লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গল্প

সোহম দাস

টিকটিকি

সকালে বাথরুমে গিয়ে কমোডে বসার পরেই টিকটিকিটাকে দেখতে পেল মণি।

আজ খানিক তাড়াতাড়িই ঘুম ভেঙেছে তার। অন্যদিন আটটার আগে চোখ খুলতেই চায় না। আজ একেবারে এক ঘণ্টা আগেই। অবশ্য কারণও আছে। গতকাল রাত আটটা অবধি ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে থাকতে হয়েছে। না থেকে উপায়ও ছিল না। যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, বা বলা ভালো, তৈরি করা হয়েছে, তার মধ্যে টিকে থাকতে গেলে এ-পথ ছাড়া উপায় নেই।

ক্যাম্পাস থেকে একবার থানায় যেতে হয়েছিল তাকে আর পড়শি বিভাগের অয়নেন্দুদাকে। অয়নেন্দুদা অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর। থানায় যাবতীয় কাজকর্ম সেরে, বয়োজ্যেষ্ঠ সহকর্মীকে ক্যাব বুক করে তুলে দিয়ে মণি নিজে যখন বাড়ি ফিরল, তখন বাজে সাড়ে দশটা। ফিরে এসে চান করে, কোনোরকমে দু-টো রুটি আর একটু আলুভাজা খেয়ে এগারোটায় শুয়ে পড়েছে সে। শরীর আর দিচ্ছিল না।

কৃতি অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করবে বলে উসখুস করছিল। মণি ওর হাত দুটো ধরে বলে দিল – “আজ নয়, বুড়ি, কাল বলব সব। সারাদিন বড্ড ধকল গেছে। আজ শুয়ে পড়ি।”

মণির চোখের ক্লান্তির দিকে তাকিয়ে বুড়ি ওরফে কৃতি আর কিছু বলেনি।

তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ার দরুন ঘুমও ভাঙল নির্ধারিত সময়ের আগে। জানলার সিলে রাখা চশমাটা নিয়ে সে আগেই মোবাইলটা খুলে দেখেছে। নেট পরিষেবা চালু করতেই একগুচ্ছ নোটিফিকেশন। চারটে নিউজ লিঙ্ক, বেশ কয়েকটা হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ, একটা মেইল, ইত্যাদি ইত্যাদি।

হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজের মধ্যে অয়নেন্দুদার মেসেজ দেখে সেইটেই কেবল খুলল সে। গতকাল রাতেই পাঠানো। তিনি লিখেছিলেন – “পৌনে এগারোটা নাগাদ ফিরলাম। তুই ফিরেছিস তো ঠিকঠাক? কাল আমার যেতে দেরি হবে। তোর বৌদির চেক-আপ আছে সকালে। তোরা আমার জন্য ওয়েট করিস না, যেমন শিডিউল আছে, শুরু করে দিস।”

অয়নেন্দুদাকে যথাযোগ্য উত্তর পাঠিয়ে মণি উঠে পড়েছিল। বর্ষার সময়ে সকালবেলায় একটা ঠাণ্ডা হাওয়া বয়, ফলে কৃতি শোওয়ার সময়ে বালিশের পাশে হালকা চাদর রেখে দেয়। ভোরে উঠে গায়ে জড়িয়ে নেয়। আজ মণি আগে উঠেছে, ফলে, দেখতে পেল, চাদরটা কৃতির গা থেকে সরে গিয়েছে। মণি বড়ো যত্নের সঙ্গে আদরের স্ত্রীর গায়ে চাদরটা আবার দিয়ে দেয়। ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকায়। কাল রাতে বড়ো দুশ্চিন্তায় ছেয়ে ছিল ওই মুখটা, দরজাটা খুলতেই সেটা লক্ষ করেছিল মণি। কিন্তু, সত্যিই সে কাল বড়ো ক্লান্ত ছিল, সারাদিনের লড়াইয়ের কথা আর বলতে ভালো লাগছিল না। এখনও কি সেই দুশ্চিন্তা লেগে আছে ওই মায়াবী মুখে? না, অন্তত মণি সেরকম কিছু খুঁজে পায়নি।

কৃতির ওঠার সময় ঘড়ি ধরে ঠিক সাড়ে সাতটা। উঠেই সোজা বাথরুমে আসবে, আধঘণ্টার আগে বেরোবে না। এ-সব অন্যদিন মণি জানতে পারে না, তখন সে গভীর ঘুমে। আজকে পরিস্থিতি আলাদা। মণি তাই সময় নষ্ট না করে বাথরুমে এসে ঢুকেছিল। সঙ্গে নিয়ে এসেছিল মোবাইলটা। মোবাইলের স্ক্রিন দেখতে দেখতে দিব্যি কমোডের কাজ সারা হয়ে যায়। অবশ্য এই মোবাইল আনার ব্যাপারটা করতে হয় কৃতিকে লুকিয়ে। জানতে পারলেই চেঁচাবে। আজ ঘুমোচ্ছে যখন, তখন সে-ব্যাপারে নিশ্চিন্তি।

অন্যদিন দেরি করে বাথরুমে আসে, শরীরের নিজস্ব ঘড়িটাও সেই অনুযায়ী তৈরি হয়েছে। ফলে, কমোডে বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পরও কোনও নিঃসরণ নেই। মণি সময় কাটাতে মোবাইলটা খোলে।

গতকাল রাতে নেট আর চালু করেনি সে। ফেসবুকে আরও নতুন কী তত্ত্ব প্রকাশিত হল, কে জানে! কমোডে বসে তাই প্রথমেই ফেসবুকটা খুলেছিল সে। একটা চেনা নামের প্রোফাইলের লেখা দেখে সেটাই আগে পড়বে বলে ঠিক করে। দু-লাইন সবে পড়েছে, এমন সময়ে টিকটিকিটা এসে পড়ল তার পায়ের ওপর। বাথরুমের দেওয়ালের গায়ে সাদা টাইলস বসানো। টিকটিকিটা সেই মসৃণ টাইলসের গা বেয়ে ওঠার চেষ্টা করেছিল কোনও কারণে। কোনও কারণে ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলেছিল, ফলে পতন।

আর, পড়বি তো পড়, একেবারে মণির ডানপায়ের পাতার ওপরে।

চমকে উঠল মণি। ডান পা-টা নড়ে উঠল তার। সঙ্গে সঙ্গে তার পা ছেড়ে প্রাণীটা বাঁ-দিকের কোণে ছুটল। ওখানে মেঝেতে ঝাঁঝরির মুখ। ঠিক তার উপরেই কল ফিট করা আছে। কলের সঙ্গে যুক্ত করা আছে একটা হ্যান্ড শাওয়ার। ঝাঁঝরির সামনে গিয়ে থেমে গেল টিকটিকিটা।

মণি বাঁ পা-টা মেঝেতে ঠুকল একবার। টিকটিকি দেখলেই এমন করা তার আশৈশব অভ্যাস। ঝাঁঝরিতে লোহার শিক বসানো। জং ধরে গিয়ে তাদের আসল রং বহুবছরই বিলুপ্ত। একটা শিকের মাঝখান থেকে ভাঙা। সেখানে দিব্যি একখানা ফাঁক তৈরি হয়ে আছে। মণির পা ঠোকায় ভয় পেয়ে সেই ফাঁক গলে ভিতরে ঢুকে গেল মাঝারি আকারের সরীসৃপটা।

তারপর, সোজা নামতে শুরু করল গর্তের নীচের দিকে। ভয়ে বুক কেঁপে উঠল মণির। আর কিছুটা নামলেই যে ঘন অন্ধকার, সে অন্ধকারে তলিয়ে যাবে ওর ছোট্ট শরীর। অজান্তেই মণির মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল – “হে—!”

ভয়ের চোটে খানিক জোরেই চেঁচিয়ে ফেলেছিল মণি। কিন্তু, ‘ই’ শব্দটা বেরিয়ে আসার আগেই সে নিজের মুখ চেপে ধরল। কৃতি এখনও ওঠেনি, এই চিৎকারে যদি তার ঘুম ভেঙে যায়!

যদিও দু-টো ঘটনার কোনোটাই ঘটল না। টিকটিকিটা তলিয়ে গেল না, বরং অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় শরীরকে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরিয়ে নিয়ে উর্ধ্বমুখী হয়ে আটকে থাকল গর্তের দেওয়ালে। কৃতিরও ঘুম উঠে পড়ার কোনও লক্ষণ শুনতে পেল না মণি।

ঝাঁঝরির নীচে গাঢ় অন্ধকার। কলের জল, হাত-ধোওয়া জল, সাবানগোলা জল, প্যান-ক্লিনার ভরা জল, সব গিয়ে জমা হয় ওই অন্ধকারে। তারপর, পাইপলাইনের গিরিখাত বেয়ে হারিয়ে যায়। পাইপ কেবল অন্ধকারকে ধরে রাখে, জলকে নয়।

টিকটিকিটা এখন সেই অন্ধকারের একটু উপরে আটকে রয়েছে। গত দশ বছরের জল পড়ে পড়ে গর্তের দেওয়ালে জন্মেছে ঘন শ্যাওলা। ওই শ্যাওলার দেওয়ালে চারহাত আঁকড়ে টিকটিকিটা স্থির হয়ে আছে।

কিন্তু কতক্ষণ ওভাবে থাকবে? জলের মতো ও-ও যদি ওই অন্ধকারে হারিয়ে যায়? সেক্ষেত্রে পাইপের মধ্যে দম আটকে মারা যাবে সরীসৃপটা। তার অভিঘাত কী কী হতে পারে?

মণি ভাবার চেষ্টা করল।

প্রথমত, নিঃসৃত জলের মতো ওর খুদে মৃতদেহ পাইপ দিয়ে বেরিয়ে যাবে না, পাইপের মুখে গিয়ে আটকে যাবে, সঙ্গে হয়তো আটকে দেবে জলের অবাধ প্রবাহকে। তাতে কি গোটা অ্যাপার্টমেন্টের জলের লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হবে? এটা মণির সত্যিই জানা নেই। অনেক বিষয়ের মতো এটাও অজানা রয়ে গিয়েছে! আজকে এই ঘটনার আগে পর্যন্ত গত দশ বছরে এমন কিছু ঘটেওনি যাতে এই ভাবনা তার মনে উদয় হয়। ফ্ল্যাটটা কেনার সময়ে পাইপলাইন সিস্টেমটা নিয়ে আরেকটু বিশদে জেনে নেওয়া দরকার ছিল। মণি কেমন অসহায় বোধ করে।

আজকেই কোনও ইঞ্জিনিয়ার-বন্ধুকে ধরে জেনে নেওয়ার চেষ্টা করবে পাইপলাইনের কার্যপ্রণালীটা।
দ্বিতীয়ত, টিকটিকিটা মরে গেলে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর শরীরে পচন ধরবে। ইংরাজিতে যাকে ‘রাইগর মর্টিস’ বলে। পুরো প্রক্রিয়াটা সেই স্কুলবেলায় জীববিজ্ঞানের বইতে পড়েছিল, এতদিনে ভুলে যাওয়ারই কথা। তবে এটুকু মনে আছে, ব্যাপারটা ধাপে ধাপে হয়। কোনও একটা ধাপে, গন্ধ বেরোনো শুরু হয়। বোধহয়, দ্বিতীয় কি তৃতীয় ধাপেই। টিকটিকি মরলে কতক্ষণ পরে গন্ধ বেরোনো শুরু হবে, সেটা সে জানে না। এদের শরীরে বিষ থাকে বলেও শুনেছে মণি, সেক্ষেত্রে ওই শরীর-পচা গন্ধে জলের লাইনটাই পুরো বিষাক্ত হয়ে যাবে কিনা, সেটাও তার অজানা।

বন্ধুতালিকায় কোনও প্রাণীবিদ নিশ্চয়ই আছে, সে-রকম একজনকে পাকড়ে এই খুদে সরীসৃপদের ফিজিওলজিটাও জেনে নিতে হবে, আজকেই।

এই দুটো ভাবনা ছাড়া আরও একটা চিন্তা আচ্ছন্ন করে ফেলল মণিকে। টিকটিকি মরে যদি গন্ধ ছড়ায় পাইপলাইন জুড়ে, প্লাম্বার ডাকা হবে, সে এসে খুঁজে বার করবে গন্ধের উৎস, অনুসন্ধানে ধরা পড়বে মণির বাথরুমের সঙ্গে সংযুক্ত পাইপলাইনেই টিকটিকি মরেছে, অ্যাপার্টমেন্টের সমস্ত লোক তাকে প্রশ্ন করা শুরু করবে, কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মণি কোনও ঠিকঠাক জবাব দিতে পারবে না, সমস্যা সমাধানে কমিটির মিটিং ডাকা হবে। পুরো পরিষ্কারের খরচটা মণিকেই দিতে হবে হয়তো, অথবা, অন্য কোনও সমাধানও উঠে আসতে পারে। এই যেমন, পাবলিক নুইসেন্সের অভিযোগ তুলে তাকে ফ্ল্যাট ছাড়ার আইনি নোটিশ ধরানো।

দশবছর আগে তৈরি হওয়া এই ফ্ল্যাটে পাঁচবছর আগে এসেছে সে আর কৃতি। চারিদিক খোলামেলা দেখে পছন্দ হয়েছিল তাদের। কৃতি স্বভাব-মিশুকে, দিনচারেকের মধ্যেই উপরতলা, নিচতলার কয়েকটা পরিবারের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ফেলার চেষ্টা করল। বাঁধা কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল, বর কী করে, তুমি কী করো, এতবছর বিয়ে হয়েছে, এখনও ওই ব্যাপারে কিছু ভাবোনি কেন, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু, মণির পুরো নামটা তখনও তারা জানতে পারেনি। সেটা জানল দিনকয়েক পরে, যখন কাঠের দরজায় নেমপ্লেট বসল, ফ্ল্যাট – ২সি, তার নীচে পরপর দুজনের নাম – কৃতি চ্যাটার্জি, মণিরুজ্জামান মণ্ডল। সেটার পর থেকেই কৃতি লক্ষ করেছে, লোকজনের হাবেভাবে খানিক পরিবর্তন, আর সেভাবে সহজ হতে পারছে না কেউ। মণিকে সঙ্গে সঙ্গেই জানিয়েছিল। মণি তখন অত পাত্তা দেয়নি, স্বাভাবিক অস্বস্তি, কিছুদিন পরে কেটে যাবে, এমন বলে আশ্বাস দিয়েছিল স্ত্রীকে। কিন্তু আজকে, এই ঘটনার ছুতো পেয়ে তাদের যদি এখন উঠে যেতে বলে, তখন আবার বাসা খোঁজা… মণি আর ভাবতে পারল না, শক্ত হয়ে এল তার শরীর।

কিন্তু আইনি নোটিশ কি এভাবে ধরানো যায়? বন্ধু কিংশুককে একবার জিজ্ঞাসা করতে হবে, কিংশুক এখন বড়ো বড়ো কোম্পানির লিগ্যাল প্রসিডিওর দেখাশোনা করে। কোনও পরামর্শের প্রয়োজন হলেও ও-ই দিতে পারবে।

মণি এতক্ষণ খেয়াল করেনি, হাতে মোবাইলটা ধরাই ছিল। খেয়াল হতেই মনে পড়ল, এতক্ষণ ধরে সে বন্ধুবান্ধবদের জিজ্ঞাসা করার কথা ভেবে চলেছে, অথচ, গুগলের কথাটা একবারও ভাবেনি। এসব অস্বস্তিকর ব্যাপার বন্ধুবান্ধবদের জিজ্ঞাসা করলে হাসির খোরাক হওয়ার সম্ভাবনা আছে, অন্য সন্দেহও ধেয়ে আসতে পারে। আজকাল কিছুই অসম্ভব নয়। তার চেয়ে গুগলে সার্চ করাই তো ভালো বিকল্প। সেক্ষেত্রে জানাজানি হওয়ার কোনও বিপদ নেই। জানলে জানবে কেবল গুগলের সার্ভার।
কিন্তু ব্রাউজার খুলে সার্চ করতে গিয়ে মণি দেখে, তার আঙুল সরছে না। ভয়ে দুশ্চিন্তায় তার হাত বুঝি অসাড় হয়ে গিয়েছে।

মোবাইলে সময় দেখাচ্ছে, সাতটা কুড়ি। মণি বাথরুমে ঢুকেছে সাতটা দশের একটু আগে। মাত্র এগারো-বারো মিনিটেই এত কিছু ঘটে গেল!

কয়েক মিনিট পরে কৃতিও উঠে পড়বে, উঠে পড়ে সোজা বাথরুমে আসবে। বাথরুমে মোবাইল নিয়ে আসার মতো টিকটিকি প্রাণীটিকেও সে চরম অপছন্দ করে। ঘেন্নাই করে, বলা যায়।
সে উঠে পড়ার আগে যা করার করতে হবে।

কোনো একটা কার্যকরী উপায় ভাবা দরকার। কিন্তু, উপায় ভাবতে গেলে আগে মনকে শান্ত করতে হবে। এবং, মন শান্ত করতে হলে এই একগোছা দুশ্চিন্তাকে ঝেড়ে ফেলতে হবে, সকালের পায়খানার মতো।

অতএব, মণি অন্য ভাবনায় মন দেওয়ার চেষ্টা করল।

টিকটিকিটা এখনও ঠায় সেভাবে আটকে আছে। কতক্ষণ ওভাবে… না, ভাবতে গিয়েও মাঝপথে ভাবনা বন্ধ করে দিতে চাইল মণি। কথার মতো ভাবনাকেও যে এভাবে আটকানো যায়, ওই পাইপলাইনের কার্যপ্রণালী বা টিকটিকির শারীরবিদ্যার মতো এটাও এতক্ষণ অবধি মণির অজানা ছিল। অন্যভাবে ভাবলে টিকটিকিটা ওই গর্তে সেঁধিয়ে গিয়ে মণির একপ্রকার উপকারই করছে।
এ-কথাটা মনে উদয় হতেই তার ভালোলাগাটা বাড়ল। বুকের ধুকপুকানিটাও খানিক কমল বোধহয়। শরীরের সার্বিক কাঁপুনি ভাবটাও কমল। এই তো, ভালো দিকগুলো দেখতে পাচ্ছে সে।

টিকটিকিটা প্রথম যখন গর্তে সেঁধোল, সেই মুহূর্তটায় ফিরে গেল মণি। সোজা ঢুকে যাচ্ছিল নীচের দিকে, কিন্তু বিপদ বুঝে নিয়েই কী অসম্ভব গতিতেই না আবার সঠিক দিকে ঘুরিয়ে নিল শরীরটাকে! খুদে জীবের এমন সহজাত ক্ষমতাকে তারিফ না করে কি থাকা যায়?

খালধারের রাস্তার সেই চড়াই পাখিটার কথাই যেমন। মণির নিশ্চয় মনে আছে। তখন সে কলেজে পড়ে। বাড়ি থেকে স্বল্প দূরত্বে কলেজ, সাইকেলেই যাতায়াত। একদিন বিকেলে ফেরার পথে ঘটেছিল ঘটনাটা। খালধারের রাস্তায় একটা কাগজফুলের গাছ ছিল, সে গাছ থেকে চড়াই পাখিগুলো উড়ে উড়ে যেত রাস্তার অন্য পাশে। কী যে উদ্দেশ্য ছিল, তা মণি জানত না। সেদিন, ওদেরই মধ্যে একজন, বেশ নীচ দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময়ে এসে পড়ে মণির সাইকেলের চাকার একদম সামনে। সাইকেলের ধারালো, জং-ধরা স্পোকে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে মোলায়েম পালকশরীর, এই ভেবে সেদিনও মণি ‘হেই’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে।

কিন্তু, সেদিনও মণিকে অবাক করে দিয়ে ছোট্ট চড়াইটা দেহটাকে দিব্যি একশো আশি ডিগ্রি ঘুরিয়ে নিয়ে ফিরে গিয়েছিল কাগজফুলের গাছটায়। মণি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পড়েছিল সাইকেল নিয়ে। ঘোর কাটতে চাইছিল না তার। খালপাড়ের রাস্তা দিয়ে তখন অবিরাম রিক্সা, সাইকেল, বাইক। কেউ বুঝছেই না, এইমাত্র কী অত্যাশ্চর্য এক ঘটনা ঘটে গেল, তার একমাত্র সাক্ষী অন্নদাচরণ কলেজের বি. এ. ইংলিশের ছাত্র মণিরুজ্জামান। দু-একজন কেবল তার ‘হেই’ শুনে এ-দিকে তাকিয়েছিল, তার বেশি কোনও ভাবান্তর ঘটেনি খালপাড়ের নিস্তরঙ্গতায়।

এই ধরনের ক্ষমতার নিশ্চয়ই কোনও বৈজ্ঞানিক নাম আছে, সে নাম গালভরাও হতে পারে। কিন্তু তখন সে এসব ভাবেনি। তার মাথায় ঘুরছিল অন্য এক ভাবনা।

আব্বার আব্বাকে সে দেখেনি। গল্প শুনেছে মাত্র। সে লোকটা যৌবন বয়সে কংগ্রেস করত, সত্যাগ্রহী হয়েছিল, খদ্দরের ধুতি ছাড়া পরত না। জেলও খাটে কয়েকবার। ’৪৭-এর পর পেট চালাতে একখানা দর্জির দোকান দেয়। চরকা সরে গিয়েছে ততদিনে, সেই জায়গায় বসেছে সস্তার সেলাই মেশিন। মফঃস্বল শহরের একচিলতে পাড়ার একচিলতে দোকানঘরে সকাল-বিকেল খং খং শব্দে সেলাই মেশিন চলত। দুপুরে কিছুক্ষণের জন্য কেবল বিশ্রাম। দোকানঘরের খোলা জানলা দিয়ে প্রায়ই ঢুকে আসত দু-একটা চড়াই, ডিসি পাখার ব্লেডে ঘ্যাচাং-ঘ্যাচ কাটা পড়ত তারা, দাদুর সাদা ধুতিতে লেগে যেত রক্তের দাগ। দাদি নাকি অনেক চেষ্টা করেও সে দাগ তুলতে পারত না!

ওই চড়াইগুলো বুঝি খালধারের চড়াইদের চেয়ে আলাদা হত, তাদের অমন রিফ্লেক্স ছিল না, তাই কাটা পড়ত যখন-তখন, এরকমই একটা কিছু মাথায় এসেছিল সেদিন।

টিকটিকিরাই তো চড়াইদের পূর্বপুরুষ। সেই যে জীববিজ্ঞানের বইতে পড়েছিল একসময়ে, জার্মানির ব্যাভেরিয়া অঞ্চলে প্রথম পাওয়া গিয়েছিল আর্কিওপটেরিক্স নামের এক প্রাণীর ফসিল। সরীসৃপ থেকে পাখিতে রূপান্তরপর্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি। অনেকেই বলে, ডানাওয়ালা ডাইনোসর। এমন ক্ষিপ্র প্রতিবর্ত ক্ষমতা হয়তো এদের থেকেই পেয়েছে পাখিরা, তেমনটা ভাবতে ক্ষতি কী!

খুদে জীবটা এখনও সেভাবেই আটকে রয়েছে গর্তে। সেই একইরকম স্থির। মণি অনুভব করল, সে আগের থেকে খানিক স্বাভাবিক বোধ করছে। ব্রাউজারে এবার খোঁজ করার চেষ্টা করা যেতে পারে। গুগলটা খুলে সার্চ বারে টাইপ করতে গিয়ে আবারও থেমে গেল। এবার আর আঙুলে অসাড়তা নেই, থেমে যাওয়ার কারণ অন্য। একাধিক ভাবনা সে ভেবে ফেলেছে এই কয়েক মিনিটে। কোনটা আগে খুঁজবে?

এক মুহূর্ত স্থির থেকে টাইপ করল – “can house geckos hold on to mossy surface?”

অজস্র লিঙ্ক খুলেছে। কিন্তু কোনোটাতেই ঠিকঠাক ব্যাখ্যা আছে বলে মনে হল না। একটা লিঙ্কে পাবে ভেবে খুলতে গিয়ে দেখে, ৪০৪ এররের খবর। আপনা থেকেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল – “ধ্যার, বাঁ…”

সময় আরও খানিক এগিয়ে এসেছে। সাতটা ছাব্বিশ। এবার কৃতি উঠে পড়বে। উঠে মণিকে পাশে না পেলে মনখারাপ হবে তার। যেদিন যেদিন মণি আগে উঠে পড়ে, সেদিনগুলোয় কৃতি ভারী খুশি হয়, চট করে বিছানা ছাড়তে চায় না। স্বামীর বুকে মাথা রাখে, দু-জনে মেশামেশি করে থাকে কিছুক্ষণ। তার উপর কাল রাতে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল মণি, সেই অপরাধও জমা হয়ে আছে।

এবার উঠে পড়তেই হবে। এতক্ষণ ধরে কমোডে বসে থাকা অনুচিত কাজ, এতে পাইলসের সম্ভাবনা বাড়ে। কোনও একটা কাগজে পড়েছিল।

কিন্তু, টিকটিকিটার ওঠার কোনও লক্ষণ নেই। হ্যান্ড শাওয়ারটা হাতে তুলে নিয়ে আরেকটা ব্যাপার লক্ষ করল মণি। জমে থাকা বর্জ্য শরীর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর এক স্বর্গীয় অনুভূতি হয়, সেই অনুভূতিটাই এখন সারা মন-শরীর জুড়ে। ভয়ের আঘাতে কখন যে আপন নিয়মেই সে বর্জ্য খুঁজে নিয়েছে তার নিজস্ব নির্গমনপথ, সেটা মণি বোধহয় বুঝতেও পারেনি। টিকটিকিটা এই উপকারটাও করে দিল।

হ্যান্ড শাওয়ারের কাজ সেরে সেটাকে যথাস্থানে রেখে ছোটো হয়ে আসা গোলাপি টয়লেট সোপটা দিয়ে হাত ধুতে থাকে মণি। কলের হাতলটা অল্পই ঘুরিয়েছে সে, জল পড়ছে অত্যন্ত ধীরে। তাতেই দিব্যি হাত ধোয়া হয়ে যাচ্ছিল। সাবানগোলা ফেনাজলের ফোঁটা গিয়ে পড়ে টিকটিকিটার গায়ের ওপর। চমকে চমকে ওঠে সেটা। দীর্ঘ সময়ের নিস্তব্ধতার পর এই মৃদু স্পন্দন দেখে মণি ভরসা পায়। কিন্তু পরমুহূর্তেই আবারও এক ভয় তাকে ছেঁকে ধরে। আকস্মিক চমকানিতে টিকটিকিটার যদি হাত ফস্কে যায়!

কলটা বন্ধ করে দেয় সে। হাত সরিয়ে নেয় ঝাঁঝরির উপর থেকে। দেওয়ালের আংটায় রাখা তোয়ালেতে হাত মুছে সে এবার উঠে পড়ে।

চান করার কলের নীচে একটা ঝাঁটাকাঠি পড়ে আছে, এটা বাথরুমে ঢুকেই লক্ষ করেছিল সে। বাথরুমে ঝাঁটাকাঠি থাকার কথা নয়, কে ফেলেছে, কেন ফেলেছে, এসব নিয়ে সেই মুহূর্তে মাথা ঘামায়নি মণি, কিন্তু এখন এটা কাজে লাগতে পারে। কাঠিটা ভেতরে ঢুকিয়ে যদি পিছন থেকে টিকটিকিটাকে আলতো খোঁচানো যায়, তাহলে হয়তো উঠে পড়ার চেষ্টা করতে পারে।
কিন্তু তাতে কি সত্যিই কাজ হবে? নাঃ, অত ভাবার সময় নেই এখন। সাড়ে সাতটা ছুঁইছুঁই।
মণি বারমুডাটা পরে নিয়ে, সিস্টার্নের ওপরে রাখা মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে, এগিয়ে যায় ঝাঁঝরির দিকে। উবু হয়ে বসে। কাঠি ধরা ডানহাতটা গর্তের কাছে আনে। আর, ঠিক তখনই…

রবি শাস্ত্রীর বিখ্যাত ‘ট্রেসার বুলেট’-এর গতিতে বেরিয়ে এল টিকটিকিটা। তারপর, আরও একটু গতি বাড়িয়ে ছুটে চলে গেল সিঙ্কের আউটলেট পাইপটার নীচে। ওখানে ডাঁই করে রাখা আছে দু-খানা বড়ো আকারের রং রাখার প্লাস্টিকের ডিব্বা, তিনখানা ছোটো রং রাখার টিন, এক জার টয়লেট ক্লিনার, এক জার ডিসইনফেকট্যান্ট সারফেস ক্লিনার, দু-বোতল মিউরিটিক অ্যাসিড, সঙ্গে আরও এটা-সেটা। সেগুলোর আড়ালে লুকিয়ে পড়ল সে।

মণি পিছন ঘুরে আর তাকে দেখতে পেল না।

Facebook Comments

পছন্দের বই