লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কবিতা

সুমন জানা

বন্দর

নদীর গভীর থেকে দীর্ঘতম ক্রন্দনের মতো
উঠে আসে আজানের ধ্বনি,
বিষণ্ণ বন্দর জুড়ে সন্নাটা ছড়ায়—
মোহনায় চওড়া হতে থাকা স্যান্ড-হেড
মালবাহী জাহাজের পথে যত প্রাচীর তুলেছে
ততই বন্দর ক্রমে ফাঁকা হয়ে গেছে—

কাজ-হারা শ্রমিকেরা তবুও কাজের খোঁজে আজও
ইউনিয়ানের সঙ্গে ঘোরে, চা খায়, পতাকা ধরে থাকে
দলীয় শ্লোগান মেরে অশ্লীল ভঙ্গিতে হেসে ওঠে।
নেতাদের প্রতিশ্রুতি পরিত্যক্ত কারখানার ঝোপে
শৃগালের মতো দ্রুত গা ঢাকা দিয়েছে—

বন্দরের কয়লা ও লোহা
বাতাসে মিশিয়ে দেয় নিজেদের প্রবণতাগুলি,
ভবিষ্যতে কোনো দিন স্ফুলিঙ্গ ছড়াবে!

কয়লার তপ্ত আঁচে গলে যাওয়া লোহার দৃঢ়তা
মানুষের সভ্যতা নির্মাণ করে দিয়ে আপাতত
ব্যবহারহীন হতে হতে মরচে ধরে খসে পড়ে গেছে

আমার অভ্যাসগুলি

আমার অভ্যাসগুলি খাপছাড়া, স্বভাব-জটিল।
তার সঙ্গে যদি কোনও নদীর তুলনা করি, তবে
সেই নদী সারাক্ষণ ভরা নদী ক্ষুরধারা নয়,
হতে পারে মজা নদীও তা,
বুকে যার পলিজমা উর্বরতা, ফসলের খেত।
চটে ঘেরা শৌচাগার, সবজির বাগান, কুঁড়ে ঘর। পলাতকা
নদীর স্মারক হয়ে থেকে যাওয়া অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদে
যে-কয়েকটি জেলে ডিঙি আজও টিকে আছে,
আমার অভ্যাসগুলি তাদের স্খলিত পাটাতন
কাপড় কাচার জন্য জেলে বউ যেগুলিকে ঘাটে পেতে রাখে।

গেঁড়ি ও গুগলির খোঁজে সারাদিন জলে পড়ে থাকা
আমার কর্তব্যগুলি তাতে বসে দু-দণ্ড জিরোক!

প্রাকৃত

বৈষ্ণব কাব্যের মত্ত দাদুরী পুকুর পাড়ে ডাকে।
অসংস্কৃত জল, তাতে প্রাকৃত পৈঙ্গল ছন্দে বাড়া
কচুরিপানার দামে কোথাও গোপনে
ডাহুকীর সদ্যফোটা বাচ্চা রাখা আছে,
মেঘ দেখে তাই তার এত চঞ্চলতা—
মেঘ দেখে আরও যার বুক কাঁপে,
গোবিন্দ দাসের মেয়ে, তারও নাম রাধা।
এরকম কোনো এক শ্রাবণেই যাকে পাড়ার ছেলেরা
একরাত কৃষ্ণ-সহ ক্লাবঘরে আটকে রেখেছিল,
সেখানেই ফুলশয্যা, সেখানে বাসর। পরদিনই
কৃষ্ণ তো স্বভাবমতো বৃন্দাবন ছেড়ে
রাধিকা-বিহীন কোনও মথুরায় গেছে,
এখানে রাধিকা একা বাচ্চা নিয়ে
বাড়ি বাড়ি ঠিকা কাজ করে, আর ভাবে
বড়ো হলে ছেলেও কি একদিন বাপের মতোই
অন্য কোনো রাধিকার হৃদয় পোড়াবে?

রাস্তা

যে-রাস্তার সড়কের সঙ্গে যোগ নেই
সে-সব রাস্তার কথা ধীরে ধীরে লোকে ভুলে যায়—
শুধু সড়কের সঙ্গে যোগ আছে, এই যোগ্যতায়
বাড়ির কানাচ দিয়ে যাওয়া সব গলিঘুঁজি রাস্তাও যখন
কংক্রিট বাঁধানো হয়ে গর্বে ফুলে ওঠে,
সড়কের যোগহীন রাস্তাটির যত প্রশস্ততা
বুনো আগাছার ফাঁকে সম্ভ্রম হারায়

গলিতে তুফান তুলে যখন সদম্ভে ছোটে বাইক
সাইকেল উড়িয়ে নিয়ে বালকেরা যায়,
সড়কের যোগহীন রাস্তাটিতে তখন মন্থর এক বুড়ো চাষি
অকাল বর্ষণে ভেজা পাকা ফসলের আঁটি রোদে মেলে দেয়

লোক চলাচল নেই বলে এসব রাস্তায়
মেঠো ইঁদুরেরা তার গর্ত থেকে নির্ভয়ে বেরোয়,
বাবলার হলুদ ফুলের পাশে নীলকণ্ঠ পাখি বসে থাকে,
রোদের আশকারা পেয়ে তার কাছে ঘেঁষে আসে ছায়া,
হাওয়ার চঞ্চল হাত গাছেদের বেণি খুলে দেয়।

যে-রাস্তার সড়কের সঙ্গে যোগ নেই,
সে-রাস্তা দিয়েই রোজ দুপুরের রোদ একাকী সন্ধ্যার দিকে যায়…

শিখর

যে যার পাহাড় নিয়ে বসে থাকি, অটল শিখর,
বুক ফেটে কত শত শতদ্রু বিপাশা ঝরে যায়…
কত বর্ষা চলে যায়, ধস নামে, খসে পড়ে শিলা,
বুকে যে-পাষাণভার জমা থাকে, কখনো নামে না—
মুখোমুখি বসে থাকা, তবু দুই মুখে দু-রকম মেঘ,
একের মুখের মেঘ অন্যের আজও নয় চেনা।

মেঘের রাজ্যেই বাস, মেঘ ফুঁড়ে ওঠা দুই চূড়া,
এ-চূড়া আগ্নেয় গিরি, ও-চূড়াতে গলেনি বরফ…

মিথ

সিমেন্টের সঙ্গে আরও এক ভাগ বেশি বালি গোপনে মিশিয়ে
জোগাড়িয়া হারাধন গ্রীষ্মকালে খড়ের চালে আরামের গল্প ফাঁদে

খড়ের চালে বাসা বাঁধা চড়ুই পাখির ঝাঁক বিস্মৃতির ওপার থেকে উড়ে এসে
রাজ মিস্ত্রি হারাধনের বাটি থেকে নির্ভয়ে মুড়ি খেয়ে যায়

প্রমোটার হারাধন স্বপ্ন দেখে খোলা এক আকাশের—
সে-আকাশে উঁকি মারা সারি সারি তালগাছের পাতার শীর্ষ থেকে
বাবুই পাখির বাসা ঝোলে, তাদের ধরে আনা জোনাকিতে
সেইসব বাসার খোপে খোপে সন্ধে হলে আলো জ্বলে ওঠে।

জোগাড়িয়া থেকে রাজমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি থেকে প্রমোটার, হারাধনের বিবর্তনের ইতিহাসে
বাবুই পাখির বাসা আর খড়ের ঘরে আরামের গল্প
মিথ হয়ে বার বার ফিরে ফিরে আসে…

রাগের সন্তান

গেঁড়ি গুগলি খুঁজে ফেরা হাঁসের পালের পাশাপাশি
আমাদের এ-পাড়ার মেয়ে বউগুলি রোজ দুপুরের রোদে
ঝাঁক বেঁধে নেমে পড়ে নয়ানজুলিতে,
এক বেলা নিরামিষ কাটাবার মহাআয়োজনে
ছাকনি জালে উঠে আসে চুনোপুঁটি মাছ।
বাড়তি কিছু মিলে গেলে কাছাকাছি বাস স্টপ আছে,
নিমেষেই সব কিছু ফাঁকা হয়ে যাবে…

তাদের চোখের প্রান্তে ঝলসে ওঠে বাজারের আলো,
নখের দুরূহ কোণে নেল পালিশের মতো কাদা,
মরদ দেয় না কিছু, এইসব চোরা রূপটান
মেয়েদের নিজেদের উপার্জন, মরদ জানে না।
মরদেরা সারাদিন ঠা ঠা রোদে জগতের হাতে
পর্যুদস্ত হতে হতে সঞ্চয় করেছে শুধু রাগ,
সব রাগ ঢেলে দেবে অন্ধকারে রাতের শরীরে…

তাদের সন্তানগুলি, আমাদের এ-পাড়ার ছেলেপুলেগুলি
সেইসব মরদের ক্রোধজাত, জন্ম থেকে রাগের সন্তান…

বৃষ্টি নিয়ন্ত্রণ

মেঘেরা এখন খুব স্বাস্থ্য-সচেতন।
বিবাহিতা মেঘেরাও অষ্টাদশীটির মতো স্লিম হতে চায়,
সকাল হওয়ার আগে প্যারেডে বেরোয়,
তারপরে রোদ উঠে গেলে
ত্বকের ক্ষতির ভয়ে আর তারা বাইরে আসে না,
নেহাত বেরোতে হলে ফুলন দেবীর মতো
ওড়নায় ঢেকে রাখে মুখ।

আমাদের মতো যারা মেঘেদের বন্ধু ও স্বজন,
শনির মানত রাখি, মেঘেদের ঘরে যত কার্তিক বসাই,
কোনো কিছুতেই আর বৃষ্টি আসে না।

মনে হয়, আজকাল মেঘেরাও কন্ডোমের ব্যবহার শিখে গেছে!

শ্রীযুক্ত বদন দাস

তাঁতঘর অন্ধকার।
বদন দাসের তাঁতকলে ধুলোর চাদর বোনে নীরবতা,
মাকুর বদলে। অথচ বদন আজও হাটে যায়,
রাধামনি হাট থেকে কিনে আনা মিলের গামছা বড়ো যত্ন করে বেচে—
কেবল যে-সব দিনে হাট নেই, জাল হাতে চষে ফেলে বাড়ির পুকুর,
সন্ধ্যাবেলা এক গাছ থেকে অন্য গাছে বাদুড় ধরার জাল পাতে।
লবাদের বাঁশবনে শিরিষের ডালে ঝোলা যে-সব বাদুড়
সন্ধ্যাবেলা পর্যটনে যায়, সকাল হওয়ার আগে
তাদের দু-একটি যদি কখনও না ফেরে,
বদন দাসের ঘরে উৎসবের আয়োজন লাগে।

তাঁতঘর অন্ধকার। উৎসবের শেষে
শ্রীযুক্ত বদন দাস স্তব্ধ মাকুটির মতো বসে থাকে…

বিড়ির জন্য সনেট

বিড়ির ধোঁয়ায় আছে পাঠের বিরতি,
কৈশোরের মুক্তিস্বপ্ন, চোরা সুখ, ভয়।
ধোঁয়ার বিষম দিকে চরিত্রের গতি,
‘উন্মার্গগামিতা!’— ক’ন গুরু মহাশয়

কটুগন্ধ, তেতো স্বাদ, প্রতি টানে কাশি
প্রিয় নারীটির মুখ সহসা বিকৃত
ফারাক থাকে না কিছু, আঠারো কি আশি
যুবাকে প্রবীণ লাগে, জীবিতকে মৃত!

তথাপি বিড়ির তুল্য বন্ধু নাই আর
এক ফুঁকে দূরে যায় যত ভূত প্রেত
দেহ সূক্ষ্ম হলে বাড়ে মগজের ধার
বিড়ি অর্থে শ্রমজীবী, প্রোলিতারিয়েত,

যতই নেভাতে চাক সাহেবের বুট
আগুন লুকিয়ে রাখে পাতার চুরুট।

 

 

Facebook Comments

পছন্দের বই