লেখক নয় , লেখাই মূলধন

প্রবন্ধ

অরূপ চক্রবর্তী

পুজোর গান: অতীত ও বর্তমান

বাংলা বছর শুরু হতে না হতে ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকার পাতা উলটে প্রথমেই আমরা আশ্বিনের পাতা খুলে দুর্গোৎসবের তারিখ খুঁজতে শুরু করে দিই। কবে আসবে সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত পুজো বা উৎসব। এ কি শুধুই মনের আবেগ বা ভক্তির কারণে? না কি সারা বছরের একঘেঁয়ে ও সমস্যা জর্জরিত জীবনযাত্রার থেকে ক-দিনের জন্য মুক্তি পাওয়া। সবকিছু ভুলে নিজের আপনজনের সাথে অনাবিল আনন্দে মেতে থাকা! এ বড়ো অদ্ভুত এক রীতি যা বাঙালিরা যুগ যুগ ধরে সযত্নে লালন করে চলেছেন।

স্থান ও কালের নিয়মে আমাদের দেশের এক এক জায়গার উৎসব পালনের ধারা ভিন্ন। আমাদের পশ্চিমবাংলায় উৎসব উপলক্ষে সাবেকি সামাজিক রীতিনীতি ছাড়াও কিছু বছর আগে অবধি এই বাংলায় সংস্কৃতির এমন দুটো ধারা বহমান ছিল যা ভারতের অন্য কোনো রাজ্যে দেখা যেতো না। তার একটা হচ্ছে— পূজাবার্ষিকী সাহিত্য ও অপরটা পুজো উপলক্ষে এইচএমভি থেকে গ্রামোফোন রেকর্ডে প্রকাশিত গানের ডালি। যদিও একটা সময়ে পলিডোর (পরবর্তীতে মিউজিক ইন্ডিয়া), কলম্বিয়া, সেনোলা, হিন্দুস্থান (পরবর্তীতে ‘ইনরেকো’), মেগাফোন, টুইন, অ্যাঞ্জেল ইত্যাদি কোম্পানি থেকে কিছু গান প্রকাশ পেতো কিন্তু পরবর্তীতে একমাত্র এইচএমভি এই ধারা বজায় রেখেছিল। পূজাবার্ষিকী সাহিত্য এখনও সেই ট্র্যাডিশন বজায় রেখে চললেও অন্য শাখাটি অর্থাৎ গানের রেকর্ড প্রকাশ বর্তমানে কালের স্রোতে বিলীন হয়ে গেছে। এখন পুজোর দিনগুলিতে আর নতুন গানের সুর ভেসে আসে না। অথচ গান পাগল বাঙালির হৃদয় উন্মুখ হয়ে থাকে সেই সুর-দরিয়ায় ভেসে যাবার জন্য।

কবে থেকে এই ভাবনার, অর্থাৎ গানের এই শারদ অর্ঘ্য নিবেদন শুরু হয়েছিল তার ইতিহাস আমার অজ্ঞাত। তবে বিশের দশক বা তারও আগের থেকে কিছু রেকর্ড প্রকাশ পেতো শারদোৎসবকে কেন্দ্র করে এবং সেই গানগুলির অধিকাংশই আগমনী, কীর্তন বা ভক্তিগীতি পর্যায়ের ছিল। তুলনায় আধুনিক গান সংখ্যায় কম হত। সেই সময়ের উল্লেখযোগ্য শিল্পীদের তালিকায় ছিলেন কে মল্লিক, মানদা সুন্দরী দাসী, নারায়ণ চন্দ্র মুখোপাধ্যায়, লালচাঁদ বড়াল, আঙ্গুরবালা দেবী, ইন্দুবালা দেবী, কমলা ঝরিয়া প্রমুখ। আমার পঞ্চাশের দশক ও তার পরের গানগুলির সাথে বেশি আত্মিক যোগ এবং মূলত বেতার ও লাউড স্পিকারে বাজানো গানগুলি শোনার মাধ্যমে এই ভালো লাগা শুরু হয়েছিল। সেই সময় জনপ্রিয় সংগীত শিল্পীদের গান বছরে একবার প্রকাশিত হতো এবং সময়টা ছিল প্রাক-পুজো। দুটো করে গান থাকত 78 RPM রেকর্ডে, পরবর্তী কালে যেটা 45 EP অর্থাৎ এক্সটেন্ডেড প্লে রেকর্ড (৪টে গান), 33 সুপার সেভেন রেকর্ড (৬টা গান) বা লং প্লেয়িং রেকর্ডে (১২টা গান) পরিণত হয়েছিল। মহালয়ার দিন ভোরে বেতারে ‘মহিষাসুর মর্দ্দিনী’ গীতিআলেখ্য প্রচারের পর থেকে শুরু হয়ে যেতো সেই বছর পুজো উপলক্ষে প্রকাশিত গানের প্রচার। পুরোনো গানের সাথে নতুন গান বেতারের মাধ্যমে সারা বছরভর ‘অনুরোধের আসর’ বা ‘গীতিকা’ ইত্যাদি অনুষ্ঠানে শোনা যেতো। এ ছাড়া বিভিন্ন পুজোর প্যান্ডেলে, উৎসব বাড়িতে, জলসা ও মেলায় এইসব গানগুলি লাউড স্পিকারে বাজানো হত এবং অধিকাংশ মানুষ এইভাবে গানগুলির সাথে পরিচিত হতেন। সেই সময় দৈনিক সংবাদপত্রগুলিতে পুজোর গানের তালিকা সম্বলিত বিজ্ঞাপন প্রচারিত হত। এর মাধ্যমে গানের শ্রোতারা জানতে পারতেন সেই বছর কোন কোন শিল্পীর গান প্রকাশিত হয়েছে এবং সেইসব গানের গীতিকার ও সুরকারের নামও জানতে পারতেন। সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় এইসব গানের দীর্ঘায়ত এক পর্যালোচনা প্রকাশিত হত পর পর দু-টি সংখ্যায়।

গীতিকার ও সুরকারদের দীর্ঘ এক বছরের কঠিন সাধনার ফসল সেই গান গায়ক গায়িকারা কণ্ঠে ধারণ করে শ্রোতাদের উদ্দেশে নিবেদন করতেন রেকর্ডের মাধ্যমে। শ্রোতারাও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকতেন তাঁদের প্রিয় শিল্পীদের নতুন গানের জন্য। তবে এই প্রসঙ্গে একটা তথ্য জানানো একান্ত প্রয়োজন— শারদ অর্ঘ্যের উপচার শুধুমাত্র গানেই সীমাবদ্ধ থাকত না। কবিতা, গীতিনাট্য ও হাস্যকৌতুকের ডালি দিয়েও এই অর্ঘ্য সাজানো হত। আর গান মানে শুধু আধুনিক গান নয়— সঙ্গে কীর্তন, স্তোত্র, রাগাশ্রিত গান বা রাগপ্রধান গান, লোকগীতি, গণসংগীত, ছড়ার গান ও প্যারোডি ইত্যাদিও শারদীয় গানের ডালিকে আরো সমৃদ্ধ করত। প্রতি বছর গড়ে ৪০ থেকে ৫০টা রেকর্ড প্রকাশিত হত এই সমস্ত বিষয়কে কেন্দ্র করে। সাথে থাকত আরেক আকর্ষণ— শারদ অর্ঘ্যের গানের পুস্তিকা। বিভিন্ন শিল্পীর ছবি সম্বলিত ও তাঁদের গাওয়া গানগুলি মুদ্রিত থাকত এই পুস্তিকায়, সাথে গীতিকার ও সুরকারের পরিচয়। গীতিকারদের মধ্যে থাকতেন শ্রদ্ধেয় প্রণব রায়, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, সলিল চৌধুরী, মুকুল দত্ত, শ্যামল গুপ্ত, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, সুধীন দাশগুপ্ত, শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, পবিত্র মিত্র, মিল্টু ঘোষ, বরুণ বিশ্বাস, সুবীর হাজরা, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, মীরা দেববর্মন প্রমুখ। এ ছাড়াও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, বিমল চন্দ্র ঘোষ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সুকান্ত ভট্টাচার্য ও সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লেখা কবিতাও গানে রূপান্তরিত হয়েছে। সুরকারদের মধ্যে শ্রদ্ধেয় জ্ঞান প্রকাশ ঘোষ, শচীন দেববর্মন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, রবীন চট্টোপাধ্যায়, নচিকেতা ঘোষ, সুধীন দাশগুপ্ত, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, হিমাংশু বিশ্বাস, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রবীর মজুমদার, অনল চট্টোপাধ্যায়, রতু মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, ভূপেন হাজারিকা, রাহুল দেববর্মন, ভি. বালসারা, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, ওয়াই. এস. মুলকি, বাপি লাহিড়ী, রবীন্দ্র জৈন প্রভৃতি বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের সমারোহ ছিল উল্লেখযোগ্য।

শিল্পীদের নামের তালিকায় একনজর চোখ বোলালে বোঝা যাবে সেই সময় গানের জগতে কত রথী মহারথীকে আমরা পেয়েছি। শচীন দেববর্মন, জগন্ময় মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, তালাত মাহমুদ, কিশোর কুমার, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, গীতা দত্ত, আরতি মুখোপাধ্যায়, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অজয় চক্রবর্তী (রাগাশ্রিত গান), নির্মলেন্দু চৌধুরী (লোকগীতি), ভূপেন হাজারিকা, ছবি বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাধারানী দেবী (কীর্তন), প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, সনৎ সিংহ (ছোটোদের ছড়ার গান), রাহুল দেববর্মন, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় নৃপতি চট্টোপাধ্যায় ও জহর রায় (কৌতুক নকশা), কাজী সব্যসাচী (আবৃত্তি), ইলা বসু, নির্মলা মিশ্র, শিপ্রা বসু, মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, সবিতা চৌধুরী, সুমন কল্যাণপুর, ডঃ গোবিন্দ গোপাল মুখোপাধ্যায় ও মাধুরী মুখোপাধ্যায় (স্তোত্র), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও বটুক নন্দী (গীটার), পিন্টু ভট্টাচার্য, অনুপ ঘোষাল, মিন্টু দাশগুপ্ত (প্যারোডি গান), বনশ্রী সেনগুপ্ত, রানু মুখোপাধ্যায়, শ্রাবন্তী মজুমদার, হৈমন্তী শুক্লা, অরুন্ধতী হোমচৌধুরী, অমিত কুমার, ক্যালকাটা ইউথ কয়ার (গণসংগীত) প্রভৃতি অসংখ্য গুণী শিল্পীর নিবেদনের সম্ভারে সেজে উঠত শারদ অর্ঘ্যের ডালি। সেই যুগে শিল্পী, গীতিকার ও সুরকারদের মধ্যে এক সুন্দর শ্রদ্ধা ও প্রতিযোগিতার সম্পর্ক ছিল। একে-অপরের কাজ শুনতেন এবং নিজের কাজের সাথে তার তুল্য মূল্য বিচার করতেন। এই কারণে প্রত্যেকের নিজস্ব সৃষ্টি শ্রেষ্ঠত্বের পর্যায়ে পৌঁছে যেত।

শ্রোতাদের মধ্যে আবার কোন কোন তারকা শিল্পীর গাওয়া গান সেরা হয়েছে সেই নিয়ে রীতিমতো দলাদলি ও তর্ক ছিল একটা অবধারিত বিষয়। ফুটবলে যেমন ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান, ক্রিকেটে তেন্ডুলকার বনাম কোহলি, পুরুষদের টেনিসে ফেডেরার বনাম জকোভিচ, মহিলা টেনিসে স্টেফি গ্রাফ বনাম নাভ্রাতিলোভা, সিনেমায় উত্তম কুমার বনাম সৌমিত্র তেমনই গানের ক্ষেত্রে ছিল হেমন্ত বনাম মান্না, কিশোর বনাম আর. ডি, সন্ধ্যা বনাম আরতি, লতা বনাম আশা। আসলে তখন গানের কথা, সুর ও গায়কী এতটাই উচ্চাঙ্গের হত যে এই তুলনাগুলি আসা অবশ্যম্ভাবী ছিল এবং শ্রোতাদেরও গান শোনার ও বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সেই পর্যায়ের আগ্রহ ও জ্ঞান ছিল। আবার এক-এক সময় এমনও দেখা গেছে যে তারকা শিল্পীদের তুলনায় কম খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পীর গান সবাইকে টেক্কা দিয়েছে। কয়েকজন সুরকার আবার এই শারদ অর্ঘ্যের গানকে তাঁদের পরীক্ষা নিরীক্ষার ক্ষেত্র করে নিতেন। তাঁদের সুর করা গানের জনপ্রিয়তা অনুযায়ী পরবর্তীতে সেই গানের সুর হিন্দি বা অন্যান্য ভাষার ছায়াছবিতে ব্যবহার করতেন।

শিল্পী নির্বিশেষে গানের চাহিদা অনুযায়ী বেতারে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সেই গান সম্প্রচারিত হত। গানের জনপ্রিয়তার উপর রেকর্ড বিক্রিও নির্ভর করত এবং এর জন্য শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার রয়্যালটি পেতেন। কোনো শিল্পীর গান পর পর কয়েক বছর ব্যাবসা করতে অসমর্থ হলে তাঁকে পরবর্তীতে রেকর্ড করার সুযোগ দেওয়া হত না, এমন উদাহরণও আছে। তেমনই একটা ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি।

১৯৭২ সাল। সেই বছর এইচএমভি-র পুজোর গানের তালিকায় নির্মলা মিশ্রের নাম নেই। এই কথা জানতে পেরে নির্মলা মিশ্র তাঁর সংগীত জীবনের দিশারী নচিকেতা ঘোষের কাছে যান এবং অনুরোধ করেন তাঁর গান প্রকাশের ব্যাপারে সুরাহা করার জন্য। কিন্তু সেই মুহূর্তে নচিকেতাবাবু অন্য কয়েকজন শিল্পীর পুজোর গান ও ‘স্ত্রী’ ছায়াছবির সুরারোপের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি নির্মলা মিশ্রকে তাঁর অপারগতার কথা জানিয়ে দেন এবং বলেন পরবর্তী সময়ে পুজোর গানের ব্যাপারে তিনি নিশ্চয় সাহায্য করবেন। এর পরের ঘটনা খুব নাটকীয়। একদিন নচিকেতা ঘোষ বাজারে গিয়েছিলেন। কিন্তু বাজার না করেই বাড়ি ফিরে আসেন। ছেলে সুপর্ণকান্তি ভেবেছিল বাবা বোধহয় কিছু ভুলে গেছেন। কিন্তু সুপর্ণকান্তিকে অবাক করে দিয়ে গানের ঘরে চলে যান এবং ছেলেকে বলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে আসার জন্য ফোন করতে। পুলকবাবু চলে আসেন এবং গান তৈরি হয়। অবশেষে নির্মলা মিশ্রের ডাক পরে। শিল্পীকে দিয়ে গান তুলিয়ে সেই গানের রেকর্ডিংও করা হয়। রেকর্ডিং শেষে নচিকেতা ঘোষ নির্মলা মিশ্রকে বলেন এই বছর অন্য কারও নয় তাঁর গাওয়া গান লোকের মুখে মুখে ফিরবে এবং এইচএমভি ভবিষ্যতে আর কখনো তাঁকে বাদ দেবে না। সুরকারের ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক প্রমাণ করে সেই বছর নির্মলা মিশ্রের গান বেস্টসেলারের তকমা পায় এবং জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছোয়। এত বছর পরেও সেই গান এখনো বাংলা গানের শ্রোতার হৃদয়ে আলোড়ন তোলে। সেই ঐতিহাসিক গানটি হল— “এমন একটি ঝিনুক খুঁজে পেলাম না যাতে মুক্তো আছে”।

এর পর আরও একটা ঘটনা জানাব যেটা থেকে বোঝা যায় শিল্পী নিজেও একটা ভালো গান গাইবার জন্য কতটা দায়বদ্ধ থাকতেন। এক্ষেত্রেও শিল্পী সেই নির্মলা মিশ্র। আকাশবাণী কলকাতার বেসিক বাংলা আধুনিক গানের একটা বিশেষ অনুষ্ঠান ছিল— ‘এ মাসের গান’ এবং গানটি সেই মাসের চারটি বা পাঁচটি রবিবার প্রচারিত হত। প্রতি মাসে নির্দিষ্ট একজন শিল্পীর গাওয়া একটি গানই ওই অনুষ্ঠানে শোনা যেত। তেমনই কোনো এক মাসে প্রবীর মজুমদারের কথায় ও সুরে পূরবী দত্ত একটি গান গেয়েছিলেন। সেই গানটি শোনার পরে নির্মলা মিশ্র প্রবীর মজুমদারের বাড়ি চলে যান এবং ওঁকে অনুরোধ করেন সেই গানটি দেবার জন্য। কারণ, তিনি সেই গানটি পুজোর সময় রেকর্ড করতে চান। তখন প্রবীরবাবু বলেন যে গানটি যেহেতু বেতারে প্রচারিত হয়ে গেছে তাই এ-গানের বদলে অন্য কোনো গান রেকর্ড করতে এবং প্রবীরবাবুই সেই নতুন গান ওঁর জন্য কম্পোজ করে দেবেন। কিন্তু নির্মলা মিশ্র জেদ ধরেন, এই গানটিই তাঁর চাই এবং শেষে শিল্পীর জেদ জয়ী হয়। সেই বছর পুজোর অনেকের গানের মাঝে সেই গানটি অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল এবং এখনও সেই গান মানুষের হৃদয়ে রয়ে গিয়েছে। গানটি হল—
“ও তোতা পাখি রে
শেকল খুলে উড়িয়ে দেবো
মা’কে যদি এনে দাও।”

আরও কয়েকটা ঘটনার কথা বলছি। প্রখ্যাত সুরকার সুধীন দাশগুপ্ত মহাশয়ের বাড়িতে পুজোর গান নিয়ে ডাক পড়েছে তাঁরই প্রিয় ছাত্রী বনশ্রী সেনগুপ্তর।

বনশ্রী সেনগুপ্ত যথা সময়েই উপস্থিত হয়েছেন। সুধীনবাবু গান গেয়ে শোনানোর পরে লক্ষ করলেন বনশ্রী সেনগুপ্ত চুপ করে আছেন, কিছু বলছেন না। তিনি একটু অবাকই হলেন। প্রিয় ছাত্রীর কাছে জানতে চাইলেন গানটি কি তার পছন্দ হয়নি? ছাত্রী তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলেন যে গানটি খুবই ভালো। কিন্তু এর পরে যা বললেন সেটা শোনার জন্য সুধীনবাবু মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। বনশ্রী সেনগুপ্ত বলেছিলেন যে এই গানটি গাইলে অবশ্যই সুপার ডুপার হিট হবে এবং তিনি যে-অনুষ্ঠানে গাইতে যাবেন সেখানে সবাই এই গান শোনার অনুরোধ করবেন। এই গানটি গাইতে গেলে অনেক সহযোগী যন্ত্রশিল্পীর প্রয়োজন। কিন্তু ওনাকে অনুষ্ঠানের আয়োজক সংস্থা ততটাও টাকা দেন না। যার ফলে অনুষ্ঠানে অনেক যন্ত্রশিল্পীকে নিয়ে যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না। তাই তিনি এই গানটি রেকর্ড করবেন না।

পরবর্তী সময়ে এই গানটি রেকর্ড করেন শ্রীমতি আরতি মুখোপাধ্যায় এবং সত্যিই গানটি প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সেই গান এখনও বহু মানুষের কাছে খুব প্রিয়। গানটি হল—
“বন্য বন্য এ অরণ্য ভালো
অন্ধকারে সূর্য সোনা আলো।”

আর-একটি ঘটনা। যাকে কেন্দ্র করে একটা গান তৈরি হয়েছে ও পরবর্তীতে গানটি লোকের মুখে মুখে ফিরেছে। ঘটনাটি হল দুর্গাপুরে বনশ্রী এক অনুষ্ঠানে গাইতে যাবেন। দূরের পথ তাই সঙ্গে চলেছেন স্বামী শ্রী শান্তি সেনগুপ্ত। অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফিরলেন যখন তখন মাঝরাত্তির পেরিয়ে গেছে। ঘরে প্রবেশ করতে গিয়ে চাবির খোঁজ। বনশ্রীর ব্যাগ শান্তিবাবুর পকেট গাড়ির ভিতরে তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোথাও চাবির হদিস মিললো না। ওঁদের ঘরের দু সেট চাবি ছিল। একটা ওনাদের কাছে থাকতো, অন্যটি পরিচারিকার কাছে। এবং সে অনেকক্ষণ আগেই বাড়ি ফিরে গেছে। অগত্যা সেই মাঝরাত্তিরে তাঁরা গাড়িতেই বসে কাটিয়ে দিলেন। সকালে পরিচারিকা এল সাথে দু-সেট চাবির গোছা। সে বলল, তোমরা তো দরজায় চাবি ঝুলিয়ে চলে গিয়েছিলে। যাইহোক, সেদিন যখন বনশ্রী গান শিখতে গেলেন তাঁর সংগীত জীবনের গুরু ও মেন্টর সুধীন দাশগুপ্তর কাছে তখন তিনি হাসতে হাসতে এই ঘটনাটি তাঁর সংগীতগুরুকে জানালেন। এর পরে যা ঘটল সেটা হল একটা গান। সুধীনবাবুর কথা ও সুরে সেবার পুজোয় বনশ্রী সেনগুপ্ত গানটি গাইলেন এবং গানটি জনপ্রিয় হল।গানটি ছিল—
“ছি ছি ছি এ কী কান্ড করেছি
আমি সুখের ঘরের চাবিটাকে
হারিয়ে ফেলেছি।।”

আরও একটি ঘটনা বলছি। এইচএমভি স্টুডিয়োতে শ্রদ্ধেয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুরে বনশ্রী সেনগুপ্তর পুজোর গানের রেকর্ডিং চলছে। গানটি টেক হয়ে যাবার পরে বনশ্রী দেবীর মনে হল গানটি আরও একবার গাইলে মনে হয় আরও ভালো হবে। সে-কথা হেমন্তবাবুকে গিয়ে জানালেন। উত্তরে হেমন্তবাবু বলেছিলেন, হ্যাঁ, গানটি তুমি দুবার তিন বার গাইতেই পারো। সেইমতো গানটি আরও কয়েকবার গাইবার পরে বনশ্রী দেবী গানটি রেকর্ড করতে গিয়ে দেখেন স্বয়ং হেমন্তবাবু ফ্লোরে নেই। খোঁজ করে জানতে পারলেন হেমন্তবাবু গেটের দিকে রওনা দিয়েছেন। শুনেই বনশ্রী সেনগুপ্ত গেটের দিকে ছুটে গেলেন। হেমন্তবাবুকে গিয়ে বললেন, তিনি এবার গানটি রেকর্ড করার জন্য প্রস্তুত। উত্তরে হেমন্তবাবু জানালেন, আমি তো তোমাকে গানটা গাইতে বলেছি। কিন্তু রেকর্ডিং তো করব বলিনি। তোমার গাওয়া প্রথম টেকটাই আমার কাছে সেরা মনে হয়েছে। ওটাই থাকবে। গানটি হল—
”আর এক নতুন কোনো পৃথিবীর খোঁজে চলো যাই
তুমি আমি দুজনেই যাই।”

এই গানের ক্ষেত্রেও সুরকারের কথা মিলে গিয়েছিল মানুষের কাছে গানটির গ্রহণ যোগ্যতায়।

প্যারোডি গানের ক্ষেত্রে একটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয় ছিল। আগের বছরের সবচেয়ে জনপ্রিয় গানগুলি তার পরের বছর প্যারোডিতে রূপান্তরিত হত এবং সে-ক্ষেত্রে সুরই ছিল প্যারোডি গানটার সৃষ্টির উৎস। প্যারোডি গানের প্রতি ছত্রে এমন সব মজার কথা (নির্মল হাসি) থাকত যে তাতেই সবাই আকৃষ্ট হতেন। এবং এই গান জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে পাইওনিয়ার হলেন মিন্টু দাশগুপ্ত। তাঁর লেখা অজস্র গানের মধ্যে দুটো গানের উদাহরণ রাখলাম:

১. মূল গান— “আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা
আর কতকাল আমি রব দিশাহারা”
(শিল্পী ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়)

প্যারোডিতে এই গানটি হয়ে গেল—

“আমায় পাওনাদারে করে পথে তাড়া
তাই দেখে প্রাণপাখি হয় খাঁচাছাড়া”

২. অপরটি হল— “তোমার নীল দোপাটি চোখ
শ্বেত দোপাটি হাসি
আর খোঁপাটিতে লাল দোপাটি
দেখতে ভালোবাসি”
(শিল্পী ছিলেন মহঃ রফি)

প্যারোডি গান—
“তোমার ট‍্যারা ব‍্যাঁকাটি চোখ
দাঁতকপাটি হাসি
দেহ প‍্যাঁকাটি চলা ন‍্যাকা-টি
দেখতে ছুটে আসি”

কিন্তু এই গানভাসি দিনগুলিতে লাগল অশুভ শক্তির টান। আশির দশকের শেষভাগ থেকে পুজোর গানের জোয়ারে আসে ভাটার টান। হয়তো বেশ কয়েকজন গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীর মৃত্যু এর একটা প্রধান কারণ। বিক্ষিপ্তভাবে কয়েকবার সুমন, নচিকেতা, শ্রীকান্ত, ইন্দ্রনীল, রূপঙ্কর, রাঘব, অঞ্জন, শিলাজিৎ, লোপামুদ্রা বা শুভমিতার গান জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। মানুষের মনে তাঁদের গাওয়া নতুন গান জায়গা করে নিয়েছিল। কিন্তু গানের ভালো বাণী ও সুরের বৈচিত্রের অভাবে তাঁদের থেকেও সেই মন ছুঁয়ে যাওয়া গান মানুষ পেলেন না। অন্য কয়েকজন শিল্পী পুরোনো কিছু গানকে রিমেক করে গেয়েছিলেন কিন্তু পরবর্তীতে এই প্রচেষ্টা বন্ধ হয়ে যায় কপিরাইটের ঝামেলায়। সেই আশির দশক থেকে আরও বেয়াল্লিশটা বছর কেটে গেছে। কিন্তু মনে রাখার মতো বেয়াল্লিশটা গান সৃষ্টি হয়েছে কি? এখনও যে-কোনো রিয়েলিটি শো-তে ছেলেমেয়েরা ষাট থেকে আশির দশকের অধিকাংশ গান গাইছেন। এই প্রসঙ্গে একটা কথা ভাববার যে গান বিষয়বৈচিত্র‍্যে ও সুরের মাধুর্যে এত সম্পন্ন, সেই গানের এমন হাল ভাঙা পাল ছেঁড়া অবস্থা কেন?

এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমার কিছু নিজস্ব ভাবনা এখানে আমি তুলে ধরছি।

১. গানের প্রধান শর্ত অর্থাৎ মেলোডিকে অস্বীকার করে বর্তমান প্রজন্মের মানুষ শুধুই গতিময়তাকে (রিদম) প্রাধান্য দিচ্ছে। গানের সুর ছাপিয়ে তালবাদ্য ও যন্ত্রের ঝংকার তাঁদের পছন্দে সর্বাধিকার পাচ্ছে।

২. হালে সৃষ্টি করা অধিকাংশ গানই অনেকটা কবিতার মতো লেখা। লেখার গুণে উত্তীর্ণ হলেও তাকে গানের মতো শোনাচ্ছে না। গানের লিরিক্স ও কবিতার মধ্যে একটা ফারাক রয়েছে। গানের কথা কেমন হওয়া উচিত এটা সর্বপ্রথম উপলব্ধি করার প্রয়োজন আছে। এই কারণে সব লেখাতে উপযুক্ত সুর বসানো সম্ভব হয় না এবং অচিরেই সেইসব গান হারিয়ে যায়। একমাত্র কথা ও সুরের সঠিক মেলবন্ধনে একটা গান সৃষ্টি হয়।

৩. একটা সিডিতে একজন শিল্পী ৭/৮ টা গান করার বদলে যদি তাঁদের গানের সংখ্যা কমিয়ে আনেন বা একই সিডিতে অন্য কোনো শিল্পীর গান অন্তর্ভুক্ত করা হয় তবে সেটা কিছুটা হলেও বৈচিত্র্যময় হবে। সংখ্যায় কম হওয়ায় গানের গুণগত মান বজায় থাকবে এবং দুই বা ততোধিক শিল্পীর গান একই সিডিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ব্যানিজ্যিক সাফল্য পাবারও সম্ভাবনা রয়ে যায়।

৪. কপিরাইট আইনে ফাঁকফোকর থাকার ফলে গানের পাইরেসি বেড়ে গেছে এবং নকল সিডি ক্যাসেট সস্তায় বিক্রি হওয়ায় গানের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা রয়্যালটি থেকে ও কোম্পানি তার ন্যায্য লাভ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অচিরেই এই আইনের রদবদল করা দরকার। জালচক্রের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন আছে।

৫. যোগ্য গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীর অভাব আরও একটা কারণ।

৬. ব্যক্তিগতভাবে শিল্পীরা তাঁদের ইউটিউব চ্যানেল সৃষ্টি করে তাতে নিজেদের গান প্রচার করা বা ফেসবুকে নিজেদের গান পোস্ট করা ইত্যাদি হয়তো তাঁদের গানের বাণিজ্যিক চাহিদা কমার আরও একটি কারণ।

৭. গান নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলতেই পারে এবং সেটা হবার প্রয়োজন রয়েছে। তবে সহজ সরল সুরের গানের প্রতি মানুষের সবসময় একটা আকর্ষণ ছিল এবং এখনো আছে। দেখা গেছে সেইসব গানই জনপ্রিয় হয় যে-গানের সঙ্গে শ্রোতা তাঁর কণ্ঠ মেলাতে পারেন। অবসর সময়ে দু-কলি গুনগুন করে গাইতে পারেন। সেই গান ভারতীয় বা পাশ্চাত্য যে রীতি মেনেই সৃষ্টি হোক না কেন সুর হৃদয়গ্রাহী হওয়াটাই আসল অর্থাৎ মেলোডির কোনো বিকল্প নেই, হবেও না।

পরিশেষে বলতে চাই যে-কোনো শিল্প বেঁচে থাকে তার গুণমানের উপর এবং এর সঙ্গে বাণিজ্যিক সাফল্য তার আয়ুবৃদ্ধি ঘটায়। যদি এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত যোগ্য ব্যক্তিত্বরা ও ইচ্ছুক কোম্পানির কর্ণধারেরা একজোট হয়ে সেই হারানো গানের মর্যাদা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে উদ্যোগী হন তবে মনে হয় বাংলা গানের জগতে সেই সুদিন ফিরে আসতে পারে। নতুন সৃষ্টি করা গান হয়তো সুররসিক মানুষের মনে ফেলে আসা দিনের গানের শূন্যস্থান পূর্ণ করতে সক্ষম হবে। নচেৎ আগামী প্রজন্মের কাছে বাংলা গান একটা লুপ্তপ্রায় শিল্প বলে পরিগণিত হবে।।

Facebook Comments

পছন্দের বই