লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গদ্য

রিমি দে

অমিতাভ মৈত্র: এক ঝোলাওয়ালা

অমিতাভ মৈত্রকে নিয়ে একটি স্মৃতিচারণগোছের লেখা লিখছিলাম একটি পত্রিকার জন্য। লেখাটি শেষ করে একটু হালকা লাগছিল। ভাবলাম অমিতাভদাকে একটা ফোন করি। করলাম। ৮৯০৬২০… নম্বরে। রিং হয়ে গেল। কেউ রিসিভ করলেন না। এরকম আগেও হয়েছে। পার্থক্য একটাই আগে অমিতাভদা রিং ব্যাক করতেন। আজ সে শব্দহীন! ফাল্গুন মাস। খাঁ খাঁ করছে চারদিক। দখিন হাওয়া মৃদু। টবের ফুলের আলোতেও যেন বিষণ্ণতার চাহনি। বাড়িটাও ফাঁকা। আশ্চর্য ধূসর। কেউ যেন কিছু খুঁজছে। পাচ্ছে না! ‘ছায়া আঁকার খাতা’ পড়ে আছে। শূন্যতা এসে গ্রাস করে নিয়ে গেছে শুকনো পাতাভর্তি ঝোলাটা! জীবন্ত ছায়ারা অচেনা ছায়ার দেশে চলে গেছে।
জানি মৃত্যু এক অনিবার্য সত্যের নাম। তবু মানুষ সেই অনির্দিষ্ট বৈতরণীর দিকে তাকিয়ে থাকে অসহায়ভাবে। ভেবেছিলাম বৌদি বা অর্যমার সঙ্গে কথা হবে। অর্যমার মেয়ে কি দাদু দাদু বলে কাঁদছে! দাদু নাতনিকে খুব ভালোবাসতেন। প্রায়ই নাতনির ছবি পাঠাতেন। কথা বলতে চেয়েছিলাম! হল না।

চাকরির শেষদিকে এই নম্বরটা দিয়ে বলেছিলেন সেভ করে রাখতে। সেই থেকে নম্বরটি গুগলেই সেভ হয়ে আছে। ফোন হারালেও নম্বর হারায় না! এরকম প্রচুর নম্বর আমার সেলফোনে রয়েছে। আমি মাঝে মাঝে নম্বরগুলোতে রিং করি। বেশিরভাগ ফোন বেজে যায়। কেউ হয়তো সেই নম্বরটা সারেন্ডার করেন। কেউ-বা ব্যবহার করেন। যেমন কবি সমর চক্রবর্তীকে ফোন করলে কাবেরীদি রিসিভ করেন। দীর্ঘক্ষণ কথা হয়! আমার মনে হয় আমি সমরদার সঙ্গেই কথা বলছি। সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়। বিকেল সন্ধে নিয়ে আসে। সমরদার ব্রাশ করা হয় না! এটা আমার একটা খেলা বলা যেতে পারে!

অমিতাভদার সঙ্গে আমার প্রথম যোগাযোগ কলকাতা বইমেলায়। সেতু কবিতাপাক্ষিক। প্রভাতদাই পরিচয় করিয়ে দেন। এখন প্রভাতদা নেই। তবু কবিতাপাক্ষিক হচ্ছে প্রভাতদারই আদর্শে। কোনো এক বছর কবিতাপাক্ষিকের বাৎসরিক অনুষ্ঠান হয়েছিল বাঁকুড়ায়। জায়গাটির নাম ছাঁদাড়। মাদল, লাল মাটির তৈরি বাড়িটা। কবিতা আখড়া করার পরিকল্পনা ছিল প্রভাতদার। মাদলকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। সে-বছর আমাকে কবিতাপাক্ষিক সম্মান দেওয়া হবে জানলাম। তো খুব আনন্দ। যাব বাঁকুড়া। কীভাবে যাব! প্রভাতদা বললেন কলকাতা চলে যেতে। তারপর একসঙ্গে বাঁকুড়া। সে অনেকটা সময়ের ব্যাপার। সেসময় শতাব্দী এক্সপ্রেস ছিল না যে টিকিট ঠিক পেয়ে যাব! তাছাড়া আকাশবাণী আর দূরদর্শনের কাজটাও তো করতে হয়। যাতায়াত অনুষ্ঠান নিয়ে দু-দিনের বেশি থাকা যাবে না। অগত্যা কষ্ট হলেও ঠিক হল বাসে যাব। বাড়ি থেকেও চিন্তা করছিল। প্রভাতদা ফোনে জানালেন, ‘অমিতাভ আসবে রিমি, তুমি ওর সঙ্গে যোগাযোগ করো।’ তখন সম্ভবত ঘাটালে ছিলেন। সঠিক মনে নেই। কথা হল। বাড়ি থেকেও নিশ্চিন্ত হয়ে আমাকে বাসে তুলে দিল। বাঁকুড়া পৌঁছোলাম। একটুও অপেক্ষা করতে হয়নি। অমিতাভদা এসে গেছিলেন বাসস্ট্যান্ডে। তারপর ওঁর গাড়ি চেপেই ছাঁদাড়। দেখি সবাই এসে গেছেন। শঙ্খ ঘোষ থেকে ইন্দ্রানী দত্ত পান্না। হই হই কাণ্ড। নাসেরদা, প্রভাতদা, বৌদি, গৌরাঙ্গদা এবং আরও অনেকেই আগের রাতে চলে এসেছিলেন। আমি সেই প্রথম লালমাটির গ্রাম দেখলাম। অনুষ্ঠান চলল। আমরা সেবারেই অনেকে মিলে মাদলে সমবায় কবিতা লিখেছিলাম। মাটির দোতলা বাড়ি দেখে বোকার মতো হাঁ করে তাকিয়েছিলাম! সেই দোতলায় প্রভাতদার দুই বোনের সঙ্গে রাতে ছিলাম। কী যে স্বচ্ছ আনন্দে কবিতার ভেলায় গা ভাসিয়েছিলাম সে বলে বোঝানো সম্ভব নয়! অমিতাভদা রাতে নিজের কাজের জায়গায় ফিরে গেছিলেন। পরদিন আবার এসেছিলেন। এই লেখা লিখতে গিয়ে ফেলে আসা সময় ও ঘটনা ছবির মতো ভাসছে। কত কবি সম্পাদকের সঙ্গে যে পরিচয় হয়েছিল তার ইয়ত্তা নেই। দু-দিন কবিতামহলে কাটানো হল মহানন্দে। দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ রবিবার সন্ধেবেলা আমাকে অমিতাভদা বাসে তুলে দিলেন। তাতেই ক্ষান্ত হননি! বেশ ক-বার ফোন করে খবর নিয়েছেন। সোমবার ভোরে তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ড। বাড়ি। বিকেলে অফিস। বাইরের মানুষেরা হয়তো এভাবেই কাছের হয়ে ওঠেন। পরিবারের হয়ে ওঠেন। আবার বাইরেরও থেকে যান! আসলে আমার মনে হয় সময় যেভাবে কথা বলতে চায়, কথাকেও সময়ের সুরের কাছে ঠিক সেভাবেই ধরা দিতে হয়, দূরত্ব এবং সম্ভ্রম বজায় রেখে! সেখানে ঘনিষ্ঠতা কোনো সমস্যা তৈরি করে না।

লেখালেখিতে অমিতাভ মৈত্রর অর্থ এবং অর্থহীনতা দুটোর প্রতিই বিশ্বাস এবং প্রশ্রয় ছিল। হেনরি, ম্যাডাম এম, ক্রিস্টোফারকে নানান ভঙ্গিমায় লালন করেছেন। একের মধ্যে ফুটেছে বহু স্বর। সিসিফাস ওঁর প্রিয় চরিত্র হলেও জিউসের মধ্যে নিজেকে অন্বেষণ করেছেন বহু আঙ্গিকে। পৌরাণিক চরিত্র হলেও সিসিফাস ও পাথরের প্রচুর ব্যাখ্যা। হোমার, কামু ছাড়াও যারা যেভাবে দেখেছেন প্রতিটি দ্যাখাকে নিজের লেখায় চোরাস্রোতের মতো নির্মোহ লালন করেছেন। প্রচুর পরিমাণে বিদেশি সাহিত্য শুধু পাঠ করতেন না, আত্মসাৎ করে ফেলতে পারতেন একবার পাঠেই। মিথ, ইতিহাস, সাহিত্য, লেখকদের জীবনী, চিত্র, চিত্রকরদের জীবনযাপন, কল্পনাশক্তি, অভিজ্ঞতা এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতার সংমিশ্রণ ওঁর লেখাকে এক অদ্ভুত আশ্চর্যজনক জায়গায় নিয়ে যায়। কবিতা কিংবা গদ্য যাই হোক না কেন প্রকরণ এবং প্রক্রিয়াগত দিকে অবিচল থাকলেও, স্বভাবগত অস্থিরতার প্রভাব লেখায় পড়েছে। সেই কারণেই লেখায় একটি অনির্দেশের ইশারা থাকে! অমিতাভদার মর্মে মর্মে দান্তে এবং ডিভাইন কমেডি লেগে আছে। পদ্যতে ২০০৩-এ কবিতা দিয়ে লেখা শুরু হয়। ২০০৪-এ প্রচ্ছদ করলেন এবং একটি গদ্য লিখলেন। ওরকম গদ্য আগে পড়িনি, তাই খুব অবাক হয়েছিলাম পাঠ করে। গদ্যটির নাম ‘পতনশীল নায়ক’। ২০১২-তে কেমব্রিজ ইন্ডিয়া থেকে ‘পতনশীল নায়ক’ শিরোনামে প্রথম গদ্যের বই প্রকাশ পায়। ১১.০১.১৩ তারিখে বইটি উপহার পাই। অর্থাৎ সেদিন কলকাতায় বাংলা আকাদেমি পরিচালিত লিটল ম্যাগাজিন মেলা শুরু হয়েছিল। ২০০৪ থেকে ২০২১ নভেম্বর আর্তিসংখ্যা অবধি প্রতি সংখ্যাতেই গদ্য লিখেছেন। ২০১৫-তে ‘মা: মিথ কিংবা ডিমিথ’ ভাবনায় পদ্যর একটি সংখ্যা করেছিলাম। সেখানে ‘এক ধূসর অন্তহীন হাওয়া’ এই শিরোনামে মনকাঁপানো একটি গদ্য লিখেছিলেন। আশা করি গদ্যসংগ্রহে লেখাটি পাব। সেখানে অদ্ভুত এক মায়েদের মন্তাজ আঁকেন। শেষে ডি এইচ লরেন্সের Sorrow নামের কবিতাটি। এই গদ্যটি লেখা হয়েছিল কাফকা, কামু, The Outsider-এর নায়ক ম্যরসো এবং স্যামুয়েল বেকেটের মোলোয় উপন্যাসের মায়েদের নিয়ে। তারপর এসেছে বিমল করের ‘ভুবনেশ্বরী’’ উপন্যাসে পরিবারের পূর্ব নারীকে অলৌকিক মা বানিয়ে মিথ করে তোলা। মায়ের সঙ্গে সন্তানের আলোছায়ায় জড়িয়ে থাকা বিন্যাসের কোলাজ।

নাথিংনেসে অগাধ বিশ্বাস রেখেছেন অমিতাভ মৈত্র। নিজের জীবনের ক্ষেত্রেও যেন সামনে একটি শূন্য ঝোলানো। লিখেই চলেন লিখেই চলেন উদ্দেশ্যহীন প্রত্যাশাহীন! তবে প্রচুর গদ্য লিখবেন অবসরের পরে এরকম পরিকল্পনা ছিল। কর্মরত অবস্থায় যা লিখেছেন, তা-ই বা কম কীসের! একটা ভুল ধারণা হয়তো অনেকের আছে যে ওঁর লেখা তেমনভাবে পঠিত নয়! একজন মেধাবী লেখক হিসেবেই উনি পরিচিত। অনেকেই পড়েন কিন্তু চুপ থাকেন! তাতে অবশ্য লেখকের কিছু এসে যায় না! ২০০৫-এ পত্রলেখা থেকে ‘ষাঁড় ও সূর্যাস্ত’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। ইদানীং লোকমুখে শোনা যায় অমিতাভ মৈত্র ‘ষাঁড় ও সূর্যাস্ত’ বইটিকে নাকি গুরুত্ব দিতে চাননি! তবে লেখাগুলি এবং পাণ্ডুলিপি যখন তৈরি হয় তখন একটা ঘোরের মধ্যে থাকতেন একথা নিজে বলেছেন সেই বিগত সময়কালে। তাহলে অপছন্দের কাব্যগ্রন্থ কীভাবে হয়! পিতার পাঁচ সন্তান। পিতা জীবনের সব স্তর পেরিয়ে বৃদ্ধ হলেন। পাঁচ সন্তান পাঁচ-রকম। দ্বিতীয় সন্তানের মধ্যে পিতার পছন্দের গুণাবলী না থাকলে তাকে কি তিনি অস্বীকার করতে পারেন? মলিন হয়ে আসা ফ্যামিলি গ্রুপ ফটো থেকে একজনের উপর গাঢ় নীল পেনের দাগ দিয়ে বুজিয়ে তাকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করা হলে তাতে পাঠকের আগ্রহ আরও বেড়ে যায়। আমি ‘ষাঁড় ও সূর্যাস্ত’-কে অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। কাব্যগ্রন্থটির লেখাগুলি পাঠ করলে পাঠক অনুভব করবেন কবিতাগুলির অনুরণন। লেখকের মতের বিরুদ্ধে কথা বলছি অথচ দেখুন লেখকবাউল কাঁধে গেরুয়া ঝোলা নিয়ে কোন অজানায় পাড়ি দিয়েছেন! পেছন ফিরে দেখছেন না একটিবারও! কী অদ্ভুত, না!

Facebook Comments

পছন্দের বই