লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কবিতা

সুজয় ঘোষ

কফিহাউসের প্রকাণ্ড ঘুলঘুলিগুলো খুব অবাক করত। মনে হত, দূরে কোথাও ঝাউবন। ফাঁকে ফাঁকে আকাশ দেখা যাচ্ছে। মেঘলা। বৃষ্টি হচ্ছে। এখানে রোদ। ওখান থেকে দেখলে দেখবে আমরাও প্রকাণ্ড। তাঁরই মতো। মাটির কতগুলি মূর্তি। বনের প্রান্তে। একলা মন্দিরে। কান পেতে শুনি। কবিতার শব্দ। ওংকার। প্রসূতি। প্রসূন। হামাগুড়ি দিতে, উঠে দাঁড়াতে, মায়ের হাত দরকার, ঈশ্বরের হাত ছেড়ে। কবি উঠে দাঁড়ায়। বলি, তারপর! বলে, আরেকদিন হবে। আজ সন্ধ্যের আগে ঘরে না ফিরলে ফিনিশ! কী? আলো। মোমবাতি! লাইট!… এইভাবে গ্যেতেও চেয়েছিলেন, নাকি, মরার সময়… বড্ড লাউড! কফিহাউস তো! না, এই চিৎকার। কোথায় নেই! কবিতায়… শুনলেন না, টেবিলের নীচে বেড়াল বসে নিঃশব্দ! নাহ্‌, উঠি… ভালো লাগল, আপনার সাথে… আলাপ… প্রথম দিন তো। দ্বিতীয় দিন এলে লাগবে। লাগবেই বলছেন! আচ্ছা চলি… শোনালেন না তো! কী? কবিতা— বসে লিখছিলেন এখানে— আচ্ছা রাখুন… নতুন কবিতা!… উঁহু-হু— খুলবেন না— আমি যাই আগে… কবি ঘুলঘুলি দিয়ে চলে গেলেন। ঝাউবন মিলিয়ে গেল। আকাশের গায়ে এখন চিকচিকে জল। চিরকুট খুলে দেখি তাতে লেখা: কফির দামটা দিয়ে দেবেন, ধন্যবাদ!

একটা দুটো করে গাছ পুঁতে যায় অনেকে। ভিয়েতনামের গলিতে ধরে না। প্রেসিডেন্সির ছাদ থেকে দেখা যায়। স্থানাঙ্ক নির্মাণ। খালি হাতে আসে কবি হয়ে ফিরে যায়। ঝোলাব্যাগ চশমা কিনবে মায়ের কাছে বায়নায়। বাবার ছবি দেখিয়ে বলে, ঝুল ঝাড়েনি বাদল সরকার কটা পথনাটিকার পর! এবং ইন্দ্রজিৎ সময় করে পড়লে। বাবার চশমাটা হারিয়ে ফেলে! নাকি পকেটে করে পটলডাঙায় খুঁজতে যায় নকশাল স্পট। মেসের মাছের ঝোলের মতো দেয়ালে লেগে। ছিটকে গোপাল মল্লিক লেনে ঢুকল আলোবাবু। ধুতি হাঁটুতে তোলা, হাতে আঁকশি। অন্ধকারে সুইচ খোঁজে। খুঁটিতে গাঁথা পরপর কবিতার অন্ধকার। আলোবাবু আলো জ্বেলে দেয়। বিড়ির আলোয় দেখে একটা ঝাঁকড়া মাথা ছুটে পালাচ্ছে। একটা চারাগাছ, কয়েকটা পাতা। ঝিরঝিরে হাওয়া। আর জলপাই রঙের মুখ। প্রতিদিন লুকিয়ে চাঁদের জন্ম দেখে কবিতা লিখবে বলে। ইউনিভার্সিটির ছাদে কিংবা হাড়কাটার আকাশে।

কলেজ স্ট্রিটকে কলকাতা নাকছাবির মতো পরে থাকে। তার বিউটিগ্রাফ। কখনো কমে কখনো বাড়ে। কখনো লোক ডাকে কখনো ভড়কায় কখনো বিনা মৈথুনে কবজা করে কায়দায়। আঁচলে বেঁধে ফেলে। উঠতে বলে ওঠায় বসতে বলে বসায়। প্রয়োজনে দাড়ি সরিয়ে আঁচিল খুঁটে দেখে রক্তমাংসের মানুষ কিনা। গা শুঁকে বুঝে ফেলে জেলা: পশ্চিম দিনাজপুর, দুপুরে খায়নি, লোকসংস্কৃতি বইটার লেখককপি বেচেও গাড়িভাড়া ওঠেনি। অতএব রাত কাটানোর তদ্বির করতে যায় পুস্তনি রাখার গোডাউনের গলিতে। গাড়ির ভিড়ে ঢুকতে পায় না। পাঁচ টাকার মুড়ি একটা ফুলুরি কিনে কাজললঙ্কা চেয়ে তেলেভাজা দোকানির খিস্তি খায়। লঙ্কায় কামড় বসিয়ে সম্ভোগসুখ না পেয়ে ভেবে নিজের যৌনঅক্ষমতার ভূত দেখে মহাবোধির ছাদে একঝাঁক পায়রা উড়ে গেল। বেজে উঠল, ‘বুদ্ধং শরণং…’। আকাশে আলো ছড়িয়েছে। সন্ধ্যার বিউটি নামছে কলেজ স্কোয়ারের কালো জলে পা ডুবিয়ে।

পুঁটিরাম ল্যান্ডমার্ক করে অনেক দোকানিই করে খায়। বইয়ের দোকানদারও। এমনকী পাশের মিষ্টির দোকান মৌচাক কোথায় জানতে চাইলে, ও-ই তো পুঁটিরামের পরেই বললে লোকটি বুঝে চলে যায়। এই লাইনে পুঁটিরাম ল্যান্ডমার্ক করতে পারে এমন দোকান হয়নি। হত, বাঘা এক দু-জন প্রকাশক দোকান দিলে। কিন্তু এ-লাইনের দুর্ভাগ্য: অধিকাংশ নামি বইয়ের দোকান কলেজ স্কোয়ার টপকে। এ-লাইনে ছোটখাটো কয়েকটি প্রকাশনীর বিপণি। একসময় তো তাও ছিল না। আসলে বাঙলার সংস্কৃতি রোদ বাঁচিয়ে চলতে ভালোবাসত বোধহয়। এ-লাইনে বেলা অবধি রোদ থাকে। বৃষ্টিতে রাস্তা ডুবে দোকানে জল ঢুকে যায়। তাও নতুন কিছু গাছ গজিয়েছে। তারা রোদ-জল-ঝড়ে সমান লড়ে। তাদের মধ্যে হয়ে-ওঠা একটা ঝাঁকাল বটগাছ কে পুঁটিরাম কবে ল্যান্ডমার্ক করে দেখার।

ভাগাড়ে নতুন কী মড়া পড়ল যেমন আকাশে চক্কর দিতে দিতে চিল শুঁকে চলে যায়, তেমন কিছু লোক বই শুঁকতে আসে। তারা খরিদ্দার নয়, প্রকাশক নয়, সেলার নয়, লেখক। হয়তো পাঞ্জাবির বুকপকেটের কোণটা ছেঁড়া, কলমটা ঝুলতে ঝুলতেও আটকে আছে, পড়ছে না; কালি লিক করে বুকের কাছটা কালিময়। দাঁত দিয়ে মুড়ির ছিবড়ে খুঁটতে খুঁটতে ঘোলাটে চোখে বইয়ের মলাট উলটে দামটা দেখে নিয়ে যথাস্থানে রেখে দেয়। পাশের পেয়ারায়ালার কাছে পাঁচ টাকা দরের পেয়ারা কেনে। পেয়ারার বিচি দাঁতের ফাঁকে ঢুকে যাওয়ার ভয়ে গায়ের সবুজ মাংসটুকু খেয়ে বাকিটা কলেজ স্ট্রিটের পায়রাদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে কলেজ স্কোয়ারে হাওয়া খেতে ঢোকে। রোদ থাকলে ডান দিকটায় বৃষ্টিতে বাম দিকে। অনেকসময় সন্ধ্যা-আরতি দেখে বিদ্যাসাগরের মূর্তির পাশে মন্দিরটায় কীর্তনের দলে ভিড়ে যায়। হেয়ারের সমাধির কাছটায় প্রেমিকপ্রেমিকা থাকে বলে যায় না। প্রেম দেখলে লেখকের অসুখ করে।

Facebook Comments

পছন্দের বই