লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গল্প

অরুণাভ গঙ্গোপাধ্যায়

যারা অফুরন্তভাবে মৃত

আমি মরে যাবার পর আমার ছেলে একদম কাঁদেনি। এর সঠিক কারণ আমি জানি না। তবে দুটো সম্ভাব্য কারণ আন্দাজ করতে পারি। এক, আমার ছেলে হয়তো কাঁদতেই জানে না। দুই, আমার ছেলেকে আমি ‘পাপ’ বলেছিলাম একবার। এবার যদি এক নম্বর কারণের ব্যাখ্যা দিই তাহলে বলতে হয়, ছোটোবেলা থেকে আমার ছেলে কম মারধর, কম লাথি-ঝ্যাঁটা তো খায়নি আমার কাছে, কিন্তু একবারের জন্যও ওকে চোখের জল ফেলতে দেখিনি। যত মেরেছি, যত অত্যাচার করেছি তত ভাবলেশহীন মুখে, তত যন্ত্রণাহীন মুখে দাঁড়িয়ে থেকেছে। এছাড়া, শুধু আমি নয়, অন্য লোকেও চিরকাল ওকে দেখ-মার করেছে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও কাঁদা তো দূরের কথা, এতটুকু শুকনো মুখে কোনোদিন বসে থাকতে দেখিনি আমার ছেলেকে। আর, ওর এই কোনো কিছু তোয়াক্কা না করা মনোভাবটাই আমার ভেতরে ক্রমাগত একটা জ্বালার জন্ম দিত। ফলে অত্যাচারের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিতাম আমি। যাইহোক, এবার আসি দ্বিতীয় কারণের ব্যাখ্যায়। তবে তার আগে একটা ঘটনা বলি।

একদিন অনেক রাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভাঙে আমার ছেলের আমাকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য। রোগা প্যাংলা আট বছরের একটা বাচ্চা, কিন্তু বেশ জোরে জোরে ধাক্কা দিচ্ছিল! আমার ঘুম ভেঙে যায়। আমি পাশ ফিরি। দেখি, আমার মাথার শিয়রে বসে আছে। মারওয়াড়িবাবুর বাড়ি ওভারটাইম করে, রাত বারোটায় বাড়ি ফিরে, স্নান সেরে, নাকেমুখে দুটো ভাত তরকারি গুঁজে, বোধহয় ঘণ্টাখানেক হয়েছে কি হয়নি আমি শুয়েছি, আর মরেছি। কিন্তু ওর ধাক্কা দেওয়াতে আমার কাঁচা ঘুমটা গেল চটকে, ফলে খুব স্বতঃস্ফুর্তভাবেই মুখ দিয়ে— “ধ্যার ল্যাওড়া, কী হয়েছে কী?”— বেরিয়ে এল। তখন দেখি ও আঙুল তুলে ওপর দিকে দেখাচ্ছে। ওপর দিকে মানে সিলিঙের দিকে। চোখে তখন ঘুমে শেকল পরিয়ে রেখেছে, পিচুটি ভ্যাদভ্যাদ করছে, তার ওপর ঘরে একটা জিরো পাওয়ারের নীল রঙের নাইট ল্যাম্প জ্বলছে। ফলে ওই প্রায় আধিভৌতিক পরিবেশে প্রথম চোটে কিছুই বুঝতে পারলাম না ও কী বলতে চাইছে, কিংবা কী দেখাতে চাইছে। তাই বাধ্য হয়ে বিছানায় উঠেই বসলাম। ভালো করে কচলে কচলে চোখ পরিষ্কার করলাম। তারপর হাতড়ে হাতড়ে বেড সুইচ টিপে ঘরের বড়ো আলোটা জ্বালালাম। আর দেখলাম, ঘরের অ্যাসবেস্টসের সিলিং ধরে রাখা লোহার খাঁচার একটা রডের সাথে, গতবছর পুরী থেকে কিনে আনা সুতির কটকি চাদরটা বেঁধে ফাঁস তৈরি করে, সেই ফাঁস গলায় পরে আমার বউ ঝুলছে। মুহূর্তের আপাদমস্তক চমকে ওঠায় আমি আমার ছেলেকে জড়িয়ে ধরলাম তখন। তবে ওই প্রথম। ওইই শেষ। কিন্তু ওই জড়িয়ে ধরাটা এখনও আমার শরীরে, যে-শরীর আর নেই সেই শরীরেই, যেন লেগে রয়েছে! তবে ওর ওপর আমার যা আক্রোশ, তাতে তো ওই স্পর্শ লেগে থাকার কথা নয়! যাইহোক, মুহূর্তের জড়িয়ে ধরা, মুহূর্তেই ছেড়ে দেওয়া। তারপর, একটি আত্মহত্যা পরবর্তী ঝুটঝামেলা সামলানো। চলতে থাকল। বেশ কয়েকদিন ধরে। পুলিশ তো প্রথমে আমাকে আটক করেও নিয়ে গেল! মেরে ঝুলিয়ে দিয়েছি এই সন্দেহে। পরে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট যখন বেরোল, মর্গের ডাক্তার যখন নিশ্চিত করল, যে শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই, হত্যা নয়, এটা আত্মহত্যাই, তখন হাজত থেকে ছাড়া পেলাম। কিন্তু আমার বউ কেন গলায় দড়ি দিল তা জানতে পারলাম না। আমার বউয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কেমন ছিল? সেই নিয়ে আমি আদৌ কোনোদিন ভাবিত ছিলাম না। কিন্তু আত্মহত্যা করতে পারে, এরকম জায়গায় চলে গিয়েছিল কি ব্যাপারটা? কে জানে! দু-চারদিন ভাবার পর আমি ভাবা বন্ধ করে দিলাম। ওদিকে পুলিশও দু-চারদিন পরেই হাত তুলে নিল।

এর পর বেশ কিছু মাস কেটে গেল। দুর্গাপুজো এল। আমি যে-মারওয়াড়ি ব্যবসাদারের বাড়ি বাজার সরকারের চাকরি করতাম তিনি লোক ভালো। বউ আত্মহত্যা করা স্বত্তেও, তিন দিন হাজতবাস করা স্বত্ত্বেও উনি আমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেননি, উলটে পুজোর সময় ডবল বোনাস দিলেন। বললেন— “মা তো নেহি রহি যো পূজাকে ওয়াক্ত বচ্চে কো সাজায়েগি, তুমহি উসে অচ্ছে সে কপড়ে খরিদকে দেনা”— এই বলে, খুব সুন্দর একটা খামে পুরে ক্যাশটা আমার হাতে দিলেন। ক্যাশ মাইনে, ক্যাশ বোনাস, এছাড়াও উপরি বোনাস। সেটাও ক্যাশ। চল্লিশ হাজার টাকা ক্যাশ তখন আমার পকেটে। পা আর মাটিতে পড়ছে না। কী করি? কী করা উচিত এখন এতগুলো টাকার সাথে? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মাথায় এল বউ মরে যাওয়ার পর থেকে আর কারও সাথে শোয়া হয়নি আমার। তাই যেমন ভাবা, তেমন কাজ। রেড লাইট থেকে একটা বেশ্যা তুললাম। বাড়ি নিয়ে এলাম। শুলাম। যেদিন প্রথম শুলাম সেদিনও বহু জায়গায় মণ্ডপে পেরেক পোঁতা শেষ হয়নি। সেদিন ছিল পঞ্চমী। আর সেদিন থেকে শুরু করে টানা নবমী পর্যন্ত আমি শুলাম। গোটা দুর্গাপুজোটা আমি ওই এক্সট্রা বোনাসের দশ হাজার টাকা খরচ করে একটা মেয়েছেলের শরীর ভাড়া করে আনলাম ভোগের জন্য। তারপর, সারারাত কাটানোর পর বিজয়া দশমীর দিন সকালে যখন ওই বেশ্যা ফিরে যাচ্ছে তখন হঠাৎ মনে পড়ল ছেলেটাকে এবার পুজোয় কোনো নতুন জামা-প্যান্ট কিনে দেওয়া হয়নি। তাই দুপুরে চান খাওয়া সেরে, বিকেল বিকেল বাড়ি থেকে বেরোলাম। রাস্তায় তখন সারি সারি নতুন জামা। নতুন প্যান্ট। নতুন জুতো। আনন্দ-বিসর্জনের পথে। তখন সেই সমস্ত নতুন জামা-নতুন প্যান্ট-নতুন জুতোদের পেরোতে লাগলাম আমি। ঢাকের বাদ্যি পেরোতে লাগলাম। তাসা পার্টির বাজনা পেরোতে লাগলাম। ঝকমকে আলো পেরোতে লাগলাম। আলোর তলার ছায়া পেরোতে লাগলাম। পেরোতে পেরোতে একসময় দেখতে পেলাম খুব ছোট্ট একটা জামাকাপড়ের দোকান তখনও খোলা। ফাঁকা। কোনো খদ্দের নেই। ভেতরে একজন বৃদ্ধ কর্মচারী বসে আছে কেবল। প্রতিমা নিয়ে ম্যাটাডোর বেরিয়ে যাবার পর যেভাবে প্যান্ডেলে একটা নিঃসঙ্গ প্রদীপ জ্বলে; ঠিক সেইভাবে। যাইহোক, গিয়ে উপস্থিত হলাম সেই দোকানে। তারপর বেছে বেছে খুব সস্তা দামের একজোড়া জামা-প্যান্ট কিনতে গিয়েও কিনতে না পেরে, বেশ দাম দিয়েই একটা পাজামা-পাঞ্জাবীর সেট কিনে ফেললাম। তারপর ফিরতে লাগলাম; আবার সেই ঢাকের বাদ্যি-তাসা পার্টি-আলো-ছায়া পেরোতে পেরোতে। আর ফিরতে ফিরতে হঠাৎ, ওই বেশ্যা আর আমার, একদিনের বেশ লম্বা একটা সংলাপ আমার মাথার মধ্যে ফিরে এল।

“শেষপর্যন্ত আর জানতে পারোনি না?”

সপ্তমীর দিন। রাত্রিবেলা। শোয়া পর্ব মিটলে বিরিয়ানি আর থাম্বস্‌ আপ নিয়ে খেতে বসেছি আমি আর ওই বেশ্যা। পাশের ঘরে ছেলেটাকেও এক প্যাকেট বিরিয়ানি আর এক বোতল কোল্ড ড্রিংক দিয়ে এসেছি। তবে খেয়েছে কি না দেখিনি। আমার পাড়ার রতনের দোকানে মটন বিরিয়ানিটা রাঁধে ভালো। আয়েশ করে খাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমার ভাড়া করা মেয়েছেলের প্রশ্নে খাওয়ায় ছেদ পড়ল। মুখ তুলে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম—

“কী জানতে পারার কথা বলছ?”

“তোমার বউ কেন গলায় দড়ি দিয়েছিল?”

মেজাজটা গেল খিঁচড়ে। খাওয়ার সময় এসব কথা কেন যে বলে এইসব আহাম্মক মেয়েছেলেগুলো! বললাম—

“তোমার কি খেয়ে দেয়ে কোনো কাজ নেই যে এখন এসব কথা তুলছ?”

আমার বলার মধ্যে যথেষ্ট তিক্ততা ছিল, কিন্তু দেখলাম ভবি ভোলার নয়। পাঁঠার টেংরি চিবোতে চিবোতে প্রশ্ন করেই চলল—

“জানতে ইচ্ছে হয়নি?”

“নাহ্‌”।

“কেন?”

“এমনিই”।

জোরের সাথে বললাম। কিন্তু তারপরেও সেই বেশ্যা বলে—

“আচ্ছা তুমি কি তোমার বউকে সন্দেহ করতে?”

“সন্দেহ করতে যাব কোন দুঃখে?”

“করতেই পারতে! হতেই তো পারত যে অন্য কারও সাথে ওর লটরপটর ছিল। সেখান থেকে হয়তো ব্ল্যাকমেল করছিল। তাই ভয় পেয়ে সুইসাইড করে ফেলেছে!”

“একদম ফালতু কথা বলবে না। আমার বউ মোটেও ঐরকম ছিল না!”

“বাবা! এখনও এত টান!”

কথাটা বলে, একটা বাঁকা হেসে, ঢকঢক করে গলায় খানিকটা কোল্ডড্রিংক ঢেলে দিল বেশ্যাটা। তবে এর পরেই, থাম্বস্‌ আপের বোতলটা নামিয়ে রেখে অদ্ভুত গম্ভীর গলায় বলল—

“তাহলে দায় তো তোমারই। অস্বীকার করো কোন সাহসে? মারধোর করতে না তো?”

কেন জানি না, এই কথাটা শোনার পর আমার খাওয়া থেমে গেল। মনে হল, পুলিশের পর আমি যেন দ্বিতীয়বার আটক হলাম এই মহিলার কাছে। খুব ধীরে ধীরে বললাম—
“তুমি খোঁজ নিয়ে দেখতে পারো পাড়ায়, কোনোদিন আমি আমার বউয়ের গায়ে হাত তুলেছি কি না! কোনো খারাপ ব্যবহার করেছি কি না!”

“কিন্তু ভালোবাসতে কি?”

“নাহ্‌… তা আর বাসতাম না।”

এই কথাটা এত সহজে এই বেশ্যাটাকে বলে দিলাম, অথচ কোনোদিন নিজের কাছেই বলার ধক ছিল না! এই অতি সাধারণ, শরীর বিক্রি করা মহিলা ঠিক যেন মনের ডাক্তার! কালো জল, যার বাইরে থেকে তল বোঝা যায় না, তার ভেতরে হাত চুবিয়ে পোড়খাওয়া মনোবিদের ভূমিকাতেই যেন ঘুলিয়ে দিল সে সবকিছু, আর মারল শেষে মোক্ষম ঘা—

“কিন্তু ছেলেটাকে এরকম দূরছাই করো কেন? ওর কী দোষ?”

“দোষ নেই?”

“আছে! ওর জন্মের ওপর ওর হাত ছিল বুঝি?”

এই প্রশ্নে আমি চুপ। আবার ওই মহিলা—

“আর অস্বীকার করতে পারবে যে ওর এইরকম জন্মের জন্যে তুমি তোমার বউকেই দুষতে?”

নাহ্‌! আমার বিরিয়ানি খাওয়া ঘুচল। মেয়েটা মুখ পড়তে পারে। ওর সামনে আর বেশিক্ষণ বসে থাকা যাবে না। পাঁঠার মাংসের সাথে সাথে এবার আমার ছাল চামড়া ছাড়িয়ে খেতে শুরু করবে। আমি তাই খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়লাম। তারপর আরও একটু বেশি রাতের দিকে চুক্তি অনুযায়ী যখন আমরা আর-এক প্রস্থ সংগমরত, তখন আমার বুভুক্ষু পুরুষাঙ্গ নিজের ভেতরে নিতে নিতে বেশ্যা বলে উঠল—

“তোমার ছেলে দুর্ভাগ্য জড়িয়ে জন্মেছে। ওকে পাপ বলে দাগিয়ে আর ওকে বাঁচিয়ে মেরে রেখো না।”

আমার তক্ষুনি মনে পড়ল একদিন আমার বউয়ের সঙ্গে কথা কাটাকাটির সময় আমি আমার ছেলের মুখের ওপরেই বলেছিলাম—

“সালা ঢ্যামনা কোথাকার! কোত্থেকে একটা পাপ এসে জুটেছে কপালে!”

এই বলে ওর পায়ের কাছে এক দলা থুতু ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর অনেক রাতে যখন নিজেই গেটের চাবি খুলে বাড়ি ঢুকলাম, শুনতে পেলাম বাথরুমে বসে আমার বউ গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদছে আর বলছে— “আমি আর তোকে আগলে রাখতে পারব না বাবা, কিন্তু এবার আমি নিজেকে বাঁচাব।”

প্রথমে বুঝিনি, কিন্তু পরে যখন আরও রাত্তিরে আমার ছেলের ধাক্কা খেয়ে ঘুম ভেঙে, গতবছর পুরী থেকে কিনে আনা সুতির কটকি চাদরের ফাঁসের সঙ্গে আমি আমার বউকে ঝুলতে দেখলাম, বুঝতে পারলাম আমার বউ আসলে কত ভীতু ছিল! নিজের সন্তানকে সে আর অপমানের হাত থেকে বাঁচাতে পারছে না বলে নিজেই পিঠটান দিয়ে পালাল! অবশ্য আমার বউ যে ভীতু এটা আমার, হাসপাতালে ছেলের জন্মের পর পরই নিশ্চিত হয়ে বুঝে যাওয়া উচিত ছিল। ডাক্তার যখন বলেছিল—

“আপনাদের ছেলের সেক্স ডিটেক্ট করা যাচ্ছে না।”

“তার মানে ডাক্তারবাবু?”

“ওর যৌনাঙ্গের জায়গায় ভ্যাজাইনা আর পেনিস দুটোরই হিন্ট আছে।”

কথাটা শুনে আমার বউ সাদা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ও তো ছেলের গর্ভধারিণী! ওর কি কলিজায় আরও জোর নিয়ে আসা উচিত ছিল না? উচিত কি ছিল না পক্ষীমাতার মতো তার সন্তানকে সব বিষ থেকে আগলে রাখা? আর সে মা হয়ে এ-কাজ পারল না বলেই না আমার মনে ধীরে-ধীরে ধীরে-ধীরে বিষের পাহাড় জমতে লাগল আমার ছেলের জন্য।

কিন্তু আমারও কি উচিত ছিল না এই আগলে রাখার শ্রমে আমার বউকে সাহায্য করা! কিন্তু এখন আর এসব ভেবে লাভ কী? মরে গিয়ে আত্মোপলব্ধি খুব সহজ কাজ। করতাম যদি বেঁচে থাকতে! তাই আমার মতন এরকম বাপ মরে গেলে ছেলেই বা কেন কাঁদবে! তবে ঠিক আমার ওপর ঘৃণা থেকেও নয়, ছেলে আমার এমনিতেই কোনোদিন কাঁদবে না। ছোটো থেকেই আমি, আমরা ওকে বুঝিয়ে দিয়েছি ওর পক্ষে কান্নাকাটি করা আসলে বিলাসিতা। আমার ছেলে অত বিলাসী নয়।

আর শেষে বলি কীভাবে মরে গেলাম। ঢাকের বাদ্যি-তাসা পার্টি-আলো-ছায়া পেরোতে পেরোতে খেয়াল নেই কখন একটা তুমুল উত্তেজনার মধ্যে ঢুকে পড়েছি। হঠাৎ শুনি চারিদিক থেকে অনেকের মিলিত ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর। “এই ধর ধর সামলে… মাগো রক্ষা করো… এ কী সর্বনাশ হয়ে গেল মা…” এইরকম সব কথার টুকরো কানে ভেসে আসছে। ঠাহর করে দেখি বাঁশের মাচায় করে প্রতিমা নিরঞ্জনের জন্য নিয়ে যাচ্ছিল একদল বেহারা। পথে কোনোভাবে কারও পা বেসামাল হয়ে পড়ায় গোটা মাচাটাই মাঝখান থেকে ভেঙে বেসামাল হয়ে গেছে, এবং প্রায় একতলা বাড়ির সমান উঁচু প্রতিমা তখন মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়ার উপক্রম হয়েছে। কাঠামোর পিছনে দড়ি বেঁধেও স্থির রাখা যাচ্ছে না, মাচাও রাস্তায় নামানো যাচ্ছে না। এদিকে অত টানাটানিতে প্রতিমার দেহে তখন চিড় ধরতে শুরু করে দিয়েছে। ওদিকে উত্তেজনা, হাহাকার বেড়েই চলেছে। আর আমি তখন নিজের অজান্তেই এক অমোঘ টানে এগিয়ে চলতে শুরু করে দিয়েছি প্রতিমার পায়ের কাছে। চিড় ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে, আর আমার চোখের সামনে অন্য একটা পুরোনো ছবি স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। আমি দেখতে পাচ্ছি আমার ছেলে স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা থেকে ফিরে এসেছে। সেই বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ‘যেমন খুশি সাজো’ বিভাগে আমার ছেলে নাম দিয়েছিল। বাড়ি ফিরে এসেছে সেই পোশাকেই। পরনে সস্তার জরির শাড়ি। লাল রঙের। সস্তার গয়না। ইমিটেশনের। আর পিঠের সঙ্গে বাঁধা, পিচবোর্ড দিয়ে তৈরি দশটা হাত। হাতে অস্ত্র নেই। সেদিন আর আমার মাথার ঠিক থাকেনি। মেরে মেরে বুকে, গলায় দাগ ফেলে দিয়েছিলাম। ঠিক এই ভঙ্গুর মৃৎপ্রতিমার মতো। আমার বউ চুপ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার ওই চণ্ডাল মূর্তি দেখেছিল। এই মুহূর্তে রাস্তায় দাঁড়ানো এই অসহায় গণর মতো।… আবার একপ্রস্থ হই হই রব উঠল চারিদিকে। সেই রবে ভয়ের মাত্রা আগের চতুর্গুণ। আমি দেখলাম কাঠামোর পিছনে দড়ি ধরে দাঁড়িয়েছিল যারা তারা একে একে দড়ি ছেড়ে দিচ্ছে। আর পারছে না। মানুষ তো, কত আর সহ্য করবে? দেবীই ভেঙে যাচ্ছেন!…

একসময় দেবীমূর্তি পুরোপুরি ভেঙে পড়ল। সামনে দাঁড়ানো বেশ কয়েকজন মানুষের ওপর। সামনে দাঁড়ানো সেই বেশ কয়েকজন মানুষের মধ্যে আমিও ছিলাম।

Facebook Comments

পছন্দের বই