লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গদ্য

কমলকুমার দত্ত

একটি বিস্ময়চিহ্ন

‘সেই আমিই জাহাজ, যার পায়ে কোথাও ছোট্ট আঘাত আছে/ নোঙর করা বারণ, তবু মাটি মাঝে মাঝেই ধরে ফেলে আমাকে/ তখন কর্পূর ছড়িয়ে এড়িয়ে যাই, আকাশে মুখ তুলে এড়িয়ে যাই/ নোঙর করা বারণ, কারণ পায়ে কোথাও ছোট্ট আঘাত আছে’

লেখার নাম ‘ আঘাত’। কোথাও ছোট্ট আঘাত আছে। এই আহত মানুষটার সঙ্গে কম করেও বাইশ-তেইশ বছর আগে পরিচয় হয়েছিল। তখন মনে হয়েছিল মানুষটা আহত। বাইশ-তেইশ বছর পরেও তা-ই মনে হয়।

প্রথম পরিচয়ের পর মাঝে মাঝে রাতে ফোন করতেন। তখন তিনি জীবিকাসূত্রে ঘাটালের এস-ডি-ও। বলতেন সেইসব দিনগুলির কথা যখন তাঁকে মৃত্যুপথযাত্রীদের জবানবন্দি নিতে হতো, মৃতদেহের কাটাছেঁড়ার সাক্ষ্য লিখে রাখতে হতো। আর বলতেন ভিনদেশি কবি, চিত্রকরদের কথা। শুনতে শুনতে মনে হতো মগ্নস্বরে যেন নিজেকেই শোনাচ্ছেন সেসব। আজ তাঁর লেখাগুলি যখন পড়ি তখন একই অনুভূতি হয়।

সামনাসামনি যখনই দেখা হয়েছে, মনে হতো মানুষটা লুকিয়ে পড়তে চাইছে। কথা বলছে, কিছু বলতে হয় তাই। ভদ্রতাবশত।

হ্যাঁ, আমাদের কাগজে, তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের পর থেকে, প্রায় প্রতি সংখ্যায় লেখা চাইলেই দিয়েছেন— কবিতা চাইলে কবিতা, গদ্য চাইলে গদ্য। দেওয়ার সময় প্রতিবার বলতেন, কিছু হয়নি, দেখুন ছাপবেন কি না। তাঁকে নিয়ে সংখ্যা করবো শুনে অবাক হয়ে বলেছিলেন— আমাকে নিয়ে! না না, ওসব করবেন না। অনেক বুঝিয়ে রাজি তো করালাম, তারপর দেখি সহযোগিতা করছেন না। অনেক কষ্টে সংখ্যাটা করা গিয়েছিল। সংখ্যাটি বেরনোর পর কিছুতেই পাঁচটা কপি দিতে সফল হইনি, জোর করে কিনে নিয়েছিলেন। ব্যস, ওই পর্যন্তই, তারপর সংখ্যাটা নিয়ে একটি কথাও বলেননি, কোনো আগ্রহ প্রকাশ করেননি। না, ভুল বললাম, দু-তিনবার অপরাধীস্বরে জানতে চেয়েছিলেন যে বিক্রি থেকে খরচাটা উঠে এসেছে কি না।

আমি ব্যক্তিগতভাবে কবিতার আলোচনা করি না বা পড়ি না। কবিতার কোনো আলোচনা সম্ভব বলেই বিশ্বাস করি (কবিতার কোনো আলোচনা সম্ভব বলেই বিশ্বাস করি) না। তবে অন্য কবির কবিতা নিয়ে অমিতাভ মৈত্রের লেখা আগ্রহ নিয়ে পড়ি। তিনি কখনো কবিতার ‘আলোচনা’ করেননি, আমি তাঁকে সেইসব কবিতার মধ্যে মগ্নচৈতন্যস্বরূপ দেখতে পাই। অন্য কবির একটা পাঁচ-সাত পংক্তির কবিতা কীভাবে তাঁর নিজের অস্তিত্বের অংশ হয়ে উঠছে তা দেখে বার বার শিহরিত, বিস্মিত হয়েছি। তিনি লিখেছেন, ‘কবিতায় প্রতিটি শব্দ দাঁত চেপে থমথম করে তার পাশের শব্দটির ছিটকে যাওযার চরম সময়টির জন্য। যিনি শব্দের এই বুনো আক্রমণাত্মক মুখ দেখেছেন তিনিই কবি, শব্দের মেডিসিনম্যান।… যখন কবি লিখছেন, ‘কিছু শব্দের এই দ্বিতীয় জীবন তখন তিনি টের পান। কবির নিজের দ্বিতীয় জীবন নেই’। আরেক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, ‘কবিতার শব্দকে হতে হবে আ্যলজাইমার রোগীর মতো আত্ম-অর্থ-বিস্মৃত’।

বাংলা কবিতার জগতে অমিতাভ মৈত্র এসে পড়েছেন মূর্তিমান উপদ্রবের মতো। তাঁকে অস্বীকার করা যায় না, তকে স্বীকার করলে বাংলা কবিতাক বড়ো একটা অংশকে ছেড়ে আসতে হয় ।

আমি মনে করি তকে গ্রহণ করতে হলে পাঠককে অনেক পাঠসংস্কার ত্যাগ করে এগিয়ে আসতে হবে, কেন না এই কবি আমাদের কাছে অনেকটা আগে এসে পড়েছেন। বাংলা কবিতার ইতিহাস বহুকাল পরে পরে এমন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়।

Facebook Comments

পছন্দের বই