লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গল্প

অলোকপর্ণা

মেহিকো

সবই ঠিক ছিল, কিন্তু কুন্তলা অদিতিকে মরে যেতে দেখল ভোরবেলা। সম্ভবত অতিরিক্ত মাদকসেবনের ফলে চোখের সামনে মুখে গ্যাজলা তুলে সে নিথর হয়ে গেল, অথচ কুন্তলার ঘুম ভাঙল না। বেলা ন-টা নাগাদ চোখ খুলে সে তার পায়ের পাতার দিকে তাকিয়ে থাকল চুপ করে। মনে হল, পাতাগুলো দেহের আন্দাজে একটু বেশিই বড়ো। তবে কি আরেকটু লম্বা হওয়ার কথা ছিল তার? সময়ের আগে মাসিক হয়ে না গেলে কি আরও ইঞ্চি তিন-চার লম্বা হতে পারত সে? তখনই মনে পড়ল আজকে তার ঘুমের মধ্যে অদিতি মরে গেছে।

সে ভেবে রাখল দুপুরে অদিতিকে জিজ্ঞেস করতে হবে সে কখনো মাদক সেবন করেছে কি না।

অদিতি আর কুন্তলা এখনও একে-অপরকে প্রিয় পাখি, ফুল, ফল, প্রিয় ঋতু ইত্যাদি ইত্যাদি মারফত চিনছে।

এ বড়োই পেলব পর্যায়।

হাওয়াশহর ছেড়ে কলকাতা ফেরার বছর দুয়েক পর কুন্তলার উপরের বারান্দায় এলে বাড়ির সামনের উঠোন বাঁধানোর কাজ চোখে পড়ে। জনা তিনেক মিস্ত্রি এটা সেটায় ব্যস্ত। মেঝে পিটিয়ে সমান করছে যে-জন তাঁর গলায় তুলসির মালা। চকিতে দীপাকে মনে পড়ে যায় তার। কেবল তুলসির মালা বলে নয়, আজকাল সমস্ত অলংকার, সমস্ত রঙিন ফুলে তার দীপাকে মনে পড়ে। লোকটা মেঝে পেটাতে পেটাতে মাঝে মাঝে চুপ করে আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। কী ভাবছে তা আন্দাজ করার চেষ্টা করে কুন্তলা। যে-দৃষ্টি সে রচনা করেছে, তাতে নিকট নয় বরং সুদূরের আঁচ আছে। বিগত সময়ের কথা সে ভাবছে হয়তো শারদীয় রোদে মাটি পেটানোর কাজের অবকাশে। লোকটাকে তার ভালো লেগে যায়। সে তার নাম দেয় কৃষ্ণ।

আজ আকাশ বাতাস চমৎকার। শুধু অদিতির মরে যাওয়াটুকু বাদ দিতে পারলে সবকিছু খাসা।

এইসব রোদের কথা, আলোর কথা, হাওয়ার কথা তার দীপাকে জানাতে ইচ্ছে করে, অথবা সুমনকে, অথবা তুলিকেও। এইসব রোদ, আলো, আকাশ ছবিতে মুড়ে পাঠিয়ে দিতে চায় সে ওদের নাগালে।

প্রাতঃরাশ সেরে বারান্দায় এসে কুন্তলা দেখতে পেল কৃষ্ণ হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে ফলবতী শীর্ণ পেঁপে গাছের সামনে। উঁকি দিলে শিশুপেঁপেকে ঝুলন্ত দেখা যাবে। আজ পেঁপে গাছ কাটা পড়বে এমনটাই নির্ধারিত হয়েছে। গোটা উঠোন বাঁধাতে গেলে তা অনিবার্য। দূর থেকে পেঁপে গাছের কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাওয়া কৃষ্ণকে দেখে সে চুপ করে। একটু পরে কৃষ্ণ দাঁ তুলে নিলে অকুস্থল থেকে সরে আসে কুন্তলা। পালিয়ে আসে। তার আর ক্ষমা চাওয়া হয় না। নিজেকে ক্ষমার অযোগ্য বলে মনে করে সে আর দিনের আলো অল্প নিভে যায়।

অদিতির সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার যাবতীয় উদ্যমও উবে যায় কীভাবে যেন। ভয় করে, যদি ফের একঘেয়ে হয়ে ওঠে শহরটা? তার তো আর পালাবার পথ নেই!

তবু জোর করে তৈরি কুন্তলা হয়। নিজেকে সাজায় কাজলে। মেট্রোয় উঠে কানে গান ভরে দেয়। গানে গানে চোখে আলো জ্বালাতে চেষ্টা করে, মনে আলো জ্বালাতে চেষ্টা করে। লড়াই করে বিস্মৃতির সঙ্গে, লড়াই করে অন্ধকার সোঁদা কালো পাথরের সহিত যা সে সিসিফাস হয়ে ঠেকিয়ে রেখেছে কোনোমতে।

বেলগাছিয়া যায় আর তার দীপাকে মনে পড়ে। আজকাল যত্রতত্র শব্দে শব্দে দীপা। কুন্তলা সংযত হয়।

অদিতির মন আজ আগের থেকে ভালো আছে। সে অনেক কিছু বলছে ব্যক্তিগত সপ্তাহ সম্পর্কে। কুন্তলা শুনছে মন দিয়ে, ভুলেও যাচ্ছে কিছু কিছু। খেয়ালবশত অদিতির হাত সে নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে।

কুন্তলা কিছু অনুভব করে না। মনে মনে সতর্ক হয়। অদিতির আঙুলের ফাঁক দিয়ে নিজের আঙুল গলিয়ে দেয়। একফোঁটা আঠা নেই তাদের ছোঁয়ায়। হাত আলগোছে ছেড়ে দেয় সে। আলো আরও নিভে আসে।

অদিতি বলে চলে শামুক আর ব্যাঙের মাংসের কথা। হরিণ, কচ্ছপ ইত্যাদির কথাও প্রসঙ্গে এসে পড়ে। সে চুপ করে অদিতিকে দেখে, মনে পড়ে গত সপ্তাহে তারা একে-অপরকে একটি চুম্বন উপহার দিয়েছিল। অথচ আজ কোথাও কোনো আঠা নেই। অদিতির সঙ্গে মিউজিয়ামে যায় কুন্তলা। অদিতির পাশে মাথা নীচু করে হাঁটে। মনে পড়ে, তারা একদিন একটা মাঠে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল পাশাপাশি। “এই তো সেদিন অদিতি…” তার ইচ্ছে হয় বলে ওঠে, “এই তো সকালেও আলো ছিল!”

“কী বলবি বলছিলি?”

“আজ সকালে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছি”

“কী স্বপ্ন?”

“দেখলাম তুই মরে গেলি চোখের সামনে”

“ও আচ্ছা…”

“তুই কখনো ড্রাগ নিয়েছিস?”

“Never, I hate it”

“অদিতি,”

“বল!”

“I am not feeling anything”

“মানে?”

“মানে, স্বপ্নটা দেখার পরেও আমার ঘুম ভাঙেনি, এমনকী ঘুম থেকে উঠেও যখন কথাটা মনে পড়ল আমি চুপ করে বসে রইলাম, দুঃখ না, ভয় না, কিছুই হল না ভিতরে, am I getting bored again?”

অদিতি আর কুন্তলা চুপ করে দক্ষিণ কলকাতার উপকণ্ঠে থমকে থাকে।

“কী হবে তুই বোর হয়ে গেলে?”

“আমি জানি না। আমার হাতে তো আর কোনো অপশন নেই, আমি সব ছেড়ে কলকাতা ফিরে এসেছি। এখানেও যদি এমন হয়, আমার যাওয়ার জায়গা থাকবে না। আমি কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছি অদিতি। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।”

“বোর হয়ে গেলে অন্য কোথাও যাবি, তোর তো সেই সুযোগ আছে!”

অদিতি সব সমস্যার সহজ সমাধান করে দেয়। কুন্তলা অদিতির হাত ধরে উঠতে পারে না আর।

উঁচু থেকে সে শহরটাকে দেখে, দূর থেকে দেখে। কখনো কারও বেশি কাছে আসতে নেই, এ-কথা শহরের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আলো আরও কিছুটা নিভে যায়।

আলগোছে অদিতির গাল টিপে দেয় কুন্তলা, তার কাঁধে মাসাজ করে, গাড়ি প্রায় তার বাড়ির সামনে এসে পড়েছে।

অদিতিকে নামিয়ে দিয়ে ফেরার সময় বৃষ্টি নামে বেশ জোরে। গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে থাকে সে। ছাতা খোলে না। মনে পড়ে দীপার বাড়ির ছাদের গাছগুলির কথা। তারাও এখন ভিজছে।

“What if I were a tree?”

গাছের কোথাও যাওয়ার যন্ত্রণা নেই, কোথাও পালানোর অভীপ্সা নেই। কুন্তলাদের দু-খানি পা আছে। আর আছে একটা অসহ্য মস্তিষ্ক।

সুমনের সঙ্গে কাল দেখা করার কথা তার আজ এই মুহূর্তে অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে।

কুন্তলার মাথার উপর দিয়ে উড়ে একটা ছোটো এরোপ্লেন উড়ে মেঘের ভিতর আত্মগোপন করল। অন্তরাল থেকেও সে তার ডাক শুনতে পেল। তার মনে পড়ল, পাসপোর্টে মেহিকোর ছারপত্র ঘুমিয়ে আছে দু-মাস হল। সেইভাবে চেষ্টা করলে কি যাওয়া যেত মেহিকোয়? গিয়েই বা লাভ কী? কিছুদিন পর তো আবার কালো বল পাথর ঠেলে ঠেলে পাহাড়ের উপরে তুলতে থাকা।

কুন্তলা তুলিকে ফোন করে, জিজ্ঞেস করে, সবাই যদি এত যন্ত্রণায়, তবে মানুষ বেঁচে আছে কেন?

তুলি জানায়, আর কোনো অপশন নেই তাই। মৃত্যুটা কোনো অপশন নয়। ফোন কেটে যায়।

সিঁড়ি ভরে আছে মদের গন্ধে। অর্থাৎ সহোদরটি ঘরে ফিরেছেন। তাকে মদ্যপান সম্পর্কে সাবধান করতে কুন্তলা তার ঘরে ঢোকে।

দেখে, চোখ বুজে একটা দাঁড়ির মতো লম্বা হয়ে সে বিছানায় পড়ে আছে, তার এক হাত তার হাফপ্যান্টের ভিতর, নিশ্চুপে স্বমেহন চলছে। চুপিসারে দরজা বন্ধ করে কুন্তলা নিজের ঘরে এসে পড়ে।

কোথাও কোনো মেহিকো নেই তার জীবনে। এ-সত্য সে টের পায়।

একদিন সে সবেতেই ক্লান্ত হয়ে পড়বে। নিজেতেও। এ-কথা সে অনুভব করে সে অদিতিকে মেসেজ করে, “আমার মনে হয় না আমি আর কোনোদিন কাউকে ভালোবেসে উঠতে পারবো অদিতি। আমি ভিতরে ভিতরে বড়ো ক্লান্ত। আমার দ্বারা নতুন করে কাউকে ভালোবাসা সম্ভব নয়। আমার এক্সপায়ারি ডেট পেরিয়ে গেছে কবে আমি নিজেও টের পাইনি। আজকাল বড়ো ক্লান্ত লাগে সবকিছু। কোথাও আলো জ্বলে ওঠে না। কোথাও বিস্মিত হই না। আমার কাউকে মনে পড়ে না আর।”

কুন্তলা বুঝতে পারে অদিতি মেসেজটা দেখেছে। কিন্তু সে কোনো জবাব দেয় না।

আকাশ ভেদ করে একটা উড়োজাহাজ চলে যায়। কুন্তলা চুপ করে তার ডাক শোনে। কলকাতা থেকে সমস্ত প্লেন এখন মেহিকোতে চলে যায়। সব নদী যায় মেহিকোতে বয়ে। সমস্ত ডাক এখন মেহিকো থেকে আসে আর কুন্তলা জানে মেহিকো বলে আসলে কোথাও কোনো দেশ নেই, পৃথিবীর সকল দেশ কুন্তলা এবং সকল দেশ শ্বাসরোধকারী, সকল শহর সমান অন্ধকার।

ফোনে আলো জ্বলে উঠলে সে বোঝে অদিতি উত্তর দিয়েছে। ফোন খুলে দেখে অদিতি লিখেছে, “আমারও। আমারও।”

Facebook Comments

পছন্দের বই