লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কবিতা

ঋতুপর্ণা খাটুয়া

চা বাগানের কথা


সবুজ ধানক্ষেত, তারপরের বাঁশ জঙ্গল পেরোলেই সরুগাঁও টি এস্টেট।
একটি মজদুর ক্ষেত দিয়ে হেঁটে চা বাগানের দিকে যাচ্ছে, ভাবছি বন্ধু,
তোমায়ও আমি চা বাগানের মাঝে এভাবে হাঁটিয়ে নিয়ে যাব। চা ফুল
হয়, তা দেখোনি বোধহয়, দেখাব তোমায়। পৃথিবীর যা যা আশ্চর্যজনক
বলে আমার মনে হয়, সবই তোমায় দেখাব। একপ্রকার কুহক লুকিয়ে
আছে ওইখানে, দিনের বেলায়ও স্থির গাছগুলি। ওদের দাঁড়িয়ে থাকার
দৃঢ় সিদ্ধান্তের মাঝ বরাবর হেঁটে যাব। হাত তো ধরাই আছে, একটা চুমু
খেতে পারি না কি আমরা! আহ্ কী নির্লজ্জ সুন্দর আমার মন। ছাড়ো।
বাদ দাও। ওই হাঁকুপাঁকু করে উড়ে যাওয়া বকটিকে দেখো তো, কীসের
এত তাড়া কে জানে! কত কথাই বলছি, তুমি আমার দিকে এই থম
মেরে দাঁড়িয়ে থাকা ঠান্ডার মতো তাকিয়ে আছ! যা খুশি করো না কেন,
আমার ভেতরে থাকা ভয়কে আমি হাটের মুরগি করে সবার সামনে
আনব না। আহা চারিদিকে সবুজ মদিরার মতো ঘুম ছড়িয়ে আছে। তুমি
এভাবেই কি গিলিগিলি ছুমন্তর কিছু করো নাকি! হালকা সবুজ আর
গাঢ় সবুজ পাতা একটি গাছেই! উফফ জাদুর পর জাদু! একটু বাড়তি
জাদু এনে আমাকে এগিয়ে রাখো আলোর দিকে, আরেকটু ভাসিয়ে
রাখো, অযথাই বাবার চোখের আড়ালে,
আমার এটুকু মদ্যপ উৎপাত কি তুমি মেনে নেবে না!


মাগুরমারি পৌঁছে গেছে নিজস্ব সৌন্দর্যের চূড়ান্ত সীমায়।
মাঝে কাজল টানা রাস্তা আর দুপাশে ঘন চা বাগান—
টোটো এখনই ঢুকে গেল নিভৃতে, তিনযাত্রী নিয়ে,
টিংটিঙে সবুজ পাখিটি উড়ে গেলে বনের ভেতরে
এইবার হয়েছে একটি কেলো। চা বাগানের গোপন মাদকতায়
রাস্তা শুয়ে আছে দু-পা ফাঁকা করে। ঠিক যোনিতে দাঁড়িয়ে
টোটো চালক বলল, আমি তো চিনি না মাগুরমারি স্কুল!
ঠিক যোনিতে এসেই এমন হতভম্ব হয়ে যায় অনেকেই
যোনির ভেতরে ঢুকে যাওয়ার রাস্তা নেই, নইলে
ঘুরে আসতাম টোটো নিয়ে বিশ্বের আদিস্থলে
এমতাবস্থায় আহ্বায়ককে ফোন করা হলে সে
ফোন ধরে বললে, টাওয়ার যেদিকে, ওদিকে যেতে—
আমরা এগিয়ে গেলাম রাস্তার বাঁ পা ধরে
চা বাগানের উঁচু স্তন দেখতে দেখতে—


আজ এসেছি কৈলাশপুর চা বাগানে, তোমার চেয়ে একটু দূরে
সবুজের গা ঘেঁষা জঙ্গলের মধ্যস্থলে। কী লিখি আর! যা দেখেছি,
কী করে বলি! ওই শিশুরা কটেজের মেঝেতে বসে আছে, দূরে
ফুটছে মাংস, তার আগে চলছে সংস্থার অনুষ্ঠান, সবশেষে খাবে
শিশুরা। ভাতের জন্য ছুটে আসা শিশু কখনও রাগ করে অনুষ্ঠানের
মাঝে ছুটে চলে যাবে না বাড়ি। এসব এড়িয়ে তাও এলাম লুকোতে
সরকারি গেস্ট হাউসের দিকে, কিন্তু ওদের ক্ষিদে এড়ানোর ক্ষমতা
আমার নেই, এসবই লিখছি তোমায়। তুমি কি প্রতিটি অক্ষরে ওদের
দেখলে! দ্যাখো, ওই যে মেয়েটি ছেঁড়া জামা পরে ঢুলছে ঘুমে! ওই
ঘুম একটি সজোরে লাথি হয়ে অনুষ্ঠানের ক্যাঁতায় পড়েছে। কিন্তু
আমরা সকলে দিব্য ঘুমিয়ে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সমাজসেবার অনুষ্ঠানটি মারকাটারি হলো,
ক্ষুধার অনুষ্ঠানে এবারে বক্তব্য রাখবেন মাননীয়…


একটু এপাশে শাল সেগুনবাড়ি। কিছুদূর গেলে শাপলাপুকুর।
এড়িয়ে এদিকে এসেও শান্তি নেই,
তোমায় নিয়ে লেখার ফুরসৎ পাচ্ছি না, এই
চা শ্রমিকদের শিশুরা আমায় দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে কী একটি লেখা।
ওই লেখা আমায় মাঝ জঙ্গলে ফেলে চাবকাচ্ছে, চরকির মতো ঘোরাচ্ছে
নাকে দড়ি দিয়ে। আমার চারপাশে যে হলুদ পোকাটি বারংবার ঘুরছিল,
অস্থির করছিল, সে আর কেউ নয়, জঙ্গলের ক্ষিদে। ভুখা শিশুর ক্ষুধা।
ওদের মুখ, আর বাকি সবকিছুই সব অস্পষ্ট হয়ে আসছে আমার
কনজাঙ্কটিভাইটিসে লাল হয়ে যাওয়া তীব্র লাল চোখে


মা শেতলার দিব্যি, ওদের কথা আর একটি বারও লিখব না, শুধু
এইবারটি লিখে রাখতে দাও, গোপন বিষাদ। এ আঁচড় রয়ে যাবে।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলে যাবে, চা বাগানের উঠতি কিশোরী কোমর
দুলাবে ছম্মোকছল্লো নেপালী গানে। ওই কোমরের খাঁজে লুকিয়ে
থাকবে তামাম দুনিয়াদারী। তুমিও জানো না, আমিও জানি না,
কীভাবে এ ভঙ্গিতে পরপর ওরা খুঁজে নেবে গোপন যৌনসঙ্গী এবং
ক’টা টাকা। ক’টা টাকা! কতটাকায় ক’টা টাকা হয়, কীভাবে জানা
যায় বলো! অমিমাংসিত এই বর্তুলে ঢুকে ঘুরে যাচ্ছে রাতের কালো
গাঢ় চা বাগান। আমি তার কতটুকুই বা জানি! চোখে ধুলো পড়লে
কাঁচ উঠিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। চা বাগান ঘুমায়নি। ঘুমায় না। ওরা
ঘুমাতে পারে না! রাস্তায় নেমে চা খেয়ে ঘুম কাটিয়েছি, চা ওদেরও
ঘুম কেড়ে নিয়ে কোথাও যেন ছুমন্তর …

Facebook Comments

পছন্দের বই