লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গদ্য

উমাপদ কর

নির্বাণের কাছাকাছি অমিতাভ

“জলকে অনুরোধ করেছে তাকে ভুলে যাওয়ার জন্য”— অমিতাভ মৈত্র

“পরস্পরকে হত্যা করে হেমন্তের মৌমাছিরা যা বলতে চায়
বরফের অভিশাপ সারাজীবন মাথায় নিয়ে
কোনও পাহাড় যা বলে
মুখভর্তি নকল দাঁত নিয়ে
চোখ নামিয়ে সেটাই আজ বলছে হেনরি—” (‘কৃত্রিম হেনরি’/ অংশ)

অমিতাভ মৈত্র (দ্বিতীয় এবং অদ্বিতীয়। যে-কেউ উপরোক্ত পংক্তিগুলি পড়ে বলে দেবেন। হ্যাঁ, এসব প্যারাডাইম শিফট করার পর উদ্ভাবন করা তাঁর এক নয়া ডিকশন, অমিতাভীয়। আলাদা করতে পারি না, হেনরি, অমিতাভ, বিস্মিত আমি আর এক্স-ওয়াই-জেডকে।

যন্ত্রণার চামড়া উঠিয়ে নিলে ত্বকের নীচে ঘুম ভেঙে যায়। ধূসর-সাদা। আরেকটু নীচে লোহিত কণিকার চলাচলের আভাস। বেদনাকে অপারেশন টেবিলে সার্জিক্যাল ছুরিতে চিরে দিলে খোলামুখ দু-ভাগ হয়ে সাদা ধবধবে। ভেতরের দেয়ালে বিন্দু বিন্দু ভেজা রক্তকণিকা। ভালোবাসায় ফোলানো ব্লাডারে কুঠার মারা হচ্ছে রোমশ হাতে। অথবা আঙুলডগা ব্লাডারটা ঘোরাচ্ছে ধীরে, পৃথিবী ঘোরানোর মতো। বার বার ব্যর্থ কুঠার একবার নিশ্চিত ব্লাডারটা দেবে ফাটিয়ে। আঙুলের নখ ঘূর্ণনে-ঘর্ষণে ফুটো করে দেবে। জেনে এসেছি, ভালোবাসা অপার, মৃত্যুহীন। কিন্তু এ-যে শেষবাতাস ছেড়ে নিঃসহায়। তাহলে ভালোবাসা কি…

এখান থেকেই এক বিপন্নতার শুরু আমার মধ্যে। মানে, আমি উমা, আমি অমিতাভ, আমি হেনরি বা আমি এক্স-ওয়াই-জেড। বিস্ময়ের সঙ্গে রহস্যকে নেড়েচেড়ে বিপন্ন বোধ করি। কোনোকিছুই গোটা নয়, ভাঙা-ভাঙা আর অগোছালো। আবার ক্যায়টিকও নয়। বিন্যাস আর অবিন্যাসের মধ্যে বিপন্নতা দুলতে দুলতে বিপন্নতর হয়ে ওঠে। বস্তুজগতের অভীপ্সাগুলোকে বাজিয়ে বিপন্ন বোধ করি। বিপরীতে এক কল্পপৃথিবী আছে আমাদের। হেনরি, অমিতাভ, এক্স-ওয়াই-জেডসহ আমার।

কল্পের সঙ্গে চলমানকে মেলাতে গিয়ে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলে বিষণ্ণতা গ্রাস করত। আবার সবটা একদম মিলে গেলে উল্লসিত-জয়ী-তৃপ্ত আমরা হারিয়ে ফেলতাম বাহ্যজ্ঞান। তা হয় না। আশ্চর্যভাবে কিছুটা মেলে, আধো, আংশিক। স্পষ্ট, কাছে, ছোঁয়া যায়। আবার কোথায় উধাও। ধরা-অধরার মধ্যে পেন্ডুলাম আমরা। অভিসারী রশ্মিগুচ্ছ একবিন্দুতে মিলিত হওয়ার আগেই বিপন্নতার চূড়ান্তে নিয়ে অপসারী হয়ে যায়। হেনরি অমিতাভকে বলে— ‘দেখলে, দেখলে কাণ্ডখানা’? অমিতাভ এক্স-ওয়াই-জেডকে হেনরি বানায়। আমি, হেনরি ও অমিতাভ একই বিভবপ্রভেদের বৃত্তের মধ্যে বিপন্ন উজ্জ্বলতায় জ্বলতে থাকি।

আমার অস্তিত্বর ওপর আমারই চেতনার আলো ফেলে দেখি তার প্রতিফলিত ক্যারিশমা। অনস্তিত্ব সে কখনোই প্রতিষ্ঠা করেনি। কিন্তু আমি কি আছি? মানে আমি, অমিতাভ, হেনরি, এক্স-ওয়াই-জেড। পূর্ণতার বাসনায় অপূর্ণতা ঘুম হয়ে নামে। আমাদের কামনা রাগবি খেলতে নেমে, খেলে সাদামাঠা ফুটবল। আমাদের রাগ-দ্রোহ-দ্বেষ-অভিমান ঝংকার তুলতে গিয়েও বাজিয়ে ফেলে আলাপ।

দৃশ্যাতিদৃশ্যের সঙ্গে সবসময় কোনো সম্পৃক্ততা অনুভব করি না। সমমেলে বেজেও উঠি কোনো ফ্রেগ্র্যান্স অফ কালার-এ। অতলান্ত স্পর্শে। মজে যাই রসের ভিয়েনে। আবার হাসতে হাসতে আমারই সামনে গড়ে ওঠা কোনো মঞ্জিল ভেঙে পড়তে দিই। এ শুধুই আমি। আমি আছি বলেই নিত্যতার এই সূত্র, এই মহিমা। কিন্তু আমি না-থাকলেও এসবই থাকবে। এই গড়া-ভাঙা, এই হাসি হাসি মুখ অন্য কোনো আমি, সদ্গুণসমৃদ্ধ হেনরি, সাদাহাসি অন্য অমিতাভ, অজস্র এক্স-ওয়াই-জেড। আমি না থাকলেই সব অনিত্য নয় তাহলে? বিপন্নতা এ-সময়েই এক কাপ চা নিয়ে আমার মধ্যে বসে। হেনরি হাসে।

আমার মধ্যে সবসময়ই একটা ভয় কাজ করে। কীসের জন্য ভয়, নির্দিষ্ট নয়। কেন ভয়, নেই তার হদিশ। বিপন্নতার মধ্যে সারভাইভ্যালের একটা কৌশল আবিষ্কারে মগ্ন হই। সহ্যের সীমাভাঙা অন্ধকার! অলস মন্থর অন্ধকারকে আমি ভয়ই পাই। খুঁজি, আলো, অনেক আলো, যা আমার ভয়কে আশ্বস্ত করবে। আমি হেনরি হয়ে যাই, বা হেনরি ঢুকে পড়ে আমার মধ্যে।

অনন্তের মধ্যে খণ্ড হয়ে বাঁচি। ভালো-মন্দ সার-অসার তত্ত্বজ্ঞান সব বুঝি না। সাধারণ দ্যাখা। স্পষ্ট গতিশীল কোনো উচ্চারণ নেই। তবু চোখে ভেসে ওঠে সেই পাহাড় যে ‘সারাজীবন মাথায় বরফ নিয়ে’ অনন্তের মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়ে। অভিশাপ না নিয়তি? দেখি, বিশালের বিপরীতে ক্ষুদ্র এক দেয়ালে অনন্তকাল তাকিয়ে থাকা ততোধিক ক্ষুদ্র এক টিকটিকি। সে কি ফসিল হয়ে যাবে? নষ্ট হয়ে যাবে? আমাকে বলতে হয়, অভিশাপ অভিশাপ। বলতেই হয়, নষ্ট হয়ে যায়, নষ্ট নষ্ট। কিন্তু স্বাভাবিক প্রকৃত আমি পারি না। বলার আগে নকল দাঁত লাগিয়ে নিই মুখভর্তি। নিজের বিপন্নতা অপনোদনের জন্যই কি এই ছলনায় মেতে উঠি? জানি না, হেনরি জানে না, আমি নিশ্চিত অমিতাভও জানে না।
এসবই অতীতের বর্তমানের এবং ভবিষ্যতেরও। ছিলাম আছি থাকব। হেনরি ছিল আছে থাকবে। অমিতাভরাও। আমার চারপাশের অস্তিত্ব, ঘটার সম্ভাবনায় থাকা বহুবিধ ওয়েটিং লিস্ট, খোঁজা-দ্যাখা-অনুভব করা আর মিথস্ক্রিয়ায় ভরিয়ে তোলা চলতেই থাকবে। আমি, হেনরি বা অমিতাভরা ভাষ্য দিতে থাকব এসবের। তবে তা আনুপূর্বিক নয়। টানা নয়। মৌহূর্তিক। খণ্ড খণ্ড। কোলাজ কোলাজ। মহাকাব্যের অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে সঞ্জয় উবাচ রণক্ষেত্রের ভাষ্য নয়। ওল্ড কিংবা নিউ টেস্টামেন্টের Complete Commentary নয়। এ জাগতিক পরিসরের কাব্যভাষ্য। ভাঙা, অনুবাদ-অযোগ্য, অপূর্ণ, আর জ্ঞান-তত্ত্বহীন। অমিতাভদের চেষ্টা এ-কারণে, যেন এতে বিপন্নতাবোধ লাঘব হয়। হেনরিকে আমি দেখেছি একই অধ্যবসায়ে। অমিতাভ হেনরির প্রতিচ্ছবি। এক্স-ওয়াই-জেডসম আমি, হেনরি, অমিতাভ কখন যেন একাত্ম ও এক আত্মা হয়ে যাই। আমেন, আমেন।

সমান্তরাল অমিতাভ

দ্বিতীয় অমিতাভর জীবনপ্রণালী প্রাগুক্ত অবস্থানের সমান্তরালে হাঁটে আমার দ্যাখা-শোনা-বোঝা ও অনুভবে—
ক) ভিড়ভাট্টায়, গতিময় যানবাহনে, কানে তালা লেগে যাওয়া শব্দে, অমিতাভদা রাস্তা পেরোতে ভয় পেত। হেজিটেট করত। অনেকসময় তাঁকে হাত ধরে রাস্তা পার করে দিয়েছি।
খ) যে-কোনো মঞ্চে উঠতে ইতস্তত করত। একটা সংকোচ। একটা ভয়জড়ানো অস্বস্তি। কাটিয়ে উঠলেই মাইকের সামনে ছোট্ট করে হলেও বলত ভালো। অন্তত চার-পাঁচবার আমার এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে। একই মঞ্চে হলে, অমিতাভদার নাম আগে উচ্চারিত হলেও বলে বসত— ‘এই উমাপদ, তুমি আগে চলো না!’
গ) আড্ডা থেকে একটা পালাই-পালাই ভাব তৈরি হয়েছিল। ফোনাফুনি করে একত্রিত হওয়ার চেষ্টায়, হয়তো এল, কিন্তু অনেক দেরিতে, সামান্য কিছু কথাবার্তার পরই, কিছু একটা দোহাই দিয়ে, পালিয়ে যেত। আমরা বুঝতে পারতাম। একমাত্র ব্যতিক্রম দেখেছি, ২০১৬-র অক্টোবরে আমার বাড়িতে অ্যারেঞ্জ করা দু-দিনের আড্ডায়। ফুরোতেই চায় না। অকপট অমিতাভ।
ঘ) বাড়িতে গিয়ে কথাবার্তার সময় খুব ছটফট করত, আর পরে হয়তো নিয়ে বেরিয়েই পড়ত সেটেলমেন্ট অফিসের সামনের চায়ের দোকানে।
ঙ) চোখের ছানিকাটা অপারেশনের কিছুদিন পরে কথায় কথায় বলেছিল— ‘আমার মনে হয়, সবারই একবার চোখের অপারেশন করানো ভালো। কী আলো, কত উজ্জ্বল, কী উদ্ভাস। প্রাণভরে একবার পৃথিবীটা দেখে নেওয়া যেতে পারে’।
চ) রাগতে দেখিনি সচরাচর। বরং গাম্ভীর্য চিরে বের করা হাসি, কিঞ্চিৎ শব্দসহ। সেই অমিতাভদাই একদিন রাতে ফোনে (আমি কলকাতায়) বেজায় ক্ষিপ্ত। ‘ভেবেছেটা কী? আমি নপুংসক! চিল্লাতে পারি না! আমার চুপচাপ থাকাকে দুর্বলতা ভাবলে ভুল করবে। জিন্দেগিতে আর এই ইতরটার ফোন ধরব না’। ইত্যাদি। কথায় কথায় জেনে নিলাম ব্যাপারটা। বহরমপুরের তথাকথিত এক তরুণ কবি, ফোনে নানারকম গালিগালাজ করেছে। বলেছে ‘ন্যাকা’।
ছ) পত্র-পত্রিকায় কোথাও কিছু (গদ্য বা কবিতা) পড়লে ফোন করে প্রশংসা করত। প্রশংসা করতে জানত মানুষটা। কিন্তু একটা ব্যাপার খেয়াল করে দেখেছি, ফেসবুকে যেন কিছু-মিছু সাধারণ লেখাকেও একটু বেশিই প্রশংসা করে ফেলত। কারণ জিজ্ঞাসা করা হয়নি কখনও।
জ) একটা ইচ্ছা মনে মনে পোষণ করত। রেজারেকশন অফ অমিতাভ মৈত্র-র পরেও। তাঁরই মুখে— ‘এখনও যা লিখছি, সেটাও আমি জানি। যেটা লিখতে চাই, সেটা ঠিকঠাক হচ্ছে না। কিন্তু এখান থেকে এখনও আমি বেরোতে পারব না। চাইছিও না। আমার আরও বছর চারেক লাগবে। তারপর আমি শেষবারের মতো একটা চেষ্টা করব। যদি কিছু করা যায়… যদি না-ই হয়, তবে সেটাও হবে গিয়ে আরেকবার Story of failure।’ (আড্ডা— ২০১৬)। জানি না এই প্রয়াস অমিতাভদা নিয়েছিল কিনা! প্রকাশিত কবিতায় আমি সেই ডিপার্চার দেখিনি। সবকিছু এত সময় মেপে হয় না যে, ডাক চলে এলে তো আরওই না।

অমিতাভর নির্বাণ-খোঁজ

দ্বিতীয় অমিতাভ যখন বলেছি, তাহলে প্রথম অমিতাভ একজন ছিল নিশ্চয়ই। ছিল তো বটেই। তাঁর সঙ্গেই আমার প্রথম আলাপ-পরিচয়-আড্ডা-ভালোবাসা-হৃদ্যতা। ১৯৭২। কলেজপড়ুয়া আমি ও জমিল সৈয়দ কবিতাপত্রিকা ‘শ্রাবস্তী’-তে মাতলাম। আমি স্রেফ হুজুগে। জমিলই সব, আমি সঙ্গে থাকি। কবিতাসংগ্রহের কাজে অমিতাভদার রানিবাগানের বাড়ি (তখন বেশ ছোটো বাড়ি, হলুদ রং)। ছোটোখাটো পাতলা-সাতলা হাসিমুখ অমিতাভদা। তারপর বাড়ির সেই ঘরে মাঝেমধ্যেই নানারকম কবিতালোচনা আর আড্ডা, এমনকি প্রেমিকার চিঠিপাঠও, অনেক দিন, চাকরি নিয়ে বহরমপুর ছাড়া পর্যন্ত। একটা হৃদ্যতা বুঝতে পারতাম। পরে হঠাৎই বহরমপুরে কখনও-সখনও দ্যাখা হওয়া, কিছু কথাবার্তা। ৭৯-তে আমিও বাড়ির বাইরে। যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন।

এই অমিতাভও কবিতা লিখত। প্রকাশ করত। প্রশান্তদা (গুহমজুমদার) আর সে ছিল হরিহর আত্মা। বলতাম— ‘মানিকজোড়’। ৮৪-৮৫ নাগাদ একটা কবিতার পত্রিকা ‘পাণ্ডুলিপি’ যৌথভাবে শুরু করেছিল। মাত্র তিনটে সংখ্যা। আমার কবিতা চেয়ে নিয়েছিল, অমিতাভদাই। “তারপর চাকরির দৌলতে সব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাওয়া। ও পর্ব শেষ। লেখাটেখাও প্রায় বন্ধ। একদম Out of touch যাকে বলে। আমি তো ছিয়াশির পর থেকে লিখিইনি প্রায়। টুকটাক, সামান্য… বলার মতো কিছু নয়।” (আড্ডা— ২০১৬)

৮৬-র আগে কবিতা লেখালিখির একটা নমুনা—
“পানপাত্র ভেঙে যায়, সাথে ভাঙে সমূহ আড়াল
জল কি গড়িয়ে যায় তার মৃদু উষ্ণতা নিয়ে
সমর্পিত হতে কারো কাছে? যে রয়েছে দূরে কুয়াশায়
আজ তার মুখে আমি গোধূলির রহস্যকে লগ্ন হতে দেখি
যেন সে পাথর কোন, জল যার শ্বেত পরিত্রাণ—
পানপাত্র ভেঙে যায়, সাথে ভাঙে রাত্রির আড়াল
জল কি গড়িয়ে যায় তার মায়া বিষণ্ণতা নিয়ে
সমর্পিত হতে কারো কাছে?” (ভেঙে যায়/ ‘রৌরব’-এ প্রকাশিত)

প্যারাডাইম শিফটের কথা বলেছিলাম। একবার মিলিয়ে নিতে পারেন হে উৎসুক!

সমান্তরাল অমিতাভ

এই পর্বে (পরিচয় থেকে আটের দশকের প্রায় শেষ পর্যন্ত) আমার দ্যাখাশোনা অমিতাভদা—
ক) চায়ের দোকানে, রবীন্দ্রসদনে, বাড়িতে আড্ডা মারত, পরনিন্দা-পরচর্চা ছাড়া।
খ) আমার মতো নবীন কবিতাকারের কবিতা মুখস্থ বলে দিতে পারত।
গ) গল্পের মধ্যে মজা ও উইট ছড়িয়ে দিয়ে, নিজেও হেসে উঠত। প্রাণবন্ত।
ঘ) যত্রতত্র লেখা প্রকাশে দ্বিধা ছিল, নিজেকে নিয়ে সবসময়ই একটা সংশয় পোষণ করত।
ঙ) চাকরিতে মনোনিবেশ আর সেখান থেকেও লেখার রসদ আত্মস্থ করা।

ট্রানজিশন

যে-কোনো অপরিমেয় বাঁকে একটা ট্রানজিশন থাকে। অমিতাভদারও ছিল।
“শাক্যসিংহ বিষয়ক আমাদের গল্পের ভিতরে
ভেসে ওঠে ফাঁপা, গোল চাঁদ— আর
আমাদের ছোট বোন গলা মোচড়ানো শাদা হাঁস
কাপড়ে আড়াল করে প্রধান ফটক ধরে
ভোরবেলা বাড়ী ফিরে আসে।
ক্ষুধাকে সে বোধিজ্ঞান করে না এখন” (ক্ষুধা/ ‘রৌরব’ বারোবছর, জানুয়ারি-৮৮)

এর পরপরই ‘টোটেমভোজ’ সিরিজ। দ্বিতীয় এবং অদ্বিতীয় অমিতাভ। তাঁর মুখ থেকে— “আমি আবার যখন শুরু করব বলে ঠিক করলাম, তখন নিজেই ঠিক করলাম, এবার নিজের কবিতাটা লিখব।… এতদিন তো নিজের কবিতা লিখিনি। লিখেছি প্রেজেন্টেবল কবিতা, লোকে পড়েই ভালো বলবে, বেশ বেশ করবে। এটা ভুল ছিল, ভাবনায় মারাত্মক ভুল।… এবার ভেতরে ঢোকার কবিতা লিখব, আত্মস্থ করার কবিতা। ধ্যানের মতো জায়গা থেকে লেখা। মনে একটা ক্ষোভ… একটা যাকে বলে বিবমিষাও তৈরি হল। বুঝলাম, নিজের লেখা ভাঙা দরকার। তো সেখান থেকে নিজের কবিতার একদম পুরোনো ছাঁচ ভেঙে বেরিয়ে আসতে ইচ্ছে হল। দেখাও হল এরই মধ্যে নানারকম, সামাজিক টানাপোড়েন, মানুষজন, চাকরির সুবাদে মরতে যাওয়া মানুষের, পোড়া মানুষের জবানবন্দী নিতে হত, ভয়ংকর, সব মিলিয়ে একটা নিজেকে মোটিভেট করা।… ভাবলাম, কিছুই তো পারি না, তাহলে নিজেকে একটু ভ্যাঙাই, নিজেকে নিয়ে একটু মজা করি। ‘টোটেমভোজ’, ‘ষাঁড় ও সূর্যাস্ত’ এসব থেকেই…” (আড্ডা ২০১৬)।

অফুরান স্মৃতি

বহরমপুর গেলে ভোরের দিকে হাঁটতে ভালো লাগে আমার। ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে এক ভোরে এমনই হাঁটতে হাঁটতে, রানিবাগানের এক গলিতে। বাকিটা ফেসবুকে পোস্ট করা লেখা থেকে (২১/১১/২০২০) টুকরো টুকরো তুলে ধরি।

“তখনই চোখে ভেসে উঠল একটা রঙিন দো-তলা বাড়ির কোলাপসিবল গেটের পেছনে কাঠের বড়ো দরজার গায়ে যেন স্বর্ণাক্ষরে লেখা, ‘অমিতাভ মৈত্র’, নীচে, ‘শিখা মৈত্র’। পেয়ে গেছি। ভুলিনি। ঠিক চলে এসেছি। এই বাড়িতে সবমিলিয়ে কতবার-যে এসেছি, আজ তা আর গুণে বার করতে পারব না। কিন্তু আমার প্রথম দ্যাখা বাড়িটা এখন আমূল বদলে গেছে, স্বাভাবিক নিয়মেই। বছর কয়েক আগেও যখন এসেছিলাম, তখনও এতটা বদল দেখিনি।…“

১৯৯৬-এ বহরমপুর ফিরে যখন আবার নয়া উদ্যোগে ‘রৌরব’ করার প্ল্যান হচ্ছে, তখন একদিন অমিতাভদাকে ধরলাম রবীন্দ্রসদনে, রৌরবে কবিতা-বিষয়ক গদ্য লিখতে। প্রথমে না-না করলেও, আমার আর সমীরণের (ঘোষ) পীড়াপীড়িতে লিখল। পরপর কয়েকটা সংখ্যায় গদ্য। কবিতা ও মিউজিক, কবিতা ও স্বপ্ন আরও দু-একটা! এই অমিতাভদা একদম আলাদা অমিতাভদা। অসাধারণ গদ্য। সেসময়ও অমিতাভদার বাড়ি বেশ কয়েকবার গেছি।… “সুশীলদার স্মরণসভায় না থাকতে পারলেও, ‘স্মরণ’-এ লেখাতে পেরেছিলাম। সুশীলদার মৃত্যুর পর একবার দ্যাখা হলো সুশীলদার বাড়িতে। গিয়েছিলাম, অতনুদের (বন্দ্যোপাধ্যায়) এখন বাংলা কবিতা কাগজের ক্রোড়পত্র বৌদির হাতে তুলে দিতে। সেদিন স্ক্যয়ারফিল্ডে বসে জমাটি আড্ডা হয়েছিল।”… “বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভাবলাম, ডেকে উঠি, ‘অমিতাভদা’! চকিতেই। না, ডাকিনি। ডাকিনি, যদি এই সকালে ঘুমজড়ানো অথচ তেজিগলায় ভেতর থেকে অমিতাভদা চিৎকার করে ওঠে, ‘কে রে অর্বাচীন! এই সকালে আমার নাতনির ঘুম ভাঙাস?’ বা বলে ওঠে— “দ্যাখ তো হেনরি! এই সক্কালে ‘চল্লিশ পা দূরে একজন গরম মানুষ’ মনে হচ্ছে!” আমি তো জানি অমিতাভদার ‘হেনরি’ আছে। যদি ‘হেনরি’ অমিতাভদার কথায়, ‘ভয় পেয়েই সে আরও জোরে জোরে কাচ মুছতে শুরু করে দেয়’ আর ‘চামচটাকে ছুঁড়ে দেয়’ (চুল্লির মধ্যে) আমার মাথায়! কোথায় দাঁড়াব তখন। না, ডাকিনি। অমিতাভদার অনেক বিকল্প, ‘ম্যাডাম’, ‘ক্রিস্টোফার’, ‘হেনরি’। অমিতাভদা চিনলেও এরা আমায় চিনবে না। ঢুকতে দেবে কেন বাড়িতে? উল্টে জিজ্ঞাসা করে বসবে, ‘পতন কথা’ থেকে একটা লাইন বলো দেখি! ঠিক আছে, ‘টোটেম ভোজ’ থেকে হাফ-লাইন, বেশ বেশ তাহলে ‘ষাঁড় ও সূর্যাস্ত’ থেকে কোয়ার্টার লাইন! ওরা হয়তো, ‘অমিতাভ মৈত্রর কবিতা সংগ্রহ’ পর্যন্ত দৌড় করাবে আমায়। ওঁরা জানে না আমায়! পাসওয়ার্ড তো চাইবেই। নিজে নিজেই হাসলাম। ঘুমোক দাদা, পরে হবেখন, কখনো।”

পরদিন ফেসবুকে পড়ে আমায় ফোন— “উমা তুমি লজ্জায় ফেলে দিলে আমাকে! তুমি ডাকলে না! এতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলে! আশ্চর্য। বলো তো, তুমি কি আমাকে একটু পর করে দিলে না? আমি বিস্মিত হই তোমাদের ভালোবাসায়। তবে তুমি অন্যায় করেছ, না-ডেকে” ইত্যাদি।

ফেসবুকে লেখাটা শেষ করেছিলাম এইভাবে— “আমাদের সময়ের বড়ো (মেজর) কবি ও গদ্যকার অমিতাভ মৈত্র। প্রথার বাইরে, স্বতন্ত্র চিন্তা-চেতনা, বাকরীতি, ভাষা, আর পরিবেশনা। এগিয়ে থাকা এক শিল্পীমানুষ। আমার মতো ক্ষুদ্রের সঙ্গে তাঁর ৫১ বছরের পরিচয়, হৃদ্যতা, কথাবার্তা-আড্ডা হয়, আমার লেখালিখি নিয়ে অন্তত দু-বার কলম ধরে, এর চেয়ে শ্লাঘার বিষয় আর কিছু হতে পারে না! মাথা নুইয়ে প্রণাম জানিয়ে ঘরের পথ ধরলাম। আজ ঘরটা যেন অনেকটা দূর মনে হচ্ছে। বস্তুত বহুদূর কোথাও যেন একটা পৌঁছে গিয়েছিলাম। ঠিক স্ববশে নেই।”…

না, মৃত্যুদিন, দুপুরে অমিতাভদার বাড়ি থেকে বাবুয়া (অনুপম ভট্টাচার্য) ফোন করলেও অমিতাভদার মৃতমুখ আমি ফোটো কিংবা ভিডিওতে দেখতে চাইনি, যেমন চেয়েছিলাম নাসের-এর সময়। জানি না, কেন যে!

Facebook Comments

পছন্দের বই