লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গদ্য

শতানীক রায়

দিনযাপন

দিন অতিক্রম করার মধ্যে সময়ের ধীর হয়ে যাওয়াও লুকিয়ে থাকে। যেভাবে পা ফেলি আর পা মিলিয়ে যায়। যাত্রাপথ সন্ধ্যাভিমুখী। সব ধ্বংস বিধ্বস্ত করে যেভাবে জীবন নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে নেয়। অনেক অভ্যাস, নিবিড়তার অকালপ্রয়াণ ঘটে। আমরা কেউই ঘাড় উঁচু করে তার মীমাংসা করতে পারি না। অথচ এসবই দৃঢ়তার দাবি রাখে। আদৌ রাখে কি?! এমন কিছু প্রশ্নের উত্থান আর জ্বরঘোর থেকে শুরু হওয়া বোধের টানা গতি। কোন দিকে যায়। মানুষ যেদিকে নিজস্ব অভিমুখ বেছে নেয়। নরম শরীর শায়িত আছে (যেন)। এমন ভাবতে গিয়ে দেখা যায় শূন্যতা বিষয়ক অনেক দর্শন অথবা দর্শনের মৃত্যু ঘটতে শুরু করে। এখান থেকেই নতুন পথ এবং তার অন্যরকম যাত্রা।

চিহ্নে রূপায়িত হওয়া মানুষের গতিপ্রকৃতি তখন বুঝতে পারি না। আক্রান্ত হওয়া কাকে বলে, এমন সবের মধ্যেও মাত্রাতিরিক্ত ধ্বংস আত্মগোপন করে থাকে। কেউ কখনো তার শুরু নির্ধারিত করে দেয়। যেন এই পথেই পৃথিবী সবচেয়ে সুন্দর। সবচেয়ে মধুর অথচ এখানে কোনো কিছুই স্বাভাবিক নয়। সবই তাই স্বভাবসিদ্ধ। ‘স্বভাব’ আর ‘সিদ্ধ’ এই দুটো শব্দ একসঙ্গে জুড়ে দেওয়া যায়। এরকম কোনো শব্দের অভিঘাত মানুষকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে যায়। যেন ব্রহ্মাণ্ডের কোথাও বিচরণশীল মানুষেরা ক্কচিৎ কোনো কল্পে বিচরণ করতে করতে দেখা হয়ে যায় সেই আকাঙ্ক্ষিত মানুষের সঙ্গে। যার আকাঙ্ক্ষার মধ্যে নিহিত অনাকাঙ্ক্ষা।

সময়ের স্থিতাবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অর্থহীনতা। মানুষের জীবনে সবরকম ঘটনার সঙ্গে এও বিরাজ করে। আস্তেধীরে সহজ জটিলে মিশে থাকা অর্থহীন স্রোত। মাঝেমধ্যে একটা নদী টের পাই। নদীর চিহ্ন এই পথে-প্রান্তরে জুড়ে আছে। বিকেল শেষ হচ্ছে আর সন্ধ্যায় শুরু। নদীর অদৃশ্য উপস্থিতি। বা আমার অদৃশ্য উপস্থিতি নদীর অস্তিত্বকে স্পষ্ট করছে। এমনও হতে পারে কিছুক্ষণ পরে পূর্ণ চাঁদ দেখা দেবে আকাশে। আমার আর নদীর মাঝের পথটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমার চোখ অনেক অনেক বছরের সূর্যতেজ নিয়ে আছে। এই অপেক্ষারত সূর্যপ্রতিমা কাঙ্ক্ষিত চাঁদের জ্যোৎস্নাকে গিলে ফেলতে চায়। এতদিন হয়তো নদীটা পরিষ্কার ছিল না। এভাবে নদীর চারপাশের ভুবন মাটি গাছপালা সব নদীপথকে আড়াল করতে চাইছে। সূর্য আর চন্দ্রের এই খেলাকে সম্পূর্ণ অর্থহীন প্রমাণ করে দিয়ে সব যেন স্থির। মানুষ এভাবে আয়ুবর্ধক। বৃদ্ধি হতে থাকে জীবনের। মৃত্যু তবেই-না ম্লান। কিছুক্ষণ পরে রাতের নদীপথ আবছায়া হয়ে হারাচ্ছে। এক অরূপের খেলা নিয়ে দাঁড়িয়ে মানুষ। আমাকে এসব বুঝে নিতে হয়। অনুভূতির স্রোত যেন স্বাভাবিক না হয়। আমার কাছে এ-পথ মৃত্যুর দিকে নয় অমরত্ব যেন অবতলে নির্ধারণ করে দিয়েছে কেউ। সহস্রপাঁপড়ির পদ্ম সেখানে বিচিত্র খেলা। আর সূর্য থাকতেও তার শোষণখেলা আপাতত রুদ্ধ। পথটা কুয়াশাচ্ছন্ন। আর এই দেহ অযথা চাঁদের দিকে উঁচু হয়ে থাকে। অর্থহীন।

অনুভূতির স্ফূরণ কখনো কখনো একটা আমেজ সৃষ্টি করে। যেখান থেকে শুরু হয় একটানা দৌড়। নানারকম চিন্তা এসে বাসা বাঁধে। আসলে স্রোতটা চিরকালই অর্থহীন। এই অর্থহীনতাকে প্রমাণ করার চেষ্টা থাকে শরীর ও মনের। নিজেরই অদম্যতায় নিজেকেই ছুঁয়ে দ্যাখা। আর একবার ছুঁয়ে ফেললে আবার পূর্ব মুহূর্তের মতো আবেগ শীর্ষে উঠতে থাকে। মন্দিরচূড়ায় ওঠা যায় না কখনো। অথচ ভার বহন করে চলার মধ্যে কী যে সুখ আর তৃষ্ণা কাজ করতে থাকে জানি না। শরীর থেমে থেমে অনুভব করে এই চারপাশের ঘটমান বিষয়গুলিকে যেখান থেকে শুরু হয় পুনরায় ওই ‘স্রোত’ আর স্রোতের সঙ্গে ভেসে আসা অর্থহীনতার ধ্বনি। অন্তত ধ্বনিটুকু শোনা যায়। এর পরেও কিছু বাকি থেকে যায়। আমার সংগ্রহ করা অনেক মুহূর্ত যখন বাস্তবের স্বীকার এবং অস্বীকারের মাঝখানে থেকে সবকিছুকে মূল্যায়ন করতে থাকে। এসব মূল্যায়নে অর্থহীনতা শরীর এবং বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়। তারই একটা বিকল্প বাস্তব এখানে তুলে ধরছি যার স্বয়ং অস্তিত্বও আছে আমার এই অনুভূতিমালা ব্যতীত। আমারই কবিতায় বলব—

কার প্রতি তাক করে থাকো যাকে তুমি কালী বলে ভুল করো। জ্বলন্ত প্রতীক হিসেবে ভরসা করো কাকে— এখানে আমরা একত্রিত আছি আমাদের একটা করে কবিতা থাকা উচিত প্রতিটি অঙ্গের একক উৎসরেখা শব্দমায়া দানপ্রতিক্রিয়া সঙ্গে আরও একটা করে শরীরের কবিতা বীজাধার আর— কী হতে পারে পুরোনো দরজার পাশে গজিয়ে ওঠা লতাগুল্ম ব্যতীত

“যেহেতু তার মনেই পড়ে না সে কেমন ক’রে কথা কইতে শিখেছিল—তা তার মনেই পড়ে না—”… ভাবনাস্রোত শুরু হয় এখান থেকেই। যদিও এই চিন্তার বয়ান পিটার বিক্সেল-এর। তাঁর একটা গল্পের অংশ। আর সমগ্র গল্পটা এর সঙ্গে জুড়ে থেকেও আলগা। অন্য দিকে যায়। চলার ছন্দ একরকম। মনের ছন্দ একরকম। যেভাবে সূর্যের আলো কখনো মেঘাচ্ছন্ন হয়। ফুটে ওঠে শরীরে। সময় সময় বাক্যস্ফুরণ। চলনরীতি বদলে যায়। আমি এ-সময় আয়না দেখি। দেখার ভেতর থেমে থাকা। খুঁজে চলা অন্যের ছন্দ। চারপাশে সবাই বিচিত্র বেহুঁশ। চলতে চলতে ঘোড়ার আড়াই চাল। তারপর আবার একইরকম। আয়নার ভেতর শুধুমাত্র আমার প্রতিচ্ছবি আছে এমনটা নয়। অনেক কিছু ধরা পড়ে। এঁটে যায়।

জগৎটা যে কীসের টের পাই না। আশ্চর্য অন্ধকারে আচ্ছন্ন… আমি ক্রমাগত টের পাই ওসিপ মান্দেলস্তামের একটি কবিতায় যেমন একজন মানুষ পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে যাচ্ছে আর তাকে কবিই প্রশ্ন করছেন, তাকে কেউ আহ্বান জানিয়ে এই পথ চিনিয়ে নিয়ে যাবে না। পথটা ঢালু… পথটা ঢালু আর আমি নেমে যেতে থাকি। নেমেছি বা এখনও নামছি কিনা জানা নেই। কিছু দৃশ্য হারিয়ে যায়। থেমে যায়। আর উধাও হয়। তবুও রেশ থাকে। স্মৃতি এমন এক অস্ত্র যা একজন দক্ষ অস্ত্র বাহক কিংবা যোদ্ধাকেও এই অস্ত্র বিনা আঘাতেই ক্ষতবিক্ষত করতে পারে, তার গতিপথের কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। অথচ ক্রমাগত সে জীবনের দিকে যেতে থাকে। জীবনের টান। জীবনের গল্প। স্বয়ং জীবনকেই টেনে নিয়ে যায়। আর এরকম লম্বা ঝুলে থাকা জীবনে আমি ঝুলে থাকি। আমার শরীর তখন অদ্ভুত শরীর এক। শরীরকে ঘিরে জমে ওঠে।

ভেতরে। কোথাও। মানুষ। হওয়ার। প্রস্তাব। চলে। অনেকেই হয়তো জীবনানন্দের কবিতা পড়েছেন। তবুও। আমি পড়ি নিজের মতো। আমার ভেতর কত কী যে বাসা বেঁধে আছে। কোনো এক সন্ধ্যায়। কোনো এক রাতে অন্ধকারে। যেমন অন্ধকার কখনো কখনো হয়। এ-সময় মানুষ মানুষের শরীরের দিকে দেখে ডুব দেয়। ডুব দেয় অন্ধকারে। আর বিশ্রামের প্রস্তাবে শরীরের দিকে চোখ যায়। মন থেকে বিচ্ছিন্ন হয় অন্ধকার। পুনরায় মন অন্ধকারের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। এই ছবি এমনই। এখানে মেঘ আছে অথচ বৃষ্টি নেই। নির্ভুল সুন্দর। আর ‘মহাপৃথিবী’র একটা কবিতা আমার কোথায় কোথায় ‘নিরালোক’ সৃষ্টি করে জানতে পারি না। এমনও হতে পারে আমার জানার ভেতর স্মৃতির শরীর অযথা লম্বা হয়, ছোটো হয়। কুঁজো হয়। বেঁটে হয়। অষ্টাবক্র ধারণা পোষণ করে। গেঁথে বসে জীবনে। আলোতে। আঁধারে। জলে। অন্তরীক্ষে।

Facebook Comments

পছন্দের বই