লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কবিতা

মহিউদ্দিন সাইফ

রিমিল-পিয়ং কথা


পিয়ং-এর মতো অস্ট্রিক কন্যা রিমিল কখনো দেখেনি।
ওড্রো দেবীর সাথে সুমার সে রূপ প্রাঞ্চ অভিঘাতে। খেরোয়াল ভাষার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে নামতে মুখোমুখি, মুলাকাত হল
আর সেই খ্যান নিরুপাখ্য মধুর ধারা
করমডাল থেকে টিপিটিপি ঝরে পড়ছে ফুল…
সেই দৃশ্য, পাগল জারহি, ছুটে বেরোচ্ছে
জলের ছাওয়াল খুশবু-হরিণ…

এসব মর্ম একা যখন একলা রিমিল,
ডাগর দুটি চোখ দিয়ে নির্মলা জল, দরিয়া নাজুক,
দেশ পেরিয়ে খজকামান আর হারাতা পাহাড়,
আরও দূরে জারপি-চায়চাম্পা ফেলে বয়ে যাচ্ছে
নদী, আরও দূর কোনো দেশে…


চিলেছাদে ভাতঘুমের অবসর,
আর দিদিবুড়ি গেছে বেনাকুচির বনে
ঘরপিছে আড়বাঁশি, রোদেভরা দিন
বাজিয়ে বাজিয়ে একঠার, দুলছে রিমিল
দেখে লেবাস শুকানোর ছলে পিয়ং এসেছে,
আর ‘সুই উড়… সুই উড়…’ বলে খিলে উঠল
বিমুগ্ধা রাধিকা…

আমের বোলের রীত মগ্না আকাশ হতে
দিব্য সাদম মস্ত এক, নেমে এল
প্রাচীন হৃদয়বারি পান করতে
আর যাবার খ্যানে ফেলে গেল মুখের ফেনাটি

সরিয়ে নাকাব, মধুর হাওয়ার স্রোত
নিরাময় স্রোত আর হাওয়ায়
ভেসে বেড়াচ্ছে রিমিল-পিয়ং, ফেনাটি মান্দাস
দুটি আদিঅন্তহীন পাখি
তেলেশমাতি ভেসে যাও পাখি, লিটার উঠান থেকে
ওই দূরে
মানুষ জন্মেছিল জেনে যেদিকে উদয় হচ্ছে
নরম সঘন দাড়ি মিহির দেবতা…


সারা রাতের নাচের ক্লান্তি পুষিয়ে নিচ্ছে ঘুম। আলগা জুড়াটি থেকে ফিরাক নিয়ে পড়ে আছে
বিছানায় গুলাব, চাম্পা আর সাদা তোয়া-বাহা।
পুন্নিমার রাতটুকু ওরা হাত ছুঁয়ে বসেছিল,
তারপর বিরহী জীবন এল, রেখে গেল দুইফোঁটা
সিপির উপরে অশ্রুজল…
মনে হল এই সেই জল যা কেবল ছিল সর্বপ্রথমে,
আপন হৃদয় চিরে বের করে এনেছিল
জনক-জননী, সেই হাঁস ও হাঁসিল…

পাশের মোড়াটিতে বসে রিমিল
না-বোঝা চোখ দেখছে গয়েবী, ঘুমন্ত পিয়ং
কেমন ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে শিরম-গাছের দিব্য শিকড়,
তার মোড়াটি এক বিশাল শিরমপাতা
নীচে অপরূপ অগাধ অথৈ জলরাশি…


বাস থেকে নামতেই টেনে ধরল হাত
অপেক্ষায় চুর দুই চোখ দেখল মর্ম
আর মর্মের ভেতরে মায়াবী পিয়ং

শ্বেতপদ্দের পারা দুবরাজি বাজু
কাঁকালের ঝালর চটুলা মদির,
গায়… হাসে…
কানের লতির খানে করঞ্জার ফুল
ষোড়শী বাতাসে বাসে বিস্ময় সুবাস

এই অপলক দেখাটুকু দেখতে দেখতে
আসমানে আবের চাকা মেঘ নিচে জানুমধুন
ছেয়ে গেল আদিগন্ত মাঠ-ঘাট-পথ
পাশে ঘোঙার মতন টাঁড়, লসুৎ বুরুই
ওরা চেপে দেখল –
কে একজন মাথায় গামছা বেঁধে, প্রত্যুষ বদনে
বুনে চলেছে সাগাঘাস, সার্জম, মহুল, পিয়াল, বান্দলতা, কাশি আর আবহমান সময়ের বীজ
বুনে চলেছে আশ্চর্য জাহানে…


ভোরবেলা ঘুম ভাঙার আগেই এল সাবিলা পিয়ং

ঘরের মাঝারে সেই আদিম লোবানের  ঘ্রাণ
সেই শিল্পীত উন্মাদ সুবাস, প্রথম আশনাই
আর আলমের আনাচেকানাচে জাগা সুষমা আলপনা
যেন পায়ের নেউর হতে ছড়িয়ে পড়া মোতি
সামের শোলোক

এই স্বপনটুকুন দেখে
চোখ খুলতেই দেখল রিমিল ঝুঁকে আসা মুখ,
সটান গেল সরে—
এতদূরে, যে আর ছোঁয়া গেল না এ জনমে
এ জাহানে একবারও

তিরিল ডালের থেকে ঝরে গেল চাঁদ
নিচে আতশগুঁড়োর পারা ছড়ানো লিয়র
যতনে বেছে রাখা হলুদ
অমলতাস, হরিদ্রা, চাম্পার থেকে,
সব কালো হয়ে মিশে গেল রাতে—
যে রাত প্রথম জাগা আম পাতার পারা
যে রাত শুকিয়ে যাওয়া আম পাতার পারা…

Facebook Comments

পছন্দের বই