লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গল্প

শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস

গিনিপিগ

এই লোকটা, সেই লোকটাই— যাকে চিনতে রীতিমতো গবেষণা করতে হয়েছে। তবে কি মানুষকেও গবেষণার জন্য গিনিপিগ করা যায়? তাহলে লোকটাকে একটা গিনিপিগই বলি। এই যে ‘বলি’— শব্দটায় একজন বক্তা আছেন। তিনিও লোকটার মতো একজন মানুষ। মানুষই মানুষকে বোঝে। অবিকল হাত পা, মাথা, পেট, বুক, জনন, প্রেম, চুম্বন সবই মানুষের আছে বলে, অন্য মানুষকে বোঝা সহজেই সম্ভব। কিন্তু গিনিপিগ? সে-তো খুদে একটি চঞ্চল প্রাণী! সারা শরীরময় ইট-সাদা, সাদা-কালো গোলাকার দাগ। ওগুলো এক-একটি পৃথিবী। ওইসব পৃথিবীতে বারংবার মহামারি গেছে, এসেছে। ওরা সবকিছুকেই ঝেঁটিয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে আবারও গবেষণাগারের স্বেচ্ছাবন্দিত্ব মেনে নিয়েছে।

এইসবের কোনো বিচার নেই। গিনিপিগকে শুয়োরের বাচ্চা বললে ও কোনো প্রতিবাদ করতে পারে না। চুপচাপ গবেষণাগারের জেলখানার কয়েদি হয়ে মিটিমিটি হাসে। একজন মানুষ গিনিপিগকে বোঝে না বলে, আগের সেই ‘আমি-বক্তা’ এইবার গিনিপিগ হওয়ার চেষ্টা শুরু করল।

বউকে বলল— ও বউ, খেতে দাও। বউ ওমনি তাড়াতাড়ি পাকের ঘর থেকে এক থালা গরম ভাত আর কলমির গন্ধভরা জলের থেকে আবিষ্কৃত শাকের মৃতদেহ নিয়ে স্বামীর ভাতের থালার ওপরটা দেখতে দেখতে উঠোন পেরিয়ে দাওয়াতে উঠে গেল। সাদা ভাতের ওপর সবুজ কলমির শাক ততক্ষণে জলে ভাসা মৃতদেহ হয়ে গেছে। এক হাতে বউটার জলের ঘটি। ওই হাতের বগলে গোঁজা তালপাতার হাতপাখা। পাখার হাওয়ায় ভাত জুড়োবে। জুড়োবে বউয়ের মন।

আহা! স্বামী বলে কথা! জন্মজন্মান্তরের বোঝাপড়া! বউকে কখনো সখনো জড়িয়ে ধরলে লোকটার যৌবন ফিরে আসে।

যৌবন কি সত্যিই ফিরে আসে? এসবও গিনিপিগের মতোই গবেষণার বিষয়। তবে, মহাজনের কাছে হাওলাত বরাত বন্ধ হয়ে গেলে লোকটা বউকে পেটায়। মারতে মারতেই বনবন করে গাছের মগডালে উঠে যায়। আবারও সরসর করে নীচে নেমে আসতে গিয়ে পঞ্চায়েতি বিচারকদের দেখে পাতার আড়ালে চলে যায়। অর্থাৎ, লোকটা তখন একটা গিনিপিগ। ওকে আড়াল করতে সারা শরীরে পেটাইয়ের ব্যথা নিয়ে এবার ওর গিনিপিগ বউ দরজার খুঁটিতে দাঁড়িয়ে ছেঁড়া আঁচলে মুখ চেপে বলে— তিনি বাড়ি নাই।

গিনিপিগ সন্ধ্যাকালে সরসর করে নীচে নেমে আসে। নিজের যৌবনকে আদর করে ডেকে নিজেকেই বলে— আয়…

রাত বাড়লে আকাশ জুড়ে পূর্ণিমার ধবধবে সাদা চাঁদের কামিনী কাঞ্চন। গিনিপিগ তাঁর বউ গিনিপিগকে জড়িয়ে ধরে ফিরে যায় যৌবনের গবেষণা করতে। কেন, কেন তাদেরকে শিকার করে একদল মানুষ?

আবারও সকাল হয়। গতকালকের রাতের অভিজ্ঞতাকে নোটপ্যাডে মনে মনে লিখে রেখে গিনিপিগ জনমজুরি খাটতে যায়।

বউ চুলাতে রান্না বসায়। কাঁচা-পাকা পাতা পোড়ার গন্ধে বউয়ের হাতের কারসাজিতে জলে ভাসতে ভাসতে আসা রান্না করা ঢোলকলমির শাক করোনাতে মৃত্যু হওয়া লাশ হয়ে যায়।

এই লাশটাও কেউ ছিল। একদিন ওর ঘর ছিল। বউ ছিল। জলে ভাসা কলমির দামের মতো সংসার ছিল। বউ শাকভাত রান্না করে লোকটাকে খেতে দিত। রাত হলে আদর করত! আরও কত কিছু করত বউটা, ওই মৃতদেহর জন্য!

চিন্তায় ছেদ পড়ে। সারাদিন খেটেখুটে স্বামী স্ত্রী খেতে বসেছে। বেলাবেলি খেলে গরিবের একবেলার খাবারেই দু-বেলার স্বাদ মেটে। এসব সরকার জানে না। সরকারের ঘর থেকে আসা ফ্রী রেশনের চালের ওপর গিনিপিগেরা তিড়িংবিড়িং করে লাফায়। আটা কিম্বা ফ্রি গম দশ টাকা কেজিতে বিক্রি করলে বিনা পুঁজির ব্যাবসাতে লক্ষ ঘরে আসে। বিদ্যুতের ব্যবহার শিখে গেছে ওরা। আর সেখানেও বিপিএল -দের টিকিয়ে রাখার ভোটব্যাংকের শুভকামনায় দুটো বাল্ব আর একটা পাখার মিটার রিডিঙের কাঁটা শূন্যতেই দাঁড়িয়ে থাকে। গিনিপিগদের বরাদ্দকৃত জমানো কেরোসিন তেল শহর থেকে আগত তেল ক্রেতাদের কুড়ি টাকা লিটারে বিক্রি করে দেয়। ওই তেল দিয়ে করোনাকালে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বাস মালিকেরা মোবিলের সঙ্গে মিশিয়ে বাস চালায়। পরিবেশে দূষণ বাড়িয়ে তোলে সেই তেল পোড়া কার্বনমনোক্সাইড গ্যাস। গ্যাসের ধাক্কায় গিনিপিগের শরীরের গোল গোল চাকা চাকা সাদাকালো পৃথিবীতে ধস নামে।

তাতে কিছুই এসে যায় না গিনিপিগদের। বাঁচা মানে বর্তমান। কার কী ভবিষ্যৎ হবে, কে বলতে পারে?

বিনা পুঁজির ব্যাবসা সম্প্রসারণ করতে করতে এভাবেই চঞ্চল প্রাণীগুলো সামনের দিকে এগোয়।

এতক্ষণে বউ গিনিপিগ এঁটো থালাগুলো জড়ো করে বয়ে নিয়ে যায় সেই জলের কাছে। মাজাঘষা সারতে সারতে রাত বাড়ে। জলে ভাসা কলমির গন্ধভরা মৃতদেহকে সনাক্তকরণ হয়ে গেছে ততক্ষণে। এটা করোনা বডি। দৌড়ে এসে স্বামীকে জানায় সে। এতে স্বামী গিনিপিগের কোনো হেলদোল নেই। কেন-না, এই সময়টাতে সে নিশ্চিন্তমনে ভাবতে বসে। এঁটো হাত শুকিয়ে কাঠ! চোখে নেশা ধরানো জলে ভাসা কলমির গন্ধভরা মৃতদেহকে এখন চিতায় তোলা হবে। পাশাপাশি আরও চিতা। চিতাতে শায়িত প্রতিটি বডিই গিনিপিগের। গণচিতার আগুনের ধোঁয়ায় চারদিক ছেয়ে গেছে।

এতক্ষণে গিনিপিগ বউ গিনিপিগকে বলল— জোরে নয়। এটা আমাদের দু-জনের মৃতদেহগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন। আস্তে আস্তে আমার সঙ্গে শেষের কথা বলো— “বলো হরি, হরি বোল! রাম নাম সাথ হ্যায়…”

শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস

জন্ম ১৪ই নভেম্বর, ১৯৬৩। বাসস্থান— মালদা। পেশা— সংবাদমাধ্যম কর্মী। প্রকাশিত গ্রন্থ— ‘সাতে সমুদ্র’, ‘কৃষ্ণচূড়ার ছায়া’, ‘কাল তোমায়’, ‘পারিজাত বনে দুজনে’, ‘৪র্থ তৎপুরুষ’, ‘ক বর্গ’ (কাব্যগ্রন্থসমূহ)। ‘চাঁদোর ছড়া’ (ছড়াগ্রন্থ)।

পছন্দের বই