লেখক নয় , লেখাই মূলধন

অগ্রন্থিত গদ্য

রাত্রি রচনা করেছে যাঁকে

“Find by means of this face, what it means to be confronting the infinite world.”
— Rilke.

কোনো গভীর বন্ধনে যেন বাঁধা ছিলেন রিলকে ও রাত্রি। রাত্রির মতোই গহন রহস্যময়, আর একা একজন মানুষ আর তারায় ভরা রাত্রি যেন নাছোড় জান্তবতায় জড়িয়ে আছে পরস্পরকে। রাত্রি বার বার প্রিয় মোটিফ হয়ে ফিরে এসেছে তাঁর কবিতায়। সেই রাত্রি কখনো ঘুমের মধ্যে আমাদের শিরায় শিরায় প্রবাহিত রক্তের মতো শান্ত। আবার কখনো নীচে দেওয়া কবিতাটির মতো বিদ্বেষপূর্ণ—

“When I approach a window, over there/some one who’s dying turns to in maybe/groans, gazes, and devours me dyingly.” (For Lotte Pritzel) যেখানে একজন মুমূর্ষুর তীব্র চোখ নিয়ে জানলার বাইরে থেকে রাগে গরগর করতে করতে রাত্রি খেতে শুরু করছে কবিকে।

হতেই পারে তাঁর অনেক কবিতা রাত্রির প্রসঙ্গ থেকে বহু দূরে, কিন্তু বিলকের কবিতার প্রতি শব্দে, এমনকী তাঁর ভাবনা ও যাপনের সবকিছুই রাত্রির আত্মা থেকে উঠে আসে। যেন অন্তর্নিহিত রাত্রি নিয়ন্ত্রণ করে তাঁকে। জীবনানন্দর কবিতা ও যাপনেও একধরনের রাত্রির উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। মনে হয় এই কবি রাত্রির রচনা।

“My shy moon-shadow has something to say to my sun shadow from far away in the language fools can share. I between an illumined sphinx, that stand establishing silence on either hand, have given birth to the pair.” (Antistrophes)

রাত্রিকে নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছেন রিলকে। এইসব কবিতা যেন জীবনের অপার বিস্ময় আর রহস্যের, এক মহান বিশালতার, এক সীমাতিক্রান্ত নিয়েতার সামনে মানুষের তুচ্ছ মলিকিউলার অস্তিত্বের কথা বলে যায়। কবির চিন্তা ও অনুভূতির স্তর ছাড়িয়ে এইসব কবিতার অন্তঃসারে পৌঁছানো দুঃসাধ্য। কিন্তু একবার হাতে তুলে নিলে পাঠকের আর নামিয়ে রাখার উপায় নেই। শক্ত করে রিলকে ধরে ফেলবেন তার হাত।

একবার বার্লিনের ‘Egyptian Museum’-এ ঘুরতে ঘুরতে রিলকের চোখে পড়ল চতুর্থ অ্যামেনোফিসের মূর্তি। অনেকক্ষণ ভূতগ্রস্তের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একসময় তাঁর মনে হল তিনি যেন হারিয়ে যাচ্ছেন মহাশূন্যে আর পাথরের একটা মুখ বড়ো হতে হতে অসীমে ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমশ। মুখের রেখাগুলি যেন ছড়িয়ে পড়ছে ছায়াপথে, নীহারিকা আর নক্ষত্র রাশির অপরিমেয় দূরত্বে।

রিলকে অনুভব করলেন যে মহাজাগতিক নিয়ম এই আর ছায়াপথ রাত্রির নক্ষত্রপুঞ্জকে নিয়ন্ত্রণ করে সেই একই অব্যক্ত মহিমা, নিয়ম ও দুর্জ্ঞেয়তা অ্যামেনোফিসের মুখের আলোছায়ায় ধরা।

একটি রাত্রি আর পাথরের একটি মুখ আমূল বদলে দিল রিলকেকে। সেই রাত্রির স্মৃতি সারাজীবনের জন্য গভীর এক দাগ রেখে গেল রিলকের মধ্যে। বদলে গেল তাঁর জীবন-দেখা। সমস্ত কিছুর মধ্যে এক অনুপস্থিতির চলমান প্রক্রিয়া, an act of disappearing অনুভব করলেন। মানুষই দূরত্বের জনক। যেখানে মানুষ নেই সেখানে দূরত্ব নেই। যখন মানুষ আসে তখন চারপাশ থেকে কাচের এক সুমসৃণ পিছল রাস্তা আসে তার সঙ্গে— যে-রাস্তা পার হওয়া খুব কঠিন। এই রাস্তা দূরত্ব। এমনকী অ্যামেনোফিসের কোনো ছোট্ট রেপ্লিকাতেও সেই একই দূরত্ব ও দুর্গমতা থাকবে। ড্রয়িংরুমে সাজিয়ে রাখা এই অভিজাত মূর্তিও একই ভাবে স্পর্শ সীমার বাইরে থাকা এক সুদূরতা, এক ভ্যাকুয়াম। ঐ মুখকে হাজার বছরেও চেনা মনে হবে না। বন্ধু মনে হবে না।

এই মূর্তি দেখার অভিজ্ঞতা সুদূরপ্রসারী ছিল রিলকের জীবনে। ১৯১৩ সালের গ্রীষ্মে কয়েকদিনের ব্যবধানে তিনি একটি কবিতা ও একটি গদ্য লিখেছিলেন। প্রথমে কবিতাটি পড়া যাক। “Head of Amenophis IV in Berlin
as young and flowery meadows through a lightly spread covering of growth will give a slope a share in the sensations of the season, wind-wise, perceptive, gentle, almost happy along the mountain’s perilous abruptness; so, bloom-expending, mildly transient, face rests on this skull’s anteriors, which, descending with something like the slope of terraced vineyards, outreach into the All, confront the shining.

এবার গদ্য লেখাটি বাংলা অনুবাদে পড়ব— “কাপের আকৃতির আধার বা হোল্ডারে যেমন ওক ফল সংযুক্ত থাকে, সেভাবেই অ্যামেনোফিসের মাথা যুক্ত ছিল তার বেদীর সঙ্গে, নিবিড়ভাবে। হেলে পড়া হাড়ের কাঠামো থেকে ঝুঁকে আছে অ্যামেনোফিসের মাথা কোমল ভাবে, যেন সূর্যঘড়ির ওপর ছায়া সরে যাচ্ছে ঘড়ির হাতের। চওড়া ছোট্ট কপাল মুকুটে ঢেকে আছে। ডানার মতো এক জোড়া কান, যেন আভ্যন্তরীণ কোহলের ব্যাকাস। মুখের গঠন সহজ, অভিব্যক্তিবর্জিত, স্থির। ওষ্ঠ এমনভাবে চেপে ধরেছে অধরকে, যেন স্বর্গ-প্রভুত্ব করছে পৃথিবীর ওপর। গভীরে হারিয়ে যাওয়া চোখ যেন রেখাচিত্রের আভাসে ধরা। ভ্রূজোড়া যেন বন্ধুত্ব করছে চোখের সাথে।” বদলে গেল তাঁর জীবন দেখার ধরন। বেনভেলুটাকে লিখলেন—

“Through such things I learnt to look into reality. In Egypt they stood round me in numbers… insight into them came over me in such waves that I lay for almost a whole night beneath the great sphinx. The plane on which it was enacted had moved into dark night, all that makes world and existence proceded upon a loftier scence, on which a star and a god lingered in silent confrontation.” (Letter to Benvenuta)

অ্যামেনোফিসের মুখে তিনি দেখেছিলেন অসীমতা, যেমন কোনো মহান ভূদৃশ্য, তারায় ভরা রাত্রির, আকাশ,
সমুদ্র আমাদের দেখাকে প্রসারিত করে, অবারিত করে দেয়। যখন মিশরে সেই রাত্রে প্রথম স্ফিংস দেখলেন রিলকে, তাঁর মনে হল ঈশ্বরের প্রতিরূপ তাঁর সামনে। নক্ষত্রখচিত রাত্রির সমভার যেন তার মানুষী মুখে।

দশম এলিজিতে দেখা গেল এক শান্ত ঈশ্বরের মতো স্ফিংসকে—

“That has silently poised
for ever, the human face or the scale of the stars.”

মানুষের মুখে খোদাই করা স্ফিংসের মধ্যে তিনি দেখলেন তাঁর ক্ষণস্থায়িত্বের; নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার ভয়। রাত্রি, স্ফিংস আর অ্যামেনোফিসের মুখ তাঁর কাছে জীবনের দুর্ভেয় রহস্য আর ভয়ের প্রতিরূপ হয়ে উঠল। বস্তু যেন প্রতিমা হয়ে এল। জন বার্জার যেমন বলেছিলেন “অ্যান অবজেক্ট স্ট্রাইভিং টু বিকাম অ্যান ইমেজ”— বস্তু যেখানে প্রতিমা হয়ে উঠছে। রিলকের নিয়তি হয়ে উঠছে।

Facebook Comments

পছন্দের বই