেত। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন ব্যাধি, মহামারি, রোগ-জীবাণুর হাত থেকে মুক্তি পেতে। গারোরা বিশ্বাস করে এই উৎসবকালে আসংততা নামে এক অদৃশ্য শক্তি উপস্থিত থাকে। সে সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করে থাকে।

ওয়ানগালার নিয়ম রীতি, সমবেত ভোজন, নৃত্য-গীত এসব মনের আনন্দের বহিঃপ্রকাশ এবং বাহ্যিক বিষয়। দেবদেবীদের ভুলে না যাওয়া, তাদের স্মরণ করা, তাদের আশীর্বাদের প্রতিদানে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন। তাদের মান্য করে জীবনযাপন করাই ওয়ানগালার নিগূঢ়তথ্য ও আসল বিষয়।

সহকারী লেখক: গৌতম সরকার

Facebook Comments

পছন্দের বই