লেখক নয় , লেখাই মূলধন

ধারাবাহিক।পর্ব৬

সোমা মুখোপাধ্যায়

তাঁতশিল্পী আলপনা ভড়

সংস্কৃত তন্তু থেকে তাঁত শব্দের উৎপত্তি। বাংলার তাঁত এক ঐতিহ্যবাহী শিল্প। একসময় মানুষ গাছের ছাল বাকল দিয়ে পোশাকের প্রয়োজন মেটাত। ধীরে ধীরে কৃষিভিত্তিক সভ্যতার উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে স্থায়ী বসতি ও গড়ে ওঠে। মানুষ নিজের ব্যবহারের জন্য বোনা শুরু করে। পৃথিবীর নানা দেশে নানা ধরনের বোনার এই পদ্ধতি রয়েছে। এভাবে বাংলার তাঁতশিল্পের এক সুপ্রাচীন ইতিহাস আছে।

পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব জেলাতেই তাঁতের কাজ হয়। এর মধ্যে হুগলি জেলার ধনিয়াখালি, রাজবলহাট, বেগমপুর এইসব অঞ্চলে তাঁতের সুপ্রাচীন ইতিহাস আছে। এই লেখায় রাজবলহাটের এক তাঁতশিল্পী আলপনা ভড়ের সঙ্গে পরিচয় করাব।

বছর তিনেক আগে রাজবলহাটে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল আলপনা ভড়ের সঙ্গে। রাজবলহাটের প্রসিদ্ধি দেবী রাজবল্লভীর জন্য। সকালে পৌঁছে মন্দিরে ঘুরে প্রসাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলাম। এই সময় পরিচয় হয় আলপনা ভড়ের স্বামী রবিন ভড়ের সঙ্গে। আমার গবেষণা বিষয়ে শুনে তিনি ওঁর বাড়ি নিয়ে যান। মন্দির থেকে হাঁটাপথে মিনিট পাঁচেক। শুনেছিলাম রাজবল্লভীর মন্দির ঘিরে আছে তাঁতিপাড়া। ঠকঠকি তাঁতের শব্দে মুখরিত থাকে এ-অঞ্চল।

গ্ৰামের পাড়ার বিভিন্ন বাড়ির পাশ দিয়ে যেতে যেতে সেটাই নিজের কানে শুনছিলাম। আর ভাবছিলাম সেই প্রচলিত কথা ‘চরকার ঘর্ঘর পড়শির ঘর ঘর’। এখানে সব বাড়ির সামনে রয়েছে কাঠে জড়ানো রঙিন সুতো। রোদে শুকিয়ে নেবার জন্য। বোনার‌ নানা রঙে সুতোকে রং করে নেওয়া হয়। আগে এখানকার মাটির বাড়ির দেওয়ালগুলো কালো রং করা। যদিও এর ভেতর অনেক পাকা বাড়িও আছে। আর আছে অনেক টেরাকোটার বর্ষপ্রাচীন মন্দির।

রবিন ভড়ের বাড়িতে ঢুকেই সামনের ঘরে তাঁত বুনতে দেখা গেল আলপনা ভড়কে। নদিয়ার নবদ্বীপে মহিলাদের তাঁত চালানোয় নিষেধ আছে বলে শুনেছি। চাক্ষুস এভাবে তাঁতবোনা দেখার অভিজ্ঞতা এর আগে ছিল না। এখানে সকলের হাত চালানো তাঁতটাই বেশি। ওঁরা স্বামী স্ত্রী দু-জনে আমাকে পরিচিত করান তাঁত যন্ত্রটির সঙ্গে।

আমরা টানাপোড়েন শব্দটির সঙ্গে অনেকেই পরিচিত। এখানে এসে তার আসল অর্থটা জানলাম।

তাঁতের মধ্যে কুণ্ডলী আকারে সুতো টানটান করে ঢোকানো থাকে। এখানে দু-ভাবে সুতো থাকে। লম্বালম্বিভাবে থাকা সুতাগুলিকে টানা এবং আড়াআড়িভাবে থাকা সুতাগুলিকে পোড়েন বলা হয়। যখন তাঁত চালু করা হয় তখন নির্দিষ্ট সাজ অনুসারে সুতা টেনে বোনা হয়। তাঁত হচ্ছে কাঠের ফ্রেমের একটা যন্ত্র। তাঁতের আকার এবং এর ভেতরের কলা কৌশল বিভিন্ন রকমের হতে পারে।

“বাংলা তাঁতযন্ত্রে ঝোলানো হাতল টেনে সুতো জড়ানো মাকু (spindle) আড়াআড়ি ছোটানো হয়। মাকু ছাড়াও তাঁতযন্ত্রের অন্যান্য প্রধান অঙ্গগুলি হল— শানা, দক্তি ও নরাজ। শানার কাজ হল টানা সুতার খেইগুলিকে পরস্পর পাশাপাশি নিজ নিজ স্থানে রেখে টানাকে নির্দিষ্ট প্রস্থ বরাবর ছড়িয়ে রাখা। শানার সাহায্যেই কাপড় বোনার সময় প্রত্যেকটি পোড়েনকে ঘা দিয়ে পরপর বসানো হয়। শানাকে শক্ত করে রাখার কাঠামো হল দক্তি। একখানি ভারী ও সোজা চওড়া কাঠে নালী কেটে শানা বসানো হয় আর তার পাশ দিয়ে কাঠের উপর দিয়ে মাকু যাতায়াত করে। শানাটিকে ঠিক জায়গায় রাখার জন্য তার উপরে চাপা দেওয়ার জন্য যে নালা-কাটা কাঠ বসানো হয় তার নাম মুঠ-কাঠ। শানা ধরে রাখার এই দু-খানি কাঠ একটি কাঠামোতে আটকে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এই সমগ্র ব্যবস্থাযুক্ত যন্ত্রটির নাম দক্তি।

শানায় গাঁথা আবশ্যকমতো প্রস্থ অনুযায়ী টানাটিকে একটি গোলাকার কাঠের উপর জড়িয়ে রাখা হয়, একে বলে টানার নরাজ। আর তাঁতি যেখানে বসে তাঁত বোনে, সেখানে তার কোলেও একটি নরাজ থাকে— তার নাম কোল-নরাজ। টানার নরাজের কাজ হল টানার সুতাকে টেনে ধরে রাখা আর কোল-নরাজের কাজ হল কাপড় বোনার পর কাপড়কে গুটিয়ে রাখা।” (এই অংশটি উইকিপিডিয়া থেকে ব্যবহার করা হয়েছে)

এই সমগ্ৰ প্রক্রিয়াটি মূর্ত করে তুলেছিলেন আলপনা ভড়। আলপনা দেবীর বাবার বাড়ি রাজবলহাটেও। তাঁরাও তাঁতের কাজ করেন। কিন্তু আলপনা দেবী কখনো বিয়ের আগে তাঁত বুঝতেন না। বিয়ের পরেই এই কাজটা তিনি নিজের চেষ্টায় শেখেন। সাধারণত তাঁতি পরিবারের মেয়েরা চরকা দিয়ে সুতো কাটার কাজটাই করে থাকেন। তাঁত বোনার কাজ করেন খুব অল্প মেয়েরাই।

পাঠক ওপরে তাঁত বোনার বিষয়ে যে-লেখাটা রয়েছে তা পড়ে নিশ্চয় উপলব্ধি করবেন এই কাজটা অত্যন্ত জটিল। অনেকগুলো ধাপ আছে একটা শাড়ি বোনার। সেই কাজটিই নিজের আগ্ৰহে শিখেছেন আলপনা দেবী। আমরা নারী ক্ষমতায়ণ নিয়ে অনেক আলোচনা করি। কিন্তু একজন ক্ষমতাময়ী নারীকে নিজের সামনে দেখে সত্যি অন্যরকম অভিজ্ঞতা হয়। এই শিক্ষা তো আলপনা ভড়ের অর্জিত। কতটা আগ্ৰহ থাকলে একজন সংসারী মহিলা এটা রপ্ত করতে পারেন তা আর নতুন করে বলতে হয় না।

আলপনা দেবীদের দুই পুত্র। দু-জনেই অন্য পেশায় নিযুক্ত। এছাড়া পরিবারে আছেন রবিন ভড়ের মা ও বাবা। বাড়ির ভেতর আছে তাঁতের সুতো জড়ানোর ও সুতো কাটার যন্ত্র। আলপনা দেবীর বউমা এগুলোর কাজ কী করে করতে হয় তা দেখালেন। সঙ্গে ছিল চা জলখাবার-সহ উষ্ণ আপ্যায়ন।

রাজবলহাটের শাড়ি ও ধুতি ৮০/১০০ সুতোয় বোনা। একটু মোটা ধরনের হয় ফুলিয়া বা শান্তিপুরের তুলনায়। নকশার ক্ষেত্রেও সাবেকি নকশা অনুসরণ করা হয়। এই নকশা হল রঙ্গবতী, ডবিবুটি, দানিবুটি ইত্যাদি। সুতো মহাজনদের থেকে তাঁতিরা কেনেন। শাড়ি মোটামুটি ৪৫০ থেকে শুরু। নকশা অনুযায়ী দাম হয়। এই শাড়ি মহাজন বা হাটেই বেশি বিক্রি হয়। একটা শাড়ি দেড়দিন মতো লাগে বুনতে।

 

রাজবলহাটের তাঁতিদের আরাধ্যা রাজবল্লভী। এই দেবীর জন্য ১৪ হাত তাঁতের কাপড় লগে। যেটা এখানকার তাঁতিদের তৈরি। এই মন্দির চত্বরের দোকানে এই শাড়ি পাওয়া যায়। পুজোর জন্য এখানে সবাই শাড়ি কিনে পুজো দেয়।

Facebook Comments

পছন্দের বই