লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গদ্য

অর্যমা সিংহ মৈত্র

বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিলো বাবার সঙ্গে

অমিতাভ মৈত্র, আমার বাবা, বন্ধুর মতো সম্পর্ক ছিলো বাবার সঙ্গে, আমাকে ডাকতেন ‘মা জননী’ বলে। কোনোদিন কিছু চাইতে হয়নি বাবার কাছে। না চাইতেই আমার সব প্রয়োজন বুঝে আমার কাছে সেগুলি এনে হাজির করতেন। সারাজীবন চাকরিসূত্রে বাইরে বাইরে কাটিয়েছেন। প্রত্যেক শনি, রবিবার বাড়িতে আসতেন। সপ্তাহের ঐ দুটো দিন ছিল আমার কাছে সবচেয়ে আনদের দিন। বাবা খুব ভালো ছবি আঁকতেন। আমার ছোটোবেলার আঁকার হাতেখড়ি বাবার কাছেই। বাবা ভীষন ভালো গান গাইতেন। তখন আমার বয়স ছয়/ সাত হবে। রাত্রিবেলা খাওয়া সেরে জ্যোৎস্না রাতে আমাকে আর মাকে নিয়ে ছাদে বসতেন চেয়ারে। আমরা বাবার কাছে গান শুনতে চাইলে ‘আজ জোৎস্নারাতে সবাই গেছে চলে’, ‘বড়ো আশা করে’, ‘আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু’— এসব গানগুলো গাইতেন। আর আমিও ববার কাছে শুনে শুনে ঐ বয়সে গানগুলো মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। এত ব্যস্ততার মাঝেও পরিবারকে প্রচুর সময় দিতেন। আমার পড়াশোনার শিক্ষকও ছিলেন বাবা। একটু যখন বড়ো হলাম, ইংরেজিতে যেকোনো চিঠি, অনুচ্ছেদ যেগুলো ভালো বুঝতে পারতাম না, বাবা লিখিয়ে দিতেন। এমনকী ফোন করে অনেকক্ষণ ধরে বিষয়গুলো বুঝিয়ে দিতেন। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে যখন পড়া শুরু করলাম, বাবা নাটকের এক একটা সিন মুখস্থ বলে যেতেন আমাকে বোঝানোর সময়। খুব অবাক হতাম এতদিন পরেও ম্যাকবেথের লাইনগুলো বাবার কীভাবে মুখস্থ আছে। ভাবতে খুব অবাক লাগে একজন মানুষ, যিনি উচ্চপদস্থ অফিসার হওয়ার সুবাদে সঙ্গে সিকিওরিটি নিয়ে গাড়িতে লাল আলো জ্বেলে ঘুরে বেড়াছেন, বিভিন্ন জায়গায় রেড করে বেড়াচ্ছেন, সেই মানুষটাই আবার বাড়ির লক্ষ্মীপুজো, সরস্বতী পুজো করছেন সব নিয়মনিষ্ঠা মেনে। সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণ ছিল বাবার অসম্ভব সুন্দর। এবছরও নিজেই বাড়ির সরস্বতী পুজো করেছেন। ICU তে ভর্তি থাকাকালীন একদিন দেখা করতে গিয়েছি, বললেন পরের দিন একটা সাদা কাগজ আর পেন নিয়ে আসতে। কিছু লেখা মাথায় এসেছে, লিখে ফেলতে হবে ঝটপট। যেদিন রিলিজ পেলেন নার্সিংহোম থেকে, অর্থাৎ মঙ্গলবার, ২১.০২.২০২৩ বিকেলবেলা, বাড়িতে ঢোকামাত্র আমাকে বলেন “পড়ার ঘর থেকে আমার কিছু বই কাগজ আর টেন নিয়ে আয়। আমার প্রচুর কাজ বাকি আছে”। ভীষণ যেন একটা তাড়া কাজ শেষ করার। হাতে পেন নিয়ে চেষ্টা করলেন কিছু লেখার, তখন অক্সিজেন চলছে, শরীরে প্রচুর ক্লান্তি। পারলেন না লিখতে শত চেষ্টা করেও, আর লেখা হলো না। পরের দিন নিঃশব্দে চলে গেলেন আমাদের থেকে অনেক দূরে। তুমি যেখানেই থেকো খুব ভালো থেকো বাবা।

Facebook Comments

পছন্দের বই