লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কবিতা

শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তী

ডাক

দু-হাতে আঙুল ঘাঁটতে ঘাঁটতে তোমার দৃষ্টি চলে যাচ্ছে
অনেক দূরের কোনো বালিকার পড়ার টেবিলে।
রোগা বসতির মধ্যে যেখান দিয়ে চলে গেছে
একখানা একহারা স্টেশন—
চা-ওয়ালা ডেকে যাচ্ছে,
ঝালমুড়ির মধ্যে থেকে উঁকি দিচ্ছে নারকোলের প্রেম,
সাইকেল-কিশোরদু-টি অপেক্ষা করছে ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার।
যে-কোনো দিকেই ট্রেন চলে যেতে পারে এক্ষুনি।
বালিকাটি মন দিয়ে এসবের মধ্যে দিয়ে লিখে যাচ্ছে
অজস্র অক্ষর, শব্দ, পিছুডাক।
স্টেশনে দাঁড়ানো ট্রেন অথবা আঙুল ঘাঁটতে ঘাঁটতে তুমি
সেই ডাক শুনতে পাচ্ছ না।

আজকের বিশেষ বিশেষ

ঝরে পড়া সংক্রান্ত সমস্ত শব্দবন্ধরা
মেঘেদের মন ভেঙে দিয়ে সাদাকালো খবর হয়ে যাচ্ছে।
খবর হয়ে যাচ্ছিস তুই, আমি, আমরা আর
দুপুরজানলার ফাঁক দিয়ে ছিটকে আসা ফোঁটাদের কাটাকুটি খেলা।
যে-কোনো খেলাই তো শেষ হয়ে গেলে,
কাগজে— মগজে— শুধু ফলাফল হয়ে থেকে যায়।
রেফারির হুইস্‌ল থেকে শুরু করে ব্যাকপাস, ভলি থেকে ড্রিব্‌ল;
সমস্ত ঝাপসা রোমান্সের মতো ফোকাসের পিছনে মিলায়—
সেমিকোলনের মতো, স্তব্ধতা নেমে আসে রিমঝিম— মাঠের উপর।
বৃদ্ধ গ্রাউন্ড্‌সম্যান শিরা ওঠা হাত নিয়ে ঘাসের তবিয়ত দেখে রাখে,
আগামী খেলার কথা ভেবে।

অতিমারির গল্প

এখন তোমাদের মুখর কবিতাসন্ধ্যাগুলি ভেঙে যাচ্ছে বাইনারি ব্যথায়, কাগজ থেকে অক্ষর চুইয়ে পড়ছে দ্বিধাহীন এল.ই.ডি-র ঠোঁটে। বছরের পর বছর আলো ঝলমল করতে করতে ক্লান্ত ম্যয়খানাজুড়ে পড়ে আছে অনির্দিষ্ট ছুটির খেদ, থরে থরে সাজানো অব্যবহৃত তরল মৌতাত আর অজস্র বঙ্কিম সখ্য সম্ভাবনাগুলি; যেগুলি সপ্তাহান্তের পর আর রাস্তা পেরোতে পারেনি। ছড়িয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে হাতগুলি যারা উল্লাস করেছিল, অফিসে অফিসে উদ্বিগ্ন মক্ষীসকল একাধিক চোখ জ্বেলে সন্দিহান ইতিউতি নজর ফিরিয়ে নিচ্ছে। ছোঁয়াছুয়ি খেলাগুলি স্তব্ধ হয়ে বসে পড়েছে নিরুপায়, আর সাইকেল চালিয়ে যে-কিশোরটি বারান্দায় একটি শ্যামল মুখ খুঁজে খুঁজে চলে যাচ্ছে একা ওকে তুমি রক্ষা কোরো ঠাকুর, ওদের বহুদিন কোনো স্কুলপালানো নেই আপাতত।

ব্যবধান

এই এত গুমোট দিনলিপি
পড়ানো গেল না বলে
ইদানীং দুঃখ হয় না।
অথচ দুঃখ হয় দোয়াতের, কালি-কলমের –
কলসির ভেতরে যেমন কিশোরী জিয়ল মাছ
অবিরাম ছটফট করে—
ঢাকা খুলে দিলে তার সামান্য-জীবন বেড়ে যায়।
আরও কী অজস্র স্তো‌‍‌কে ডোবানো বয়স আছে;
এ-হেন জীবন নিয়ে কোথা থুই কোথা রাখি
মাথায় আসে না।
অকথ্য সমস্ত ওই মেলামেশা-লিপি খুলে দেখি
স্পর্শ পর্যন্ত ঠিক পৌঁছে যাবার আগে
সামান্য নখ রয়ে গেছে।

কথা ও কাহিনি

ঘেন্না আর প্রতিশোধস্পৃহাকে কাটিয়ে ড্রিব্‌ল করতে করতে
ওই যে পেনাল্টি বক্সের দিকে এগিয়ে যাওয়া মেয়েটি,
ওকে চিনে রাখো কথকঠাকুর।
ওর গল্প তোমাকে বলে যেতে হবে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে।
ওর লাল রিব্‌ন তিন দশক পার করতে করতে এখন লাল পাড়,
সৈন্ধব লবণ আর কামরাঙা-দুপুরকে পেছনে ফেলে
সে একদিন হাঁটা লাগিয়েছিল হাইওয়ে ধরে।
হুহু ছুটে যাওয়া দৈত্য ট্রলারে ওর উড়তে থাকা ওড়নাসৌষ্ঠব
ছুলে গিয়ে রক্তপাত হয়েছিল বহুদিন,
বহুদিন রজঃস্বলা অবস্থায় ওর ব্যথার ভেতরে
গরম সীসার মতো প্রেম ঢেলে দিয়েছিল দোসর।
সঘন শ্রাবণে চুল এলো করে উইপিং উইলোর নীচে
দেহ মেলে ধরেছিল সে আদ্যন্ত বিস্বাদ ধুয়ে নিতে।
অথচ তার খাতার ভাঁজে অক্ষরজ্ঞান ছিল কবিতাপ্রতিম,
অথচ দু-চোখ তুলে চাইতে পারলে দেখতে পেত
গুটোনো ডানা মেলার মতো বিস্তর আকাশ আছে দিগন্তপ্রমাণ,
পুরোনো চিঠির মধ্যে এখনও ধক্‌ ধক্‌ করছে একখানা টাটকা হৃদয়।
সেখান থেকে এতদূর ঘেন্না, তাচ্ছিল্য আর প্রতিশোধস্পৃহাকে কাটিয়ে
ড্রিব্‌ল করতে করতে ওই যে পেনাল্টি বক্সের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েটি,
ওকে তুমি চিনে রাখো কথকঠাকুর।
ওর গল্প তোমাকে বলে যেতে হবে প্রজন্মের পর প্রজন্মকে।

Facebook Comments

পছন্দের বই