লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কবিতা

শুভাগত রায়

কন্যা, তোমায়


কন্যা তোমার চোখের ভেতর দীঘল যৌবন,
হেঁটে যায় বহুদূর মায়া সীমানায়।
এইভাবে একে একে মরে গেছে মন,
সে-শরীর ভেসে আসে আবিল হাওয়ায়।
তোমার বুকের কাছে ছায়া ফেলে স্নেহ,
কবেকার বিষণ্ণতা জেগে আছে একা।
জুড়িয়ে আসে ক্লান্ত যাযাবর এই দেহ,
তমালীর বনে মনে পড়ে আমাদের শেষ দেখা।

কন্যা তোমার মুঠোর ভেতর শ্রাবণী মেঘের দল,
জমে আছে গহীন যেন উদাস গাভীর চোখ,
এই সন্ধ্যায় অলক্ষ্যতে হাত ছুঁয়েছে জল,
শিরায় শিরায় জমাট বাঁধে প্রাচীন কোন শোক।
দূরে কোথাও শুনি তোমার প্রেমিকের বাঁশি সুর,
চোখের কোলে জলের রেখা শুকিয়ে দেয় আলো,
কিশোরবেলার মতো ভেসে যাও যোজনব্যাপী দূর,
কন্যা, আমাদের কথারা সব বাকি থেকে গেল।


যাওয়ার বেলায় তাকিয়েছ ফিরে,
পিছুডাক ভুলে একা হল জলাশয়।
আয়ুরেখা ধরে বিষাদের চলাফেরা,
তোমাকে মনে পড়ে এই নীরবতায়।

উদাসী ছায়া ফেলে ফাল্গুনী দুপুর,
শীতল হাওয়ায় উড়ছে কাজললতা।
মায়াবী স্নেহে ধুয়ে যায় আদরের পথঘাট,
আমাদের ঘুমে নামে অলীক মুগ্ধতা।

নীলাভ শাড়ির ভাঁজে অপেক্ষার ধুলো,
নৌকো ফিরেছে কোথাও বহুদূরে।
বেড়ে ওঠে যত আদিম গুল্মলতা,
কুয়াশা প্রাচীন সব ব্যথাদের ঘিরে।

পলাশের দেহভারে নুয়ে পড়ে স্মৃতি,
কবেকার কিশোরী মুখ ভাসে আবছায়।
দেবীর চোখের কাছে নিভে আসে আলো,
স্মৃতিহত এই ম্লান পঞ্চমী সন্ধ্যায়।

ফিকে হয়ে এল আলোদের চলাচল,
রাত নেমে আসে কলকাতা দক্ষিণে।
নেশাতুর বালক ফিরে আসে ঘরে,
একা হয়ে আসা তারাদের পথ চিনে।

এ-শহর ঘিরে জমে বিস্মৃত উপকথা,
বিষাদের ঘুম ভাঙে বেঁচে থাকাজুড়ে।
দূরে কোথাও ফাল্গুন মরে যায়,
এই নীরবতায় কন্যা, তোমাকে মনে পড়ে।


বলা হয়নি তোমাকে কখনো,
নিমফুল ঝুঁকে ছিল ব্যথায়।
বিষণ্ণ জীবন ছুঁয়ে এসে দূরে
দাঁড়িয়ে আছ একা নীরবতায়।

আমিও ছিলাম এখানে এমনই,
যেমন জমে থাকে প্রাচীন কোনো শোক।
কী মায়ায় মিশে গেছ দেহে,
জলে ভিজে ওঠে কিশোরীর চোখ।

মনে পড়ে ম্লান রোদ্দুরে?
প্রেমিকের সাথে সেই দেখা?
গুমরে কাঁদো আজ একাকী,
দীর্ঘ রাত যেন বিষণ্ণ আয়ুরেখা।

আমার উঠোন থেকে বহুদূরে,
নিশ্চুপে জ্বলে আছে আলো।
তোমাকে খুঁজে ফিরে কতকাল,
বালকেরা কীভাবে আছে ভালো?

দুঃখেরা দাঁড়িয়ে একা নতমুখে,
দূরে নীরবে বিষাদেরা জ্বলে।
জল ছুঁইনি বহুদিন হল আজ,
কন্যা, তোমার স্পর্শ হারিয়ে ফেলব বলে।


ভুলে গেছ আমার বাড়ির কথা
আমারও তো ছিল না সে-জানা
যত কথা লিখেছিলাম এতকাল
ফিরেছে চিঠি হারিয়ে তোমার ঠিকানা

আমার শহরে এসে মনে পড়ে কিছু?
কবেকার কথারা আজ উড়ছে হাওয়ায়।
ফিরে গিয়ে একা চোখ মুছেছ কতবার!
প্রেমিককে বলোনি কী গোপন ব্যথায়।

স্মৃতিগন্ধ এসেছে ফিরে বর্ষা মৌসুমে,
শরীর নিভিয়ে রাখে অসুখের দিন।
মনে পড়ে ক্লান্তিকর দীর্ঘ আয়ুরেখা
শিখিয়েছ তুমি ব্যথারাই চিরকালীন।

সেই যে ছাতা তোমায় দিয়েছিলাম ডেকে,
আজ একলা কোণে লোটায় মলিন, আতুর।
এ-আষাঢ় শরীর বিদ্ধ করে শুধুই,
আমার এখন একাকী ভেজাই দস্তুর।

জীবন ভুলেছে কত কী বহুকাল হল,
আবছা হয়েছে সব সময়ের ঘষা কাচে।
জলের গন্ধ লেগে আছে স্মৃতিদের গায়ে,
শুধু কিছু বিচ্ছেদ চোখে লেগে গেছে।

সমস্ত জীবনজুড়ে বিস্তৃত দাহকাল,
মুছে ফেলেছ কবে আমাদের পরিচয়?
এশার নমাজে কেঁপে ওঠে বিহ্বল সন্ধ্যা,
সবকিছু কন্যা, শুধুই তোমার চলে যাওয়া মনে হয়।


আমার এখন শীতের বিকেল,
ঘনিয়ে আসছে এই অবেলায়।
পুরাতন শাড়ি একা অযতনে,
আড়ালে ভেঙে পড়ে কান্নায়।

উড়ছে হাওয়ায় ম্লান সাঁঝবাতি,
তোমারও তো আছে কারণ ঘরে ফেরার।
আমি ছিন্ন মলিন চিঠির গোছা,
বহুকাল আর খোঁজ পড়ে না যার।

দাওনি তুমি স্রোতস্বিনীর ঢেউ,
বুকের ভেতর অতলান্ত খাদ।
তোমার গৃহস্থালির পাশেই বসবাস,
ক্ষমাহীন জানি তোমাকে চাওয়ার অপরাধ।

সেই আমাদের অনেককালের দেখা,
কবরে ঘুমিয়ে যে-কথারা ছিল বাকি।
প্রেমিকের বুকে বলে ওঠো আনমনে,
‘বাতিল ছেলে, কবিতা লেখে নাকি!’

শীতের বিকেল পাশে চিঠিদের গোছা,
সন্ধ্যার মুখে জ্বলে ওঠে আলো।
মায়াবী জানি আজ তোমার সংসার,
তবুও কন্যা, এভাবেই বিদায় দিতে হল?

 

Facebook Comments

পছন্দের বই