লেখক নয় , লেখাই মূলধন

ধারাবাহিক।পর্ব৬

শতদল মিত্র

মস্তানের বউ

১০

সেদিনও ছিল দুপুরই। তবে গ্রীষ্মের না, বসন্তের— যেহেতু, কাছে পিঠে কোথায় যেন কোকিল ডেকে উঠেছিল। কেন-না এ-এলাকাটা নতুন গড়ে উঠেছে। মুদিয়ালির কিশলয় গলির পেছন থেকে নিয়ে পার্টি অফিসের পেছনের কয়েক ঘর বিহারীবস্তি ছুঁয়ে ওদিকে ফতেপুর সেকেন্ড লেন পর্যন্ত বিস্তৃত বিরাট যে-হোগলার জলাজঙ্গলটা বিরাজিত ছিল জলের মাঝে মাঝে কয়েকখানি শিমুল আর কদমের গাছ নিয়ে, এই তো সেদিনই যেন-বা, বিশাল বিপুল এক থম মারা নির্জনতা বুকে জাগিয়ে— যে-নির্জনতা ভর দুপুর বেলাতেও মাঝ-নিশার অন্ধকার ডেকে আনত, যেখানে দিনমানে কখনো কখনো বেওয়ারিশ লাশ ভেসে উঠত এই সেদিনও, সেই জলাটা একদিন রাতারাতি ভানুমতীর জাদুতে বা ময়দানবের ছোঁয়ায় বর্তমানে মধ্যবিত্ত মানুষের একতলা বা দোতলার জমাট বসতি, পুরোনো জাগানো দুয়েকটি শিমুল বা কদম গাছ সমেত, যেগুলো আপাতত আজও বেঁচে মানুষের লোভী শানিত নখর এড়িয়ে। এখন ময়দানব কৃষ্ণ হলেও আসল ভানুমতী-জাদুকাঠিটা ছিল আসল ভগবান প্রদীপ রায়ের হাতেই! লোকে বলে আধাআধি হিস্‌সা ছিল নাকি কৃষ্ণের আর প্রদীপের। লাল পার্টির যাই বদনাম থাকুক তারা কিন্তু দলের ওপর থেকে নিচু সবাইকে দিয়ে-থুয়েই খায়। যেমন দেখতে দেখতে উবে যায় ঘেঁষকালের মাঠ, শান্তিনগরের বিপুল সেই হোগলার বন— না, সেখানে ইদানীং আর লাশ ভেসে ওঠে না, কেন-না লাল জমানার মধ্যগগনে শান্তি হি শান্তি! এবং টাকা মাটি, মাটি টাকা— এ ঈশ্বরীয় বাণীটিও বাস্তব আদল পায়! সে-সব টাকাও সমান বখরায় ভাগ হয়েছিল কৃষ্ণ আর প্রদীপের মধ্যে। যেমন উবে যায় লালার মাঠ, পাল বাগানও। শুধু আজও রয়ে যায় বাঁধা বটতলার বাবুলের গলির পেছন থেকে নিয়ে রামদাসহাটি পর্যন্ত বিস্তৃত হোগলার জলা-জঙ্গলটা, যেহেতু সেখানে মাঝে মাঝে জেগে থাকা দ্বীপে চোলাইয়ের চাষ হয়, এবং অবশ্যই পার্টি, পুলিশ, প্রশাসনের নজরের আড়ালেই, যেহেতু জলাটা কলকাতা কর্পোরেশন আর মহেশতলা গ্রামপঞ্চায়তের সীমানায়, ফলে দুই থানার মাঝখানে নিশ্চিন্তে বিরাজমান! হ্যাঁ, বর্তমানে মেটেবুরুজ যেমন উন্নয়নের প্রগাঢ় শরিক হয়ে মিউনিসিপালিটির ঊর্ধ্বে উঠে কলকাতা কর্পোরেশনের বর্ধিত এলাকা— ওয়ার্ড নং ১৩৩-১৪১, মহেশতলাও ক-বছর বাদে উন্নততর উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে পঞ্চায়েত থেকে মিউনিসিপালিটিতে উন্নীত হয়ে যাবে।

যে-কথা হচ্ছিল, সেদিনও ছিল দুপুরই। তবে গ্রীষ্মের না, বসন্তের— যেহেতু পুরোনো জাগানো শিমুল কিংবা কদম গাছে কোকিল ডেকেছিল, যা সেই দুপুরটাকে বিষণ্ণ ও ঘন করে তুলেছিল। আর সেই ঘন দুপুরখানি আরও ঘনান্ধ হয়ে উঠেছিল যখন কৃষ্ণ ঘরে এসেছিল, কেন-না তার শ্যাম মুখখানি ছিল কালো, থমথমে। ফলে সে-ক্ষণের ঘন আঁধার ভাঙতে সাহস হয়নি রূপার। বিস্মিত রূপা অপাঙ্গে তাকিয়েছিল কেবল, কেন-না কৃষ্ণের আজকের ফেরাটা সঠিক সময়ের ছিল। পরে স্নান করে, ভাত খেয়ে একটু ধাতস্থ হয়ে ফুকরে উঠেছিল কৃষ্ণ আপন মনে নিজেকে শোনাতেই যেন,— হেরে গেলাম। একটা বাচ্চা ছেলে হারিয়ে দিল! নাক-মুখ দিয়ে গলগলিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে সে, মনের চাপা হাহাকারটাকেই উগড়ে দেয় যেন।

ক-দিন ধরেই শেরু নামটা শুনছে রূপা। ধানখেতি বস্তির বছর সতেরোর কিশোর সে। কিশোরই তো, তবুও তার করিশ্মায় আব্বাস-বাদশার একচেটিয়া খানদান ভেঙে চৌচির যেন। কাচ্চিসড়ক, আয়রন গেট রোড, শাহী আস্তাবল লেন, ধানখেতি, বাত্তিকল কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে সে ইদানীং! অথচ কেউ তাকে দেখেনি নাকি! ডকের চোর, ট্রান্সপোর্টার, লেবার কনট্রাক্টর— সবার কাছ থেকে তোলা তুলত তার দল। যারা এতদিন আব্বাসকে দিয়ে এসেছে, তারা প্রথমে পাত্তা দেয়নি। ফলে দু-একটা লাশ পড়ে যায়, যে-খেলার যা নিয়ম তা মেনেই। ফলে টাকা আপনি পৌঁছে যেতে থাকে তার কাছে। সে-কিশোর, শেরু সব টাকা নাকি বিলিয়ে দেয় ধানখেতি-বাত্তিকলের গরিব সকল মানুষকে। পুলিশ অনেক বার রেড করেছে ধানখেতি বস্তি আচমকা, দিনে-রাতে। না, শেরুর টিকিটি খুঁজে পায়নি তারা। বোরখা পরা মহিলারা প্রত্যেকবারই পুলিশকে ঘিরে ধরে জানিয়েছে যে,— শেরু-এরু কিসিকো হমলোগ নাই জানিস। না, পুলিশরা বস্তির কোনো ছোকরাকেও ধরতে সক্ষম হয়নি। কেন-না সে মহিলাকুল সকল সময়েই তাদেরকে ঘিরে থেকেছে। পুলিশ জোরও করতে ভয় পেয়েছে— ডি॰সি॰ হত্যার কেসটা যে তখনও দগদগে। দ্বিতীয়ত এ-বস্তির গলির গলতা, তার ভুলভুলাইয়া! সরু সে-গলির দু-পাশে ঝুঁকে আছে বস্তির খাপরা-টালির চাল, মাথা ঠেকাঠেকি করে যেন, আবার হঠাৎ তুমি দেখলে সে-গলি শেষ হয়েছে কোনো বাড়ির উঠোনে, বেকুব তুমি জানো না যে, সে-বাড়ির লাগোয়া কাঁচা ড্রেনের পাশ দিয়ে আবার এক নতুন গলির শুরু। যদি-বা জেনে নিয়ে সে-পথ ধরে এঁকে বেঁকে এগোলে, আচমকা দেখলে তুমি সহসা হাজির একচিমটে এক খোলা প্রান্তরে, তাকে ঘিরে টালি-খাপরায় ছাওয়া দশ ঘর! ব্যস, ফেঁসে গেলে তুমি! যদি শত্রু হও, পিছন পানে ফিরতে চেয়ে দেখলে সে ড্রেন ঘেঁষা গলির আধা- অন্ধকারে জ্বল জ্বল করছে কয়েকটা শার্দূল চোখ সে-আঁধার চিরে! অগত্যা পুলিশকে ফিরে যেতে হয় বার বার মেন রাস্তায় খাড়া তাদের গাড়ির নিরাপদ ঘেরাটোপে। কিংবা এ এমনও চাল হতে পারে পুলিশ-প্রশাসনের আব্বাস-বাদশাকে সবক শেখানোর! হতে পারে বখরায় কম পড়ছে লালবাড়ির।

বাদশা নামটা ইদানীং শুনেছে রূপা। দেখেছেও একদিন এক ঝলক। হুডখোলা জিপে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল সে— ছ-ফুটের ওপর লম্বা, টকটকে গায়ের রং, সাদা জামা, সাদা প্যান্ট, সাদা জুতো, এক কানে ঝিলিক দিচ্ছে সোনার হাত— পাঞ্জা। হ্যাঁ, বাদশার মতোই তার শান-সওকত। অল্প দিনেই আকাশ ছোঁয়া উত্থান। আব্বাসের হাত ওর মাথার ওপর, ও নাকি পরের ভোটে সবুজ দলের উমিদবার-প্রার্থী এবং জিতবেও, কেন-না আব্বাস ফ্যাক্টর। শোনা যায় সবুজ পার্টির শিয়ালদ-র ছোড়দার সঙ্গেও ওঠাবসা, বেরাদারি। তবে এটা সত্যি যে, কলকাতা-হলদিয়া ডকের অর্ধেক ট্রান্সপোর্ট, ট্রেলারের মালিক নাকি সে। আবার এদিকের জাহাজ কারখানা, রাজাবাজার ডক ইয়ার্ড, জি॰ই॰সি॰, ল্যাম্প ফ্যাক্টরি, সাবান কল— সবের লেবার কনট্র্যাক্টের অর্ধেক তার, বাকি অর্ধেক প্রদীপ রায়ের বকলমে কৃষ্ণের।

সহসা সে দুপুরের শব্দহীনতাকে চলকে দিয়ে, ফলত রূপার ভাবনাকেও, কৃষ্ণ বাঁহাতের তালুতে ডান হাতের ঘুসির আঘাত হেনে হিসহিসিয়ে উঠেছিল— গো হারান হেরে গেলাম! দাঁড় করিয়ে গোল দিয়ে চলে গেল বাচ্চা ছেলেটা! মুড়ি-মুড়কির মতো পেটো। সঙ্গে শূন্যে ফায়ার! আমরা পালটা দিলে পাড়ার সাধারণ মানুষের ক্ষতি হত। সেটা আমি থাকতে হার্গিস কোনোদিন হতে দেব না। অপেক্ষায় ছিলাম, যদি প্রদীপদার বাড়ি অ্যাটাক হত তখন তো…। আর প্রদীপদা বলে কিনা,— ‘আমরা কাপুরুষ! আমাদের নাকি ফালতু পুষছে!’ একটু থামে কৃষ্ণ, যেন-বা দম নেয় ক্ষণিক ভেতরের রাগটাকে পরিপূর্ণ ভাবে উগড়ে দেবে বলে।

— আমরা ফালতু! যে-যুদ্ধের যে-কৌশল— আমরা মোটে জনা দশেক আর ওরা পঞ্চাশ-ষাট জন। আগে কোনো খবর ছিল না, এমনই হঠাৎ চাল! তা তোর গোয়েন্দা-পুলিশ কি ঘাস ছিঁড়ছিল! শুধু আমরাই ফালতু! আমদের পোষে হারামিটা! কে কাকে পোষে! আমরা আছি বলেই তো তুই আছিস! শালা কালা নাগ!

ঘটনাটা সত্যিই চমকে দেওয়ার মতোই, যেহেতু তা চিন্তারও অতীত ছিল, কেন-না প্রদীপ রায়ের আস্তানা ফতেপুর সেকেন্ড লেনের নোনাপুকুরে, খাঁটি হিন্দু বাঙালি পাড়া, তাছাড়া কৃষ্ণের খাস তালুক— সবচেয়ে বড়ো কথা প্রদীপ রায় নামের প্রতাপ, মাটির দুর্গের আসল নবাব যে, যতই ভোটে হারুক সে, বা মানুষ যতই অপছন্দ করুক না কেন! এ হেন প্রদীপ রায়ের বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করেছিল একটা নাদান বাচ্চা ছেলে, নালায়কই যে! যা আব্বাস-বাদশারও স্বপ্নে হার্গিস আসবে না। তাও দু-আড়াই মাইল দূরের ধানখেতি থেকে উজিয়ে রামনগর লেন হয়ে, মিঠাতলাও, ব্রাহ্মসমাজ রোড, করমঞ্জিল, মুদিয়ালি ফার্স্ট লেন, মুদিয়ালি হরিসভা পার করে, ফতেপুর সেকেন্ড লেনের মতো হিন্দু পাড়ায় রঙবাজি, প্রদীপ রায়ের প্রতাপকে পায়ে দলে! এক ফুঁয়ে নিবিয়ে! বৃষ্টির অঝোর ধারার মতো পেটো ফেটেছে। নাঃ, দম আছে ছেলেটার! সব্বাই একবাক্যে সেলাম ঠুকেছিল শেরুকে। এখন নেতার প্রতাপ পাংচার হলে নেতা তো সর্বহারা! সমান সত্য মস্তানের ক্ষেত্রেও। প্রতিটা মানুষ ঘরে লুকিয়ে ক্ষ্যা-ক্ষ্যা হেসেছিল, যদিও মনে মনে। ফলে গল্পের গোরু গাছ ছাড়িয়ে আকাশে ভেসেছিল।

— আবে, কালা নাগ, বাপকা আওলাদ হো বাহার নিকালিস!

— কিয়া বে শালা নাগ, চুহা বন গায়িস ক্যা!

একটা করে ডায়ালগ একটা করে পেটো।

— দেখলিস তো শেরুকা করিশ্মা!

— ইয়ে তো জাস্ট ট্রেলার থা বে নাগ কা আওলাদ। পিকচার অভি বাকি হ্যায়।

এমন বলেই নাকি ওরা ফিরে গিয়েছিল পেটোর বৃষ্টি ঝরাতে ঝরাতে, সঙ্গে শূন্যে ফায়ার। এমনকী এ-গানও নাকি ভেসে উঠেছিল পেটো-পিস্তলের সংগতে— টিপ টিপ বরষে পানি, পানিমে আগ লাগে তো…! যেমন ঝড়ের বেগে এসেছিল, তেমনই ঝড়ের বেগে ফিরেও গিয়েছিল ওরা, যে-ঝড়ে প্রদীপ রায়ের সাজানো বাগান একটু হলেও তছনছ হয়েছিল বৈকি!

— আরে ওই ফর্সা পানা লম্বা ছেলেটাই শেরু।

— ধুস! শেরু তো কালো।

— যাইহোক, দেখিয়ে দিল বটে ছেলেটা। সত্যি দম আছে। নইলে বাঘের গুহায় এসে এমন রংবাজি!

কথারা আড়ালে আবডালে গড়ে ওঠে, হাওয়া পায়, ভেসে যায় দূরে রং পালটে পালটে।

হ্যাঁ, মুসলিম মহল্লায় চিকন কালো প্রদীপ রায় কালা নাগ বলেই প্রখ্যাত।

তবে নাগ তো! শীতঘুমে গেলেও যখন গর্ত থেকে বের হয়ে আসে শীত-অবসানে, তখন বিষথলি তার কানায় কানায় ভরা, টনটনায় তা যতক্ষণ না এক ছোবলে সবটুকু বিষ উগড়োতে পারে সে। এর পরের সময়টা, যা শীততুল্যই যেন প্রদীপ রায়ের সাপেক্ষে, কেন-না এই সময়টা সে নির্বিকার থাকে। আর এ-শীতলতার ঘেরাটোপে সে প্রশাসনের সর্বোচ্চস্তরে প্রভাব চালায় নীরবে, যেহেতু এটা প্রবাদ যে, আগুনের ফুলকির পিছনে হাওয়া থাকেই! সে-হাওয়ার উত্স খুঁজতে জানতে হয়। এবং ওপর তলার একটু তল্লাশিতেই খোঁজ মেলে এ-আগুনের পিছনে সেই শিয়ালদার ছোড়দা যোগ! অতএব গোপন রফা হয় রাজায় রাজায়। তবে সে-রফা অমূল্য আপোশের, নাকি মূল্যযুক্ত পাবলিক তা জানতে পারে না। শুধু ভাসা ভাসা এটুকুই জানতে পারে যে, সবুজ পার্টির নেতা সে-কিশোরকে নাকি ডেকে পাঠিয়েছিল এক ধোঁয়ামাখা সাঁঝে তাদের বাঙালিবাজার-বিচালিঘাটের দোতলা পার্টি অফিসে— হ্যাঁ, অতি অবশ্যই ইমানের শপথ চোয়ানো গোপনে।

কাচ্চি সড়ক, বাঙ্গালিবাজার থেকে শাহী ইমামবারা, থানা, লাল মসজিদ, শ্লটারহাউস রোড তক খানদানি মেটেবুরুজ সকালে শুনশান, বেলা যত বাড়ে, দিন ঢলে, আঁধার ঘনায় ততই সে জেগে ওঠে জুলুশে-জৌলুসে। সে-সাঁঝও ছিল তেমনই জৌলুসময়। একটি দোহারা কিশোর চোখের নির্লিপ্ত ইশারায় তার সঙ্গি চারজন সদ্য যুবাকে কাছে-দূরে লোকের ভিড়ে দাঁড় করিয়ে রেখে তরতরিয়ে উঠে যায় পাঞ্জাছাপ পার্টি অফিসের দোতলায়। সঙ্গে সঙ্গে পানের গুমটিতে, সামনের ফুটপাথে ফলের দোকানে কয়েকজন ক্রেতার মধ্যে আলতো চোখাচোখি হলে কিছু বাদে লুঙ্গি-শার্ট পরা একজন উঠে যায় ওপরে নিঃশব্দে। কত লোকই তো এ-সময়ে পার্টি অফিসে যায় দরকারে-অদরকারে! ভেতরে লোক আছে দেখে যেন থমকায়, ইতস্তত করে, নাদান পাবলিক হেন। ততক্ষণে চোখে-চোখে যা কথা হওয়ার হয়ে গিয়েছে ঘরের ভেতর থেকে বাইরে। কেন-না ঘরের ভেতর থেকে নেতাসাবের খাস চেলা খিঁচিয়ে উঠেছিল,— থোড়া ঠাহর যাও বাহার। অব জরুরি মিটিন চল রহা হ্যায়।

পিঠ ফেরানো কিশোরটির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কিছু সংকেত হানলেও হানতে পারে, যেহেতু সে চকিতে ঘাড় ঘুরিয়েছিল এবং একজন এলেবেলে মানুষকেই শ্লথ পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে দেখেছিল। কিন্তু ইমান শব্দটা, ও বাইরে তার অতি বিশ্বস্ত সঙ্গীদের উপস্থিতি তাকে নিশ্চিন্ততা দিয়েছিল। কিন্তু তার অজান্তেই লোকটি সিঁড়ির লান্ডিং-এ দাঁড়িয়েছিল দেওয়ালে পিঠ দিয়ে শিকারি শার্দূলহেন বিভঙ্গে। কিছু বাতচিত, কিছু চেতাবানি, কিছু লেনদেন ও উত্সাহব্যঞ্জক কথার শেষে কিশোরটি দরজা পার হয়ে সিঁড়ির মুখে ঘুরতেই শার্দূল হেন লোকটি চকিতে লুঙ্গির পেছন থেকে সাইলেনসার লাগানো পিস্তল বার করে নিঃশব্দে ছ-ছ-টা দানা গেঁথে দিয়েছিল কিশোর শেরুর শরীরে, নামে-কামে শেরই ছিল যে, সেহেতু ঘাতকজন পুলিশি শিষ্টাচারে দু-পা জোড়া লাগিয়ে স্যালুট ঠুকেছিল লুটিয়ে পড়া বীর শত্রুকে।

ততক্ষণে সিভিল ড্রেসের বাকি পুলিশরা পজিশন নিয়ে নিয়েছে পিস্তল উঁচিয়ে,— ভিড় হটাইয়ে সবলোক। জলদি। বিচালিঘাটের গলির ভেতর লুকিয়ে থাকা পুলিশ ভ্যান ত্বরিতে চলে আসে অকুস্থলে। পুলিশ দখল নিয়ে নেয় গোটা চত্বরের। ঝপাঝপ শাটার নামে দোকানে। ফুটপাথের হকারের মাল গড়াগড়ি যায়। যেমন সিনেমায় হয় তেমনই। শেরুর সঙ্গীরা বিপদের গন্ধ পেয়ে উদ্‌ভ্রান্ত মানুষের ভিড়ে বোধহয় নিঃশব্দে মিশে গিয়েছিল। ভ্যানে চেপে শেরু চলে যায় লালবাজারে। সবুজ নেতা চোখের আঁশু মুছে ধরা গলায় বলেছিল পরে সংবাদ মাধ্যমকে— কৌন থা হামকো কিয়া মালুম! উ তো উপর ভি নেহী উঠ সকা। হাম উসকা সুরত ভি নেহি দেখ সকা। সিঁড়িমেই তো পুলিশ উসকো মার দিয়া। পুলিশ কা ইয়ে গুণ্ডাগর্দিকো হমারা পার্টি অপোজ করতে হ্যাঁয়।

ততক্ষণে বৈদ্যুতিন সংবাদ মাধ্যমে এই খবর ঝলসে ওঠে যে— মেটিয়াবুরুজের শেরু নামক কুখ্যাত গুন্ডা পুলিশের সঙ্গে এনকাউন্টারে নিহত আজ সন্ধ্যায়।

সে-সাঁঝে বাত্তিকল-ধানখেতিজুড়ে শকুন সান্নাটা নেমেছিল, যা থকথকে কালো।

হঠাৎ শাঁখের আওয়াজে বাস্তবে ফেরে রূপা। সন্ধ্যের ধূপ-জল দিতে দোকানের বাইরে আসে সে। পাশের হলটা অভ্যাসবশত নজর টানে তার। আবছা অন্ধকার পোড়ো প্রাসাদের কঙ্কাল যেন তা। কে এক শামবাবু কিনে নিয়েছে হলটা— শামবাবুর আসল নাম রূপা জানে না, এটুকুই শুনেছে যে, সে নাকি বটতলার খুব বড়ো দর্জি ওস্তাগর— কাঁঠাল বেরিয়া রোডে হাভেলি তার। হয়তো বকলমে আব্বাসেরই লোক! ফতেপুরের অত বড়ো গ্যারেজটাও নাকি কিনে নিয়েছে, হাসপাতাল বানাবে। তার দোকানটাও কিনতে চায় সে। না, ন্যায্য দামই দেবে বলেছে, বরং বেশিই তা। বিক্রিই করে দেবে সে। কী হবে আর রেখে? নেহাত স্মৃতির অভ্যাস, তাই আসা! লক্ষ্মী-গণেশের মূর্তিতে ধূপকাঠিটা গোঁজার আগে কৃষ্ণের ছবিতেও একবার ধূপ দেখায় সে।— বোকা, বড়ো বোকা ছিল লোকটা, শেরুর মতোই। রাজনীতির দাবার চালে সামান্য বোড়েই শুধু। সন্ধ্যার ছায়া ক্রমে জমাট বাঁধতে থাকে দোকানজুড়ে। সুইচ টিপে আলো জ্বালে রূপা।

প্রথম পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব

তৃতীয় পর্ব

চতুর্থ পর্ব

পঞ্চম পর্ব

Facebook Comments

পছন্দের বই