লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কবিতা

দেবজ্যোতি রায়

বাড়ি

দীর্ঘ ভ্রমণের পর রক্ত গড়াচ্ছে পা ফেটে
শরীরে বাতাস ঢুকে উড়ে গেল চৌহদ্দি, ঠিকানা।

এ পাড়ায় সব নেমপ্লেটই ঝাপসা
বাড়ির দরোজাগুলো একই ছুতোরের তৈরি!
সূর্যাস্ত রঙের বাড়ি শনাক্ত হলো না

বিস্মরণের ভেতর গৃহচেতনার আভাস পেয়েছি
খুঁজেছি যুবকবেলা, হারানো চোখের মৌতাতে
বাড়ির গঠন নিয়ে অলীক ধারণা।
সংসার ক্রমশ অশরীরী হয়ে উঠছে

রান্না হচ্ছে ফুলের পাপড়ি,
থালায় থালায় নীহারিকা আলো।
চলো, কুয়োর ভেতর খোঁজ করি
গৃহচ্যুত জীবনের ছেঁড়া অ্যালবাম

চালকবিহীন সাইকেল ছুটেছে দিগন্তপথে
তাকে জিজ্ঞাসা করি বাড়ির ঠিকানা!

চুল দাড়ি পাকছে, চোয়াল শিথিল হচ্ছে
সন্দেহ আরও তীব্র
একসময় নিজেই ঢুকে পড়ি সন্দেহ তালিকায়।
একখণ্ড আমি অন্য খন্ডকে সন্দেহ করে
এক টুকরো সাদা মেঘ সন্দেহ করে কালো টুকরোকে।

বাড়ির আপেক্ষিকতায় ভাসছে বাড়ি
ঘুঙুরের এক লহমা ধ্বনির মতো কম্পিত বর্তমান,
অতীত, সমুদ্রের জোয়ারভাটা
ভবিষ্যৎ, অন্তহীন চিৎসাঁতার।

মরণোত্তর

বুনোফল ফুটো ক’রে ঢুকেছে পোকা ও শূন্যতা

ফলের শরীর নিঃশেষ করতে চায় পোকা
শূন্যতা নিশ্বাস ফেলে
সারসের ঠোঁটে ভেসে আসে তিলক কামোদ

তুমি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, প্রেমে, রূপান্তরে।
প্রতিশ্রুতি ঘুরতে থাকে অ্যান্টিক্লকওয়াইজ
দূরে অরুন্ধতী আরও ম্লান

হারানো পথের রেখা রাত্রির আকাশে
আরেকটু উদাস হোক মন

টের পাওয়া যায় প্রতিশ্রুতির মধ্যে
বসে আছে পুরোনো ঘাতক
আত্মপক্ষ, মাংস, শোণিত ও ত্বক।

আশমানে ভাসছে বাকি কথাগুলো
কবে তোমাকে শোনাতে পারব?
আমার সব অবয়ব ভেঙে পড়ছে
দুই কানে শববাহকের পদধ্বনি

পান ও সুপুরি মুখে নিয়ে কথাগুলি
জেগে উঠতে চায় মরণোত্তর!

তুমিই পারদ, অধরাও তুমি

স্টেশন, বাজার, জনপদ ঘুরে দিনশেষে
বোবা ভিক্ষাপাত্র ঘুমিয়ে পড়েছে।
অর্থনীতির প্রশ্নে বাটিটি সূচকমাত্র
চারপাশে বাজারের জলস্রোত, কলকোলাহল
উড়ালপুলের শীর্ষে, মন্দির চাতালে বাটি
বৃদ্ধ, পঙ্গু, জরাগ্রস্ত ভিখিরির হাতে হাতে ওড়ে।

চাল ও কাঁকর ছাড়া আর কোনো সঞ্চয়মাহাত্ম্য নেই
কয়েনের তালে তালে গাছে ফুল, ডালে পাখি
জলে মাছ, খেতে শস্যের হাওয়া।

বাটপাড় উৎসাহ হারায় চোরের ওপর
নিঃস্বতায় কোনো ফাঁকি নেই
এখন সমস্ত গান অরাজনৈতিক।

সৎকার সমিতির গাড়ি চড়ে আমরা বেড়াতে যাব
পকেটে রয়েছে মৃত্যুর সার্টিফিকেট।

স্বপ্নের ফাতনা কাঁপে। স্থির চোখ, আশ্রম আঙিনা।
অন্ধ দোহার মনে মনে দেখে—
জ্যোৎস্নায় স্নান করে বোবা হরিমতি

যুগলমূর্তির পরা ও অপরা
বাজারদরের মতো ওঠানামা করে
এক পাশে হরিমতি, জ্যোৎস্না, চরণমঞ্জীর
অন্যদিকে রাশি রাশি শূন্য থালা বাটি।

ফ্রেম

ফিরে এলাম স্টেশন থেকে বাড়ি
রেল-টিকিট উড়িয়ে দিয়ে হাওয়ায়
কোথায় যেন যাওয়ার কথা ছিল?
দরজা জুড়ে ঘুণের স্মৃতি আঁকা

ক্রুশকাঠের মরচে পড়া পেরেক
শরীরে গেঁথে দাঁড়িয়ে আছো, একা
চাবির গায়ে রক্তছাপগুলি…
কিছু শকুন পাক খাচ্ছে দূরে।

আমাকে ডাকে বেদনাহত শেকড়,
ছয়টি নদী, পদ্মফুলে ভ্রমর,
মনে পড়ছে? মহানিমের ছায়া
শিশিরভেজা ঘাসের আপ্যায়ন।

আকারহীন বাড়ির কার্নিশে
বালি, পাথর, ইটের শূন্যতা।
তোমার গানের দৈব স্বরলিপি
ভেসে যাচ্ছি, রোগা পাতার মতো

শালিক হাঁটে উঠোন জুড়ে পা
পেরিয়ে যায় ত্রিমাত্রিক ফ্রেম
ফিরে এলাম, বোবা দেয়াল বাড়ির
বিন্দু বিন্দু পিপাসা জমে আছে।

কীটাণুকীট

কুণ্ডলী পাকিয়ে আছ স্বপ্নে, আধখাওয়া ফলে :
সনাতন কীট ঢুকছি গরুর কানে, মৃতের শরীরে

দূর থেকে লক্ষ রাখে রাত্রিবর্ণ কাক—
কাকের ঐতিহ্য আমি কপালে ঠেকাই
আমার তিনকুল কাকের জঠরে বসে
অন্নজল গ্রহণ করেছে।

বায়ুভূত পরিচয় নিয়ে বন্ধুরাও আসে

যা চেয়েছি সবই কুণ্ডলিত,
সাপ ও কেঁচোর মধ্যে শরীর বদল হয়
বদলায় আধার, আধেয়।
সময়ের হতবাক প্রান্তে বসে ঝিমোয় গোরুর গাড়ি,
কালিমাখা লন্ঠনের আলো।

বুঝতে পারি না, তক্ষকের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল
নাকি, তোমাকে জড়িয়ে ধরছি রাক্ষসের হাতে!
তুমি সেই নিরাকার, অপরিবর্তিত
আকাশের রঙে ভাসমান

আমার বিভ্রম, রক্তের স্বাদ খোঁজে শেয়ালের জিভে,
দাবার চৌষট্টি খোপে বোড়ের ভূমিকা
থেকে সরে এসে
ষাঁড়ের অন্ডকোষে কান পেতে শোনে
আদি স্তব, ব্রহ্মকমলের।

Facebook Comments

পছন্দের বই