লেখক নয় , লেখাই মূলধন

সূচনাকথা

গৌতম সরকার

এই ক্রোড়পত্রে দু-টি বিষয়কে তুলে আনবার চেষ্টা করা হয়েছে—

এক) ভারতবর্ষের চার ভাষা গোষ্ঠী হল ইন্দো-ইউরোপীয়, দ্রাবিড়, অস্ট্রিক এবং ভোট-বর্মী। এই চার ভাষাগোষ্ঠীর মানুষদের উৎসব তুলে আনা।

দুই) নিজেরা নিজের কথা বলবে। এখানে ভোট-বর্মী থেকে টোটো, রাভা, গারো। ইন্দো-ইউরোপীয় থেকে রাজবংশী। দ্রাবিড় থেকে ওঁরাও, অস্ট্রিক থেকে বাউরি- ওরা নিজেদের কথা বলেছে।

প্রশ্ন হতে পারে— এখানে তো আদিবাসীরাও বলেছে। তাহলে এই ক্রোড়পত্রের নাম ‘লোকজ উৎসব’ কেন? আদিবাসী উৎসব নয় কেন। অনেকের কাছে এই জবাবদিহি করতে হতে পারে। দ্বন্দে না গিয়ে, ক্রোড়পত্রের নাম ‘আদিবাসী ও লোকউৎসব’ করা যেত নিশ্চয়। তবে লোক বিষয়কেই যেহেতু লোক (সাধারণ)-এর অন্তর্ভুক্ত করা হয় সেহেতু প্রবন্ধের বিষয়গুলো লোক। যাঁরা লিখেছেন তাঁরা সকলেই বিশেষ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। নিজস্ব সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ।

উৎসব মানেই মিলন। আদানপ্রদান। ব্যাবসা বাণিজ্য।

উত্তর দিনাজপুর জেলায় ‘কাঁদাকাটির মেলা’ অনুষ্ঠিত হয়। দেশভাগের পর থেকে এই উৎসব হয়ে আসছে। মেলার উদ্দেশ্য দেশের ওপারে থাকা আপনজনদের একপলক দেখা এবং কান্নাকাটি করে মিলিত হওয়া। স্বজনের সুখ-সমৃদ্ধি চেয়ে প্রশান্তি লাভ করে ঘরে ফেরা। এই হল লোকউৎসব। এই হল লোকমেলা।

সাধারণ মানুষ বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে লোকউৎসব পালন করে, সেটা কখনো পারিবারিক, সামাজিক অথবা গোষ্ঠীগতভাবে। কথায় বলে ‘জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে’ ঈশ্বরের হাতে। তাকে কেন্দ্র করে নানা আচার তৈরি হয়েছে। গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে আলাদা। সম্প্রদায়গতভাবে ভিন্ন। যন্ত্রণা-শোক-আনন্দ সবকিছুর মিশেল নিয়ে লোকউৎসব আয়োজিত হয়। লোকউৎসব একটি গোষ্ঠীর পরিচয় তুলে ধরে। প্রাচীন ইতিহাস জানা যায়। জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস-ভয় ও সংস্কার নিয়ে লোকদেবতার প্রতিষ্ঠা হয়। তার পূজাচার, মন্ত্র, সংগীত, খাদ্যাভাস লোকসমাজকে যূথবদ্ধ করে তোলে। সংগীত খাদ্যাভাস পোশাক ইত্যাদি সবকিছু মিলেই এই লোকউৎসব।

এই সংখ্যায় আমাদের উদ্দেশ্যই হল ‘নিজেরা নিজের কথা বলবে’। আমরা সেটাই চেষ্টা করেছি। সমাজ-ভাষাবিজ্ঞানে প্রাথমিক উপাত্ত সংগ্রহের অন্যতম পদ্ধতি হল ক্ষেত্রসমীক্ষা। সেই সমীক্ষা করি বিষয় অনুসারে। বিশেষ স্থান বিশেষ গোষ্ঠী নির্বাচন করি। সেখানে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করি। আলোচনা করি। তবে বর্তমান সময়ের পরিস্থিতিতে এই পদ্ধতি একটু ভাবা প্রয়োজন আছে। যেখানে শিক্ষার প্রসারতা বেড়েছে। মনোরঞ্জন ওঁরাও সম্প্রতি কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণা করছেন। সঞ্চিতা টোটো একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। সংগীতা সাংমা যাদবপুরে পড়াশোনা ও গবেষণা করছেন। সুশীল কুমার রাভা ‘নাকচেংরেনি’ নৃত্য নিয়ে দিল্লির রাজপথে প্রজাতন্ত্র দিবসে অংশগ্রহণ করেন। ভাস্বতী রায় ভাষা গবেষণা করছেন। জয়দেব বাউরি লেখক। এতে বোঝা যায় নিজেরা নিজেদের কথা বলতে সক্ষম। তাঁদের দিয়েই এই উৎসবগুলো লেখানো হয়েছে। এইসব লেখায় প্রাথমিকভাবে কিছু ক্রুটি থাকবে যেমন বাক্যগত, শব্দগঠনগত, পরিচ্ছেদ বিন্যাস এবং ভাবপ্রকাশে। অর্থাৎ, বাংলা লিখার ব্যাকরণগত ক্রুটি। কারণ ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষিক গোষ্ঠীর প্রাবন্ধিকত্রয় বাদে অন্যান্যদের ক্ষেত্রে বাংলা দ্বিতীয় ভাষা।

এই ক্রোড়পত্রে লিখেছেন টোটো থেকে সঞ্চিতা টোটো— ‘টোটোদের ‘অউচু’’। গারো থেকে সংগীতা সাংমা— ‘ওয়ানগালা একটি উৎসব’। রাজবংশী থেকে ভাস্বতী রায়— ‘নন্দোৎসব: দধিকাদো ও পুরাতন রাজবংশী সংস্কৃতির অবক্ষেপ’। ওঁরাও থেকে মনোরঞ্জন ওঁরাও— ‘ওঁরাওদের কয়েকটি উৎসব’। রাভা থেকে সুশীল রাভা— ‘লোকধর্মের পীঠস্থান: আদি কামাখ্যাধাম’। বাউরী থেকে জয়দেব বাউরি— ‘বাউরী জনগোষ্ঠীর পরব’। এবং আমি গৌতম সরকার দেশিদের ‘আইচুরা’-র কথা বলেছি।

যাঁরা প্রবন্ধ দিয়েছেন তাঁদেরকে কৃতজ্ঞতা জানালাম…

Facebook Comments

পছন্দের বই