লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কবিতা

অর্ণব রায়

সংসাররাত্রিকোরাস

রাতের প্রথম যামে মার্জারপ্রভাতগীত,
মৎস্যঅন্নলোভে দরোজা আঁচড়ায়ন ও প্রবল লুটোপুটি,
তৎসহ যে রাগিনী গৃহস্থের দুয়ারে অনুষ্ঠিত হয়
তার দর্শক ও শ্রোতা কিছু শুকনো পাতার ওপর একটি বিপুল ব্যাঙ
আর প্রবল প্রতাপশালী রাত। পাহারাওলাদের শ্বাসবায়ু
হুইসেলে, হাত সাইকেলে, নজর গৃহের দিকে থাকে। তারা
ধর্তব্যের মধ্যে নেই।

অনুকম্পা নিতান্ত সুলভ। সকালেই পাওয়া গেছিল। ভাত
ও দুধের রূপে। এখনও পাওয়া যেবে। পায়ে মুখ ঘসাঘসি ওলটপালট
ইত্যাদি কিছু সঙ্গত লাগবে। তার আগে কিছু আরশোলা টিকটিকি
পোকা ও ইঁদুর। রাতের প্রথম যামে
শিকার ও শিকারীর যৌথসংগীত।

দ্বিতীয়ার্ধে নিদ্রাকর্ষণ। অন্ততঃ চেষ্টা। না আসে তখন ব্যবস্থা
অন্য। ইতিমধ্যে কোলাহল আলাদা মাত্রা নিয়েছে। কিছু বালক মার্জার সহ
একত্রে মনোবাসনা ব্যক্ত করতে চায়। সঙ্গতে টিকটিকি। বালকদের শিশুটি
বেড়ালের মৎস্যটি সংসারের দুধের বাটিটি— একসাথে বেজে চলেছে
দরোজার ওপারে।

পৃথিবীর কোনও ফাটলবশে মায়ায় চড়ে এরা আসে। গৃহস্থকে দায়ী
করে অকালে চলে যাবে বলে বুঝি— এরকম বুঝে নিদ্রার বুকের
কৃষ্ণবর্ণ কুঞ্চিত লোম ধরে টানাটানি। বাক্য সমাপ্ত হওয়ার আগে অভিভূত হওয়া।

নববিধান, সুসমাচার


ভিক্ষান্নে কি জীবন বাঁচে? তাই দু-চারটে হত্যা, মা।
প্রতি শনি-মঙ্গলে লোকালয়ে আসতে হয়। গুরুর আদেশ।
তাছাড়া সেলাই করা কাপড় পরতে মানা। না মা,
আমাদের গেরুয়া নয়। গেরুয়া সব মঠ মিশনের। আমাদের
এই বর্ণহীন। না, সাদা না, কালো না। বর্ণহীন।
হ্যাঁ, রক্ত লেগে যাবার ভয় তো থাকেই। তাছাড়া
আজকাল এত মানুষ বেড়ে গেছে! খুব সাবধানে
চলতে হয়। দড়ি, দড়িই ভালো মা। পেছন থেকে। গলায়।
হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনি শুধু চালই দিন। প্রত্যেক হপ্তায় কি আর
ডাল আলু ব্যাঞ্জন জগাড় থাকে! আমাদের মা ভিক্ষান্নে জীবন।
অত বাছবিচার করলে হবে?


হিমচতুর্দশীর রাতে আমাদের করোটি গুনে গুনে ঘরে তোলা হয়।
আমাদের গুরুমা, নিজ বেশবাশ সামলে হাড়ের ফটফটে
মেঝেতে আমাদের অন্ন দেন। সে অন্ন খাবার নিমিত্ত নয়।
অশুভসংযোগে সে অন্ন ত্যাজ্যজ্ঞানে শরীরের বাঁ
দিকে ফেলে এগিয়ে যেতে হয়। অন্নে পুষ্ট শরীর
সেই সঙ্গে একটু একটু করে ত্যাগ হয়। মানুষের সংযোগ
তবু থেকে গেলে আমরা তাকে দেহের মায়া মনে করে
যতদিন দেহ আছে, লক্ষীর ভাঁড়ের খুচরোজ্ঞানে
রেখে দিই। শবানুগমনে খরচ করি।


কাহিনীও আমাদের আরাধ্য। বিশেষ কল্পনাবশে
তার বিশেষ সাকার মূর্তি জেগে ওঠে। সমবেত মানসপট
তখন আমাদের আচমনঘর। ধোঁয়া, উনুনের তাপ ও
আন্তরিক ইচ্ছার চাপে তিনি দৃশ্যমান হন। কী তার রূপ
বেরোবে তা নিয়ে জল্পনার শেষ থাকেনা সন্ধ্যে থেকে।
আরাধ্য বটে, কিন্তু তিনি আমাদের সকড়ি দেবতা।
দর্শন হলে হাত ধুতে হয়, ছুঁয়ে দিলে একজীবন চান
করবার বিধান। না মা, আমাদের যেসব বইপত্তর,
যা আমরা মেলাটেলায় বিলি করে থাকি, সেখানে এই দেব্‌তার
কথা পাবেন না। গৃহস্থে এনার আরাধনা করতে পারবে না।
সইবে না।


প্রতিটি শ্বাস ঘৃণাভরে নিতে হবে। প্রতিটি শ্বাসের
ঘৃণা দমে দমে পাকিয়ে দেহভান্ডে পরতে পরতে জমা হবে।
কালো চটচটে, অল্প অল্প দানা। এই আমাদের নিত্যকর্ম।
দেহ থেকে শ্বাস বের হলে যেন সেই জমে থাকা ঘৃণার
ওপরের বাস্প বের হয়, এমনই আশ্রমের আদেশ।
আমাদের সাধনা ঘৃণায় সুস্থিত হওয়া। আমাদের ইষ্ট আত্মলোপ।

মধ্যবিন্দু

আকাশে রাত। পৃথিবী কথার ভারে ঝুলে আছে।
ভয়াবহ মনোযোগে কপালের মধ্যবিন্দু পুড়ছে ধীরে।
সুগন্ধ ধোঁয়া ঘনিয়ে উঠছে কপালের ঘর ঘিরে,
সে ঘরে হাঁটু বুকে নিয়ে বসে আছে চারখানি জোয়ান পুরুষ,
আর কোনও আসবাব নেই সেই সাদা চুনকাম করা ঘরে, শুধু দেওয়াল
তোমার হাত পিছু থেকে ধরে ধরে রাতের শুরুতে এই ঘরে এলাম,
বিবাহের পরেও তোমাদের গ্রামে তোমার কক্ষে রাত কাটানো মানা—
এরকম স্বপ্নে বহুবছর পরে, ঠিকঠাক দশবছর পরে তোমাদের দাওয়ায়
চারপাই পেতে ন্যাড়া পাহাড়ের কোলে শুতে হবে শুনে রাত থাকতে থাকতে
এখানেই চলে এলাম। এখানে পাহাড়ের কপাল, ঠিক মধ্যবিন্দু পুড়ছে
আর রাতের তারার মাঝে অগুনতি তারার মাঝে মানুষের কথার ভারে
ভারী আরও ভারী হয়ে ধীর ও ক্লান্ত অনিচ্ছায় ঘুরছে পৃথিবী—

কারা যেন এখানেই থাকে। আমি ভেদ করে যে চারজন বসে
আছে, তারা থাকে, তারা বাদে আরও কারা যেন এখানেই থাকে,
আমাদের মধ্যবিন্দু দিয়ে যাতায়াত করে, ঘরের কাজ করে,
মাঝে মাঝে নিজেদের মধ্যে বলে, বোধহয় আরও কেউ এখানেই
থাকে। কথার ওপরে কথা চেপে চেপে ভার। ঘোরে। আকাশে
রাতের ওপারে আরও আরও রাত

Facebook Comments

পছন্দের বই