লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গদ্য

অমিতজ্যোতি সেনগুপ্ত

একজন দক্ষ প্রশাসক এবং একজন রুচিশীল সাহিত্যিক

গত ২২-শে ফেব্রুয়ারি চলে গেলেন অমিতাভ মৈত্র। সাহিত্য জগতের বিরাট ক্ষতি তো হলই, আমি হারালাম আমার এক বন্ধু ও প্রাক্তন সহকর্মীকে। একই সার্ভিসের সহকর্মী হওয়াতে, আমরা যে যেখানেই থাকি না কেন, আমাদের প্রায় ১৭০০ আধিকারিকের ডব্লিউ বি সি এস (এক্সিকিউটিভ) ক্যাডারের সবার মধ্যেই একটা অদৃশ্য যোগাযোগ সবসময়ই থাকে। তাই ওঁর সাথে ২০০৭ সালে রায়গঞ্জে সাক্ষাৎ হওয়ার আগেই ওঁর বিষয়ে অনেক সংবাদই আমার জানা ছিল। ওঁর জলপাইগুড়ি এবং পরে ঘাটাল মহকুমার মহকুমাশাসক হিসেবে প্রশাসনিক দক্ষতা আমাদের কাছে উদাহরণ হয়ে থাকবে। বিশেষ করে ঘাটাল মহকুমার প্রচণ্ড বন্যা পরিস্থিতি উনি যেভাবে ঠাণ্ডা মাথায় সামলেছেন তাতে উনি রাজ্য সরকার এবং সার্ভিসের সম্পদ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছেন।

অমিতাভদার সরকারি কর্মজীবন আরম্ভ হয় ভূমি-সংস্কার দপ্তরের আধিকারিক পদে। ১৯৮৩ সালে রাজ্য সরকার বিভিন্ন দপ্তরের কর্মরত আধিকারিকদের মধ্য থেকে ডব্লিউ বি সি এস (এক্সিকিউটিভ) অফিসার চয়ন করার জন্য একটি বিশেষ পরীক্ষা নেন এবং সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উনি সার্ভিসে যোগ দেন ১৯৮৬ সালে। প্রশাসনে ভূমি ও ভূমি-সংস্কার দপ্তরের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা আছে কারণ প্রত্যেক দপ্তরেরই উন্নয়নের স্বার্থে ভূমির প্রয়োজন। চাকরির শুরুতেই সেই দপ্তরের অভিজ্ঞতা নিয়ে কাজে নামায় ওঁর কর্মদক্ষতা সবসময়ই প্রশ্নাতীত ছিল।

অমিতাভ মৈত্রর সাথে আমার প্রথম দেখা হয় ২০০৭ সালে, আমি যখন উত্তর দিনাজপুর জেলা গ্রাম উন্নয়ন সেলের প্রকল্প নির্দেশক পদে যোগ দি। উনি তখন জেলা ভূমি ও ভূমি-সংস্কার আধিকারিক পদে আসীন। খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদ এবং ভূমি-সংক্রান্ত অনেক জটিল সমস্যার সমাধান অধস্তন পর্যায়ে সম্ভব না হওয়ায়, সেগুলো সমাধানের দায়িত্ব এই পদের ওপর বর্তায়। এছাড়াও ছিল অতি সংবেদনশীল ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়। অমিতাভদাকে দেখেছি খুব নিপুণভাবে আইনের বিশ্লেষণ করে এবং একই সঙ্গে যথাসম্ভব মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে সব সমস্যাকেই গ্রহণযোগ্য সমাধানের দিকে নিয়ে যেতে। এ-কথা সর্ববিদিত যে নিরপেক্ষ সরকারি সিদ্ধান্ত সবার পছন্দের না-ও হতে পারে। অনেক সময়ই বিভিন্ন ধরনের চাপ এসেছে সিদ্ধান্ত পাল্টাবার জন্য, কিন্তু ওঁর মতো একজন স্পষ্টবক্তা এবং ধীর স্থির আধিকারিকের পক্ষে ওইসব চাপকে নস্যাৎ করে দেওয়া একেবারেই কঠিন ছিল না। তা সত্ত্বেও ক্ষমতাশালীর আঘাত নেমে আসতে দেখেছি, দেখেছি ওদের নতজানু হয়ে ক্ষমা চাওয়া এবং ক্ষমাশীল অমিতাভ মৈত্রর সব ভুলে পরিতাপীকে ক্ষমা করে দেওয়া। ওঁর চরিত্রের এই দিক ওঁর শুভাকাঙ্ক্ষীর সংখ্যা ক্রমশই বর্ধমান রাখত।

এক বছরের কিছু বেশি উত্তর দিনাজপুরে থাকার পর আমি বদলি হলাম নদিয়ার জেলা ভূমি ও ভূমি-সংস্কার আধিকারিকের পদে। তার কিছুদিন পরেই অমিতাভ মৈত্রও নদিয়া চলে এলেন জেলা পরিষদের অতিরিক্ত নির্বাহী আধিকারিক হয়ে। আবার কিছুদিন এক জেলায় কাজ করলাম আমরা। রাজ্যের ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সর্বোচ্চ স্তরের অতিরিক্ত নির্বাহী আধিকারিককে কার্যত নির্বাহী আধিকারিকের সম্পূর্ণ দায়িত্বই সামলাতে হয় কারণ নির্বাহী আধিকারিক অর্থাৎ জেলাশাসকের ব্যাপক ব্যস্ততার মধ্যে জেলা পরিষদে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করা সম্ভব হয় না। একারণেই অতিরিক্ত নির্বাহী আধিকারিক পদের প্রণয়ন। এই ভূমিকায়ও সম্পূর্ণ সফল অমিতাভ মৈত্র। শাসক ও বিরোধী দলগুলোর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সরকারি আইন বুঝিয়ে জেলাকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যেতে ওঁর কোনো অসুবিধাই হয়নি। আইন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, স্পষ্টবক্তা এবং ধৈর্যশীল আধিকারিক হওয়াতে ওঁর কাজ উনি নিজেই খুব সহজ করে নিয়েছিলেন।

সময়ের প্রভাবে আমরা দু-জনেই জেলা থেকে বদলি হয়ে রাজ্য সরকারের মহাকরণের বিভিন্ন দপ্তরে যোগদান করলাম, প্রথমে উপসচিব এবং পরে যুগ্মসচিবের পদে। যুগ্মসচিব থাকাকালীনই অমিতাভ মৈত্র সরকারি চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করে সাহিত্যের প্রতি সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করলেন খুবই আনন্দের সাথে। উনি প্রায়ই বলতেন সরকারি আধিকারিকের সাহিত্যচর্চা হচ্ছে বিগ ব্রাদারের নজরদারিতে নিজেকে প্রকাশিত করা। লেখার সময় সতর্ক থাকতে হয় যা লিখছি তা ন্যায্য কথা হলেও কোনো সরকারি নিয়মকে আঘাত করছে না তো! আসল প্রতিভার প্রতিভাস হয় আধিকারিকের সঙ্গে বাধানিষেধরাও অবসর গ্রহণ করলে।

অমিতাভ মৈত্র সময়ের আগেই চলে গেলেন, কিন্তু ছাপ রেখে গেলেন একজন দক্ষ প্রশাসক এবং একজন রুচিশীল সাহিত্যিকের। ভালো থাকুন অমিতাভ মৈত্র।

Facebook Comments

পছন্দের বই