লেখক নয় , লেখাই মূলধন

সাক্ষাৎকার

শ্রীমতি গোপা কাঞ্জিলাল

সঠিকভাবে কন্ঠ চর্চা বা সঠিক স্বরস্থান সম্পর্কে ধারণা হলে তবেই গান সুন্দর স্বাভাবিক ভাবে গান কণ্ঠে ধারণ করা সম্ভব

আলাপচারিতায় অরূপ চক্রবর্তী

আমাদের সংগীতের আদি রূপ শাস্ত্রীয় বা উচ্চাঙ্গ সংগীতের যে ধারা কয়েক শতক ধরে যা স্বমহিমায় উজ্জ্বল ছিল বর্তমান সময়ে এসে সে তার কৌলিন্য হারিয়েছে। সারা ভারতবর্ষের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গেও একই চিত্র দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। আজ থেকে কিছু বছর আগেও কলকাতা ও অন্যান্য জেলায় সারা বছরব্যাপী বিশেষ করে শীতের সময় জুড়ে উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসর বসতো এবং সেই অনুষ্ঠানে বাংলা তথা সারা ভারতের বিখ্যাত সব কণ্ঠশিল্পী ও বাদ্যযন্ত্রশিল্পী উপস্থিত থাকতেন। সকলেই একবাক্যে স্বীকার করতেন যে কলকাতা তথা পশ্চিমবাংলায় সমঝদার শ্রোতার আধিক্য অন্যান্য যে কোনো অঞ্চলের চেয়ে বেশি। কাজেই বিভিন্ন ঘরানার শিল্পীরা মুখিয়ে থাকতেন এখানে সংগীত পরিবেশন করার জন্য।

কিন্তু উচ্চাঙ্গ সংগীতের সেই রস গ্রহণ করার মতো শ্রোতা আজকাল বিরল। বিভিন্ন যন্ত্রের উচ্চকিত ও অসংযমী প্রয়োগ ও তার সাথে গান গাওয়া— এখনকার প্রজন্মের মানুষের চিত্ত বিনোদনের অন্যতম অঙ্গ। উচ্চাঙ্গ সংগীত শিক্ষার জন্য যতটা সময় দেওয়া দরকার, সঠিকভাবে তানপুরায় সুর বেঁধে কন্ঠ চর্চার প্রয়োজন ও যোগ্য গুরুর অধীনে থেকে নিবিড় শিক্ষা ও অনুশীলন— তার সদিচ্ছা বা আগ্রহ এই সময়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে খুব কম দেখা যায়।

আমরা তবুও প্রয়াস-এর পক্ষ থেকে উচ্চাঙ্গ সংগীত ও নজরুলগীতি-র প্রথম সারির শিল্পী গোপা কাঞ্জিলাল-এর বারাসতের বাড়িতে গিয়েছিলাম তাঁর সংগীতজীবনের কিছু কথা শোনার জন্য। তাঁর অভিজ্ঞতার কথা নিয়ে এই উপস্থাপনা।

আপনার সংগীত শিক্ষার হাতেখড়ি কখন শুরু হয়েছিল? বাড়িতে কেউ কী সংগীত চর্চা করতেন? তাঁদের আগ্রহের কারণে কী আপনার সংগীত জীবন শুরু হয়েছিল?

আমি তখন খুব ছোটো। আমাদের পাশের বাড়িতে একজন শিক্ষক আসতেন গান শেখাতে। তাঁর নাম শ্রী গৌর গোপাল কুণ্ডু। তিনি এলেই আমি তাঁদের বাড়ি চলে যেতাম গান শুনতে। আমার খুব ভালো লাগতো। তিনি চোখে দেখতে পেতেন না। একদিন আমি মায়ের কাছে বললাম যে আমি গান শিখতে চাই। মা বাবাকে আমার আগ্রহের কথা জানালেন। তারপর বাবা ওনার সঙ্গে কথা বলে আমার গান শেখার ব্যবস্থা করে দিলেন। সেই থেকে আমার গান শেখা শুরু হলো। এভাবেই কিছুদিন চললো। উনি সব ধরণের গান শেখাতেন যেটা বাবার পছন্দ ছিল না। বাবা পছন্দ করতেন উচ্চাঙ্গ সংগীত। নানা ভাবনা চিন্তার পরে একদিন বাবা আসাম রওনা দিলেন। উদ্দেশ্য আমার দাদুর (বাবার কাকা) কাছে আমার গান শেখার বিষয়ে আলোচনা করার জন্য। আমার দাদু ছিলেন লখনৌ-র ম্যরিস কলেজ অফ মিউজিক (বর্তমানে ভাতখণ্ডে কলেজ অফ মিউজিক) এর ছাত্র। তিনি গান শিখেছিলেন পণ্ডিত বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখণ্ডে ও পন্ডিত শ্রীকৃষ্ণ নারায়ণ রতনজনকারের কাছে। পাহাড়ী সান্যাল, প্রশান্ত দাশগুপ্ত, রবীন্দ্রলাল রায় (বিদুষী মালবিকা কান্নন-এর বাবা) ও আমার দাদু এঁরা সবাই এক সাথে সংগীতের পাঠ নিয়েছেন। যাইহোক, বাবা কিন্তু আসাম গিয়ে দেখলেন দাদুর ঘর তালাবন্ধ। উনি বাইরে কোথাও গেছেন। আসলে উনি সংসারী মানুষ ছিলেন না। তখন বাবা ওনার উদ্দেশে একটা চিঠি লিখে রেখে আসেন।

 এর পরবর্তীতে কী হলো?

বাবা আসাম থেকে ফিরে আসার কিছুদিন পরের ঘটনা। একদিন দেখি আমাদের বাড়ির সামনে একটা রিকশা এসে থামলো। রিকশা থেকে একজন অচেনা মানুষ নামলেন। তাঁর পরনে টকটকে লাল রঙের ধুতি ও জামা। ওনার সঙ্গে রয়েছে একটা ব্যাগ ও একটা তানপুরা। আমি তো এই রকম লাল রঙের পোষাক পরা মানুষ আগে দেখিনি। যথারীতি খুব ভয় পেয়ে গেলাম ও বাড়ির ভিতরে গিয়ে বললাম, তোমরা শিগগির এসো। দ্যাখো আমাদের বাড়িতে একটা কাপালিক এসেছে। আমার ঠাকুরমা তাড়াতাড়ি বাইরে এলেন ও বলে উঠলেন, কাপালিক কোথায়! এ তো আমাদের স্মরজিৎ! ওনার নাম স্মরজিৎ কাঞ্জিলাল। উনি সংসার ছেড়ে সন্ন্যাস নিয়েছিলেন এবং উনি স্বামী সচ্চিদানন্দ নামে পরিচিত ছিলেন।

বেশ মজার ব্যাপার তো?

(হেসে উত্তর দিলেন) বাবা অফিস থেকে ফেরার পরে ওনাদের মধ্যে আমার গান শেখার বিষয়ে কথা হলো। সব শুনে উনি বললেন যে গান শেখানোর দায়িত্ব উনি নেবেন। কিন্তু হারমোনিয়াম কেন? বাক্সবন্দি গান বাজনা চলবে না। প্রথমেই উনি ও বাবা হারমোনিয়াম বিক্রি করে তানপুরা কিনে আনলেন। সেই প্রথম তানপুরা নামটা শুনলাম ও স্বচক্ষে দেখলাম। এর আগে আমি তানপুরার ত-ও জানতাম না। শুরু হলো তানপুরায় সরগম শিক্ষা। প্রথম প্রথম তানপুরায় গান গাইতে অসুবিধা হতো বৈকি! কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে তানপুরায় অভ্যস্ত হয়ে পড়লাম। এভাবেই শিক্ষাগ্রহণ পর্ব চলছিল। কিন্তু দাদুর মন পড়েছিল সেই আসামে। উনি সেখানে ফেরার জন্য একটু অধীর হয়ে উঠছিলেন। হয়তো সেই কারণেই একদিন বাবাকে বললেন, আমাকে নিয়ে উনি বর্ধমান যেতে চান। সেইসময় পণ্ডিত ধ্রুবতারা যোশী বর্ধমান থাকতেন। আমাকে নিয়ে দাদু যোশী-জির বাড়ি গেলেন। সেদিন ওখানে উপস্থিত ছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও আমার পরবর্তী সংগীতগুরু প্রশান্ত দাশগুপ্ত। ওখানে সবার সামনে আমাকে গান গাইতে হলো। তখন এতটাই ছোটো ছিলাম যে ঠিক না ভুল কী গিয়েছিলাম জানি না। তখন প্রশান্তবাবু দিল্লির নিবাস ছেড়ে কলকাতায় যতীন দাস রোডে বসবাস করছেন। দাদু প্রশান্তবাবুকে আমার সংগীত শিক্ষার দায়িত্ব দিলেন। সেই থেকে ওনার মৃত্যুকাল অবধি আমি ওনার কাছে সংগীতের পাঠ নিয়েছি। কয়েক বছর পরে আমি কলকাতার সংগীত রিসার্চ একাডেমিতে যোগদান করলেও প্রশান্ত দাশগুপ্তের কাছে নিয়মিত গান শিখতে গিয়েছি। প্রশান্তবাবুর মৃত্যুর পরে আমি শ্যামচৌরাশি ঘরানার বিখ্যাত উস্তাদ সালামত আলি খাঁ সাহেবের ছাত্র শ্রদ্ধেয় শ্রী ভীষ্মদেব ভট্টাচার্য মহাশয়ের কাছে তালিম নিয়েছি।

আপনি কি কখনো সংগীতের পরীক্ষা দিয়েছেন?

হ্যাঁ। আমি ১৯৭২সালে এলাহাবাদের প্রয়াগ সংগীত সমিতি-র সর্বভারতীয় ‘সংগীত প্রবীণ’ (এম মিউজ এর সমতুল্য) দিয়েছিলাম এবং সর্বভারতীয় স্তরে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলাম।

এছাড়া অন্য কোনো পরীক্ষা বা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন?

আমি ১৯৭৩ সালে আকাশবাণী আয়োজিত All india classical music competition এ অংশগ্রহণ করেছিলাম। সেখানেও আমি সর্বভারতীয় স্তরে প্রথম স্থান লাভ করে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার লাভ করেছিলাম।

এই প্রতিযোগিতার বিষয়ে একটু বিশদে বলবেন?

আকাশবাণী আয়োজিত এই প্রতিযোগিতা প্রতি বছর হতো। কণ্ঠ ও যন্ত্রসংগীত এই দুই বিষয়েই। ভারতবর্ষের যেকোনো রাজ্যের থেকে প্রতিযোগীরা এতে অংশগ্রহণ করে থাকে। প্রতিযোগীদের জন্য তাদের স্থানীয় আকাশবাণী কেন্দ্রে (গান বা বাজনা) রেকর্ডিং এর ব্যবস্থা থাকে। এই রেকর্ডেড পারফরম্যান্সগুলি দিল্লিতে পাঠানো হয়। ওখানে বিচারকদের নিয়ে একটা বোর্ড গঠিত হয়। রেকর্ডিং শুনে বিচারকেরা যোগ্যতা নির্ধারণ করেন।

আপনি তৎকালীন রাষ্ট্রপতি’ শ্রদ্ধেয় শ্রী ভি ভি গিরি মহাশয়ের হাত থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন?

না। সেবার পশ্চিমবঙ্গ থেকে আমি একাই পুরস্কার লাভ করেছিলাম। তাই আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে একা আমাকে দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে পুরস্কার গ্রহণের অনুমোদন দেয়নি। পরে আমার পুরস্কার আমি আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে গ্রহণ করেছিলাম। শ্রদ্ধেয় সংগীত ব্যক্তিত্ব শ্রী রাইচাঁদ বড়াল মহাশয় সেই পুরস্কার আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু উনি পুরস্কারসহ আমার সাথে ছবি তুলতে রাজি হননি।

এই পুরস্কারের সূত্র ধরে নাকি আকাশবাণীতে গান গাইবার সুযোগ ঘটে? পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাকি আর অডিশন দেওয়ার প্রয়োজন হয় না?

না। এটা সঠিক নয়। পুরস্কারপ্রাপ্তদের তাঁদের রাজ্যের আকাশবাণী কেন্দ্র তিনটি প্রোগ্রাম করার সুযোগ দেয়। কিন্তু আকাশবাণীর গ্রেডেড আর্টিস্ট হতে গেলে তাঁকে অবশ্যই অডিশন দিতে হবে। তবে আমি এই সুযোগটা পাইনি। কারণ আমি প্রতিযোগিতার আগে অডিশন দিয়েছিলাম এবং প্রতিযোগিতার ফলাফল বেরোনোর আগেই আমি আকাশবাণীতে উচ্চাঙ্গ সংগীতে নির্বাচিত হয়েছিলাম।

সেই সময় তো আকাশবাণীতে বিখ্যাত রথী মহারথীদের উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল। এমন কোনো বিখ্যাত মানুষের কথা মনে পড়ে যাঁদের সঙ্গতের সঙ্গে আপনি গান গেয়েছিলেন?

হ্যাঁ। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল বিখ্যাত তবলাবাদক উস্তাদ কেরামতুল্লা খাঁ ও পণ্ডিত শ্যামল বোসের সঙ্গে ও বিখ্যাত সারেঙ্গিবাদক উস্তাদ সাগিরুদ্দিন খাঁ সাহেবের বাজনার সাথে গান গাওয়ার। (একটু হেসে বললেন) কেরামত খাঁ সাহেবের আফিম নেওয়ার অভ্যাস ছিল। উনি অনেকসময় বাজাতে বসে ঝিমোতেন। তখন পাশ থেকে অন্য কেউ ওনাকে জাগিয়ে দিতেন।

এর পরবর্তীতে পন্ডিত অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, সমীর চট্টোপাধ্যায়, গোবিন্দ বসু, আনন্দ গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়, সমর সাহা, দুলাল নট্ট, উস্তাদ সাব্বির খাঁ ও হারমোনিয়ামে পণ্ডিত সোহনলাল শর্মা সারেঙ্গিতে রোশন আলী প্রমুখের সাথে অনুষ্ঠান করেছি। আরো অনেকে আছেন, এই মুহুর্তে তাঁদের নাম মনে পড়ছে না।

১৯৭৭ সালে কলকাতায় আই টি সি সংগীত রিসার্চ একাডেমি স্থাপিত হয়। এঁদের একটা প্রয়াস ছিল প্রাচীন গুরু-শিষ্য পরম্পরার ধারা পুনরায় শুরু করার। এই উদ্দেশ্যে সারা ভারতের স্ব স্ব ক্ষেত্রে যাঁরা বিখ্যাত তেমন সব দিকপাল শিল্পীদের তাঁরা নিযুক্ত করেছিলেন গুরু রূপে। এবং স্কলার হিসাবে উপযুক্ত প্রার্থীদের নির্বাচন করা হচ্ছিল। আপনি কীভাবে এই সংস্থার সাথে যুক্ত হলেন? এর জন্য কি আপনাকে অডিশন দিতে হয়েছিল?

আমি সংগীত রিসার্চ একাডেমির বিষয়ে কিছু জানতাম না। আমাকে শ্রীমতি মালবিকা কান্নন স্মরজিৎ কাঞ্জিলালের নাতনি বলে চিনতেন ও স্নেহ করতেন কারণ আমার দাদু ও ওনার বাবা একই সাথে সংগীত শিক্ষা করেছেন। এছাড়া এ টি কান্নন সাহেবও আমাকে খুব স্নেহ করতেন। একদিন আমাকে কান্নন ডেকে বললেন ওনাদের বকুলবাগান রোডের বাড়িতে যেতে হবে এবং গান শোনাতে হবে। কলকাতায় সংগীত রিসার্চ একাডেমি স্থাপিত হয়েছে। ওখানে কিছু স্কলার নিয়োগ করা হবে। আমি চাই তুমি ওখানে যোগদান করো। সেই কারণে আমার বাড়িতে গানের আসরে তুমি সবাইকে গান শোনাবে। তো সেইমতো ওনাদের বকুলবাগান রোডের বাড়িতে গিয়েছি। গান গাইতে বসে দেখি শ্রোতার আসনে রয়েছেন কিচলু সাহেব, উস্তাদ নিসার হুসেন খাঁ, উস্তাদ ইশতিয়াক হুসেন খাঁ, উস্তাদ লতাফৎ হুসেন খাঁ, বিদুষী হীরাবাঈ বরদেকার, দীপালি নাগ, পন্ডিত ভি জি যোগ ইত্যাদি সংগীত ব্যক্তিত্ব। যাই হোক, গানের শেষে কান্নন সাহেব সবার কাছে জানতে চাইলেন, এই মেয়েটির গান কেমন লাগলো? সবাই বললেন যে তাঁদের খুব ভালো লেগেছে। হীরাবাঈ বরদেকার বললেন, এই মেয়েটি join করলে আমি ওর দায়িত্ব নেবো। তখন মালবিকা কান্নন আমাকে বললেন, দ্যাখ! তোর গানের যে ধারা তার সাথে হীরাজির গানের ধারার অনেক তফাৎ। ওঁদের গায়ন শৈলী তোর স্যুট করবে না। তুই বরং ইশতিয়াক হুসেন খাঁ-র কাছে তালিম নে। ওদের রামপুর-সহস্বান ঘরানার গায়কীর সাথে তোদের ঘরের গায়কীর কিছুটা মিল আছে। আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি সংগীত রিসার্চ একাডেমিতে যোগদান করবো? তখন এ টি কান্নন সাহেব বললেন, অবশ্যই যোগদান করবে। আমার সংগীত গুরু প্রশান্ত দাশগুপ্তও বললেন, যখন এ টি কান্নন বলছেন তখন তুমি ওখানে যোগদান করো।

আমি ইশতিয়াক হুসেন খাঁ সাহেবের তত্বাবধানে ওখানে শিক্ষা শুরু করলাম।

ওখানে সংগীত শিক্ষার ধারা কেমন ছিল? এক একজনকে আলাদা ভাবে শেখানো হতো? নাকি গ্রুপ করে শেখানো হতো?

ওখানে আমাদের ক্লাসের একটা নির্দিষ্ট সময় থাকতো। সেই সময়ে আমাদের উস্তাদজির কাছে যেতে হতো এবং একাডেমিতে নিযুক্ত একজন তবলাবাদক কে নিয়ে যেতে হতো। অধিকাংশ সময় পন্ডিত আনন্দ গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায় থাকতেন তবলা সঙ্গতে। না, গ্রুপে গান শেখানো হতো না। স্বর্গীয় পন্ডিত অরুণ ভাদুড়ী ও আমি – এই দুজন উস্তাদজির কাছে গান শিখতাম। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ছিলেন শ্রী টি এন সিং। উনি বেনারসের মানুষ ছিলেন এবং খুবই সংগীত প্রিয় ছিলেন। কলকাতা রাজভবনে সেবার উস্তাদজির গানের আসর বসেছিল। উস্তাদজি অরুণবাবু ও আমাকে সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন গাইবার জন্য। তবে উস্তাদজি বেশিদিন কলকাতায় থাকেন নি। উনি চলে যাবার পরে উস্তাদ লতাফৎ হুসেন খাঁ আমাকে ডেকে নেন তালিম দেওয়ার জন্য। উনি আগ্রা-আত্রৌলি ঘরানার গায়ক ছিলেন। তবে আমার কাছে ওনার গায়ণশৈলী অতটা আকর্ষণীয় লাগতো না। ইশতিয়াক হুসেন খাঁ সাহেবের তুলনায় লতাফৎ হুসেন খাঁ-এর গানে মাধুর্য্য কম ছিল। আর একটা কথা বলতে ভুলে গেছি, আপ্পাজির (বিদূষী গিরিজা দেবী) মেয়ে আমাদের হিন্দি পড়া, লেখা ও কথা বলার ট্রেনিং দিতো।

সংগীত রিসার্চ একাডেমীতে নাকি প্রায়ই সংগীত সম্মেলন হতো? এ কথা কি সত্যি?

হ্যাঁ। শুধু বহিরাগত শিল্পীদের নয়, যাঁরা স্কলার রূপে যোগদান করেছিলেন তাঁদেরও প্রায়ই স্টেজ পারফরম্যান্স করতে হতো। একবার একটা অনুষ্ঠান হয়েছিল যেটার ভাবনায় খুব অভিনবত্ব ছিল। এই অনুষ্ঠানটির পরিকল্পনায় ছিলেন শ্রদ্ধেয় পন্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ ও বিদূষী দীপালি নাগ।

রাজ দরবারে গানের আসর বসেছে। সেখানে এক বাঈজি ও সভাগায়ক গান গাইছেন। রাজাও গান গাইছেন। রাজা হয়েছিলেন পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী ও ওনার স্ত্রী হয়েছিলেন রানী। তখন সদ্য ওনাদের বিয়ে হয়েছে। আমি হয়েছিলাম বাঈজি। অরুণ ভাদুড়ী সভাগায়ক। এছাড়াও বকুল চট্টোপাধ্যায় ছিলেন গানে। আরো অনেকেই গান গেয়েছিলেন। অনুষ্ঠানটি নিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আলোচনা হয়েছিল।

আর একটা ঘটনা বলি। সেবারে জয়পুর-আত্রৌলী ঘরানার বিখ্যাত গায়িকা বিদূষী কিশোরী আমনকর এসেছেন সংগীত রিসার্চ একাডেমিতে। আমরা যাঁরা স্কলার ছিলাম সবাই মিলে ওনার খিদমত করতাম। হাত পা টিপে দিতাম। উদ্দেশ্য একটাই। সামনে বসে ওনার গান শুনবো। উনি অত্যন্ত মুডি আর্টিস্ট ছিলেন। সহজে গান গাইতে চাইতেন না। তো সেবার উনি গান শোনাতে রাজি হয়েছিলেন। সারা কলকাতার বিখ্যাত সব মানুষ এসেছিলেন ওনার গান শুনতে। আমার মনে পড়ে সিনেমার জগতের শ্রদ্ধেয় সত্যজিৎ রায় ও অপর্ণা সেনও সেদিন এসেছিলেন।

একটা সময় আপনার ও লীনা মুখোপাধ্যায়ের যুগলবন্দি খেয়াল গানের কথা সবার মুখে মুখে শোনা যেত। এবিষয়ে কিছু বলুন। আপনাদের আগে আর কোনো মহিলা শিল্পীরা কি যুগলবন্দি খেয়াল গেয়েছেন?

হ্যাঁ। একটা সময়ে আমাদের যুগলবন্দি খেয়াল বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। যুগলবন্দি খেয়াল গাইবার প্রধান শর্ত হল দু-জনের মধ্যে বোঝাপড়া। দু-জন শিল্পীকেই বুঝতে হবে কোথায় ধরতে হবে, কোথায় ছাড়তে হবে। ব্যক্তিগত নৈপুণ্য দেখানোর জন্য যুগলবন্দি গানে একে অপরকে ছাপিয়ে যাওয়া অনুচিত। এছাড়াও সময় বুঝে শিল্পীদের নিজেদের দক্ষতার জায়গা দেখানো যেতে পারে।

সেইসময় মিডিয়ার এমন রমরমা ব্যাপার ছিল না। সেক্ষেত্রে অন্য কেউ গেয়েছেন কিনা আমার সঠিক জানা নেই। তবে পশ্চিমবঙ্গ ও বাইরে আমরা অনেক অনুষ্ঠান করেছি।

উচ্চাঙ্গ সংগীত নিয়ে আপনার কাছে অনেক কিছু শুনলাম। আপনার কাছে এত কথা রয়েছে যে আরো কয়েক ঘন্টা কেটে যাবে। কিন্তু আমাদের সময় তো নির্দিষ্ট করা আছে, তাই এবারে বরং আমরা নজরুলগীতি নিয়ে আলোচনা শুরু করি। আপনি নজরুলগীতি-র প্রতি আকৃষ্ট হলেন কীভাবে?

আমার নজরুলগীতি শিক্ষার ব্যাপারে একটা মজার ঘটনা আছে। সেটা পরে বলছি।

আমি কিন্তু শুধুই উচ্চাঙ্গ সংগীত শিখেছি ও তাই নিয়েই থাকতে ভালোবাসতাম। কিন্তু শুধুমাত্র উচ্চাঙ্গ সংগীত গাইলে তো চলবে না। আর অধিকাংশ নজরুলগীতি যেহেতু রাগভিত্তিক তাই আমার এই ধরণের গানের প্রতি একটা ভালো লাগা কাজ করতো। আমাদের বাড়ির কাছেই আমার এক দাদা থাকতো। সে ছিল নজরুলগীতির ভক্ত। ও মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া নজরুলগীতির রেকর্ড কিনে আনতো আর আমাকে খবর দিতো শুনতে যাওয়ার জন্য। আমি শুনে শুনে সেই গানগুলি কণ্ঠে ধারণ করার চেষ্টা করতাম। বারাসাতেই আমার এক বন্ধু ছিল – অনুপ রায়। ও ভালো তবলা বাজাতো এবং আমরা একসাথে গান বাজনা করতাম। ও যেত রাধাকান্ত নন্দীর তবলাবাদনকে অনুসরণ করার জন্য। আর আমি শুনতাম মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের গায়কী। কারণ তখন নজরুলগীতির জগতে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় এক উজ্জ্বল নাম। ওনার কাকা শ্রী সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায় ছিলেন কাজী সাহেবের শিষ্য এবং যতদিন কাজী সাহেব সুস্থ ছিলেন ততদিন অবধি উনি কাজী সাহেবের সাথে যুক্ত ছিলেন।

এর মধ্যে বারাসাত Toll Tax দফতর থেকে এক প্রভাতী সংগীতের আসরের আয়োজন করেছিলেন বারাসাতের বিজয়া সিনেমা হলে। সেখানে আমাকে গাইতে বলা হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ ছিল মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়-এর গান সাথে রাধাকান্ত নন্দী-র তবলাবাদন। আমি গান গাইছি এমন সময় ওনারা দু’জন হলে প্রবেশ করলেন এবং সামনের সারিতে বসে আমার গান শুনলেন। অনুষ্ঠান হয়ে যাবার পরে উদ্যোক্তাদের একজন এসে আমায় বললেন, আপনাকে গ্রীনরুমে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও রাধাকান্ত নন্দী ডাকছেন। শুনে আমি তো ভয়ে অস্থির। কী জানি, বোধহয় ভুলভাল গান গেয়েছি। তাই বোধহয় আমাকে ডাকছেন। তো গিয়ে আমি দুজনকে প্রণাম করলাম। দেখি মানবেন্দ্রবাবু হাসছেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি কি শুধুই নজরুলগীতি গাই, নাকি অন্য গানও গেয়ে থাকি। আমি জানালাম আমি শুধুমাত্র উচ্চাঙ্গ সংগীত শিখি ও গেয়ে থাকি। এইসব গান আমি আপনার রেকর্ড শুনে তোলার চেষ্টা করেছি। ওনাদের সাথে ছিলেন বারাসতেরই একজন মানুষ -অনন্ত চ্যাটার্জী। রাধাকান্ত নন্দী ওনাকে বললেন, এই মেয়েটাকে চেনো? উনি বললেন, নাম শুনেছি তবে চিনিনা। তখন রাধাকান্ত নন্দী বললেন, একটু খোঁজ নাও। দেখি এর জন্য কী করতে পারি।
এর কয়েকদিন পরের ঘটনা। আমাদের বাড়ি একদিন হঠাৎ করে চলে এলেন রাধাকান্ত নন্দী সাথে ছিলেন নারায়ণ চৌধুরী ও অনন্ত চ্যাটার্জী। সবাইকে আবার গান শোনাতে হলো। এরপরে রাধুবাবু বাবাকে বললেন, আপনি কি মেয়েকে নজরুলগীতি শেখাতে চান? তাহলে আমি ওর গান শেখার ব্যবস্থা করে দেবো। বাবা বললেন, ও যদি শিখতে চায় তবে আমার আপত্তি থাকবে কেন?

এরপরে আমি নজরুলগীতি শেখা শুরু করি শ্রদ্ধেয় শ্রী বিমান মুখোপাধ্যায়-এর কাছে। পরবর্তীতে পন্ডিত শ্রী সুকুমার মিত্রের কাছে শিখেছি এবং উনি যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন ওনার কাছে শিখেছি। এরপর আকাশবাণী কলকাতায় নজরুলগীতিতে অডিশন পাশ করলাম। সেই সূত্র ধরে দূরদর্শন এ অনুষ্ঠান করার সুযোগ পেলাম। ১৯৭৮ সালে মেগাফোন কোম্পানি থেকে প্রথম নজরুলগীতির চারটে গানের একটা E.P. রেকর্ড বেরোলো। এরপরে পলিডোর কোম্পানি (পরবর্তীতে মিউজিক ইন্ডিয়া) থেকে আরো একটা E.P. রেকর্ড বের হয়। এর পরে ইনরেকো কোম্পানি থেকে দুটো লং প্লেয়িং রেকর্ড বের হয়। তাতেও আমার গান ছিল। এরপরে এলো ক্যাসেটের যুগ। প্রথম ক্যাসেটটি প্রকাশিত হয়েছিল মেগাফোন কোম্পানি থেকে ও পরেরটা কিরণ কোম্পানি থেকে। তখন থেকেই নজরুলগীতি-র নিয়ে মানুষের আগ্রহ কমতে শুরু করেছিল। নজরুলগীতি-র সুর নিয়ে তখন থেকে একটা চাপান-উতোর শুরু হয়েছিল। এই শুদ্ধ সুর ও বিকৃত সুরের দোটানায় পড়ে আমি আর গান রেকর্ড করতে আগ্রহী হই নি।

নজরুলগীতি নিয়ে এই যে অভিযোগ এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ নজরুলের গানের শুদ্ধতা নিয়ে যে কাজ করছেন সে সম্পর্কে কিছু বলবেন?

অবশ্যই এটা খুব ভালো উদ্যোগ। একজন কবির গান ভিন্ন ভিন্ন সুরে কেন গাওয়া হবে? এ প্রশ্ন তো আমাদেরও? ওঁরা কাজী সাহেব সুস্থ থাকা অবস্থায় (অর্থাৎ ১৯৪২ সাল অবধি) রেকর্ড হওয়া বিভিন্ন গান সংগ্রহ করে সেই সব গানের স্বরলিপি করছেন এবং সাথে গানের শিল্পীর নাম, রেকর্ড নং ও কোন কোম্পানি থেকে কবে প্রকাশিত হয়েছিল সেইসব তথ্য উল্লেখ করছেন। কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন মনে জাগে। কাজী সাহেবের জীবদ্দশায় আরো অনেক গান সৃষ্টি হয়েছিল যেগুলি রেকর্ড করা হয়নি। সেইসব গানের ক্ষেত্রে কী সিদ্ধান্ত হবে? বহু প্রবীণ শিল্পীরা সেসব গান পরবর্তীতে গেয়েছেন। যেমন শ্রী ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্র, শ্রী সুকুমার মিত্র, শ্রীমতি সুপ্রভা সরকার। এঁরা নিশ্চয় বিকৃত সুরে গান গান নি। কাজেই এই ব্যাপারে একটা মস্ত সমস্যা রয়েছে বলে আমি মনে করি।

এবারে একটা অন্য প্রসঙ্গে আসি। আপনি দীর্ঘদিন ধরে গান শেখাচ্ছেন। আগের ছাত্র ছাত্রীদের সাথে বর্তমান প্রজন্মের ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে কোনো ফারাক চোখে পড়ছে কি?

অবশ্যই। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এখনকার প্রজন্ম অনেক বেশি কেরিয়ার সচেতন। তারা কেউ তানপুরার সাথে কন্ঠ চর্চায় আগ্রহী নয়। এমনকি ভালো করে পালটা বা অলংকার চর্চার আগেই গান শেখার জন্য ব্যগ্র। সঠিকভাবে কন্ঠ চর্চা বা সঠিক স্বরস্থান সম্পর্কে ধারণা হলে তবেই গান সুন্দর স্বাভাবিক ভাবে গান কণ্ঠে ধারণ করা সম্ভব— এই ধ্রুবসত্য বোঝানো খুব কঠিন। এছাড়াও উচ্চাঙ্গ সংগীত শেখার ক্ষেত্রে অনেকেরই অনীহা রয়েছে।

গান শেখার ক্ষেত্রে কেন এমন অবস্থা? আপনার কী মনে হয়?

আমার মনে হয় এক্ষেত্রে টেলিভিশনের রিয়েলিটি শো অনেকাংশে দায়ী। এই প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা ধারণা করে নিয়েছে রিয়েলিটি শো তে গান করতে পারলে যেন মোক্ষ লাভ করা হয়ে হবে। ওখানে গান গাইতে গেলেও যে শিক্ষার প্রয়োজন সেটা বুঝতে চায় না। আর এখন তো ইউ টিউব সবার সংগীতগুরুর ভূমিকা নিয়ে নিয়েছে।

আপনি কি তবে আগামী দিনের গানের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী নন?

একেবারেই নয়। অন্ততঃ উচ্চাঙ্গ সংগীতের ক্ষেত্রে। উচ্চাঙ্গ সংগীত হলো আসল ভিত্তি যার উপর নির্ভর করে সংগীতের পরবর্তী ধাপগুলিতে আরোহণ করা যায়। যদি ভিত নড়বড়ে হয়, তার উপরে কি প্রাসাদ নির্মাণ সম্ভব? বাংলা গানেরও সেই অবস্থা! আসলে রুচি এখন নিম্নগামী। বিগত দশ/পনেরো বছরে এমন কোনো গান সৃষ্টি হয়েছে কি যা আরো পঞ্চাশ বছর পরে মানুষ শুনবেন? এখন নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রীর মতো গানেরও তেমন অবস্থা হয়েছে। কিছুদিন পরেই সেটা বাতিলের দলে চলে যাচ্ছে। শাশ্বত বলে আর কিছু থাকছে না।

Facebook Comments

পছন্দের বই