কবিতা
সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়
গতানুগতিক
একদিন সমস্ত জঙ্গল ফুরিয়ে যাবে আর ধুলো থেকে অক্ষর তুলে তুলে আমরা চিঠি লিখব গতজন্মের। পাখির বাসার দিকে ছড়ানো হবে মনখারাপ। একটা ডিমের হলুদ আর একটা ডিমের হলুদকে ডেকে বলবে— রমণ আদতে একটা প্রয়োজন। ভালোবাসা দিয়ে তাকে ঢেকে রাখাটাই কৌশল।
পায়ে পায়ে জড়িয়ে যাবে পুরানো রেডিয়ো স্টেশন। সন্ধ্যার দিকে বিষাদ বাজবে খুব। থান ইট মাথায় দিয়ে আমিও শুয়ে পড়ব নির্ভার। শুধু তুমিই জানবে না—
দিগন্ত দীর্ঘ হলেও, বানানে হ্রস্বই লেখাটাই বিধি।
অনিবার্য এই ফেরা
মাঝরাত্তিরে উড়ে আসে গোলাপিমাথা হাঁসের দল। পুরানো ডাকবাক্স ভেঙে ঠুকরে খায় মরে যাওয়া চিঠির অক্ষর। জোনাকিহীন এই অন্ধকারে জেগে থাকে যে-সব বাতিস্তম্ভ, আসলে তারা ছায়াহীন। জল ঘুমালেও, তৃষ্ণা জেগে থাকে। হাঁসেরা নেমে আসে প্রেমিকার মতো— মুখে, ঠোঁটে, বুকে। স্মৃতি পর্যন্ত ঝলমল করে ওঠে।
মৃতদের নাম ধরে ডাকে। ডানা থেকে গড়িয়ে নামে আঁধার তরল। কুয়াশায় পালক ফেলে রেখে— এভাবেই অনিবার্য ফিরে যায় শোকপ্রস্তাবের ভেতর।
যে-আঘাত আনন্দের অধিক
সংলাপের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে গমখেতের সংযম। মেধা থেকে মনন পর্যন্ত দীর্ঘ মাংসপথ, বিষপিঁপড়ের ছায়ার মতো সরল ও জটিল। আপ্রাণ উচ্চারণ করি এমন আব্রু। ভাঙন লিখবে বলেই ছেঁড়া পর্দার পাশে আলজিভও শুয়ে থাকে নিরলস। হাওয়ারা শিথিল হয় নিম্নাঙ্গের দিকে। অন্ধকার পেরোতে পেরোতে অন্ধকারে এসে নামে শব্দ। আপাত যৌনতার কথা বলে। বলে সম্ভোগ ও সম্ভাষণ।
হে গোপন রক্তপাত, সর্বনাশের মতো তোমাকে সহ্য করি। আহত হই নন্দনের সাথে।
আত্মগ্লানি
ভেঙে যাওয়া কাঠের গোপনে গুলিয়ে ফেলেছি বিষণ্ণ সবুজ।
এই মরা চোখে অসম্ভব সন্ধ্যা নেমেছিল আর রক্তে উন্মাদনা ছড়িয়ে সেজে উঠেছিল দূরের রণভূমি। মৃত শিশুদের চোখ, ধসে যাওয়া বালির পাড়ের মতো ঠোঁট কিংবা পড়ে থাকা পাথরের বিষাদ পেরোতে পেরোতে হারিয়ে ফেলেছিলাম প্রাচীন হাড়ের দামামা, নির্দ্ধারিত রণনিপুণতা।
বালিকার হাসির পাশে নক্ষত্র ডুবে গেলে ক্ষতি নেই। আমি চাই— সমস্ত ক্ষতচিহ্নের গভীরে আরও ভারী হোক এই আত্মগ্লানি।
ভিন-দোঁহার
ভাঙা হারমোনিয়াম আলগোছে তুলে রাখছে যুবতি বৈষ্ণবীর স্তনছায়া। তুলসীমঞ্চ পেরিয়ে সন্ধ্যা নামছে আশ্চর্য। এই আহ্নিকে আমাদের দেখা হল না বলে, অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে জোড়ভাঙা খরিস। দূরে সন্ধ্যামণি ফুটছে। একটা দুটো করে লাল পিঁপড়ে এসে জড়ো হচ্ছে তিলক চন্দনে।
ভাঙা কাঁসার করতালে কিছুতেই সুর মেলাতে পারছে না দোঁহার। নামগান থেকে শরীর ভিজছে না। শুধু গোপনে গোপনে ফুলে উঠছে শ্রীখোলের গর্ভ।

সুমন বন্দ্যোপাধ্যায়
জন্ম: ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৮, পুরুলিয়া। পেশায় শিক্ষক। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: মহুলপাতে খুলা চিঠি, পথে পথে দুঃখহরণ, পাপ লিখেছি স্বপ্নদোষে, চন্দ্রবিন্দু গাছ, অসমাপ্ত ভ্রমণরেখা ও ভালো থেকো মিথুনরাশি। অন্য ভালোলাগা: নাটক রচনা, নির্দেশনা, অভিনয়।