লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গল্প

শরদিন্দু সাহা

একটি সম্ভাবনার সূত্র

এমনটা হওয়ার কথা ছিল কি! না বা হ্যাঁ কোনো উত্তরই তেমন দেওয়ার কথা ছিল না। কেউ তো নেই এমন উত্তরটা সুবোধের ঘাড়ে এসে চাপিয়ে দেবে। এই মুহূর্তটা এমন একটা ভাবনার দোলনায় ও দুলছে, বোঝা দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে কোথায় গিয়ে থামবে কিংবা থামতে চাইবে। কোনো প্রশ্নের উত্তর হয়, আবার হওয়ার জন্য অপেক্ষাও করে। অপ্রত্যাশিতভাবেই দরজাটা খুলে যায়, সুবোধ নিজে চেয়েছে কি চায়নি, সেটা নিজেও জানে না। এসে গেল হুট করে। বড়ো আজব লাগে, তাজ্জব বনে যেতে ক্ষণেক সময় নেয় না। ভাবনার সমুদ্রটা মনের দরজায় এমন করে আছড়ে পড়ে, জানে না কী জমা ছিল, বোধ, সুখ, অসুখ, জমা অন্ধকার, টুকরো আলো ঢেউয়ের তোড়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। পড়ে থাকে তো তারপরেও অনেক কিছু – দৃশ্যমান ও অদৃশ্য। ও বুঝতে পারল সবটাই সত্যি। দূরে দাঁড়িয়ে যে-লোকটা সুবোধের উপুড় হওয়া প্রত্যক্ষ করছিল, ভেবেই বসল, লোকটা এমন কিছু একটা হারিয়েছে যা জরুরি ভোগ্যবস্তু বলে তো মনে হচ্ছে না, কল্পনার ইতিউতি, রেখায় কিংবা জলরঙে।

সুবোধ কিছুতেই নিজেকে এখনও সামলে উঠতে পারেনি, তবে কারা যেন জন্ম নিতে চাইছে, উপকরণগুলো আপনা-আপনি হাজির হয়ে মূর্ত হবে বলে গোল পাকাচ্ছে। নিজেদের ইচ্ছেটা তো জন্মায়নি, আকারের কথা উঠবেই বা কেন।

সুবোধ কিছু কি দেখতে চাইছিল! এই মায়াময় পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে কেন ও ভাবতে পারবে না ওই যে ছাদটা কবে থেকে এক ফাটল ধরা চতুর্ভুজ হয়ে পড়েছিল হঠাৎই চারটে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। জং ধরা টুকরো টিনগুলো দেয়ালের ছাদ হয়ে যাবে। দেয়ালের গায়ে কত তাড়াতাড়ি শ্যাঁতলা জমে সবুজ না হয়ে ঘন লাল রঙে লেপ্টে যাবে। সুবোধের চোখের সামনেই কেউ যেন ছিটিয়ে দিয়ে গেল। রমেশকে দেখল হাঁ হয়ে খুঁজছে এমন কিছু যা ওর নিজের দেখার কথা ছিল। কী আশ্চর্য! রমেশের এমন অসময়ে আগমন! ওর কি আসার কথা ছিল? এমন একটা পথের সাক্ষী হয়ে কবেই তো আর একটা পথ কেটে কেটে চলে গেছে অনেক দূরে। ফেরত যদি আসতেই হয়, এমন অনেক বস্তুর সঙ্গে সংঘাত ঘটবে, ওর অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেবে। প্রমাণ করা এত সহজ হবে না, ও সামনাসামনি দাঁড়িয়ে প্রত্যুত্তর দিচ্ছে। সুবোধ কেন দেখল অনেকগুলো জানালা ওর দিকে ছুটে আসছে। ছোট্ট শিশুটি সেগুলো জাপটে ধরবে বলে কত আকুলিবিকুলি। রমেশ এক নরম মিষ্টি চাহনিতে ওর লাফালাফি সতৃষ্ণ হয়ে দেখছে। ওর হয়তো গ্ৰহণ বর্জনের পালার সুযোগ এসে হাজির হয়েছে যা ও অনেককাল আগে হাতের মুঠোয় পেয়েও হাতছাড়া করেছে। রমেশ ভাবতে পারে এই পাওয়া আর এক পাওয়া, এই জীবন অন্য আর এক জীবন। না, না সুবোধ রমেশের এই ভাবনাকে প্রশ্রয় দিতে যাবে কেন? রমেশের পুনরাবির্ভাব যে অনস্বীকার্য এর প্রমাণের জন্য ওর দৃষ্টিই কি যথেষ্ট নয়? তাই যদি হবে, রমেশ যে ভূমির উপর এতক্ষণ দাঁড়িয়েছিল, তা এমন করে আলগা হয়ে যাচ্ছে, তার তো না-দেখার কিছু নেই। আচ্ছা, রমেশের উপস্থিতি অদৃশ্য হচ্ছে দেখে, ও কি সমুদ্রের কথা ভাবতে পারে না, পারবে নাই-বা কেন! সেই জলস্রোত কি এক জায়গায় থেমে থাকে, চলে গিয়েও তো ফিরে ফিরে আসে। রমেশের বাসনা তো ফেলনার নয়, সময়কে বন্ধু করে কত রকমের অবয়ব নিয়ে ফিরে আসে, কত বৃক্ষ, কত শাখা-প্রশাখা, কত ছায়া, কত মানুষের প্রতিধ্বনি হয়ে সে হয়তো অন্য কায়া কিন্তু ও তো রমেশই ষোলো আনা নিশ্চিত। ছাদটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে দেখতে পেল তো সুবোধ আর দেয়ালটা ছাদ হয়ে আশ্রয়ের ঠিকানা হল। রমেশ আর রমেশ রইল না, পরেশ হয়ে প্রদক্ষিণ করল দুই ছাদের চারপাশে। রমেশ তারস্বরে ডাকল বলেই না, অনেক কথা চালাচালি করল বলেই না, না-হয় কোনো জন্মে দেখেছে, তখন তো সুবোধের হাঁটি হাঁটি পা পা। পাড়ায় পাড়ায় অনুরোধে উপরোধে খালি গলায় গান গাইত, গাইতে গাইতে এক সময় কোথায় যে হারিয়ে যেতে চাইল, সে গল্পই তো শোনাল রমেশকে। রমেশ ওর কথায় এতই মজল, ভাবল পরেশ যদি হতে পারত, এই জীবনই তো চেয়েছিল ও। তারপর তো পরেশের বঞ্চনা, মুখ থুবড়ে পড়া, দোরে দোরে যে-জীবন চেয়ে চেয়ে বেড়িয়েছিল, সকলে থুথু ছিটিয়েছিল। এত কিছুর পরেও রমেশ পরেশ হতে চেয়েছিল। এমনকি যেটুকুনি হামবড়াই ভাব রমেশের ছিল, সেটুকুনি বিসর্জন দিয়েও সুরে সুর মেলাতে দ্বিধা করল না, যদি প্রয়োজন হয় সময়কে চুরি করতে এতটুকু দ্বিধা দ্বন্দ্ব দূর করে দেবে তুড়ি মেরে। সব চাওয়া-পাওয়ার কথাই তো সুবোধ নিজের কানেই শুনল।

সংসার বড়ো মধুময় নয়, সুবোধ কি জানত না, জানত। না না, একেবারেই কোনো চাপা অভিমান ছিল না। ঘরনি পুত্র-কন্যা থাকবে না, সে আবার হয় নাকি, অদ্ভুত এক জগৎ। সকাল সন্ধ্যা যে-কথাগুলি চলত, সবই কিন্তু মিলিয়ে মিলিয়ে। শান্তি এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যেত, কী জানি মনে হত এ-ঘর পালটি খেয়ে ও-ঘরে চলে যাচ্ছে। মনে হতে লাগল রমেশের ইচ্ছেগুলোই পাক খেয়ে ওর মনের কোণে কোথাও বাসা বেঁধেছে। পাখির বাসা নয় যে খড়কুটোগুলো দূর ছাই করে উড়ে উড়ে চলে যাবে, শক্তপোক্ত ইঁট বালি সিমেন্ট গাঁথা, ঝড়ের সাধ্য কি তেড়েফুঁড়ে এসে তুবড়ে দেবে। কথাগুলো চলনসই, মিষ্টি তেতো ঝাল। তাতে কার কী আসে যায়। যেমন করে আসতে চায়, তেমন করে আসে। সুবোধই বলছে, শান্তিও শুনছে, যেমন করে শুনতে চায়। কেন শান্তির মনে হয় শেলফের উপরে কোথাও বসে কোকিলটা কুহু কুহু রবে ডাকছে। এমন সংসার হওয়া কি এত সহজ, দুজনেরই সহজ যোগদান এ-কথা মেনে নেওয়ার মধ্যে কোনও বাহাদুরি নেই। শান্তি কি টের পায় ওর প্রতিটি উচ্চারণ থেকে থেকে কেমন উঁচু-নীচু হয়। শান্তি গ্যাসের নব বন্ধ করতে করতে, ছেলের দুষ্টুমির জন্য কানমলা দিতে দিতে সুবোধ বোধ হয় কোকিলের ডানা ঝাপটানোর শব্দ পায় নিশ্চয়ই, না হলে এমন করে নড়েচড়ে বসে কেন। ওর গলার স্বরটা কিন্তু খাপে খাপে মিলে যায়। সবটাই কি সত্যি? কোনটা অসত্যি টের পাওয়া যে সোজা নয়, বিলক্ষণ জানে শান্তি। কোকিলটা আড়াল টপকে সোফার মাঝখানে কাচের টেবিলটার উপর বসে লেজ নাড়িয়ে শান্তির নজর কাড়ে, কথার পরে কথা সাজিয়ে এমন এমন কথা বলে, কোথায় যেন শুনেছে ও। অমনি সময় কথার ফাঁকে চলে আসে, মা, বাবা, দিদি। ওদের চোখেমুখে উৎকণ্ঠা। কবে কোথায় চোখ বুজেছিল। যাওয়ার মুহূর্তগুলোকে চিনে নেবে এমন সাধ্য কার। ওরা অনর্গল বলে চলেছে। কোনো দৃশ্যই আর একটা দৃশ্যকে ছুঁতে চাইছে না। কেউ কারও দিকে তাকিয়েও দেখছে না, অথচ দূরত্ব যে কোনোকালে ছিল না, সেটাও ঘুণাক্ষরেও টের পাচ্ছে না। শান্তি কি মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে, তোমার বিদায়বেলার অনুভূতিটা একবার বলো না মা। অসাড় দৃষ্টি শান্তির দু-চোখের আলোকে নিষ্প্রভ করে দিয়ে নির্বাক করে দিচ্ছে। বাবার মুখটা বেদনায় কেমন আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে, সময়ের কথা বলবে এমন প্রবৃত্তি কোথায়। কোকিলের স্বর বড়ো ম্রিয়মাণ হয়ে শান্তির দু-পাশে ঘুরঘুর করে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। এত চোখের জল দু-চোখে, সবই কী অশ্রুত, কেঁদে ভাসিয়েছিল না, বলেছিল না আমায় শক্ত করে ধরে রাখ, যেতে দিস না বোন। সুবোধকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কি দেখতে পাচ্ছ?’ ‘তোমার ইচ্ছেগুলো আমার কল্পনায় এসে জোড়া লাগছে।’ শান্তি এই প্রথম সুবোধের কথায় কোথায় যেন স্বস্তি পেল। তবে প্রপঞ্চময় এতগুলো বছর কেমন করে ডুব দিয়ে তলদেশে তলিয়ে গেল। মা শান্তির চুলে বিলি কেটে বলল, ওই দেখ কত আলো। সূর্য নয় তো। ‘আমি কি বলেছি তাই!’

এত আলোর বন্যা। তীব্র গতি তার। কেমন অদ্ভুত রঙের ছাউনি নিয়ে ঘর বেঁধেছে। ওরাও এসেছে সেই ঘরে। অবন্তীর খেলার মাঠের গোল বৃত্তটার উপর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সকল সঙ্গীসাথী। ওরা এত জোরে দৌড়ল, আলোগুলো ছিটকে গেল এপাশ-ওপাশ। এই রং তার অচেনা। কথার আগুনে পুড়ে মরবে বলে বসন্ত কোন পথ দিয়ে এসেছে কে জানে। ও তো দাঁড়িয়ে ছিল বোধিবৃক্ষের নীচে, জলময় কুণ্ডলীকে ঘিরে ছিল ওর যাত্রাপথ। এমন প্রতিকূলতার যে মুখোমুখি হবে একদিন কে-ই বা জানত। সময় যে এমনভাবে পাক খাবে, দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে চলে এসে এমন সাধনায় যে সিদ্ধিলাভ করবে কিংবা অবন্তী যে দাঁড়িয়ে থাকবে পথের মাঝে যে-পথের চিহ্নে লেগে থাকবে মাকড়সার জাল, বসন্তের অনুভূতি গোল পাকিয়ে তাই না হয়েছে আকাশচুম্বী। রমণীও এনেছিল ভাবনার প্রতিধ্বনি হয়ে, সে তো কমদিন নয়, উল্টোপথের ইশারা পেয়েছিল বলেই না মাথা চুলকাতে চুলকাতে ভেবে নিয়েছিল ও-পথে যাব না। এই বৃত্তে আসবে বলে গোপন আকাঙ্ক্ষা ছিল বলেই না গুটি গুটি পায়ে ঢুকে পড়া। হাতড়ে বেড়িয়েছিল অনেকটা সময়, বুঝেই বলেছিল, ‘এসব আমার নয়।’ কী জানি কোনো আসবাবপত্রের দিকে ইঙ্গিত করেছিল নাকি অন্য কোনও পাওনাগণ্ডা! কত মানুষই তো কত কিছুর পেছনে ছোটে, কে কার খবর রাখে। হৃদয়ের পরিধি মাপে, এমন দুঃসাধ্য কার! রমণীর অসময়ে আগমনীবার্তা অবন্তীকে নাড়িয়ে দেবে, বোঝাই যায়নি। জলের বৃত্তটা খেলা করছে আগুনের গোলা হয়ে, হতে পারে তো এমনটা? ভয় হয় কখন নিঃশেষ হয়ে যাবে, রমণীর চেতনা ডুবসাঁতার কাটতে কাটতে কোন মাঝ সমুদ্রে যে মুখ বাড়াবে, জানবে না তো। কত তো জলজ প্রাণীদের উৎপাত, ওদের ভয়ঙ্কর দাঁত-মুখ খিঁচুনি, চিনতে পারলে তো। কপাৎ করে গিলে নেবে না চিবিয়ে চিবিয়ে, বোঝা তো মুখের কথা নয়। অবন্তী আবিষ্কার করে কতগুলো খুঁটি পোঁতা রয়েছে। কে পুঁতেছে, কখন পুঁতেছে, কেনই-বা পুঁতেছে, মুখে কুলুপ এঁটেছে। কখন আবার কথার খই ফুটবে, কেউ জানে না। অবন্তী স্তব্ধ। হাঁ করে চেয়ে আছে। জানা-বোঝার ঊর্ধ্বে, রমণী কেমন করে এত কাছাকাছি এল, বসন্তই-বা চলে গেল কেন ধরাছোঁয়ার বাইরে! অবন্তী শুধু বৃত্তাকারে ঘুরপাক খায়। আগুনের গোলা ছুটে চলে আসে সুযোগ বুঝে অবন্তীকে গ্ৰাস করবে বলে। কার কোন কারসাজি কে বলবে! দেখতে তো পাচ্ছে কতগুলো মানুষ উলঙ্গ হয়ে ধেই ধেই করে নাচছে। ওদের মুখনিঃসৃত কোনও শব্দই অবন্তীর কানে পৌঁছচ্ছে না।

বাড়িগুলো অনেক উঁচু। কত নালিশ বোঝাই করে এনেছে ঝোলায়। কোথায় কোন নালিশ জানালে কোন জানালার কাচ টপকে সঠিক টেবিলটাকে নাড়িয়ে দিয়ে বলবে, ‘আমায় একটু দেখুন প্লিজ।’ অম্বালিকা ততক্ষণে মানুষের দঙ্গল থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়েছে। ক্ষণে ক্ষণে ছবিটাকে পাল্টে নিয়েছে নিজের মতো করে। দ্রুত পা চালিয়ে যারা সিঁড়ি টপকাতে এগিয়ে গেছে, হঠাৎই তারা মুখ থুবড়ে পড়ল। যা হবার নয় তা হল। যাদের চলন নিম্নগামী ছিল তারা কী এমন কথা ওদের কানে কানে বলল, ওরা নড়েচড়ে বসল। ঘেমে নেয়ে একশা হলে ভাবল একটু ছায়া হলে মন্দ হয় না। এত চড়া আলো হয়তো এই সময়ে বিপজ্জনক। ওদের কর্মচারী প্রফুল্ল ছাতা মাথায় বৃষ্টির ঝাপটা ভুলে গিয়ে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে, হাতে পতপত করে দুলছে ঝাণ্ডা। কবেকার কথা, বলেছিল, ‘মাহিনাটা পাঁচ টাকা বাড়িয়ে দিন না বাবু।’ মাথা নত করে চোখ দুটো নীচে নামিয়ে কাকুতিমিনতি করে কথাগুলো বললেও কেউ কর্ণপাত করেনি। সেই যে গেল আর ফিরে আসেনি। অম্বালিকার বাপ ঠাকুরদার ভিটে থেকে উচ্ছেদ করেছিল যে-মানুষটি, ওই তো, স্বপন বাঁড়ুজ্জেই হবে, লোকটা গটগট করে হেঁটে এসে প্রফুল্লর চুলের মুঠি ধরে কষিয়ে এমন জোরে থাপ্পড় মারল চক্বর খেতে খেতে এসে ও লুটিয়ে পড়ল ওর পায়ের কাছে। স্বপন যেমনটি দাঁড়িয়েছিল, তেমনি দাঁড়িয়ে রইল। বলার কথা তো অনেকই ছিল। অম্বালিকার সখী ছিল অনুত্তমা, মনের কোণে বিতৃষ্ণা নিয়ে ও বেড়ে উঠেছিল, বুঝতেও চায়নি, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির ভাণ্ডারটার ফারাক, ভেবেছিল এক ঝটকায় সব নিংড়ে নেবে, তাই বলে কি এত দিনের খেলায়, ঘুমের ঘোরে এত চোখের জলে বুক ভাসানো, সান্ত্বনার বাক্যগুলো ফুড়ুৎ করে উড়ে যেত, শেষ পেরেকটা পুঁতে দিয়েছিল ওই স্বপন বাঁড়ুজ্জে। এই সময় অনুত্তমাই একরাশ অভিযোগ নিয়ে রাগে ফুঁসছিল কালভার্টটার উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে। শুকনো চোখে বিদ্রূপের হাসি। কী আশ্চর্য! ওই প্রাচীরের কোল ঘেঁষে লোকটা দাঁড়িয়ে কেন? এমন অশোভন হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে সময়ের মুণ্ডপাত করা যায়! যায় কি? আপনারাই বলতে পারেন। যদি যায়, প্রফুল্লই-বা ওর হাতের মুঠোয় এসে গেল কেমন করে! এমনটা হওয়ার তো কথা ছিল না। বরঞ্চ ছবিটার আদ্যোপান্ত যে-রকমটা হলে মনের কোণে দাগ লাগতে পারত, অনুত্তমা ফোঁস করে এসে লোকটার টুটি চেপে ধরবে, বংশ নির্বংশ হবে। লক্ষ্যটা কৌণিক বিন্দুতে এসে এমন করে নাচানাচি করল, লোকটা প্রফুল্লকেই গণশত্রু হিসেবে বেছে নিল। এই তো আজব কাণ্ড! প্রফুল্লর বাঁচা না-বাঁচার খতিয়ান মনের হিসেবের খাতা থেকে তো বাদই পড়ে গেছে কয়েক দশক আগে তাই না! এতটা অনমনীয় অনুত্তমা, এতটাই বিধ্বস্ত প্রফুল্ল। তাই কি স্বপন আরও বিধ্বংসী, রুখে দাঁড়িয়েছে প্রবল পরাক্রমশালী হয়ে। অম্বালিকার কিছুই নজর এড়ায়নি। সেনানীরা লেফট রাইট লেফট রাইট মার্চ করে এগোচ্ছে। কী জানি চুলের মুঠি ধরে দ্বিগুণ তেজে বনবন করে ঘোরানোর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে। স্বপনের অঙ্গুলিহেলনের অপেক্ষায় সময় গুনছে। অম্বালিকার চোখে কি ছানি পড়েছে! এত কনকনে ঠাণ্ডায় এত খটখটে রোদ পুরো চাতালটাকে ঘিরে ফেলেছে কী করে! এমনটা হওয়ার সময় হয়েছে না কি হয়ে চলেছে অম্বালিকা টের পাচ্ছে না। এই প্রাচীর, প্রফুল্ল অনুত্তমারা সময়কে এমন করে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল কেমন করে! অম্বালিকার চোখের পাতা পিটপিট করে, কোনো শাসনই এই দৃষ্টি মানে না।

চলো এবার নিজের দেশে যাই। একটু না হয় চিন দেবার বৃথা চেষ্টা করি না কেন? রজনী অরুণকে এমন একটা প্রস্তাব দিল যখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। গাছের ডালে পাতায় পাতায় আঁধারের প্রলেপ এসে জমছে একটু একটু করে। ওরা নিজেরাই ঠিক করেছে দরজায় এসে কড়া নেড়ে জানতে চাইবে ‘তোমরা কি ঘুমের দেশে চলে গেছ? এবার কি জেগে উঠবে?’ মিনমিনে একটা স্বর ভেসে এল বুঝি। এমন কণ্ঠস্বর এর আগে রজনী কখনও শোনেনি বুঝি। কারা এসে বাসা বেঁধেছে এই নির্জনে। কোনো বনলতা, আকন্দ, ঘেঁটু ভাট কলাবতীরা গোপনে আস্তানা গেড়েছে কি না কে জানে। ওদের মিলনমেলায় জন্ম নিয়েছে কথার পরে কথা। অরুণ ফাঁকফোকর দিয়ে দেখল, গাছেরা মানুষ হতে চাইছে। আর্ত চিৎকারে ভেসে আসছে গুল্মলতার গোঙানি। ওরা চলে-ফিরে বেড়ানোর যাবতীয় কৌশল রপ্ত করতে চাইছে। কাঠুরিয়ারা গাছ হবে বলে কত যে মন্ত্র আওড়াচ্ছে, রজনীর বোঝা দায়, তবুও কান পাতে। অরুণ মানুষকে জানোয়ার হতে এর আগে কখনও দেখেনি। এমন অভাবনীয় দৃশ্য যে প্রত্যক্ষ করবে, এমন সাধ্য ছিল না অরুণের। ও-পার থেকে এ-পারে আসার দূরত্বের মাঝখানেই ওরা শরীরটাকে বাঁকিয়ে কুকুর হতে চাইল। আবার কারও নিয়ন্ত্রণহীন ইচ্ছের দৌলতে বিড়াল হতে চাইল। মানুষটাকে বাস্তুসাপ হতে দেখল ওরা। হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে গেল কচুবনে। তাই বলে এমন দশা ঘটবে পিসতুতো মামাতো ভাইবোনেরা গাছ হয়ে যাবে! এই উত্তাল সময়ে ওরা স্থির হতে চাইছে বলে। কৈশোরে ওদের স্থির সঙ্কল্প ছিল ওরা মানুষের চেয়ে বড়ো মানুষ হবে। সেই আশায় সার জল দিয়ে ওরা অনেক ধাপ পার হল। কেউ কেউ বলল, এটাই কি পথ! কথাগুলো মন্দ লাগল না। অরুণ রজনীরা যেদিন গাছের গোড়ায় জল দিতে লাগল, শাল শিমুল গরানরা তরতর করে বেড়ে গেল, তখন ওরা পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো মাঠটা কম সময়ে পার হয়ে গেল। তাতে কী এল গেল, দেখার সুখ হল না। কী আর করা! মনের সুখের আশায় রাস্তাটা পালটাতে পালটাতে কত পথ যে হাঁটল তার কি হিসেব-নিকেশ আছে। গাছেরা সমস্বরে বলল, ‘কোথায় যাও হে?’ ‘তোমরা কারা?’ ‘সে জেনে তোমাদের কাজ কী?’ ‘উপায়টা বাতলে দিতে পারি।’

গাছ হবে? আরে ঘাবড়াও কেন? মজবুত ঘরও হবে, সকল আশা পূর্ণ হবে। মুহূর্তে রজনী অরুণরা দেখল, লম্বা গাছগুলো কেমন ছোটো হয়ে যাচ্ছে। ওরা বলল, ‘আমরাও ছোটো হব।’

তরণী এসে তীরে ভিড়ল। অপেক্ষায় কারা কারা আছে কেউ আর গুনতি করেনি। যারা স্রোতের প্রতিকূলে যাবে তারাও আছে, যারা স্রোতের অনুকূলে যাবে তারাও আছে। বাজার সরকার, দোকানদার, কোয়াক ডাক্তার, কবিরাজ, শিক্ষক, ছাত্র, কারবারিদের ভিড়ে এককোনায় নীরবে দাঁড়িয়েছিল অরণি। কেন দাঁড়িয়েছিল বাকিদের কাছে অজানা, নিজেও জানে কি এই অপেক্ষা ওকে কোন গন্তব্যে পৌঁছে দেবে। কী যেন দেখতে চেয়েও দেখতে পেল না। উচ্ছল ঢেউ হঠাৎই টলমল করে উঠল। খুশিতে ডগমগ হয়ে পাড়ে এসে দোল খাবে এমন ইচ্ছায় ওরা লেজ দোলাল। পাড়ের কিনারে কেউ তো নেই। ওরা শুধু খলবলিয়ে চলেছে মাঝদরিয়ায়। কেউ যে হাত বাড়িয়ে গলুই থেকে হাত বুলিয়ে দেবে, এমন দৃশ্যও দেখা গেল না। বরঞ্চ তরণী যে-দিকে ছুটছে, হাওয়ার বেসামাল শব্দ কানে ভাসছে। অরণি যে-ছবিটা দেখতে পেল তরণীর দুলুনিতে পাড়ের গাছের ছায়ারা ভেঙে চুরমার হলে গাছেরা ভীত সন্ত্রস্ত হল, চিনতে চেষ্টা করল ওরা কারা! দু-চারটে বুড়ো উদবেড়াল চোখ পাকিয়ে আর কান খাড়া করে শুনল, গাছেরা কেমন করে কথা কয়। অরণির দিকে তাকিয়ে করুণ আর্তিতে জন্মের মুহূর্ত দেখার বাসনা জেগে উঠল, আবার পরখ করে যদি দেখতে পেত। ওরা গভীরে যেতে চায়। ওদের শরীরে মিশিয়ে দিতে চায় নিজেদের শরীর। ওরা জানে যে দর্পণে ওরা নিত্য মুখ দেখে ওদের ছবি নয়। অরণিও জানে ওদের বেদনা কেমন করে ছবি হয়ে ফুটে ওঠে। অরণি ওদের চাওয়া-পাওয়ার হিসেবও কষে রাখে। অরণিকে ডেকে ওরা কথা কয়। ‘শান্ত সলিলের দেখা যদি পেতাম, দেখ না, তোমার পায়ে পড়ি।’ আলোয় আলোময় হয়ে মানুষের চঞ্চলতা ঘুরে মরে। এই অশান্ত পথিকের লাফঝাঁপ নিরুপায় হয়ে অপেক্ষায় থাকে কখন সব থেমে যাবে, ওরা ওদেরকে দেখে জেনেবুঝে নেবে কতটা বাড়লে কতটা মেলে দিলে ছায়াবীথি হবে, কতটা গুণবতী আর রূপবতী হলে ওরা দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে বলবে, ‘তোমরা আমাদের আত্মীয় হবে গো।’ পেছন ফিরে তাকায় না, তরঙ্গ তুললে শরীর আর শরীর থাকে না। রাতের আঁধারে নিথর হয় বটে, তাতে কেবলই সবকিছু অচেনা ঘুম ঘুম মনে হয়। অরণি ওদের কথার জালে জড়িয়ে বেবোল হয়। অরণি কী মনে করে বলেই ফেলে, ‘ও গাছ, তুমি শব্দের জন্ম দাও, প্রসববেদনায় জেগে ওঠো, তোমার কথা শুনে আমি একটুখানি কান্না করি, কথা কাটাকাটি করি, ঝগড়া করি। নদী না-হয় কান পেতে শুনুক। এসো না ত্রিনাথ হয়ে যাই।’

অঙ্গদ একদিন ঠিক করেছিল যুদ্ধে যাবে। সে কথা প্রদ্যুৎকে ঘটা করে বলেই ফেলেছিল। মাঠটা এতদিন খালিই পড়েছিল, কোনো ভ্রূক্ষেপই করেনি। দর্শকদের চিৎকারে ফিরে ফিরে দেখল, বল্লাল পাঁই পাঁই করে ছুটে বেড়াচ্ছে মাঠ জুড়ে। উরুটা সমান তালে চলছে। বিপক্ষের দলে এমন কেউ নেই ওর গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। কোথায় যেন অঙ্গদের স্বপ্নটা লাফিয়ে উঠল। একটু আগেই নয় নম্বর রেজিমেন্টের দল নিজেদের কারিকুরি দেখিয়ে ব্যারাকে ফিরে গেছে। এই সুযোগে করবে বাজিমাত। একবার যাচাই করে দেখবে ও কোনো অংশে কম যায় কিনা। ওই তো পাঠশালা। ছেলেমেয়েদের হৈ হৈ রৈ রৈ কলরবে ক্লাসরুমটা শূন্য হয়ে যেন মাঠের মাঝখানে চলে এল। কে আর কার কথা শোনে। সকল প্রশ্নের উত্তর সবুজ ঘাসের বুকে লেখা হয়ে যায়। ওরা উচ্চকন্ঠে নিজের কথাগুলোই এমন করে বলতে চায় যেন এতকাল সুযোগের অপেক্ষায় দিন গুনছিল। অঙ্গদ আবারও চরকির মতো ঘুরপাক গেল। উল্টোপথ দিয়ে কত লোক তো গলাগলি করে ওদের সুখ-দুঃখের কথা বলতে বলতে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। অঙ্গদকে দেখল কি দেখল না, না দেখতে চাইল না – সে আর অঙ্গদ কেমন করে জানবে। অঙ্গদের বড়ো শখ ওই জলপাই রঙের পোশাক পরে শহরের বড়ো রাস্তা দিয়ে ছুটে চলে যাবে। মাঠটাকে যেভাবে দেখতে চাইছিল কিংবা দেখতে চাইবে তার কোনো আগাম সংকেত কেউ পৌঁছে দিতে চাইছে কিনা। মাঠটা ছিল তো বর্গাকার ধীরে ধীরে কেন ত্রিভুজ আকৃতির রূপ নিল। বল্লাল আর অঙ্গদ এই দৌড়ের খেলায় জিতবে কেমন করে? কারা ওদের স্বপ্নগুলো নিয়ে লারেলাপ্পা খেলছে। পাঠশালা আর মাঠটাও একই পংক্তিতে এসে বল্লাল আর অঙ্গদের জন্য ভিন্ন নিশানা নিরূপণ করে দিতে চাইছে। অঙ্গদ আর প্রদ্যুৎ এখন অন্য খেলায় মত্ত। পাগলা ষাঁড়টা ক্ষেপে উঠেছে। মাঠের অধিকারের নেশায় ও ঠিক করেছে এখন সকলকে গুঁতিয়ে লম্বা করে দেবে। অঙ্গদ আর বল্লালের দফারফা করে ছাড়বে। সকল যুক্তিকে ও ফুৎকারে ওড়াবে, কে আর কত নজর করবে, কানে যে ও তুলো গুঁজবেই গুঁজবে, হাসাহাসি কানাকানি চুলোয় যাক। তীব্র বেগে ও ছুটে আসছে। অঙ্গদও ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। ষাঁড়ের দুটো শিং, অঙ্গদ আর বল্লালের শক্ত হাতের মুঠোয়। ষাঁড় ভেবেছিল দেয়ালে ঢুঁ মারবে, হবে চিৎপটাং, সে গুড়ে বালি। তার আগেই খেল খতম। বিনা সওয়ারিতেই শিং দু-টো ফটাস। মাঠটা ওদের বোঝার আগেই কেমন করে বর্গাকার হয়ে গেল। স্বপ্নগুলো নিয়ে ওরা বনবন করে ছোটে এই ফাঁকে, ষাঁড়টার চোখদুটো ঝাপসা হলে ভাবে, ‘বাপরে এ আবার কী আজব কাণ্ড কারখানা!’

সুবোধ সারি সারি মরার শরীর আগলে রেখে যে উপলব্ধিতে ভেসে যেতে চাইল তা জীবনও নয়, মৃত্যুও নয়, কোথায় কী এমন এক সময়ের সন্ধিক্ষণ তার শুরুই-বা কোথায়, শেষই-বা কোথায়, অদ্ভুত এক শূন্যতা যা পূরণ করার উপায়ান্তর নেই। এক-একটা মাপজোকহীন বিন্দুতে যারা আপন নিয়মে খেলে বেড়াচ্ছে যেমন করে ওরা খেলবে বলে ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল। সৌমিত্রদাকে দেখে চমকেই গেল সুবোধ। মঞ্চের এক কোণে গুটিসুটি মেরে বসে সংলাপ আওড়াচ্ছে, নিস্তরঙ্গ নদীর উদ্বেলতা থেমে গেলে যেমন ধীর অচঞ্চল হয় তেমনি। উচ্চস্বরে মঞ্চ দাপিয়ে আওড়াতে গেলে কষ্টে বুকটা ফেটে যায়, চোখের পলকে দেখে নেয় দর্শকাসনে বসে থাকা মুখগুলো কতটা বুঁদ হয়ে আছে। ওদেরকে ধাক্বা মারবে বলেই না জোড়হাত করে মঞ্চটা প্রদক্ষিণ করে শব্দের তীক্ষ্ণতাকে বুঝতে চায়। হঠাৎই তর্জন-গর্জনে মঞ্চ কেঁপে ওঠে। দর্শকরা বিমূঢ় নির্বাক হলে সৌমিত্রদা বুঝে নেয় নিউটনের তৃতীয় সূত্র নিজের নিয়মে সংযোগ ঘটাচ্ছে, শব্দতরঙ্গ তরতরিয়ে সামনে পেছনে ডানে বাঁয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এবার সৌমিত্রদা মঞ্চের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি শূন্যে ভাসিয়ে এমন সংলাপ আওড়াচ্ছে যা কিনা মনে হচ্ছে মঞ্চস্থ নাটকের বিষয়বিভ্রম। এমন উচ্চারণের সময় যে আসন্ন প্রিয় দর্শকমণ্ডলী আঁচ করতে পেরেছে কি! দর্শকাসন থেকে হাততালি দেয় অবন্তী, অম্বালিকা, অরণি আর প্রফুল্ল। মাঝখানের তিনটে সিট বাদ দিয়ে রমেশ আর শান্তি বসে গুনেই চলছে কোন আসনটা ফাঁকা, ওখানে কি নির্বান্ধব জীবনানন্দ এসে বসবে একটু পরে। অঙ্গদ আর বল্লাল সামনের সারিতে বসার সুযোগ পেয়ে গেল! উদ্যোক্তাদের ম্যানেজ করে না ভিআইপি কোটায়! তবে কি ষাঁড়ের খাতায় নাম লিখিয়েছে! কত কী-ই না হয়। সুবোধ ঢোক গেলে। সুবোধের মনটা আনচান করে। প্রাণভরে মানুষটাকে এক পলক দেখবেই দেখবে। চারধারে কথা উড়ছে। ফিসফিসানিটা নিতে না পেরে রাগে ফুঁসল। সৌমিত্রদা চিৎকার করে, ‘এই তোমাদের হাততালি দেওয়ার সময় হল, এতদিনে বৃথাই আমি শত শত রজনী পার করে এলাম।’ একরাশ অসন্তোষ নিয়ে অস্থির হয়ে বলল, ‘ভাব-অভাবের পালা সাঙ্গ হয়েছে, এবার আমি নিজের ঘরে যাব।’ সুবোধ পেছনের সারি থেকে গ্রীনরুমে ঢুকেই দেখল সৌমিত্রদা মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে বিড়বিড় করছে, ‘এদের জন্ম! বড্ড ভুল হয়ে গেছে। ডুব দিতেই শেখেনি, বলে কিনা পয়সা দিয়ে টিকিট কিনে রস কিনবে, আবার আগাম বুকিং!’ আরে এ তো মনোময়! পার্কের জলাশয়ের পাশের আসনটায় বসে আকাশের তারা গুনছিল। রজনী অরুণকে সাক্ষী রেখে নিজের বঞ্চনার হিসেব কষছিল, আকাঙ্ক্ষিত জীবন আর ফেলে আসা জীবনের পাঠশালায় কে কোথায় কেন? এ যেন কোথায় হাজির করছে, কতকাল ধরে অজানিত, তবু সুবোধের জগৎটা নাটকের শেষ অঙ্কের মতো ঘুরে ফিরে চলে আসে। সৌমিত্রদাও আসে কি! আসে হয়তো, আসবেই হয়তো কিন্তু এখন নিশ্চুপ অন্ধকারে সৌমিত্রদার কান্নার শব্দই শুধু শোনা যায়, বাকিরা শুধু কুশীলব।

Facebook Comments

পছন্দের বই