লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গল্প

শুভজিৎ ভাদুড়ী

ঈশ্বর আর মানুষেরা

এক
সবে মাত্র দু-বার গাড়ি চলেছে। দু-বার গাড়ি খালি করে এসে তিন নম্বর বার গাড়ি লোড করার কাজ চলছিল। অর্ধেক ভরা হয়েছে এমন সময় থানা থেকে বড়োবাবু এসে হাজির। আবুল দাঁড়িয়ে ছিল পাশেই। বড়োবাবুকে দেখে খানিকটা এগিয়ে এসেছে। ‘কার গাড়ি?’ বড়োবাবু এগিয়ে আসতে আসতে প্রশ্ন করলেন। এসব প্রশ্ন করার সময় বড়োবাবুর গলার স্বর অস্বাভাবিক রকমের আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। আবুল খানিকটা দ্বিধা আর ভয় মিশ্রিত গলায় উত্তর দিল, “ছ্যার, আমার ছ্যার।”

“বালি তুলছিস কেন? বালি তোলা নিষেধ আছে জানিস না?”

আবুল কিছু বলতে যাবে তার আগেই বড়োবাবুর সঙ্গে থাকা একজন কনস্টেবল বলল, “জানে না আবার! এরা সব জানে।”

বড়োবাবু চোখ নাচিয়ে আবুলের দিকে তাকালেন। যে তিনজন ঠিকা শ্রমিক গাড়িতে বালি ভরার কাজ করছিল তারা কাজ থামিয়ে বড়োবাবুর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। হাতে ধরা বেলচা। সেপ্টেম্বর মাস। মাথার ওপর ঝকঝকে নীল আকাশ। বেলা বারোটার রোদ্দুরে সবারই গায়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। বড়োবাবু ঠিক এখানে আসেননি। একটা কাজ সেরে এই পথেই ফিরছিলেন। পথে দূর থেকে বালির গাড়ি চোখে পড়াতে এখন এসে দাঁড়িয়েছেন। গোটা রাজ্যে এখন বালি মাফিয়া, বালি চোরে ভরে গিয়েছে। এই নিয়ে থেকে থেকে ওপর মহল থেকে চাপ আসে। খবরের কাগজে লেখালেখি হয়।

“এটা তো চরার বালু নয় ছ্যার।” আবুল বলল। সে-কথা অবশ্য ঠিকই। বড়োবাবু চারপাশটা একবার তাকিয়ে দেখলেন। এখান থেকে বুড়িতোর্ষার সেতু দেখা যাচ্ছে বটে, তবে প্রায় আধা কিলোমিটার দূর তো হবে। এসব জমি হয়তো নদীর চর নয়। চাষের জমি। ইতিমধ্যে পুলিশ দেখে এখানে অল্প ভিড় হতে শুরু করেছে। আশেপাশে খাটছিল এমন ছেলে ছোকরা, বৃদ্ধ এমনকী কোলে বাচ্চা নিয়ে শীর্ণ কায়া কয়েকটা মেয়ে বউও এসে হাজির। কোথায় যে সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এরা, আসলে পুলিশের পোশাকটাই এরকম, বড়োবাবু ভাবলেন। এত চোখে পড়ে আর সবাইকে একেবারে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে।

“চরের বালি না হোক, বালি তো! কার অনুমতি নিয়েছিস গাড়ি লাগানোর আগে? কাগজ দেখা।”

“কাগজ তো, আসলে…” আবুল আমতা আমতা করে,— “…ছ্যার, করা হয়নি ছ্যার।”

“তবে?” বড়োবাবু গলার জোর বাড়িয়ে বলেন, “নিয়ে যাব গাড়ি উঠিয়ে থানায়?”

গাড়ি থানায় উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার অর্থ জানে আবুল। খানিক পয়সা খসবে আর দিনমান ভোগান্তি।

ইতিমধ্যে ভিড়ের মাঝে এসে দাঁড়িয়েছে একজন যুবক। হাতে একটা কোদাল। বেশ আঁটসাঁট তামাদি চেহারা। একগাল দাড়ি। পরনে কেবল নীল চেকচেক লুঙ্গি। খালি গা। বুকে বড়ো বড়ো লোম। এখন ঘামে ভিজে গায়ের সঙ্গে সেঁটে গেছে। এ লালচান। বলল, “নিজের জমি থেকে বালা সরানোও দোষের?”

বড়োবাবু কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার আগেই ভিড়ের মধ্যে থেকে ভেসে আসা কণ্ঠ কানে এল তার, “নেতারা সব নদী থেকে বালা তুলে নিল, তাদের ধরতি পারেনা! হুজ্জুতি করার জন্যি এই গরিবগুলানকেই পায়।”

লালচান কিছু বলছে না। কেবল দেখছে বালি পড়ে সাদা হয়ে থাকা জমিতে মাঝখানে কেবল কিছুটা খাবলা। সবে মাত্র দুই ট্রলি বালি পার করা গিয়েছে। তার মধ্যেই এই বিপত্তি। এই বছর যেন বিপত্তির আর শেষ নেই। প্রথমে বন্যার জল ঢুকে ঘর বাড়ি সব ভাসিয়ে দিল। এত প্রবল বন্যা লালচান বহুদিন পর দেখল। রাজ্য সড়কের ওপর দিয়ে হুহু করে জল বইছে। জমি বাড়ি সব জলের তলায় পড়ে থাকল আধা মাস। সারা বচ্ছর বয়সের গাছপাথর না থাকা বুড়ি ঠাকুমার মতো রোগা হ্যাংলা শরীর যে, বুড়িতোর্ষা নদীর সে কিনা আঠারো বছরের সোমত্থ যুবতীর মতো ফুলে ফেঁপে উঠল। জল নামলে দেখা গেল জায়গায় জায়গায় চাষের জমিতে ঢের নদীর বালি এসে জমা হয়েছে। এখন এই বালি না সরালে চাষ হবে কী করে! আর চাষ না হলে খাবে কী?

লালচানের সম্পত্তি বলতে এই তিন বিঘা চাষের জমি। বছরে কখনো লোকের জমিতে শ্রম দিয়ে আর কখনো নিজের জমিতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চাষ করে সংসার চলে। ঘর-ভরা সংসার। বাপ, মা, বউ, তিন-তিনটা ছেলেপুলে। সব মিলিয়ে মোট সাতটা উদগ্র হাঁ করে থাকা পেট। সেই পেট ভরার জন্য জমিতে ফসল হওয়াটা জরুরি। ফসল না হলে শুধুমাত্র লোকের জমিতে বাড়িতে গতর ঝড়িয়ে ওই পেট ভরা অসম্ভব। নিজের পেটে খিদের জ্বালা তবু সহ্য করা যায়, কিন্তু যখন ওই একরত্তি বাচ্চাগুলা পেটের জ্বালায় হামলাবে তখন? চুপ করে বসে দেখবে এমন পাষাণ হৃদয় কার আছে!

লালচান তাই তেড়ে ফুঁড়ে এগিয়ে গেল, “এরা কী বলতেছে আবুল?”

আবুল হাত দেখিয়ে লালচানকে শান্ত হতে বলে। আবুল বলেছিল, নিজের থেকেই বলেছিল, যে ও বালুটা সরিয়ে দেবে। ওর নিজের ট্র্যাক্টর আছে। লাফাবাড়িতে একজনের নতুন ঘর উঠছে। ভিটে উঁচু করার জন্য বালু দরকার। আবুল লালচানের জমি থেকে বালু সরিয়ে ওখানে দেবে।

পয়সা যা পাবে সেটা ওর লাভ হবে, আর তাছাড়া লালচানেরও উপকার হবে। এখন এতে দোষের কী আছে সেটা লালচানের মাথায় ঢুকছে না। সে চিৎকার করে এইসব বলছে।

বড়োবাবু সামান্য হলেও দ্বিধাগ্রস্থ। চাইলে গাড়িটাকে তিনি থানায় তুলে নিয়ে যেতেই পারেন। কিন্তু বালি চুরি আটকানো তার একার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। জেলা স্তরের বিভিন্ন সরকারি মিটিং-এ তাকে এই নিয়ে কথা শুনতে হয় তাই তিনি গা ঘামিয়েছেন। তবে নদীর চর থেকে তুললে তিনি ধরতেন অবশ্যই। কিন্তু বন্যার জলের সঙ্গে আসা এবং চাষের জমিতে ফেলে যাওয়া বালুর ক্ষেত্রে নিয়মটা ঠিক কী এ-ব্যাপারে তার সঠিক ধারণা নেই। আবার এতটা সময় নষ্ট করে শুকনো হাতে ফিরে যাবেন এটা ভাবতেও তার ভালো লাগছে না।

দুই
সুরঞ্জন ভাবছিল এবার অফিস থেকে বেরোবে। বেলা দেড়টা বাজতে চলল। আজ সে অফিসে আসতই না। কিন্তু একটা জরুরি কাজ ছিল বলে আসতে হয়েছিল। কাজটা সেরে নিয়েই ফেরার কথা ছিল। আজ সকালের ট্রেনে ওর স্ত্রী এসেছে কলকাতা থেকে। সুরঞ্জন নিজেও কলকাতার ছেলে।

এতদিন চাকরিসূত্রেও কলকাতার আশেপাশেই ছিল, গতবছর বদলি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের একপ্রান্তে এই কোচবিহার জেলায় এসে পড়েছে। এখানেই এক ব্লকের ভূমিরাজস্ব আধিকারিক। ঘর ভাড়া নিয়ে একাই থাকে। ফ্যামিলি আসেনি। আসবেই-বা কী করে! ওর বউ তো কলকাতায় চাকরি করে।

সামনের কম্পিউটার বন্ধ করে সবে চেয়ার ছেড়ে উঠেছে এমন সময় ফোন বেজে উঠল। মোবাইল স্ক্রিনে ভেসে উঠল— ওসি।

“বলুন।”

“একবার সাউদের বস-এ আসতে পারবেন? বালির গাড়ি ধরেছি।”

অনিচ্ছে থাকলেও মুখের ওপর একেবারে না করতে পারল না সুরঞ্জন। পদাধিকার বলে সে ওসি-এর থেকে উচ্চ। কিন্তু থানার সঙ্গে তাদের একটা ভালো সম্পর্ক রেখেই চলতে হয়, কতরকম দরকার অদরকারে লাগে। সে বলল, “ক-টা গাড়ি?”

“একটাই।”

“আসছি। একটু থাকুন।”

বালি মাফিয়াদের নিয়ে সারা রাজ্যেই বেশ অস্থিরতা চলছে। উত্তরবঙ্গের এই জেলাও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে দক্ষিণবঙ্গের তুলনায় মাফিয়াদের দাপট এখানে অনেক কম। তবে যেদিকে চলেছে রাজ্য তাতে পরিবেশ অশান্ত হতে সময় লাগবে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তো শাসক দলের নানান মাপের নেতাদের যোগসাজশ পাওয়া যায়। আর এদিকে প্রশাসনিক সভায় নির্বিচারে ভূমিরাজস্ব দফতর চোর অপবাদে গালাগাল খেতে থাকে। তাদের অকর্মণ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অথচ ব্লকের এত গুরুত্বপূর্ণ একটা অফিসের নিজস্ব একখানা গাড়ি নেই। বাইরের লোকের মোটর সাইকেলই ভরসা।

সত্যি বলতে কী থেকে থেকে বেশ লজ্জা লাগে! সুরঞ্জন যেতে যেতে ভাবছিল। বুড়িতোর্ষার সেতুর ওপর থেকেই জটলাটা চোখে পড়ল। বাইক থেকে নেমে বালির উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সুরঞ্জন জটলাটার কাছে এল। তারপর খানিক হই হট্টগোলের মাঝে সবটুকু শুনে বলল, “বালি বন্যার জলের সঙ্গেই আসুক আর যাই হোক বালি উঠানো বে-আইনি। বালি তোলার কোনও অনুমতি আমরা দেবনা। আর এগুলো জমির শ্রেণি কি? নদী বা সিকস্থি নয়তো?”

হাঁ হাঁ করে উঠল লালচান। তার সঙ্গে গলা মেলালো আরও অনেকে। সমবেত কণ্ঠস্বর জানান দিল জমি চাষেরই বটে। শ্রেণি ডাঙ্গা। সে খানিক গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “শোনো বালু তোলা যাবে না। কাজ বন্ধ। যেটুকু কাজ হয়েছে এর জন্য রয়্যালটি লাগবে। ফাইন হিসাবে দিতে হবে।”

লালচান বলল, “ছ্যার, বালি না সরান দিলে চাষ কীভাবে হবে? বিছন মাটি না পেলে ফসল হয়?”

কথাটা যে ন্যায্য তা সুরঞ্জনও জানে। কিন্তু সে কী করবে? তারও তো হাত পা বাঁধা। দিন সময় ভালো না। এখানকারই এক সাংবাদিক সারাক্ষণ খবরের জন্য ছোঁকছোঁক করে। তিলকে তাল বানিয়ে খবর ছাপায়। সে-সব খবর দেখিয়ে উপরমহল কৈফিয়ত চায়। কী দরকার অকারণ নিজের ওপর ঝামেলা ডেকে আনার। তাছাড়া একজনকে দয়া দেখালেই সব একেবারে পেয়ে বসবে। তবে এরা একেবারেই হদ্দ গরিব। কিন্তু এদের থেকে তো আর ফাইন নেবে না, ফাইন দেবে যে-ছেলেটা গাড়ি লাগিয়েছে সে। কী যেন নাম, আবুল শুনল বোধহয়। তবে সেও যে এই কাজটা করে বিশেষ কিছু পয়সা করবে তেমন নয়। নিজের সামান্য কিছু লাভ রেখে এ আসলে একধরনের সামাজিক উপকার। জমির উর্বরতা ফিরিয়ে দেওয়া। তাই এদের থেকে ফাইন নিতে যে ইচ্ছে করছে সেটাও নয়। কিন্তু এখন এই পুলিশের সামনে একেবারে কোনো ফাইন ছাড়া ছেড়ে দিলে ওরা হাসাহাসি করবে। পরে কোনো দরকারে ওদের ডাকলে খোঁটা দিয়ে কথা শোনাবে। তাই পুঞ্জীভূত অসন্তোষের মাঝে দাঁড়িয়ে সুরঞ্জন হাত তুলে বলল, “এই বালির গাড়ি রাস্তা দিয়ে গেলে কাগজে ছবি উঠবে। এলাকার লোকেরাই বালি চুরির অভিযোগ করবে। তখন আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি।

কোনো বালি কোথাও সরানো যাবে না। আর যেটুকু কাজ অন্যায়ভাবে হয়েছে তার জন্য ফাইন দিতেই হবে।”

সমবেত ভিড়ের মধ্যে গুঞ্জন উঠলে সে আরও গলার জোর বাড়িয়ে বলল, “টাকা তো আর আমাকে দিচ্ছ না। সরকারি রসিদ পাবে। সরকারকে টাকা দিচ্ছ। আর না হলে থানার লোক আছে গাড়ি উঠিয়ে নিতে বলছি। যা হবে তা আইন মেনেই হবে।”

মুখে আইনের কথা বললেও সুরঞ্জন জানে এসব আসলে আইনের ফাঁক। আইনে ঠিক এরকম কথা বলা নেই। সরকার এক-একটা ভূমিরাজস্ব অফিসে রাজস্ব আদায়ের বড়ো বড়ো লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে দেয়। সেই ‘টার্গেট’ পূরণ করতে এইভাবে নরমে গরমে কিছু আদায় করতেই হয়।

যাদের মুখের জোর বেশি, যারা তুলনামূলক অসহিষ্ণু, যাদের নেতা ধরা আছে তাদের সামনে গুটিয়ে থাকে দফতর। কত কত বাংলা ইট ভাটা সরকারকে এক পয়সা রাজস্ব না দিয়ে মুনাফা করে চলে। কত ‘সেয়ম’ জমি ‘দুয়েম’ জমি পুকুর হয়ে যায় রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে। কত ‘পুকুর’ দিনের আলোয় ‘বাস্তু’ হয়ে যায় আইনকে কাঁচকলা দেখিয়ে।

শেষমেষ আরও কিছু কথা কাটাকাটির পর দু-হাজারে রফা হল। সুরঞ্জন রসিদ বই বার করে খসখস করে লিখে দিল ‘আনঅথরাইজড এক্সট্র্যাকসন অফ আর্থ’। হ্যাঁ, “আর্থ”। পাগল নাকি যে “স্যান্ড” লিখবে। অ্যামাউন্ট লেখার সময় থানার বড়োবাবু একটু নাক সিটকালো। নীচু গলায় বলল, “এত কমে ছেড়ে দিলেন! থানায় নিয়ে গেলে মিনিমাম দশ নিতাম।”

সুরঞ্জন অবশ্য সে-কথায় বিশেষ কান করেনি। কারণ, লালচান তখন তাকে জিজ্ঞেস করেছে, “এবার তালে বালাটা পার করতে পারব?”

“একদম না। এটা অন্যায়ভাবে যে কাজটা হয়েছে তার জন্যে ফাইন। কাজ করার পারমিশন না। আর একবারও গাড়ি চলবে না।”

“পারমিশন কে দেবে তাইলে?”

“কেউ দেবে না।” ফাঁপা সরকারি দম্ভের বুটজুতো বালির ওপর মসমস করে সে যখন ফিরে যাচ্ছে তখন পেছন থেকে আবুলের গলা আলতোভাবে তার কানে এল, “বেকার বেকার খানিকটা টাকা খসল, তবে ভাবিয়েন না। ভোর রাতে গাড়ি লাগাব।”

তিন
প্রেম! কী গভীর প্রেম তার! কী গোপন সহবাস! এ-শরীর সে বানায়! এ-মাটি সে বানায়! তাঁর শরীরের ঘাম টুপটুপ করে গিয়ে পড়ে তৃষ্ণার্ত বুকে! ঘামে বুক না ভিজলে সঙ্গম হয় না। নরম হয়! নরম! নরম হতে হতে হাঁ করে থাকে বিছনের জন্য। তখন আর শুধু প্রেম থাকে না। থাকে পূজাও।

হাত জোর করা আকুল আকুতি। হে আমার ফসল ঘরে এসো। হে আমার ঈশ্বর ঘরে এসো। ছড়িয়ে দাও তোমার সুগন্ধ। দাও। দাও। দাও।

একটানা শব্দটা সুরঞ্জনের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তবু সে নিজেকে অটুট রেখেছে। আট বছর পেরিয়ে গিয়েছে বিয়ে হওয়া। বোধহয় কলকাতার কোনো গাইনি কোনো ফারটিলিটি ক্লিনিক আর বাকি নেই। সব দেখানো হয়ে গেছে। প্রায় তো মেনেই নিয়েছে ভাগ্য বলে। তবু আজও কেন যে এই প্রক্রিয়াটা দহন করে! কেন কেবল আনন্দ হয় না! আজ কি আরও বেশি করে যন্ত্রণা হচ্ছে? সংগম অসম্পূর্ণ রেখে নিজেকে স্ত্রীর শরীর থেকে পৃথক করল সুরঞ্জন। তারপর ওর পাশেই পা ভাঁজ করে হাঁটুর ওপর মাথা নামিয়ে বসল। ওর পাশে এখন ওর স্ত্রীর নগ্ন নির্জন দেহস্তব্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। হঠাৎ মনে হল ওরা চলে আসার পর লালচান কি ওর জমির পাশে ঠিক এভাবেই বসে ছিল? ওকে কি তবে লালচানের মতো দেখাচ্ছে! ও নিজেই কি আসলে লালচান? না না, তা কী করে হয়! লালচানের জীবনে ওর ভূমিকাটা তো সেই অদৃশ্য অদেখা ঈশ্বরের মতো! যার অঙ্গুলি হেলনে উর্বরতা নষ্ট হয়ে যায়! অনন্ত সম্ভাবনার ওপর যে বালি ছড়িয়ে দেয়! তবে কি ও নিজেও ঈশ্বর! তাই-বা কীভাবে সম্ভব! ও নিজে তো এই বিরাট সমাজব্যবস্থা আইন ব্যবস্থার এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীটবৎ অংশ যে শিশুর মুখস্থ করা পড়া আওরানোর মতো সমাজের দুর্বোধ্য নিয়মগুলোর চর্বিতচর্বণ করে। ঈশ্বর তো সে যে অদেখা অলভ্য। যার কেবল আকাঙ্ক্ষা করা যায় ভ্রূণ রূপে, কুঁড়ি রূপে। মনে হতেই, সুরঞ্জন, আবার নেমে গেল স্ত্রীর শরীরে, যেভাবে কুমীর জলে নামে।

প্রেম! কি গভীর তার প্রেম! কি গোপন তার পুজা! যেন নিজের যৌনাঙ্গটাকে বেলচার মতো করে চালাচ্ছে সুরঞ্জন। প্রাণপণ। যেন নিজের সমগ্রটাকেই সে একটা বেলচার মতো করে চালাচ্ছে। সে একা নয়। তার সঙ্গে আরও অনেক স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞ, বন্ধাত্ব বিশেষজ্ঞ। ফারটিলিটি ক্লিনিকের বড়ো বড়ো সাইন বোর্ডের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে ওর শরীর। মাটি খুঁজে বার করতে হবে। ফসল ঘরে এসো। এসো ঈশ্বর।

ক্লান্তি

ক্লান্তি

ক্লান্তি!

শরীরজুড়ে নেমে আসে ঘুম। বালির শরীর। বালির বিছানা। যখন দু-হাত ছড়িয়ে উপুড় হয়ে পড়ে রয়েছে একটা নিস্তব্ধ দেহ, বাইরে ভোর হচ্ছে।

লাফাবাড়িতে যাদের ভিটায় বালি দেওয়ার কথা ছিল তাদের দিয়েও এক গাড়ি বেঁচেছে বলে আবুল ওটা নিজের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে। ভোরের কাঁচা আলোয় দেখা গেল ওই যে গাড়িটা বুড়িতোর্ষার সেতু পেরিয়ে গেল।

জমির বুকে হাত রেখেছে লালচান। রং দেখছে। বুকের ওপর জন্মানো আগাছা দেখে ও মাটির মন বোঝে। তবে এখন তো সব খাঁ-খাঁ। যেন ওর সামনে নতজানু হয়ে বসেছে সেই অষ্টাদশী কিশোরী। জড়সড়। আগে আড় ভাঙতে হবে। মুখোমুখি বসেছে লালচান। দু-হাতে ঘাঁটছে। আবার প্রণামও করছে। ওর গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। এসো, এবার ছড়িয়ে দাও তোমার সুগন্ধ…

Facebook Comments

পছন্দের বই