লেখক নয় , লেখাই মূলধন

গল্প

সুরঞ্জন প্রামাণিক

গল্প নেই শহরের মানুষ

ইদানীং সমীরণ যে-কোনো চরিত্রকে শর্ট-ফিল্মের ছোটো ছোটো ফ্রেমের মধ্যে ধরতে চাইছে বা বলা যায় চিত্রনাট্যের ফ্রেমে আটকে দেখতে চাইছে বা বলা ভালো দেখছে। যেমন এখন, ওই দেখুন তার দু-হাতে ফ্রেমমুদ্রা। আনুভূমিক বুড়ো আঙুলদু-টি পরস্পরের দিকে আস্তে আস্তে দূরে সরে সরে যাচ্ছে। আর সমীরণের দৃষ্টি অনুসরণ করলে আপনি দেখতে পাবেন একজন বয়স্ক মানুষ মাথা নীচু করে ধীরে হাঁটছেন।

মানুষটা ফ্রেমের বাইরে চলে গেলে সমীরণ আপনাকে বা আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারে, আমরা লোকটাকে দেখলাম কি না, ‘যেন কী এক ভার বইছেন, না?’

আপনি ভাবতেই পারেন সমীরণ বুঝি তার দেখাটা আপনার উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। অথবা আপনার সেরকম মনেও হতে পারে। আপনি সায় দিলেন।
এবার সমীরণ তার বসার ভঙ্গি বদলে আপনার মুখোমুখি, ‘আচ্ছা বলুন তো, এই মনে হওয়া কীভাবে ভিস্যুয়ালাইজ করা যায়!’ এটা সমীরণের গুণ। সে দর্শক-পাঠকের কাছ থেকে নিয়ে তাঁদেরই ফিরিয়ে দেয়। তার কথায় এ একধরনের ‘মাধুকরী’। সৃষ্টির জন্য। ভোগের জন্য নয়। মাঝে মধ্যে মনে হয়, সমীরণ যত না শিল্পী তার চে’ অনেক বেশি দার্শনিক। আর এ-কারণে আমি তার ভক্ত। তাকে বোঝার চেষ্টা করি। তার সহযোগী হতে চাই।

ফ্রেমমুদ্রায় সমীরণ ও পাশে বসা তার বন্ধুকে দেখে এসব আমার মনে ঘটল এবং একটা গাধা ঢুকে বেরিয়ে গেল ওই ফ্রেম থেকে। আমার মনে হল সমীরণকে কিছু বলা দরকার।

তার আগে ফ্রেমবন্দি বয়স্ক মানুষটার গল্প বলে নিতে হবে। মানুষটার গল্প মানে আমাদেরও গল্প। মানুষটার নাম বিধু, বিধুভূষণ। একসময় বিধুদা আমাদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন। এই চায়ের দোকানে বসেই তিনি আড্ডা দিতেন। বিধুদাকে গল্পবাজ বলা যাবে কিনা জানি না। তিনি অবশ্য গল্পের টানেই এখানে আসতেন। গল্পের ম্যানুস্ক্রিপ্ট পড়া ছিল তাঁর নেশা। নেশাটা কোথায় বলুন তো! গল্প আবিষ্কার করা। বুঝলেন না তো! মানে গল্পের মধ্যে নানা গল্প তিনি দেখতে পেতেন। আমরা চমৎকৃত হতাম। বিশেষ করে লেখক। একবার সমীরণই তিন-তিনটে নতুন গল্পের সম্ভাবনা দেখে ভীষণ আপ্লুত হয়েছিল, কী এক আবেগে বিধুদাকে প্রণাম করে বসে। একবার হল-কী— কারো একটা গল্প পড়ার পর বিধুদার মুখ কেমন বে-বোধার মতো হয়ে গেল সেদিন। ম্যানুস্ক্রিপ্টে আরও একবার চোখ বুলিয়ে যেন নিজের মনেই নীচের ঠোঁট উলটে মাথা নাড়লেন। তাঁকে হতাশ দেখাচ্ছিল। বললেন, কথাটা এখনও মনে আছে, ‘খবরের কাগজের ঘটনা নিয়ে গল্প— ঘটনার বাইরে নতুন কোনো গল্প পাওয়া গেল না ভাই!’

তার পর অদ্ভুত সব বদলে যেতে থাকল। আমি গল্প লিখতে পারছিলাম না। সমীরণের গল্পেও বিধুদা আর নতুন গল্প পাচ্ছিলেন না। তাঁরও আসা কমে গেল। এর মধ্যে আমাদের অনেকেই কম্পুটারে লিখতে শুরু করেছি। মানে হাতে লেখা ম্যানুস্ক্রিপ্টের দিন শেষ। এসব জেনে বুঝেই হয়তো তিনি আর আসেন না। জানি না তিনি ফেসবুক সাহিত্যের কথা জানেন কি না। মাঝে একদিন পথে দেখা। কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘ভালো নেই!’

‘কেন কী হয়েছে?’

আমার মুখের দিকে, বলা ভালো চোখের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন, ‘গল্প লিখছ?’

আমি বললাম, ‘না।’

‘তুমি ভালো আছ?’

আমার কথা না শুনেই তিনি বললেন, ‘কী করে ভালো থাকবে! গল্প না থাকলে কি ভালো থাকা যায়? আচ্ছা ভাই আসি!’

সেদিন তাঁকে বেশ ঋজুই মনে হয়েছিল। এটা মনে হতেই সমীরণকে আর গাধার কথা না বলে বললাম, ‘তুই বরং বিধুদার সঙ্গে কথা বল! ক্যারেক্টারকে তো ভিতর থেকে জানতে হবে। সবচে’ বড়ো কথা, বিধুদাকে তুই প্রজেক্ট করতে চাইছিস কেন, এটা ভালো করে বুঝতে গেলে তো বিধুদাকে স্টাডি করা দরকার।’

সমীরণ কী ভেবে বলল, ‘আমার মনে হচ্ছে, বিধুদা এই সমাজে বেঁচে থাকার বৈধতা হারাচ্ছেন!’

‘কেন, এরকম মনে হচ্ছে কেন তোর?’

‘একদিন বিধুদাকে বলতে শুনলাম, একদা ডাকসাইটে নেতাকে বলছেন, তোমরাই তো এই পরিবেশ তৈরি করেছ কমরেড! আর আমাকে কয়েকদিন আগে বললেন, শুনেছ আদালত চত্বরে এক পাগলিকে ধর্ষণ করা হয়েছে? এই ক-দিন আগে এক পাগলকে কী যেন বলে, পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ কপালে— খুন করা হয়েছে— এর মধ্যে কি কোনো গল্প আছে? দেখো তো লিখতে পারো কিনা! তিনি একটা ক্লু দিলেন— একটা মানুষ এই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে, সে কিন্তু বলতে পারছে না— এই দুষ্কৃত নগর আমার দেশ না!’ এই ব্যাপার দুটো মিলে সমীরণের মনে হচ্ছে বিধুদার বেঁচে থাকার বৈধতা আর থাকছে না।

একটু ভেবে আমি বললাম, ‘মানে তুই আশংকা করছিস!’

‘আশংকার কথা ভাবিনি, তুই কী মনে করে বললি?’

‘কথাদুটো তো বিগত-বর্তমান উভয় সরকারের সমালোচনা হয়ে যাচ্ছে!’

‘ঠিক!’

‘আর সরকারের সমালোচনা মানেই দেশদ্রোহ— এক ওয়ান ফাইন মর্নিং আমরা শুনব, মাঝরাতে পুলিশ বিধুদাকে তুলে নিয়ে গেছে…’

সমীরণ অন্যমনস্ক। আমার মনে হল আমি তাঁকে ভাবাতে পেরেছি। সে কোনো নতুন দৃশ্য ভাবছে।
কথামতো বিধুদাকে চায়ের দোকানে ডেকে নিলাম। বললাম, ‘একটা অণুগল্প লিখেছি!’ বিধুদা কোনো উৎসাহ দেখালেন না। সমীরণ বলল, ‘একটা কথা খুব জানতে ইচ্ছে করে―’

‘বলো!’

‘আপনি কী এত চিন্তা নিয়ে হাঁটেন?’

‘কী দেখে তোমার মনে হল, আমি খুব চিন্তা নিয়ে হাঁটি!’

‘আপনার পথহাঁটা দেখে…’

বিধুদা একটু হাসলেন। তাচ্ছিল্যের না কি ব্যঙ্গের ঠিক বোঝা গেল না।

‘…যেন পৃথিবীর ভার আপনার কাঁধে, হারকিউলিস উপমা হয়ে আসে।’

নিজের মনেই আমি সমীরণকে তারিফ করলাম। গাধা নয়, হারকিউলিস তার মনে হওয়ার যথার্থ চিত্ররূপ।

‘আসলে হয়েছে কি, আমার চোখ ভালো নেই— সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে অসুবিধে হয় তাই মাথা নীচু করে পথ চলতে হয়—’ একটু দম নিয়ে বললেন, ‘তবে চিন্তা আছে, ছেলের চিন্তা ছেলে-বউয়ের চিন্তা— ঘরে নিত্য অভাব। খবরের কাগজের খারাপ খবর যেন ঘটে যাবে ওদের জীবনে— চিন্তা হয়, তোমাকে তো বলেছি… চিন্তা হয় কোথাও গল্প নেই দেখে।’ তারপর আমাকে বললেন, ‘দাও দেখি গল্পটা!’

গল্পটা পড়ে বললেন, ‘তুমি ঠিকই লিখেছ, শহরের বিত্তবানের চিন্তায় আমরা ভাবনা প্র্যাকটিস করছি। ধরে নেওয়া গেল, একটিও ভালো মানুষ নেই আমাদের শহরে। ভালো মানুষ করোনা আক্রান্ত রোগীর মতো, সে-কারণে ভালো মানুষ সাসপেক্টে পুলিশ একজনকে তুলে নিয়ে গেছে যাতে অন্য মানুষ আক্রান্ত না হয়। ভালো! কিন্তু এসবই তো নেগেটিভ বাস্তবের প্রসারণ— ‘একটিও ভালো মানুষ নেই’ এই অবাস্তব ব্যাপারটাকে কেউ গল্প ভাবতেই পারে, আমি ভাবতে পারছি না। আচ্ছা, ভালো মানুষের পক্ষে বাস্তব তৈরি হতে পারত নাকি?’ বলে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন।

সমীরণের হাতে ফ্রেমমুদ্রা, সে পায়ের ছবি ধরতে চাইছে। বিধুদা ফিরে এলেন। আমাকে বললেন, ‘শহর হোক-কি গ্রাম— তুমি কি মনে করো গরিব মানুষেরা চিন্তা করতে পারেন না?’

উত্তরের কোনো প্রত্যাশা ছিল না। তিনি চলে যাচ্ছেন। সমীরণের চোখ যেন দৃশ্যশূন্য। আর আমি উত্তর খুঁজছি…

Facebook Comments

পছন্দের বই