লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গল্প

তীর্থঙ্কর নন্দী

বটবৃক্ষদের আত্মকথা

মিলনপুরের গ্রামের রাস্তাটি মোট সাতটি পুকুরের পাশ দিয়ে এঁকে বেঁকে সোজা থানার দিকে চলে যায়। মিলনপুর থানা খুব বিখ্যাত। থানা ছাড়িয়ে রাস্তাটি চলে গেছে সোজা বাজারের দিকে। বাজারের আগেই বিশাল এক মাঠ। মাঠের মাঝখানে বড়ো আকারের একটি বটবৃক্ষ। বৃক্ষটি স্বাভাবিকভাবেই বেশ ঝাঁকড়া। ঝুড়িও নেমে এসছে। ফলে সন্ধ্যা হতে না হতেই এলাকাটি বেশি অন্ধকার অন্ধকার লাগে। মানুষজনের এই অন্ধকারটি বেশ পছন্দের।

বৃত্ত এবং তৃণা মিলনপুরেই থাকে। দু-জনেরই বাড়ি বাজার লাগোয়া। তবে তৃণা থাকে সামান্য দূরে। রেশনের দোকানের কাছে। দু-জনেই শৈশব থেকে প্রচুর বটবৃক্ষ দেখে আসছে। বিভিন্ন জায়গায়। স্কুলে কলেজে যেতে আসতে। বন্ধু বান্ধবদের বাড়ির কাছাকাছি। বিভিন্ন ভ্রমণস্থলে ইত্যাদি। কিন্তু মিলনপুরের এই বৃহৎ বটবৃক্ষটি তাদের অনেক আপন। কাছের। এর নীচে বসে হাসি কান্না ভালোবাসা গল্পগাথা সব প্রাণখুলে করা যায়। কখনো এই বৃক্ষ চোখ রাঙায় না। বাড়িতে রিপোর্ট করে না। রাগ করে না। এই বটবৃক্ষ সন্ধ্যার পর ছড়িয়ে দেয় অন্ধকার। স্নেহভরা ভালোবাসা। গোপনীয়তা।

নিত্য সন্ধ্যায় বৃত্ত আর তৃণা এই বটবৃক্ষের কাছে আসে। খবরের কাগজ বিছিয়ে বসে। শুরু করে কথামালা। গল্পগাঁথা। প্রেমকাহিনি। পরস্পরের ছোঁয়াছুয়ি। আবদার আহ্লাদ ধৈর্য অধৈর্যর খেলা কখনো মন কষাকষি। চোখজোড়া থেকে নেমে আসে জলবিন্দু। দুঃখ। রাগ বিরাগের গালগল্প। আবার বহুদিন শরীরের খেলা। বৃত্তর হাত চলে যায় স্তন জোড়ায়। যোনিপথে। মাংসল স্তনজোড়া তৃণার যেন খুব সুগন্ধযুক্ত। আকৃতি নরম। বৃত্তর হাত স্তনজোড়ায় পড়লে তৃণার চোখজোড়া বুজে আসে। মাথা বৃত্তর কাঁধে এলিয়ে পড়ে। আবার যোনিপথে হাত গেলে তৃণার নরম শরীর কেঁপে ওঠে। সুখে যেন কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ে। গোঙানি আসে। বটবৃক্ষটি তৃণাকে ঝুড়ি দিয়ে জড়িয়ে ধরে। আগলে রাখে। বেশি অশান্ত কামুক হতে দেয় না। তৃণাকে নির্দিষ্ট মাপে বেঁধে রাখে। একসময় রাত হলে দু-জনে উঠে পরে। বাড়ি চলে যায়।

এই শহরে নলবনের কাছে ঝাঁকড়া দু-টি বটবৃক্ষ। দু-টির মধ্যে দূরত্ব দু-শো হাত। একটি বাঁধানো। অন্যটি না-বাঁধানো। বাঁধানো বটবৃক্ষের নীচে নিত্য গল্পগুজব চলে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের। বৃদ্ধরা একটু আলাদা বসে। বৃদ্ধারা বসে একটু দূরে। নিজেদের মতন করে। এমনভাবে দুদল বসে যে কোনো দল তাদের গোপন কথা শুনতে পায় না। অথচ গল্পমালাসিঙ্গারা চলে। গল্পমালায় থাকে রস কষ বুলবুলি মস্তক।

দু-টি বটবৃক্ষই জানে নিত্য বিকাল সারে পাঁচটার পর কারা কারা আসতে পারে। বাঁধানোতে আসে সত্তরের বুড়ো নিলয় বাহাত্তরের বুড়ো অজয় পঁচাত্তরের বুড়ো জয়মাল্য আশির বুড়ো সুজয়। উলটো দিকে সত্তরের বুড়ি মাধুরী পঁচাত্তরের বুড়ি সরলাবালা আশির বুড়ি নয়নতারা পঁচাশির বুড়ি বৈজয়ন্তি। মোট আটজন বসে। বাঁধানো বটবৃক্ষ জানে এই আটজন কোনো হিসাব মিলিয়ে আসে না। চারজন চারজনের ভিতর কোনো আবেগ যুক্তি প্রেম বিরহ কিছুই নেই। আসে শরীর স্বাস্থ্যের দিকে তাকিয়ে। কেন-না এঁদের মোটামুটি সবারই ডাক প্রায় আসছে আসছে। ফলে সান্ধ্য হাঁটাচলা একটু নিজেদের ভিতর গল্প করা সবই আর-একটু বেঁচেবর্তে থাকার ওষুধ বাঁধানো বটবৃক্ষের নীচে বুড়োদের গল্প এখন সুগার প্রেসার প্রেস্টেট ইত্যাদি। এই বটবৃক্ষ জানে আগে অনেক তরুণদের সমাগম হত। সেই সমাগমে কি তখন নিলয় অজয় জয়মাল্য সুজয়রাই আসত! হয়তো তাই। বটবৃক্ষর স্মৃতি প্রখর। তার পাতাগুড়ি আজ থাকে কাল থাকে না। ঝড়াপাতার জন্য তার কম কষ্ট হয় না। যেমন আজ আর নিলয়ের স্ত্রী নেই। মৃগীতে মারা যায়। অজয়ের বড়োছেলে দুর্লভ আত্মহত্যা করে। বটবৃক্ষ সব জানে। বটবৃক্ষ যেন অনেকদিন আগে মাধুরীকে দেখে। শর্টকাট ফ্রক পরা। সবে ষোলোর যুবতী। ছিটকে যাচ্ছে যৌবন। ফ্রকটি ছিল সাদা কালোয়। সরলাবালা কি স্লিভলেস ব্লাউজে আসত! হতে পারে। পাতার ভিতরে এত যুবক যুবতী কাকদল যে বটবৃক্ষর খেয়ালও ক্ষীণ হয়ে যায়। শুধুই শব্দ সান্ধ্য কা কা। বটবৃক্ষ জানে নয়নতারা সরল মেয়ে। বিবাহ হয় চল্লিশ বছর আগে। ফর্সা গায়ের রং বৈজয়ন্তি খুব হেসে হেসে কথা বলত। এখনও এই বুড়ি বয়সেও বলে। ওর হাসিতে মাখানো থাকে এক মায়া প্রেম আদর।
দু-শো হাত দূরে যে-বটবৃক্ষটি সেখানে ইদানীং বসে ফ্রডেরা। মানে ঠগেরা। আগে আসত স্কুলের ছেলেমেয়েরা। কলেজের ছেলেমেয়েরা। গত কুড়ি বছর ধরে আসতে থাকে ফ্রডেরা। ঠগেরা। অর্থাৎ দেশ ডিজিটাল হওয়ার পর। হয়তো কথাটি ভুল। মানুষ তো আগেও ঠগ ছিল! বটবৃক্ষ ঠগের তারতম্য বোঝে। বটবৃক্ষ প্রেম অপ্রেমের ভাষা বোঝে। কান পেতে শোনে ঠগেদের বাক্যালাপ। ইদানীং রনো রুনি আসে। হাতে দামি অ্যানড্রয়েড। অনেক বাড়তি সুবিধাও আছে মনে হয় এই সেটে। বটবৃক্ষের একদম উত্তরের কোণে দু-জনে বসে। একটু ঘন হয়ে। মনে হয় যেন প্রেমিক প্রেমিকা। কিন্তু তা না। দু-জনেই বর্তমান সময়ের ফ্রড। ঠগ। খুব চাপা গলায় দু-জনে কথা বলে। এমন চাপা যে বাতাসের কানও জড় ভোঁতা হয়ে যায়। অথচ নরম বাতাস দু-জনের আসে পাশে ঘোরাঘুরি করে। বটবৃক্ষের কচি পাতা দোল খায়। রনো রুনিকে দেশের কোণে কোণে ফ্রডেদের গল্প বলে। দু-জন দু-জনের ফ্রড বন্ধুদের কনট্যাক্ট নম্বর সেভ করে। মেসেজ করে ইত্যাদি। কবে কোন ব্যক্তির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করতে হবে কীভাবে করতে হবে কোন কোন ব্যক্তির ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট কী পরিমাণ অর্থ আছে এদের সবই ঠোঁটস্থ। মুখস্থ। এরা সপ্তাহে দু-একটি করে অ্যাকাউন্ট পুরো সাফ করে দেয়। এই সাফের পিছনে এদের প্রচুর মাথা ঘামাতে হয়। খাটতে হয়।

নিত্য নতুন রহস্যময় গল্প ভাবতে হয়। আর সেইসব রহস্যময় গল্প একদমই গাঁজাখুরি নয়। গল্পগুলি ব্যাঙ্ক গ্রাহকদের কাছে বকুল ফুলের গন্ধের মতন নেশা ধরায়। নেশায় ঘোর লেগে নিজস্ব ব্যক্তিগত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সব গোপন তথ্য এক এক করে দিতে থাকে। অ্যাকাউন্ট খুব মসৃণভাবে জিরো ফিগারে নেমে আসে ইত্যাদি।

ব্যস্ত শহর থেকে একটু দূরে হৃদয়পুর। একটু দূরে বলতে বাসেও যাওয়া যায়। ট্রেনেও যাওয়া যায়। বাসে গেলে এক ঘণ্টা। ট্রেনে গেলে এক ঘণ্টা পাঁচ মিনিট। হৃদয়পুর স্টেশনে নেমে ডান দিকের ওভার ব্রিজের নীচে বিখ্যাত বিরিয়ানির দোকান। মাসি মেসোর। এই দোকানে মটন বিরিয়ানি দু-শো! মসৃণ আলু। নরম। মাংস যেন জিভে ঝোলানো। দাঁত কাঁপে না। দাঁতে জোরও লাগে না। হাড় থেকে নিঃশব্দে মাংস খুলে আসে। এই দোকানে বিরিয়ানি খেয়ে যদি একটু এগোনো যায় চোখে পড়ে সুড়কির রাস্তা। একটু লালচে। সেই লালচে রাস্তার পাশে মানে বিডিও অফিসের কাছাকাছি একটি বিখ্যাত বটবৃক্ষ আছে। রাস্তার পাশে বলে বটবৃক্ষের গুঁড়ির কাছে সাদা মার্কিং আছে। যারা গাড়ি নিয়ে আসে তাদের সেই সাদা মার্কিং-এ অনেক সুবিধা হয়। কেন-না রাস্তায় আলোগুলি দেখলে মনে হয় অনেক পুরোনো অথচ আলোয় রশ্মি এত নরম নিস্তেজ যে কোথায় গাছ কোথায় পুকুর কোথায় কচুবন কিছুই বোঝা যায় না।

আজ শনিবার জ্যৈষ্ঠের দশ। একটি কালো নেক্সান গাড়ি এসে থামে। গাড়িটি নতুন মডেলের। গাড়ির কাচও কালো। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই কে ভিতরে। বটগাছের কাছে এসে গতি ধীর হয়ে যায়। গাছ ছাড়িয়ে আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে গাড়ি থামে। নামে দু-জন মধ্যবয়সি মানুষ। একজন পুরুষ। একজন মহিলা। বটবৃক্ষ বেশ ভালোই চেনে দু-জনকে। নাম প্রিয়ক। প্রিয়া। বটবৃক্ষ জানে প্রতি শনি রবি দু-জন আসবেই। ঘাসে রঙিন রুমাল বিছিয়ে ঘণ্টাখানেক ধরে নীচু স্বরে চলবে গল্প আড্ডা চুমাচুমি। বদান্যতা অসভ্যতা। বটবৃক্ষ গত তিন বছর ধরে দু-জনেরই চেনে। দু-জনেই পরকীয়াতে লিপ্ত। দু-জনেরই গোছানো সংসার আছে। নিজস্ব বাড়ি আছে। দু-জনেরই একটি করে সন্তান আছে। তবুও কেন কীসের টানে এই পরকীয়া! কেন সংসারকে ফাঁকি দিয়ে এতদূরে আসা। পরকীয়াতে গোপনীয়তা বেশি থাকে বলেই কি এত আনন্দ! মজা! অথচ পরকীয়াতে যে-রক্তমাংসের শরীর আছে সাজানো গোছানো সংসারেও তো সেই রক্তমাংসের শরীর থাকে! তবে কেন পরকীয়াতে এত আনন্দ!

হৃদয়পুরের বটবৃক্ষটি একটু পৃথক। সে সব বটবৃক্ষর সঙ্গে নিজেকে মেলায় না। এই বটবৃক্ষ অনেক বটবৃক্ষর কথা জানে। প্রিয়ক প্রিয়া নিজেদের ভিতর আলোচনা করতে করতে জানায় গত দু-বছর কোন কোন বটবৃক্ষের নীচে তারা গল্প করে। বদান্যতা করে। অসভ্যতা করে। প্রতিটি বটবৃক্ষ প্রিয়ক প্রিয়ার বদান্যতা চেনে। পরকীয়া চেনে। হৃদয়পুরের বটবৃক্ষর নীচ থেকে নেক্সান কালো গাড়ির কালো কাচে ঢাকায় বাড়ির ফেরার পথে মাসি মেসো বিরিয়ানির দোকানে একটু প্রিয়ক থামবে। থেমে প্রিয়ক নামে। প্রিয়া গাড়িতে বসে থাকে। জানি না কেন প্রতি শনিবার রবিববার প্রিয়া গাড়িতে বসে থাকে। বটবৃক্ষ দূর থেকে দু-জনকে দেখে। বটবৃক্ষর কি কোনো অন্তর্দৃষ্টি থাকে! তার ডালের ভিতর দিয়ে! কচি পাতার ভিতর দিয়ে! প্রিয়া একজন সংসারী মহিলা। সন্তান-সহ সুখে সংসার করে। তবুও কেন পরকীয়ার এত টান! প্রশ্নটি কিন্তু এই সমাজে কারোর কাছে নয়। একমাত্র বটবৃক্ষর কাছে। বটবৃক্ষই জানে সব উত্তর। বটবৃক্ষরাই জানে সবার উত্তর। ফলে এখানেই শেষ হল বটবৃক্ষদের আত্মকথা গল্পটি।

Facebook Comments

পছন্দের বই