লেখক নয় , লেখাই মূলধন

ধারাবাহিক।পর্ব৫

সোমা মুখোপাধ্যায়

প্রতিমা শিল্পী চায়না পাল

কলকাতার কুমোরটুলি অঞ্চল মহানগরীর ঐতিহ্য। একসময় গঙ্গার ধার ঘেঁষা এই অঞ্চলে মৃৎশিল্পের বসবাস শুরু হয়েছিল। গ্ৰাম থেকে রুজির টানে তাঁরা এসেছিলেন এখানে। হয়ে গেলেন ধীরে ধীরে এখানকার বাসিন্দা। আকাশ না দেখা অপরিসর অলিগলির মধ্যে ঘিঞ্জি পরিবেশে থাকা অসংখ্য মৃৎশিল্পী পরিবার হাজারও অসুবিধা সত্ত্বেও সারা বছর ধরে নির্মাণ করেন দেবদেবী-সহ আরও নানা রকম শিল্পকর্ম। পুরুষদের পাশাপাশি এখানে রয়েছেন মহিলা শিল্পীরাও। এমন এক প্রথিতযশা অথচ সম্পূর্ণ অন্যরকম শিল্পী চায়না পাল।

আশির দশকের একেবারে গোড়ার দিকে কুমোরটুলিতে গিয়েছিলাম মহিলা মৃৎশিল্পীদের প্রতিমা নির্মাণের কিছু ছবি তুলতে। ঠিক পুজোর আগেই ছিল সেই সময়। একটি পত্রিকার জন্য প্রবন্ধ-সহ ওই ছবিটি জমা দেওয়া হয় কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেটি অন্যের নামে প্রকাশিত হয়েছিল।

এরপর অনেক বছর কেটে গেছে। প্রায় তিরিশ বছর পরে আবারও একদিন অন্য একটি কাজের সূত্রে কুমোরটুলিতে গিয়েছিলাম সেই মহিলা শিল্পীদেরই সন্ধানে‌। সেখানে গিয়ে দেখা পেয়েছিলাম চায়না পালের। আমার সেই পুরোনো স্মৃতি থেকে তার বহু আগের চেহারার মিল পেয়ে একটু অন্যভাবেই কথা শুরু করি। যে-সময় আমি প্রথম চায়নাকে দেখি তার বাবা হেমন্ত পালের স্টুডিয়োতে কাজে সহায়তা করতে তখন তার খুবই অল্প বয়স। আমার পুরোনো স্মৃতির সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছিলাম সেই চায়না পালের।

সময়ের জল অনেকদূর গড়িয়ে গিয়েছিল। ছোটো থেকেই চায়নার শিল্প কাজের প্রতি অসম্ভব আগ্রহ ছিল। আর এমনটা হওয়ারই কথা। কেন-না মৃৎশিল্পী পরিবারে জন্মগ্রহণ। তাই মাটির প্রতি টান তো থাকবেই। তাছাড়া সেলাই করতেও চায়না একেবারে সিদ্ধহস্ত ছিল। নিয়ম করে সেলাই স্কুলে সেলাইটাও শিখেছিলেন। সেখানেও নিজের পারদর্শীতা প্রমাণ করেছেন তিনি।

চায়নার প্রতিমা তৈরির গল্পটা অবশ্য একটু অন্যরকম ছিল। বাবাকে ছোটোখাটো কাজে সহায়তা করতেন চায়না। আর পাঁচটা কুমোর পরিবারের মেয়েদের মতোই। চায়না নিজেও জানতেন না একদিন এই পৈতৃক ব্যাবসার দায়ভার তাঁর ওপরেই এসে পড়বে। এক আকস্মিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়েই চায়নাকে ঠাকুর গড়ার কাজ নিজের কাঁধে তুলে নিতে হয়।

এক বিশ্বকর্মা পুজোর দিনে আচমকা ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন বাবা। সে-সময় সমস্ত অর্ডারি ঠাকুরে‌ তাদের স্টুডিয়ো ভরতি ছিল। সেই পরিস্থিতিতে একটু বিচলিত না হয়ে পুরোনো কারিগরদের সঙ্গে নিয়ে চায়না শুরু করেছিল ঠাকুর গড়ার কাজ। বাবার অসমাপ্ত কাজের সুন্দরভাবেই সমাপ্ত করেছিলেন তিনি। না, আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। সুন্দর একচালার বাংলা প্রতিমা চায়নাকে নিয়ে গেছে অনেকদূর।

চায়নাদের পরিবারে তার অনেকজন ভাই-বোন আছে। কিন্তু সেদিন বাবারে পৈতৃক ব্যাবসাটি একমাত্র চায়নাই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। সেদিন এই কাজে আর কেউই এগিয়ে আসেনি। চায়নার কাছে শিল্পই ধ্যান জ্ঞান। তাই সংসার জীবনে না জড়িয়ে এই ঠাকুর গড়ার কাজেই চায়না ব্যস্ত থাকেন সারাটা বছর। শুধু দুর্গাপ্রতিমা নয় লক্ষ্মী-সরস্বতী, কালী অন্নপূর্ণা থেকে আরও নানা ঠাকুর চায়না তৈরি করেন। মাটি, খর, রং, কারিগর আর মাকে নিয়ে চায়নার এক অন্যরকম সংসার। স্টুডিয়োর পেছনেই তার সামান্য আস্তানা।

চায়নার কাছ থেকে শুনেছিলাম ঠাকুরের দু-রকম মুখ হয়। বাংলা মুখ আর সাবেকি। চায়না দ্বিতীয়টাই বেশি করে থাকেন। হলুদ রঙের টানা চোখের ঐ প্রতিমাই বাংলার দুর্গার মূল রূপ। একসময়ে একচালির দুর্গা ঠাকুরের বদলে কুমোরটুলির প্রখ্যাত শিল্পী গোপেশ্বর পাল প্রতিটি ঠাকুরকে পৃথকভাবে তৈরি করা শুরু করেন। একচালার বদলে পাঁচটি পৃথক চালায় গড়লেন দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ আর কার্তিক‌। কিন্তু চায়না মনে করেন ওই এক চালাতেই বাঙালির দুর্গার আসল পরিচয়। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে টুকরো হওয়া চায়নার পছন্দ নয়। তিনি মনে করেন দুর্গার পরিবার-সহ এই একত্রে থাকাই যেন বাঙালির একান্নবর্তী সংসারের একটি প্রতীক।

সাবেকি দুর্গার নানা রূপকেই চায়না তুলে ধরেন। একসময় গড়েছেন শিবের কোলে বসা দুর্গা। এছাড়া কলকাতার এক প্রখ্যাত ক্লাবের পুজোর রামচন্দ্রের অকাল বোধনের প্রতিমাও একসময় তিনিই করতেন। বর্তমানে অবশ্য করেন না। এর মধ্যেই বছর তিন চার আগে রূপান্তরকামীদের পুজোয় দর্জিপাড়ায় অর্ধনারীশরীর মূর্তি তৈরি করে নজর কাড়েন সবার। একই অঙ্গে দু-টি রূপের এমন মেলবন্ধন পুজোর সময় আগে কখনো দেখেনি এই মহানগরী। আধুনিকতার সঙ্গে ঐতিহ্যের মেলবন্ধন আরও‌ একবার তাকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসে।

দোহারা চেহারার চায়না পাল সদা হাস্যমুখী। শিল্প নিয়ে আলোচনা শুনলেই তিনি মশগুল হয়ে ওঠেন। এই কারণে প্রখ্যাত শিল্পী প্রবীর গুপ্ত, ভবতোষ‌ সূতারদের সঙ্গে গুরুসদয় সংগ্ৰহশালায় চায়নার প্রতিমাও স্থান পায়। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিশ্ববাংলা স্টোরে চায়নার তৈরি ডাকের সাজের দুর্গার মুখ বিক্রি হয়েছে। অপূর্ব এই ঐতিহ্যমণ্ডিত শিল্প দেশি বিদেশি বহু মানুষের আকর্ষণের বস্তু হয়েছে।

চায়নার এই শিল্পকলা তাকে নানা পুরস্কারে ভূষিত করেছে। এর সঙ্গে চায়না পাড়ি দিয়েছে সুদূর চীন দেশে। আমি জানি না চায়না ওর নিজের নামের অর্থ জানে কিনা। একসময় কন্যাসন্তান বিমুখ অনেকেই নিজের কন্যা হবার পর হেলায় বলতেন আর কন্যা চাই না। সেই নামটি হয়ে দাঁড়ায় চায়না। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার এই চায়না তার কর্মের জোরেই পাড়ি দিল চায়না, অর্থাৎ, চীন। এমন নারী ক্ষমতায়নের নজির খুব কম আছে।

আজ নারী পুরুষের রেষারেষি শিল্পীদের মধ্যে হয়তো‌ কিছুটা কমেছে। কুমোর পরিবারে পুতুল গড়া, মাটি ছানা, টুকটাক মূর্তি গড়ায় পরিবারের পুরুষ শিল্পীকে সহায়তা করা এমনসব কাজেই বাড়ির মেয়েরা করতেন। কিন্তু পূর্নাঙ্গ দুর্গা বা কালীর মূর্তি গড়া ছিল স্বপ্নের মতো। চায়না সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন করলেন।

একটা মস্ত কাজে অনেক মানুষের সহায়তা লাগে। ঠাকুর গড়াও তেমন। আমি দেখেছি চায়নাকে মূর্তি গড়তে মাটি মেখে। ছাঁচ থেকে দেবীমুখ বানাতে। অথচ নিয়ম কুমোর বাড়ির মেয়েরা চাকে হাত দেবেন না। চায়নার সঙ্গে চাকের যোগ নেই। খড়ের কাঠামোতে মাটি লাগিয়ে স্বপ্ন বোনে চায়না। এর সঙ্গে বৃদ্ধা মায়ের দেখা শোনা থেকে বাজার রান্না সবটাই একা হাতে। ওকে দেখে মনে হয় যে রাঁধে সে চুল বাঁধে এ-প্রবাদের যেন সার্থক রূপায়ণ হয়েছে ওর মধ্যে।

চায়না জানান একসময় তাঁরা ঝুলনে পুতুল গড়তেন। তখন এত বিনোদন ছিল না। তাই ঝুলনের ক-দিন আগেই কুমোরটুলির প্রায় প্রতিটা ঘরেই এই পুতুল মিলত। বাড়ির মেয়েরাই ছিলেন বেশিরভাগ শাল্পী। এখনও এই কাজ তাঁকে টানে। তবে এখন অনেকটাই কমে গেছে ঝুলনের পুতুল। এর পাশাপাশি সুন্দর ছোটো একচালির দুর্গা বানানোর ইচ্ছে তাঁর। তবে প্রতিমা তৈরিতে সারাটা বছর এত ব্যস্ত থাকেন যে, এ-কাজের অবসর পান না। জগদ্ধাত্রী পুজোর পর কয়েক মাস একটু বিশ্রাম মেলে। তারপর আবার সরস্বতী গড়া শুরু।

এভাবেই দিনাতিপাত করেন আমাদের কুমোরটুলির সরস্বতী। এই কাজে অসম্ভব খুশি তিনি। তাঁর মতে সবকাজেই তো বাধা থাকে। তাকে অতিক্রম করতে হয়। তাঁর কাজের ক্ষেত্রেও তাই। ভালোবাসা দিয়ে যদি কিছু আঁকড়ে থাকা যায় তবে তার সাফল্য আসবেই।

Facebook Comments

পছন্দের বই