লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গদ্য

বেবী সাউ

কবির অনস্তিত্ব ও কবিতার অস্তিত্ব

‘সময়টা ভালো নয় রে, সাবধানে থাকিস।’ সময়টা যে ভালো নয়, তা অমিতাভ মৈত্র-র চেয়ে আর কেই বা বেশি করে বুঝতেন, জানি না। কারণ খবরকাগজের পাতা থেকে বাস্তবতাকে যাঁরা জানেন, তাঁদের চেয়ে অনেক বেশি বাস্তবতার মুখোমুখি হতেন সরকারি প্রশাসনের উচ্চ দপ্তরে কর্মরত এই কবি। তার জন্য বিস্তর যে সব কাঁটাঝোপ অতিক্রম করতে হতো তাঁকে, রক্তাক্ত হন তাঁর মন। বাইরে থেকে হাসিখুশি এই অনুভূতিপ্রবণ কবির মনের ভিতরে যে অস্থিরতা চলত, তা সহজে বোঝা যেত না। হয়তো সেই আগুনের মতো অস্থিরতাকেই তিনি লিখতেন তাঁর কবিতায়। বাংলা কবিতার জগতে তথাকথিত আলোর জন্য মাথা খুঁড়ে মরেননি এই কবি। কারণ প্রকৃত কবির মতোই তাঁর ছিল দৃঢ় আত্মবিশ্বাস। নিজের ভাষার সাহিত্য, দেশের সাহিত্য, বিদেশের সাহিত্য, চলচ্চিত্র নিয়ে সর্বদা তিনি নিমগ্ন থাকতেন নিজের পড়াশুনোয়। হয়তো এ কারণেও কবি অমিতাভ মৈত্রর কবিতাকে অনেক বেশি আন্তর্জাতিক বলে মনে হয়। মনে হয়, তাঁর কবিতার ভিতর যেমন মেদিনীপুর পুরুলিয়ার এক প্রান্তিক মানুষ কথা বলে উঠছেন, তেমনই স্বর শোনা যাচ্ছে এই সময়েরই প্যালেস্তাইন থেকে, সিরিয়া থেকে, ভেনেজুয়েলা থেকে। যখনই কথা হতো, মনে হতো, মনে মনে অস্থির এক কবি, বিদীর্ণ হয়ে আছেন সাম্প্রতিক সময় নিয়ে। প্রশাসনিক কাজ তাঁকে আরও রুক্ষ বাস্তবতার সামনে ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু তাতে তাঁর কবিতা শুধুই সংবাদের বৃত্তান্ত হয়ে পড়েনি। হয়ে পড়েনি বিবৃতি।

কবিতা আসলে একটা ভ্রমণ। একটা সফর। পাঠকের সঙ্গে কবির। কিংবা বলা যেতে পারে কবি এবং পাঠক পরস্পর কবিতাটির পেছন পেছন যান, তাকে ছোঁয়ার জন্য। অনুভবের জন্য। আর তাতেই রহস্যময়ী হয়ে ওঠে সেও। একটা নতুন কবিতা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় পরিদর্শনে বেরিয়েছি। এক একটা দৃশ্য এসে বসছে। আবার এসে যাচ্ছে পরের দৃশ্যপট। চারপাশে অজস্র আলো-আঁধারের খেলা। এইসব রংকে কবি যেমন কিছু শব্দের মধ্যে বেঁধে রাখার সঙ্কল্প নেন, আবার পাঠক তাকে ছড়ায় বিস্তৃতির দিকে। হাঁটে। কবি আড়চোখে হাসেন। কবিও বেরিয়ে পড়াটুকু উপভোগ করেন। পাঠক রোমাঞ্চ বোধ করে। দেখে, শব্দ আর দৃশ্যের মতান্তর। সহযোগ। মুগ্ধ হয়। কখনও বিধ্বস্ত; বিভ্রান্ত। আবার বহুদিন পরে হঠাৎ কোনো দৃশ্যে নিজে খুঁজে পায় সেই কবিতাটির প্রকৃত আধার। তাই কবিতা যতটা না শব্দের ঠিক ততটাই স্বশব্দেরও। কবি অমিতাভ মৈত্রের কবিতা জীবন ঠিক এরকমই। দৃশ্যের জগত নেমে আসছে শব্দের কাছে। আবার শব্দের জগত মিশে যাচ্ছে দৃশ্যে। বাস্তব এসে গল্প করছে সাদা অ্যাপ্রোণ পরা নার্সদের সঙ্গে; একঘরে শব্দ চিৎকার করছে। আর বিরাট নার্সিংহোম থ মেরে আছে। ঠিক তখনই যেন হঠাৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসার মত কবি যেখানে হাজির। দেখছেন এবং স্তব্ধ হয়ে আছেন। বুঝতেই পারছেন না, এই মুহূর্তে তাঁর ভয় পাওয়া উচিত নাকি অর্ডার করা উচিত দায়িত্ব সূচি অনুযায়ী নাকি চিৎকার করে আউড়ে যাওয়া উচিত কোনও সংবিধানের সাজানো, সংযোজিত মুখস্থ করা লাইন!
“This long, this long dream, I’m awaking, no, I’m going to die, dawn is breaking” —Albert Camus এর এই লাইনগুলি কবিই ব্যবহার করেছেন তাঁর কাব্যগ্রন্থ “টোটেমভোজ”-এ। এইযে ভয়াবহতার প্রকৃত দৃশ্য কবি ব্যবহার করলেন সার্জিকল টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে— আর সাদা টকটকে একটা বলের সঙ্গে মেশালেন আসন্নমান মৃত্যুর দৃশ্যকে— আর এখানেই পালটে গেল এতদিনের নিয়ম কানুন। সাহিত্য রচনার ব্যাকরণ বিধি। কই বাংলা সাহিত্য তো কখনও এমনভাবে বাস্তবের সঙ্গে কথা বলেনি! শুধু ফল-ফুল-লতা-পাতা নিয়ে পড়ে থাকার মতো দিন যে আর নেই কবি অমিতাভ মৈত্রের কবিতা পাঠের মাধ্যমে সেই অনুভূতিকে খুঁজে পাওয়া যায়। কবিও বলতে পারেন ” প্রতিটি অপরাধের পাশে রক্তের হালকা ছোপ লেখে থাকা ট্রেন/একবার মাত্র আলো ফেলে ঘুরে যায়/আর ভয়ার্ত ঘাস আর ভয়ার্ত ভেড়াদের সামনে/আমরা বিচ্ছিন্ন এবং আত্মস্থ হতে চেষ্টা করি”( মনঃসমীক্ষকের স্বীকারক্তি)।

অমিতাভ মৈত্রর জন্ম ১৯৫২ সালে। যে সময়টাতে জন্মেছেন এখনকার আরও বিশিষ্ট কয়েকজন কবি। সমকালীন অবস্থানটিকে ধরলে দেখা যাচ্ছে, কবি অমিতাভ মৈত্রের রচনাকৌশল পুরোপুরি ভিন্ন। আঙ্গিক, বচন, কবিতার বিষয় বৈচিত্র্য— সবকিছুতেই কবির নিজস্ব ছাপ; ‘বিভীষিকার জগৎ রক্তের আঁশটে ব্লান্ট-গন্ধ’ মাখা এক বাস্তব দুনিয়া। কবির নিজস্ব কথায়।

প্রথম কাব্যগ্রন্থ “বিদ্ধ করো, তীর” প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। দীর্ঘ একটা সফরের কবিতা নিয়ে কবির এই কবিতার বই। বাংলা সাহিত্যের পাঠকের মতো করে, ছন্দ, রূপ রসের সৌন্দর্যে মণ্ডিত এই সব কবিতাগুলি। কিন্তু কবির সন্তুষ্ট নন। কবি চাইছেন অন্য কিছু; ধরতে চাইছেন সেই বিরাট বাস্তবকে। মনের ভেতর চলছে অস্থিরতা; দ্বিধা-দ্বন্দ। এঁকে ফেলতে চাইছেন প্রকৃত বাস্তবকে। তখনই ব্যর্থ কবির মনে হয়েছে— “‘বিদ্ধ করো, তীর’-এর এইসব কবিতা থেকে আমার আত্মা বিযুক্ত হয়ে গেল। নিজের কবিতা বিষয়ে স্ফীত আস্থা নেই এমন মানুষ যা করতে পারেন, আমি তাই করলাম। এরিয়া ছেড়ে সরে গেলাম।”

দীর্ঘ দশ বছরের বিরতি। দীর্ঘ একটা পরাজিত মন? নাকি নিজেকে ভাঙার জন্য নির্জন কোনও সাধনা? দীর্ঘ সময় অতিক্রম করে শব্দের কাছে কবি ফিরলেন। অসন্তুষ্টি; ক্রোধ; রাগ; অভিযোগ; অভিযোগ সবটুকু নিয়েই ফিরলেন। ততদিনে ভেঙে গেছে অনেক কিছু। ততদিনে তিনি খুঁজে পেয়েছেন তলস্তয়ের “The death of IvanGlych” গল্পে ইভানইলিচের অদ্ভুত অসুখ ও যন্ত্রণা থেকে ব্যথার কেন্দ্রবিন্দু। তাঁর কাছে কবিতা শুধু শরতের মেঘোজ্জ্বল আনন্দ নয়; বরং কবিতা ধরা দিয়েছে এক রক্ত মাংস হিংসা দ্বেষ কলহ বাস্তব জীবনের প্রকৃত সত্য হিসেবে। শুধু সৌন্দর্য মণ্ডিত হয়ে নয়; বরং মিলিত সত্ত্বার রূপ ধারণ করে। কবিও এটাই চাইছিলেন। কাফকার মতো তিনিও বলতে চান “সেই মানুষটির মতো লিখতে চাই আমি যে সেই হাতের আশ্রয়ে উন্মাদের মতো ছুঁড়ে দিতে পারে নিজেকে। ” তবে যে বিপন্নতা কাজ করছিল কাফকার ভেতরে সেটি কি কবির ভেতরেও আছে? একটা বিরাট অস্বস্তি কাজ করছে কবির মধ্যে। একটা অনিশ্চয়তায় মোড়া রাত্রি; ঘাতকের মতো চোখ আর দমবন্ধ একটা অবস্থান থেকে কবি বেরোতে চাইছেন যেন। আর ওইসব অজস্র হিংস্র চোখ কবির চোখে ফোকাস করে চলেছে অবিরত। ওখান থেকে যেন মুক্তির সব পথ বন্ধ হয়ে গেছে। এতদিনের জমে থাকা মনের ভেতরে ক্রোধ মুক্তি চাইছে। কিন্তু এই পৃথিবী যে বড্ড নিস্পৃহ; নিঃসঙ্গ। কারোর কথা শোনার মতো অবসর নেই তার। কবি অসহায়। ফিরলেন শব্দের কাছে। বললেন, ” টোটেম’ এর ভাষা প্লাষ্টার করা হাতের মত শক্ত, আড়ষ্ট, কৃত্রিম। দাঁন্তের নরক ও পরিশুদ্ধিতে আমি মুক্তি খুঁজছিলাম তখন।সঙ্গে বাইবেল এবং কাফকা। “Inferno” –তে নরকের দরজায় লেখা ছিল –“Leave every hope, ye, who enter.” আমি সেটি ব্যবহার করেছিলাম বইয়ের শুরুতেই।” ম্যাডাম এম. এর সঙ্গে। ম্যাডাম এম. দেখালেন টোটেম ভোজ এর প্রাকমুহূর্ত। আত্মহত্যার আগে একজন সুস্থ সবল মানুষের কী কী করণীয়। আর প্রাসঙ্গিকভাবেই কবি তুলে আনছেন Andre Hardellet এর উক্তি “Such detachment! Such relief.” কীরকম মুক্তি? নিজেকে আবিষ্কার? নাকি নিজেকে ধ্বংস করে ফেলা? এই আত্মহত্যার ছবি আঁকতে গিয়ে কবি জোগাড় করে আনলেন চোখের সামনে এক প্রোটাগনিস্ট নারীর বর্ণনা। “এগিয়ে আসছে আপেল আর লাফিয়ে কামড়ে ধরছে ম্যাডাম এম এর গলা/ দাঁতের ডাক্তারের মতো শ্লথ গ্যাস সিলিণ্ডার দু-পায়ের মাংসে জায়গা খুঁজে নিচ্ছে”। চমকে উঠতে হয়। লাইনের পর লাইনে উঠে আসে সমাজের বাস্তবচিত্র। আর পাঠক ম্যাডাম এম এর মধ্যে দেখে সেই নারীটির যন্ত্রনাজর্জর দিনগুলির দৃশ্য চিত্র। আর এই ভারতীয় সমাজে হাঁটা ফেরা করে বেড়ায় কবি সৃষ্ট চরিত্রগুলি। কবিও তাঁর যাবতীয় চিন্তা ভাবনা; রাগ-অভিযোগ নিয়ে চরিত্রগুলির সঙ্গে সহবাস করেন।

২০১৫ সালে বেরোয় কবির ‘সি আর পি সি ভাষ্য’। ততদিনে কবি তাঁর কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। সিভিল সার্ভিসে চাকরির সূত্রে আইনের মারপ্যাঁচ স্বাভাবিক ভাবেই এসেছে। কিন্তু এই কবিতার বইটিতে আছে কবির নিজস্ব অনুভূতি এবং উপলব্ধির প্রকাশ। ‘vision of evil’ থেকে তুলে আনা কবির বয়ান; স্বীকারোক্তি।

কবি অমিতাভ মৈত্রের কবিতাতে দেখা মেলে একজন তৃতীয় ব্যক্তির— কখনো তিনি ক্রিস্টোফার, কখনো ম্যাডাম এম, কোয়ারান্ট রিগ্রেসন অথবা আয়নাতে প্রতিবম্বিত ছায়া হেনরি। এবং তারা কেউ এদেশীয় নয়। তারা কেউ লেখক নন, কবি নন, এমনকি পাঠক নন। তৃতীয় জন। নিরপেক্ষ? যারা শুধু আসে এবং চলে যায়।

চোখের সামনেই ঘটে যাচ্ছে বিভিন্ন ধরণের বাস্তব চলচিত্র। অথচ দৃশ্যের সঙ্গে অনুবাদ হচ্ছে একটি শ্লথ-মন্থর যাতায়াতের। আবার সামনে বেজে উঠছে কোনও ফ্রেগর্যান্স অফ কালার-এর অতলান্ত স্পর্শে। মনে হচ্ছে এ যেন রসের ভিয়েন। এ যেমন সত্য, তেমনি এও সত্য সমস্ত বাস্তবতা একটা আশ্চর্য গ্লোবের ওপর ঘুরছে। আবার মুহূর্তে তৈরী হওয়া সেই কালারের ফোকাস ভেঙে পড়ছে। এখানে পাঠকই সর্বত্র। নিজস্বতা আছে বলেই নিত্যতার এই সূত্র, এই মহিমা। আমি আছি বলেই রূপ রঙ রস স্পর্শ। আমার জন্যেই সমস্ত নিয়ম কানুন, ব্যস্ততা, ভাঙা-গড়া। কবি অমিতাভ মৈত্রের কবিতা এসব কথাই বলে যাচ্ছে। তাই হেনরির মধ্যে পাঠক নিজেকে খোঁজে; বাউণ্ডুলে জীবনকে খোঁজে। আর হাঁটে। আর এখানেই কবির কবিতার সার্থকতা। এখানেই কবি অমিতাভ মৈত্র-র কাব্যব্যক্তিত্ব।

এমন এক কবি এই রণ-রক্ত-সফলতা-ব্যর্থতার পৃথিবী থেকে অনেক দূরে চলে গেলেন। রয়ে গেল তাঁর কলম, যার রক্তের দাগ এখনও শুকোয়নি।

Facebook Comments

পছন্দের বই