লেখক নয় , লেখাই মূলধন

ধারাবাহিক।পর্ব৫

শতদল মিত্র

মস্তানের বউ

নার্সিং হোমে কৃষ্ণ ঢুকতেই তার হাতে সদ্যজাতকে তুলে দিয়ে, যেমন দস্তুর নার্স বলেছিল— দাদা, মিষ্টি খাওয়াতে হবে কিন্তু। কৃষ্ণ লজ্জা মাখানো হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে দু-হাত বাড়িয়ে তার প্রথম সন্তানকে কোলে তুলে নিয়েছিল। দেখতে দেখতে সে-হাসি যেন গর্বিত পিতার হাসিতে ঝলমলিয়ে উঠেছিল, কেন-না সদ্যজাত প্রাণটি সে-আশ্রয়ে বন্ধ চোখেই ঠোঁটে হাসি এঁকেছিল, অন্তত অবাক রূপার চোখে তেমনতরই প্রতিভাত হয়েছিল তা। নার্সের হাতে সন্তানকে ফিরিয়ে দিয়ে পকেট থেকে এক খাবলা একশো টাকার নোট বার করে পাশে টতস্থ আয়ার হাতে গুঁজে দিয়েছিল। নার্সটি আবারও ফুটে উঠেছিল— দাদার দিল্‌ই আলাদা! কম কথার মানুষ কৃষ্ণ হাতের ইশারা করেছিল, সে-ইঙ্গিতে নার্স ও আয়া তত্ক্ষণাৎ কেবিনের বাইরে বেরিয়ে গেলে কৃষ্ণ রূপার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল— কী, আমারই জিত হল তো! পরক্ষণেই শিশুটির বদ্ধমুঠিতে হাত রেখে স্বগতোক্তি করেছিল— আমার উদিতা, আমার দি-তা!

হ্যাঁ, লোকটা পাগলের মতো মেয়ে চেয়েছিল প্রতিটা আদরের মুহূর্তে। ভাবে রূপা। আর, আর যেদিন ছোট্ট উদিতা দা-দা, ডা-ডা বলতে বলতে বা-বা বলে প্রথম যেদিন বুলি এঁকেছিল তার পাতলা নরম ঠোঁটে, লোকটা পাগল হয়ে উঠেছিল যেন। মেয়েকে নিয়ে এমন লোফালুফি করতে শুরু করে যে, রূপা ভয় পেয়ে ধমকেই উঠেছিল— থামো, পড়ে গেলে…! দেখছ না কেমন ভয়ে সিঁটিয়ে রয়েছে!

— হাঃ হাঃ! আমার মেয়ে কিনা ভয় পাবে! কৃষ্ণের মেয়ে ভয় পাবে!

প্রথম থেকেই অল্প আওয়াজে বা জোরে দোলালেও ছোট্ট প্রাণটি ভয়ে সিঁটিয়ে যেত। তখন তো কিছু বুঝতে পারেনি রূপা বা কৃষ্ণ কেউই…। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে রূপা, সে-টানেই যেন চেতনে ফেরে রূপা। খেয়াল করে কখন যেন সন্ধ্যের আঁধার গুঁড়ি মেরে ক্রমে গ্রাস করার তালে আছে তার দোকান ঘরটিকে। সে উঠে আলো জ্বালে সুইচ টিপে। কালিপরা টিউব লাইটটা বার কয়েক দপ দপ করে জ্বলে উঠলে, ম্লান আলো তবুও ঝলকে ওঠে কৃষ্ণের ফোটোর কাচে। সে-ঝলকানি তাকে ডাকলে, রূপা উঠে গিয়ে ফোটোটা আঁচল দিয়ে আলতো মুছে দেয়, মায়ামাখা হাতে। সে-মায়ায় কৃষ্ণের হাসি ফুটে উঠলে সে তার মুখের ছায়া ভেসে উঠতে দেখে যেন! নাঃ, সামনের অনেকগুলো চুলেই পাক ধরেছে যেন। পরক্ষণেই তার নিজের ছায়াকে মুছে সেখানে ফুটে ওঠে অন্য নবীনার মুখ— সুদীপ্তা, ছোটো মেয়ে তার।

— একটু কলপ তো করতে পার, নাকি? কী এমন বয়স হয়েছে তোমার? একটু থামে, তারপর আবার বলে ওঠে সুদীপ্তা, যা ইদানীংকার বাঁধা লব্জ তার— আমি তো আছি।

সবসময় শাসনে রাখে ছোটো মেয়েটি তাকে। পুরো বাপের স্বভাব পেয়েছে সে, অল্প কথা, কাটা কাটা, ওজনদার—তেমনই লম্বা দোহারা চেহারা। ছোটোমেয়েই তার ভরসা, আবার ভয়ও।

রূপা ফিরে নিজের জায়গায় আসতেই সামনের রাস্তা চোখ টেনে নেয় তার, যে-চোখে ভেসে ওঠে গোরার মুখ, আড়চোখে তার দোকানের দিকে একবার তাকিয়েই মুখ ঘুরিয়ে হনহানিয়ে হেঁটে যায় সে। রূপার মুখে চিলতে হাসি ফুটে ওঠে।

— কাপুরুষ! কোন লজ্জায়ই-বা সে তার চোখে চোখ রাখে ?

ভাবে রূপা। আর অমনি দড়াম করে আছড়ে পড়ে কৃষ্ণের চেলা গোরার সে দিনের আধখানা বাক্য—বৌদি, দা-দা… । যা সে দিনের আঁধারকে চিরে আরো ঘনবদ্ধ করে তুলেছিল, যা আজকের ঘনায়মান অন্ধকারকে টলিয়ে ভাসিয়ে তুলেছিল আলো ঝলমল সে-আওয়াজ— দশ কা বিশ… দশ কা বিশ…!

কৃষ্ণর পর, বাবলু, তারপর গোরা… নাঃ, রূপশ্রী হলের দখলদারিত্ব ধরে রাখতে পারেনি সে। নির্লজ্জ, কাপুরুষ! যদিও কালের নিয়ম, ভিডিয়োর যুগ, হল্‌ চলছে না তেমন আর তবুও!

রূপা বাইরে এসে পাশের হল চত্বরের কালো অন্ধকারে চোখ চাড়ে, একবুক দীর্ঘশ্বাসকে চেপে ধরে।

— বৌদি, তিনটে চা।

সে-ডাকে রূপা দোকানে ফেরে, বর্তমানেও।

হ্যাঁ, কৃষ্ণের পর বাবলু, সে-ই কিছুদিন কৃষ্ণের তাজ ধরে রেখেছিল, দাপটে— তবে ওই কিছুদিনই। বাবলুর পর গোরা… গলির ছিঁচকে গুণ্ডা শুধুই, পাড়ার লোকের ওপর যত জুলুম! প্রদীপ রায়ের পা চাটা ভেড়ুয়া… ভোটের জন্য অমন কত কুত্তা, ভেড়ুয়া প্রদীপ রায় পোষে! কৃষ্ণের নাম ডুবিয়ে ছেড়েছে একেবারে! রোজ কৃষ্ণের গলিতে সন্ধ্যে লাগলেই মদ গেলা কতকগুলো চামচা জুটিয়ে আর মেয়ে দেখলেই টিটকারি দেওয়া। বিশ্বাসঘাতক, গদ্দার! অথচ সাবানকলে ওর চাকরি কৃষ্ণই করে দেয়! লোকে ঠিকই বলে— চুহা এক নম্বরের! কোর্টে গিয়ে বেমালুম বলে কিনা, ও কিছুই দেখেনি! বেশ করেছে আখতারের ছেলেরা কপাল ফাটিয়ে দিয়েছে ওর! সে-দাগ আজও মোছেনি। তবুও দাগীবাজ হয়েও ছুটকো গুণ্ডামি গেল না! সবই ওই কালো লোকটার আশকারায়। ভোটে জেতে না, তবুও তাবড় নেতা নাকি প্রদীপ রায়, এলাকা ছাড়িয়ে গোটা কলকাতার জেলা কমিটির নেতা নাকি লোকটা! রাগে গনগনে হয়ে ওঠে রূপার মুখটা, গ্যাসের আগুনেরও উসকানি হয়তো কিছুটা, তবুও।

ভিডিয়োর যুগ এলেও তখনও সিনেমা হলের রমরমা ফিকে হয়নি। তবে রূপশ্রীতে আর বাংলা ছবি লাগে না। পরি হলে তো কবেই বাংলা বই দেখানো বন্ধ। পি-সন, কমল, খাতুনমহলে তো, যেহেতু খাস উর্দু এলাকার তাই বরাবরই হিন্দি ছবি। রূপশ্রীই একমাত্র বাঙালি হিন্দু পাড়ার হল। হিন্দি সিনেমার টানেই হোক, আর কৃষ্ণের পর তেমন দাপুটে নেতা না থাকার কারণেই হোক, বা পার্টির প্রশ্রয়েই হোক উর্দুভাষী মুসলমানদের ভিড় বাড়তে থাকে ক্রমে, এ-তল্লাটে আখতারের ক্রমশ দখলদারি জারির শুরুয়াতই যেন তা। যা বাঙালি দর্শকদের হল থেকে দূরেই রাখে তখন। তেমনই এক সাঁঝকালে হলের তত্কালীন বকলমা মালিক গোরা কিছু উর্দুভাষীকে সবক শেখাতেই, যেহেতু তারা হলের গায়ে খৈনির পিক ফেলেছিল, যেন-বা বহুকাল আগের রিপিট শো— তবে এবার উলটপুরাণ, সবক শেখানেঅলা নিজেই সবক শিখে যায়! গোরা হাত তোলা মাত্র ত্বরিতে ওদের একজন লুঙ্গির গেঁজে লুকানো পিস্তলের বাঁট দিয়ে গোরার কপালে দাগা বুলিয়ে দেয়। হিসহিসিয়ে বলে ওঠে—শুন বে! অবসে ই ইলাকা হামরিস। আখতার ভাই কা। ইয়ে ভাই কা সির্ফ ওয়ার্মিং সমঝিস। কাল সে ইধার তুঝকো দেখিস তো… । এই চেতাবনি দিয়ে গোরাকে এক ধাক্কা। যা ছিটকে ফেলে দেয় গোরাকে তার তাজ সমেত। কে যেন এক কলি গেয়ে ওঠে দেওয়ালে গুটখার পিক ফেলে—চুম্মা, চুম্মা ! দে দে মুঝে চুম্মা! গোরা ডানে, বাঁয়ে তাকায়, নিজের সঙ্গী কাউকে দেখতে পায় না। শুধু তার চারপাশে দুদ্দাড়িয়ে ভীত, সন্ত্রস্ত মানুষের ছুটে যাওয়া দেখে। দিবালোকে না হলেও, গোরার এ পতন প্রকাশ্যই, নিশালোকের মায়াবী আলোয় যা আরো পল্লবিত হয়। ফলে লজ্জায় বেশ কিছুদিন এ মুখো হয় না সে আর। শান গেলে যে কোনো ক্ষমতাবানই পঙ্গু। বস্তুত বাবুলের পরে কৃষ্ণের নারায়ণী সেনা যখন ছত্রকার!

রূপার মুখে আনমনে একটা মশা ঢুকেছে যেন। বাইরে এসে নীরবে থুথু ফেলে ড্রেনে– ওয়াক থু! সাঁঝ পেরোলে তার দোকান একটু জমজমাট থাকে সকালের মতোই, বুড়োদের কল্যাণে। ঘরে বসে কাঁহাতক সময় কাটে? তাই সকাল, সাঁঝে রূপার দোকানে তাদের আড্ডা। রূপার বেশ ভালোই লাগে। বাইরে মুসলিম ছেলেদের দঙ্গল—যত দিন যাচ্ছে তত বাড়ছেই।

— হবে নাই বা কেন? ওদের মহল্লায় সবই তো বোরখা ঢাকা! এক বুড়ো ক্ষ্যা-ক্ষ্যা করে হেসে কথাগুলো ছিটকে দেয়।

— হ্যাঁ, তবে থাকত যদি কৃষ্ণ আজ! আমাদের পাড়ার মেয়ে-বউদের তো…

তবে তার কথা মাঝখানেই আটকে যায়, যেহেতু বাইরে বাইকের আওয়াজ থামিয়ে বেজে ওঠে ভারিক্কি গলা—ভাবিজি, দো চায়ে।

আচ্ছা আখতারকে কী করে তোল্লাই দিচ্ছে প্রদীপ রায়, আব্বাসের জামাই জেনেও, যতই লাল পার্টির হোক না কেন আখতার? আর আব্বাসেরই বা কী চাল? মাটির দুর্গের উর্দু মহল্লায় তো আব্বাসের ইশারা ছাড়া গাছের একটা পাতাও নড়ে না। রাজনীতির চাল বোঝে না রূপা। কৃষ্ণও কি বুঝতো?

দীর্ঘশ্বাস চেপে গেলাস দুটো এগিয়ে ধরে রূপা দুই খদ্দেরের দিকে।

৯ 

–নেতা! ঝাঁটের নেতা!

দুপুরবেলা ঘরে এসে হিসহিসিয়ে বলে ওঠে কৃষ্ণ। গায়ের ভিজে জামাটা খাটের ওপর ছুঁড়ে দেয় সে। এ সময়ে রূপা চুপ করে থাকে। ওকে শান্ত হওয়ার সময় দেয়। তবে আজ বড় রকমের কোনও গণ্ডগোল সেটা বুঝতে পারে রূপা, কেননা ঘরে কৃষ্ণ কখনো মুখ খারাপ করে না। আর আজ মানুষটা ঘরে আসতে স্বস্তিও পেয়েছে ও। নইলে সাত সকালেই ঘটনাটার খবর পেয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল কৃষ্ণ এক রকম ছুটেই প্রায়। বাবলুই খবরটা নিয়ে এসেছিল। ফাতেপুর ভিলেজ রোডে দাঙ্গা লেগেছে নাকি! তারপর থেকে লোকের মুখে , টিভির খবর শুনে রূপার মনটা আনচান করছিল। ঘর-বার করছিল সে। পথঘাট নিমেষে শুনশান হয়ে পড়েছিল। দোকানে ঝটাপট শাটার নেমেছিল। হিন্দু পাড়ার ভিলেজ রোড যেখানে বাত্তিকল-ধানখেতির মুসলমান বস্তির ভুলভুলাইয়ায় গোত খেয়েছে, সেখানে নাকি ডি॰সি॰ পোর্টকে খুন করা হয়েছে। মনটা তাই অস্থিরই ছিল সকাল থেকে রূপার। এখন ঘরের মানুষ ঘরে ফেরায় আপাত স্বস্তি পায় সে। ঠান্ডা সরবতের গেলাস নিঃশব্দে বাড়িয়ে ধরে রূপা।

মেজাজ একটু ঠান্ডা হলে স্নান করে ভাত খেতে খেতে বৃত্তান্তে ফেরে কৃষ্ণ।

— জানো, খবর পেয়েই তো ছুটলাম প্রথমে পার্টি অফিসে। দলবল নিয়ে যেতে চাইলাম স্পটে। প্রদীপদা বলে কিনা যেতে হবে না, ওটা সেটিং কেস। শরিকি অন্য দলের মামলা! দাঙ্গার নাম করে সামান্য ডাবপাড়া নিয়ে ফালতু ঝগড়া বাঁধিয়ে একটা হিন্দুর ঝুপড়িতে আগুন ধারায় আনিস। ডকের ছিঁচকে চোর কাঁহিকা! সব সাজানো নাটক! খবর পেয়ে পুলিশ ছুটে আসে—হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বলে কথা! ডি॰সি॰ পোর্টও ছুটে আসে। পুলিশও সে যোগসাজসে ছিল। বাত্তিকলের গলির ভুলভুলাইয়ায় ঢুকিয়ে দিয়ে পুলিশ ফোর্স পেছনে সরে আসে, ততক্ষণে ডি॰সি॰ অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে একা, কেবলমাত্র বডিগার্ড সঙ্গী।

থামে কৃষ্ণ। এক গ্রাস ভাত ঢোকায় মুখে, কিছুটা চিবিয়ে, ঢোক গিলে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,— ঢ্যামনা করিমের চাল সব। ডি॰সি॰টা সৎ ছিল কিনা! ডকের সব চুরি বন্ধ করে দিয়েছিল কড়া হাতে। তাই প্লান করে ডি॰সি॰কে ফাঁদে ফেলে কুপিয়ে কুপিয়ে মেরেছে আনিসের দল, সঙ্গে নিরীহ বডিগার্ডকেও। শালা, করিম আবার মন্ত্রী! ওই তো একটা দু-গাছা লোকের দল! আমরা না জেতালে ভোটে জিতবার মুরোদও নেই! ডকের ডাকাত তো ও! সুভাষ বোসের নাম ডুবিয়ে ছাড়ল! ছিঃ! মাঝখান থেকে কয়েকটা নিরীহ হিন্দুর ঘর পুড়ল।

কৃষ্ণ জল খায়। ভাত মাখতে মাখতে বলে আবার,— তেমনি আমাদের প্রদীপদা! বললাম, আমাদের এলাকা। হিন্দুরা পড়ে পড়ে মার খাবে আর আমরা দেখব? তো, লোকটা বলে কিনা, ‘রাজনীতিতে মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়। রাজনীতি অন্য জিনিস, সবাই পারে না’।

ভাত নাড়াচাড়া করে কৃষ্ণ। রূপা বোঝে, লোকটা মনে মনে আঘাত পেয়েছে খুব। নইলে কম কথার মানুষটাকে এত কথায় পায়!

— আমাদের ঘাড়ে চেপে উনি নেতাগিরি করবেন, আর আমরাই রাজনীতি জানি না!… মানুষের বিপদে যদি মানুষের পাশে না-ই দাঁড়াতে পারলাম, তবে কীসের…। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় কৃষ্ণ। ফলে সিলিং ফ্যানের ঘূর্ণি বাতাসটা আরও একটু লু টেনে আনে যেন বাইরে থেকে।

রূপা মৃদুস্বরে শুধু এটুকুই বলতে পারে,— ও কী? অর্ধেক ভাত যে পড়ে রইল!

— নাঃ, খিদে নেই আজ আর। বাথরুমে গিয়ে হাত ধোয়। ফিরে এসে খাটে হেলান দিয়ে আয়েশ করে সিগারেট ধরায়।

— ওরা দু-জন ঘুমোচ্ছে নাকি? দিদি খেয়েছে?

— হ্যাঁ, দিদি ওদেরকে ওপরে নিয়ে শুয়েছে।

— তুমি খাবে কখন? বেলা তো হয়েছে।

— এবার খাব। একটু থামে রূপা, আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মোছে। তারপর রান্না ঘরে যেতে যেতে বলে,

— পুলিশের অত বড়ো অফিসারকে খুন করেছে… পুলিশ ছাড়বে না নিশ্চয়!

সিগারেটের ধোঁয়ার সঙ্গে কথা ক-টা উড়িয়ে দেয় কৃষ্ণ,— ধু-স-স! বললাম না মন্ত্রী লেভেলে সেটিং আছে। তাছাড়া এই ডি॰সি॰-র জন্য পুলিশেরও হিস্যায় টান পড়েছে কিনা!

সত্যিই তাই হয়, অর্থাৎ, কিছুই হয় না। যদিও সেদিন সন্ধ্যে থেকেই কার্ফু জারি হয়, লালবাজার পুরো উঠে আসে ভিলেজ রোড আর ধানখেতির বস্তিতে। আনিসকে ও তার দলবলকে গ্রেপ্তার করা হয়, মানে করানো হয় এবং আগে থেকে ছকা ছক অনুযায়ীই, নইলে ধানখেতি-বাত্তিকলের ভুলভুলাইয়া থেকে কাউকে বের করে আনা পুলিশের কম্ম নয়! যেমন ক-বছর পরে পারেনি শেরুকেও। বোকা আনিস রাজনীতির বোড়ে হয়ে গড়াগড়ি যায়, সেই সঙ্গে কিছু নিরীহ হিন্দু ছেলেও। না হলে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বলে চক্রান্তটা সাজাবে কেমন করে মন্ত্রী-পুলিশের ঘোঁট!

আহা! কী অল্পবয়সি ডি॰সি॰র বউটা! আর বাচ্চাটাও কী ফুটফুটে! খবরের কাগজে ছবি দেখেছিল সে। দুপুরের খদ্দেরহীন দোকানে বসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে পৌঢা রূপা। অভ্যাসবশে আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মোছে। এইবার দোকান বন্ধ করবে সে। আর বেচারা আনিস! সে বোধহয় মুখ খুলেছিল নেতার গদ্দারি ধরতে পেরে। পুলিশ তার পেটে এমন লাথি কষায় যে পায়খানার দ্বার দিয়ে পেটের নাড়িভুঁড়ি নাকি বেরিয়ে গিয়েছিল! সে-মামলা আজও চলছে এত বছর পরও— সাক্ষী পাওয়া যায়নি নাকি কোনও! একটা করুণ হাসি আবছা ফুটে ওঠে রূপার ঠোঁটে। সেদিন রাত্রে মানুষটার গলায় আফসোস ঝরে পড়েছিল— আমাদের কাঁধে ভর দিয়েই নেতাগিরি… অথচ আমরাই রাজনীতির বোড়ে শুধু। মন্ত্রী-রাজারা দরকারে আমাদের খেয়ে নেয় আমাদের অজান্তেই! বেচারা আনিস… বোকা, বোকাচো-!

আচ্ছা কৃষ্ণের সঙ্গে প্রদীপ রায়ের কি কোনো দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল? নইলে…! সামান্য ঘরোয়া নারী জানেনি সে কিছুই! কেন-না কম কথা বলা লোকটা কখনো এ নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেনি। ঘর আর বার তার কাছে আলাদাই ছিল। কোনো হতাশায়, নিরুপায়তায় যেটুকু ধরা দিত স্বেচ্ছায় তার কাছে সেটুকুই কেবল!

একটু জোরেই যেন দোকানের দরজা বন্ধ করে রূপা।

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

চতুর্থ পর্ব

Facebook Comments

পছন্দের বই