লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কবিতা

শিবু মণ্ডল

হর-কি-পৌরি


হর-কি-পৌরি এলে সবাই হাসিখুশি থাকে। মানুষ মানুষকে দেখে। দেখে অন্যভাবে। নিজের কথা ভাবে কি না বোঝা যায় না। আমি অনেকবার এসেছি। যখনই আসি আমিও মানুষ দেখি। গঙ্গার স্রোতের মতোই আসছে আর যাচ্ছে। এক অনিঃশেষ প্রবাহ। নারীপুরুষ বালক বালিকা সকলেই ঝাঁপিয়ে চান করে। নারীরা স্নানের পর ঘাটেই কাপড় বদলায়। কেউ কেউ আড়ালে কেউ আবার প্রকাশ্যেই। তবে আমি পুরুষদের দেখি অন্য সময় রাস্তাঘাটে মহিলাদের দিকে যে-রূপ লোলুপ দৃষ্টিতে তাকায় তেমনভাবে এখানে দেখে না। তারাও শুধু জাঙিয়া পরে স্নান করে। যে যার খুশিতে বরফগলা জলে ডুব দেয় আর আনন্দে কাঁপে।


ঘাটে একটু দূর দূর লম্বা শেকল বাঁধা থাকে। পুন্যার্থীরা সূর্যকে নমস্কার করে দু-চার ডুব দেয়। কেউ কেউ সাঁতার কাটে। সাঁতার কাটলেও গঙ্গার প্রবাহের সাথে তারা অনিশ্চিত ভেসে যেতে পারে। কিন্তু কেউই যায় না। সেই শেকলটি ধরে থাকে ভয়ে। আর এমনভাবে শরীর উলটেপালটে চান করে দেখে মনে হয় নিজের সাথেই নিজে দু-টি কুমীরের মতো খেলে যাচ্ছে।


সন্ধ্যা ছ-টা বাজলেই মাইকে বেজে ওঠে অনুরাধা পড়োয়ালের কণ্ঠে— ওঁ জয় গঙ্গে মাতা…! চোদ্দো বছর হয়ে গেল আমি হরিদ্বারে আছি। তখন থেকেই দেখছি সেই একই গান বেজে আসছে। এই গানটির চেয়ে অন্য কোনো গঙ্গাস্তুতি বা তাকে নিয়ে গান হতে পারে তা আমি কল্পনাও করতে পারি না। গঙ্গা আরতির সময় যখন এই গানটি বেজে ওঠে তখন আমার শরীর জুড়ে এক শিহরণ জাগে— এ এক ভালোলাগারও অধিক কিছু। এক অতিপ্রাকৃতিক ভাবও বলা যেতে পারে। তখন আমি যেন সামনে বয়ে যাওয়া নদীটির জল হয়ে যাই। অথবা নদীর তরঙ্গে কাঁপতে থাকা আলো!


গঙ্গা আরতি শেষ হয়ে যাবার পরও আমি গঙ্গার পাড়েই বসে থাকি। আমার চারপাশ পুরুষের অন্তর্বাস থেকে ঝরে পড়া গঙ্গাজলে, মহিলার পোশাক ও চুল থেকে ঝরে পড়া গঙ্গাজলে থৈ থৈ দশা। ছোট্ট একটি ছেলে কিংবা মেয়ে তিলক ও শৃঙ্গারের বাটি এনে সামনে দাঁড়াবে। আমার হাসিমুখ দেখে কী বুঝবে জানি না। সে আমার কপালে তিলক ও শৃঙ্গার কেটে দিয়ে পয়সা চাইবে। অন্য সময় কেউ এভাবে পয়সা চাইলে ধমকে দিই। কিন্তু এখন আমি দশ টাকাও স্মিত মুখে দিয়ে দিই। তারপরেই আসবে একটি পুরুষ কিংবা মহিলা প্রদীপের থালা হাতে। আমি তাকেও ফিরাই না খালি হাতে।


দু-টি কিশোরী এলোচুলে বসে আছে সিঁড়ির ধাপে। তাদের ধবধবে ফর্সা পা জোড়াদু-টি গঙ্গার নীল জলে ডুবে আছে। সেলফি তুলছে তারা। সামনে দিয়ে বয়ে গেল গোলাপের পাপড়ি বোঝাই একটি পলাশ পাতা দিয়ে বানানো ডোঙা। তাতে জ্বলে আছে কর্পূর দিয়ে বানানো ক্ষণায়ু প্রদীপখানি। একটি মাঝবয়সি লোক ভিডিয়ো কলিং করে দেখাচ্ছে তার দূরদেশি আত্মীয়াকে! বয়ে যাওয়া আলো, গন্ধ ও জল দেখিয়ে প্রলুব্ধ করছে সেই দূরদেশবাসিনীকে। আমন্ত্রণ করছে তাকে ঈশ্বরের এই আপন দেশে!

 

Facebook Comments

পছন্দের বই