লেখক নয় , লেখাই মূলধন

প্রবন্ধ

অভ্রদীপ গঙ্গোপাধ্যায়

‘নয়নসুখ’ অথবা অমিত দত্তা-র ধ্বনিচিত্রকাব্য

চিত্রকর নয়নসুখ ডাকলেন। বুধু! ধনু! বোধি! প্রবলু! বুধু তরোয়াল নিয়ে ছুটে এল। ধনু বেরিয়ে এল পুরোনো প্রাচীরের আড়াল থেকে। হাত কোমরবন্ধের তরবারিতে। বোধি এল বল্লম উঁচিয়ে। সাথে এল আরও দু-জন। একজনের হাতে ঢাল, অপরজনের বন্দুক। বাঘের গর্জন শুনতে পেলাম আমরা। প্রবলু গাছের ডালে বসে, তর্জনী নির্দেশ করছে। ভয়ে আঙুল কাঁপছে তার। নয়নসুখ এবার বাঘকে হাঁটিয়ে নিয়ে এলেন রঙ্গমঞ্চে। পিছনে বেজে উঠল ভেরী, বাজল কাড়া-নাকাড়া। ধনু, বোধিদের মতোই বাঘের পরনে দুধ সাদা পোশাক। শুধু মাথায় বিশালাকার মুখোশ আঁটা। বাঘ আক্রমণ করল বুধুকে। সবুজ পোশাকে এলেন রাজা বলবন্ত সিং। বাঘকে তিনি হত্যা করবেন। আর এই দৃশ্যের একপাশে দাঁড়িয়ে, তুলি কাগজ হাতে পুরো চিত্রটি পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন নয়নসুখ। মুখে তাঁর তৃপ্তির হাসি। বাতাস তখন প্রবল বেগে বইছে।

স্থান জম্মুর জস্রোতা অঙ্গ রাজ্য। রঙ্গমঞ্চ, রাজা বলবন্ত সিং তথা তাঁর পিতা রাজা জরোয়ার সিং-এর রাজপ্রাসাদের ভগ্নস্তূপ। সময় অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্য ভাগ। চিত্রটিতে নয়নসুখ বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে কল্পনার মিশেল ঘটিয়েছেন, কিছুটা রাজ মাহাত্ম্যের বর্ণনায়, বাকিটুকু শৈল্পিক তাগিদে। সপ্তদশ শতকে গড়ে ওঠা ‘পাহাড়ী চিত্রকলা’-র একজন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চিত্রকর, এই নয়নসুখ। আদতে গুলের (একদা জম্মু, অধুনা পাঞ্জাবে), এবং পরবর্তীতে জস্রোতা ও বাসোলিতে জীবনযাপন করা এই চিত্রশিল্পীর যা কিছু মূল কাজ এখনও বিভিন্ন চিত্রশালায় সংরক্ষিত আছে, তা মূলত ১৭৪০-৬৫, এই সময়সীমার। এই সময়কালীন, তিনি জস্রোতা রাজদরবারে চিত্রকররূপে নিযুক্ত ছিলেন।

অষ্টাদশ শতাকের মধ্যভাগে অঙ্কিত এই বাঘ শিকারের দৃশ্য, পরিচালক অমিত দত্তা-র ক্যামেরায় আসে খণ্ডাকারে, ভেঙে ভেঙে, প্রতিটি অ্যাকশনের খুঁটিনাটি সমেত; যেখানে চিত্রকর নিজেও একজন চরিত্র, যিনি চিত্রের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। অর্থাৎ অমিত এই অঙ্কিত চিত্রটিকে নির্দিষ্ট কিছু অ্যাকশনে ভেঙে নেন। এরপর সেই অ্যাকশনগুলিকে পৃথক পৃথকভাবে উপস্থাপন করেন, থিয়েটারীয় ঢঙে। নয়নসুখ হয়ে ওঠেন সেই থিয়েটারের একাধারে পরিচালক ও দর্শক। এবার সমগ্র অ্যাকশনটিকে একসঙ্গে দেখান অমিত। সঙ্গে দেখান নয়নসুখ অঙ্কিত মূল চিত্রটিকে। আমরা অবাক হয়ে দেখি, এভাবেও একটি চিত্রকে পঠন করা সম্ভব! এই দৃশ্যকল্পের সঙ্গে, অমিত, ধ্বনির ব্যবহারের দ্বারা, আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে, সামগ্রিক কর্মকাণ্ডটিকে করে তোলেন সম্পূর্ণ নিজস্ব ও স্বতন্ত্র। সেখানে লোকশিল্পের প্রথানু্যায়ী, বাঘের সাজে আসেন একজন অভিনেতা। কিন্তু দর্শক শুনতে পায় ব্যাঘ্র গর্জন। ভেরী, তুরী, কাড়া নাকাড়ার মিলিত প্রয়োগে আবির্ভূত হয় বীররস। আর ক্যামেরা যখন বাম দিক থেকে ডান দিকে ট্র্যাক করে নয়নসুখের উপর আসে, তাঁকে একলা ক্যামেরাবন্দি করে, সমস্ত ধ্বনি শান্ত হয়ে যায়; পড়ে থাকে তীব্র বাতাসে পাতার কম্পনের আওয়াজ।

‘নয়নসুখ’ ছবিটি ২০০৯-১০ সালে নির্মিত। অমিত দত্তা-র এর আগে নির্মিত ছবি ‘শত্রঘ্ন’, ‘ক্রমশ’, ‘আদমি কি আউরত অর অন্য কাহানিয়া’ ইত্যাদিতে দেখা যায়, কোনো আপাত সামান্য স্থান বা স্পেসকে শট্ কম্পোজিশনের কি অসামান্য মুন্সিয়ানা ও ধ্বনি ব্যবহারের অদ্ভুত প্রয়োগে, কীরকম অসীম মাত্রায় নিয়ে যেতে পারেন তিনি। ‘নয়নসুখ’ ছবিতে জম্মু ও হিমাচল প্রদেশের অতীব সুন্দর ভূদৃশ্য এবং একটি ধ্বংসপ্রায় রাজমহল, এ হেন পরিচালকের কাছে স্বাভাবিকভাবেই সোনার খনি। চিত্রকর নয়নসুখের জীবনকাহিনি, তাই অমিত সাজান রং দিয়ে, প্রকৃতির ক্যানভাসের ওপর। সেখানে উপত্যকার সবুজ রং বিভিন্ন শেডে ক্যামেরায় ধরা দেয়। ফ্রেমের মধ্যে চরিত্র ও বস্তুসমূহের বিচিত্র অবস্থান, কম্পোজিশনগুলিকে একঘেয়েমির বাইরে এক নতুন জ্যামিতিক নকশায় পরিণত করে। নয়নসুখ কৃত কোনো চিত্রের চলচ্চিত্রে রূপান্তর (যার একটি উদাহরণ শুরুতেই দেওয়া হয়েছে) ব্যতীত অন্য দৃশ্যগুলি, যেখানে নয়নসুখকে তাঁর দাদা মানাকু ও বাবা পণ্ডিত সেউ-এর সঙ্গে দেখা যায়, বা যে-দৃশ্যে রাজা জরোয়ার সিং-এর মৃত্যু ও যুবরাজ বলবন্ত সিং-এর রাজ্যাভিষেক ঘটে; সেই দৃশ্যগুলিও মনে হয় যেন তুলোট কাগজে আঁকা। এমনই তার আলোকসম্পাতের গুণ। এর সঙ্গে দ্রবীভূত হয়, কোনো নির্দিষ্ট ধ্বনিকে, যেমন গড়গড়ায় তামাক সেবনের গুরগুর শব্দ বা ময়ূরের তীব্র কেকা রব, যেমন সিঁড়ি ভেঙে ওঠা পায়ের ক্লান্ত স্বর বা পায়রার পাখসাট, পারিপার্শ্বিক ধ্বনির তুলনায় উচ্চকিত মাত্রা বা লেভেলে প্রয়োগ। এই ধ্বনিগুলি তখন নিছক স্পেসকে সংজ্ঞায়িত করে না। এফেক্ট সাউন্ডের কাজও করে।

ধ্বনি ব্যবহারের এই প্রবণতার সঙ্গে, সম্পাদনার একটি প্রবণতাও পরিচালক অমিত দত্তা-র স্বাক্ষর বহন করে। অ্যাকশনের পুনরাবৃত্তি। এই পুনরাবৃত্তি কখনো আন্ডারলাইনের কাজ করে। কখনো-বা একটি স্টাইলাইজ্ড আঙ্গিক হিসেবে ধরা দেয়। ‘নয়নসুখ’ ছবিতে যেমন দেখতে পাওয়া যায়, ঘাড় ঘোরানো, এই অ্যাকশনের পুনরাবৃত্তি। অর্থাৎ একটি শটে নয়নসুখ ঘাড় ঘোরালেন। ঠিক পরবর্তী বা তার পরবর্তী শট্, সম্পূর্ণ অন্য কোণ ও পরিমাপে নেওয়া, সেখানেও নয়নসুখকে ঘাড় ঘোরাতে দেখতে পাওয়া যায়। কন্টিনিউটির এই ভাঙন, অমিত দত্তা-র পছন্দের প্রয়োগ। তাঁর চলচ্চিত্রে যেমন ভারতীয় চিত্রপরিচালক মনি কউলের আধ্যাত্মিক ছায়া দেখতে পাওয়া যায়, তেমনি আর্মেনিয়ান চিত্রপরিচালক সের্গেই পারাজনভের টেকনিকের ছোঁয়াও বিদ্যমান। এর সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের লোকশিল্প, লোকগাথা ও অতি অবশ্যই ধ্রুপদ সঙ্গিত— অমিতের ছবির কেন্দ্রস্থল। ‘নয়নসুখ’ ছবির প্রতিটি শট্ সেই কথাই বলে। চিত্রকর নয়নসুখ ‘পাহাড়ী চিত্রকলা’য় মুঘল অঙ্কনশৈলীর প্রভাব নিয়ে এসেছিলেন। ফলে তাঁর অধিকাংশ চিত্রই পার্শ্বচিত্র, যেখানে কোনো চরিত্রের শুধু একটি দিক, বাম বা ডান, দেখতে পাওয়া যায়। অমিতও সেই প্রথা মেনে চলেন চিত্রগুলির চলচ্চিত্র রূপায়ণে। ওই দৃশ্যগুলির কম্পোজিশন তিনি চরিত্রগুলির বাম বা ডান প্রোফাইল থেকেই করেন। সঙ্গে যুক্ত করেন কল্পিত ধ্বনি, যার উৎস হয়তো চিত্রে আছে, আবার কখনো তা ভাবের দ্বারা অনুপ্রাণিত। ফলে, প্রতিটি শট্, যে-দৃশ্যকল্পের জন্ম দেয়, তা ঘন, গভীর ও বহুমাত্রিক। এবং ভীষণভাবে ইঙ্গিতপূর্ণ।

দৃশ্যকল্পের ইঙ্গিতপূর্ণতা বুঝবার জন্য আমাদের ফিরে যেতে হবে বলবন্ত সিং-এর রাজা হওয়ার দৃশ্যটিতে। মনে রাখতে হবে জরোয়ার সিং নয়নসুখকে রাজদরবারে ডেকে পাঠালেও, তাঁর মৃত্যুর পর বলবন্ত সিং-ই হয়ে ওঠেন এই প্রায় সমবয়সি চিত্রকরের মূল পৃষ্ঠপোষক ও বন্ধু। দর্শক দ্যাখে, জরোয়ার সিং একটি অলিন্দে দাঁড়িয়ে আছেন। অলিন্দটির আলসে ময়ূরপঙ্খী কাপড়ে মোড়া। একটু নীচে, আর-একটি অলিন্দে দাঁড়িয়ে আছেন বলবন্ত সিং। হাতে তাঁর গড়গড়ার নল। এই গড়গড়া ও নল ভবিষ্যতে নয়নসুখের প্রতিটি রাজদরবারি চিত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠবে। জরোয়ার সিং ও বলবন্ত সিং-এর, এই ভিন্ন উচ্চতার দুই পৃথক অলিন্দে অবস্থান, ওঁদের রাজদরবারে অবস্থানের তারতম্যটিকে সুচারূভাবে বুঝিয়ে দেয়; একটিও বাক্য ব্যয় না করে। এর কয়েকটি দৃশ্য পরে দেখা যায়, জরোয়ার সিং তাঁর অলিন্দে মাথা রেখে পড়ে গেলেন। ক্রন্দনধ্বনির সঙ্গে, একজন কৃষ্ণবস্ত্রা তরুণী ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে ছুটে চলে যায় পরের শটে। বিকেলের আকাশে উড়ে যায় একঝাঁক পক্ষী। ময়ূরপঙ্খী কাপড় মোড়া অলিন্দে বলবন্ত সিং এসে দাঁড়ান। নয়নসুখ দাঁড়ান তাঁর সামনে হাত জোড় করে। দর্শক বুঝতে পারে সিংহাসন বদল হল কালের নিয়মে।

এর আগে অমিত দেখিয়েছেন, সিঁড়ি বেয়ে উঠে ক্লান্ত জরোয়ার সিং কোষাগার থেকে (শুধুমাত্র একজন মহিলার হাত ফ্রেমের সামনে আসে এবং থলিটি হস্তান্তর করে) এক থলি মোহর নিয়েছেন। তারপর তাঁকে নৃত্য গীতের আসরে দেখা যায়। বলবন্ত সিং রাজা হওয়ার পর, অমিত তাঁকে সরাসরি কোষাগারে (মহিলার হাত) থলি নিতে দেখান। এরপর আমরা তাঁকে সিঁড়ি বেয়ে নামতে দেখি। দেখি নৃত্য গীতের আসরে নয়নসুখ তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে। অর্থাৎ দরবারে নয়নসুখ তথা চিত্র অভ্যাসের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ বলবন্ত সিং শিল্পীর কদর তাঁর পিতার চেয়েও বেশি করেন। পিতা-পুত্রের রাজঅভ্যাসের এই সূক্ষ্ম মিল অথচ অমিল— পিতা সিঁড়ি ভেঙে উঠে কোষাগার থেকে টাকা নেন ও কলাবিদ্যায় প্রয়োগ করেন এবং পুত্র কোষাগার থেকে টাকা নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামেন ও একই কাজ করেন— সিঁড়ি ভেঙে ওঠা ও নামার অ্যাকশনকে দু-জনের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে এবং সঙ্গে নয়নসুখের অবস্থানের পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে— অমিত দত্তা অনেক কিছু দেখিয়ে ফেলেন, বুঝিয়ে দেন, অনুধাবন করান— একটিও সংলাপ খরচ না করে। যেমন চিত্রে কোনো সংলাপ থাকে না। দর্শককে চিত্রটি দেখে, বার বার দেখে, বিভিন্ন কোণ থেকে দেখে, প্রতিটি আঁচড়কে পর্যবেক্ষণ করে, চিত্রকরের বার্তাটি বুঝে নিতে হয়, ঠিক তেমন।

‘নয়নসুখ’ ছবিটির প্রেরণা বি এন গোস্বামীর লেখা বই ‘Nainsukh of Guler’। ছবিটি পিরিয়ড পিস হলেও, এর বাজেট ততোধিক নয়। ফলে আসল লোকেশনের ভগ্নদশার মধ্যেই ছবিটি তুলতে হয় অমিতকে। আর এই গণ্ডিই হয়ে ওঠে তাঁর হাতিয়ার। নয়নসুখের জীবনকাহিনির উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলি, এভাবেই ইঙ্গিতের মাধ্যমে দেখান অমিত। যা চলচ্চিত্রও মনে হতে পারে, আবার কখনো ইনস্টলেশন আর্টও হয়ে উঠতে পারে। অথচ একবারের জন্যেও দর্শকের মনে হয় না, অন্যভাবে দেখালে ভালো হত। কারণ, অমিত সেভাবেই মেজাজটি বাঁধেন। সঙ্গে সঙ্গত করে অনবদ্য সুন্দর ও নিটোল কম্পোজিশনের দৃশ্যমালা এবং শান্ত, সমাহিত ধ্বনি আবহের পরিসরে তাৎক্ষণিক চ্যুতি ও পরিচিত ধ্বনিকে এফেক্ট সাউন্ডে রূপান্তর। আমাদের আশ্চর্য করে, অমিতের আলোকসম্পাতে পারদর্শীতা। এক-একটি ক্লোজ-আপ শট্, যেন এক-একটি অয়েল পেইন্টিং! এক-একটি ওয়াইড অ্যাঙ্গেল শট্, যেন মিনিয়েচার পেইন্টিং-এর স্মারক বহনকারী। অথচ কখনোই তা অতিকরণ নয়।

নয়নসুখ যখন খচ্চরের পিছনে পুঁটলি চাপিয়ে গুলের থেকে জস্রোতা যাচ্ছেন, তাঁকে একটি সবুজ মাঠের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে দেখতে পাওয়া যায়। এই সবুজ মাঠ সমগ্র ছবিটিতে আমরা তিন বার দেখি। এবং তিন বারই, তিনরকম সবুজ রং আমাদের দেখান অমিত। আবার কখনো কোনো শট্ কম্পোজ করেন এমনভাবে, যেখানে নয়নসুখ বা ফ্রেমের অন্য কোনো একমাত্র চরিত্রের অবস্থান হয় একদম প্রান্তে। ফ্রেমটিকে উপর-নীচে ষোলো ভাগে ভাগ করলে, দর্শক নয়নসুখের শুধুমাত্র মাথা ও কাঁধ দেখতে পাবে, ফ্রেমের একদম নীচের দুই ভাগে। বাকি ফ্রেম জুড়ে নদীর বহতা পানি। এখানে জল বা মাটিকে প্যালেট হিসেবে ব্যবহার করেন অমিত। যেখানে জলের স্রোত অথবা মাটির রং একটা অনুভূতিকে ব্যক্ত করবে। আর ছবিটিতে যুক্ত হবে নতুন একটি পরত।

‘নয়নসুখ’ ছবিটিতে একটি অতি পুরাতন পাঞ্জাবী লোকগীতি ও তার সুর বারংবার ব্যবহৃত হয়েছে। সুরটি এক আশ্চর্য নস্টালজিয়া মাখা। এ দর্শককে এক অজানা সময়ের রূপকথায় পৌঁছে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। মনকে করে তোলে সুদূরপ্রসারী। একই সুর, ব্যবহারের তারতম্যে আবার বিষণ্ণও হয়। বলবন্ত সিং মৃত্যুকালীন অবস্থায়, যখন লিখতে লিখতে বসে থেকেই ঘুমিয়ে পড়েন, তাঁর চামরদারও ধীরে ধীরে ঝিমুতে শুরু করে। এমনই মায়াবী, ঘুমপাড়ানি সেই সুর। এ-সুর ফেলে আসা ঘরের কথা মনে পড়ায়, ফেলে যেতে হবে এমন ঘরকে প্রিয় করে তোলে।

‘নয়নসুখ’ যখন ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে আন্তর্জাতিক মুক্তি পায়, চিত্র সমালোচকরা আর-একটি বিষয় লক্ষ করে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তা এর সংলাপ ব্যবহারের প্রবল মিতব্যায়িতা। ছবিটিতে সাকুল্যে হয়তো নয় থেকে দশটি সংলাপ রয়েছে। আছে কয়েকটি ভাষ্য, যা নয়নসুখ কর্তৃক কয়েকটি চিত্রের সঙ্গে লিখিত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। আর দু-তিনটি গজল। কয়েকটি অবোধ্য কোলাহল। আর কিচ্ছু নয়। কারণ, ছবিটিতে একটি ইমেজ আর-একটি ইমেজের সঙ্গে কথা বলে। একটি ধ্বনি আর-একটি ধ্বনিকে ব্যবহার করতে বাধ্য করে। চরিত্ররাও যদি একইসঙ্গে কথা বলে যায় অনর্গল, দৃশ্যকল্প তৈরি হতে পারে; চিত্রকল্প তৈরি হয় না। অমিত তাঁর প্রতি শটে চিত্রকল্প তৈরি করায় মন দিয়েছেন। উৎসুক হয়ে অপেক্ষা করেছেন, যাতে দর্শক সূত্র ধরে ইমেজের মূল রসে পৌঁছতে পারে। যে-সূত্র লুকিয়ে রাখা দৃশ্যে, শ্রাব্যে, সাহিত্যে, সংগীতে ও চেতনায়।

২০১৮ সালে, ন্যাশনাল ফিল্ম আর্কাইভ অফ্‌ ইন্ডিয়াতে, অমিত দত্তা-র একটি রেট্রোস্পেকটিভ দেখানো হয়। শেষ দিনের প্রশ্নোত্তরপর্বে, অমিত জানান তিনি তাঁর স্বল্পসংখ্যক দর্শকেই খুশি। বলেন, চলচ্চিত্র মূলত দুই প্রকারের হয়। দেশীয় ও মার্গীয়। যাঁরা মার্গ বা পথ দেখান, তাঁদের দর্শক চিরকালই কম। আর যাঁরা সেই মার্গ থেকে শিক্ষা নিয়ে, তাকে যথাযুক্ত সহজপাচ্য করে পরিবেশন করেন, তাঁদের ছবি বেশি লোকে দেখে। কিন্তু এই কথার পরও একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। অমিত দত্তা-র ছবিগুলি (একইসঙ্গে মনি কউল ও কুমার সাহানির ছবিও) কি তাহলে চিরকালই এলিট ইন্টেলেকচুয়াল শ্রেণির ছবি হয়েই থেকে যাবে? যাদের অর্থ ও সময় আছে শিল্পকে পৃষ্ঠপোষণ করার। যেরকম এককালে রাজা-বাদশারা করতেন। যেরকম পৃষ্ঠপোষকতা নয়নসুখ পেয়েছিলেন জস্রোতের রাজসভায়। না কি কোনোদিন তা সাধারণ মানুষের চলচ্চিত্রও হয়ে উঠতে পারবে, সমস্তরকম স্বকীয়তা বজায় রেখে, বিষয় ও আঙ্গিককে এতটুকুও তরলীভূত না করে। অথবা সাধারণ দর্শক বলতে যাদের সাধারণত বোঝানো হয়ে থাকে, তাঁরা সক্ষম হবেন, ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস, সাহিত্য ও সংগীতকে সম্যকরূপে ও অবিকৃতভাবে অনুধাবন করতে, যাতে শিল্পের ইঙ্গিতবাহীতা থেকে তাঁরাও সমান রস পান।

Facebook Comments

পছন্দের বই