লেখক নয় , লেখাই মূলধন

লোকজ উৎসব

সুশীল রাভা

লোকধর্মের পিঠস্থান: আদি কামাখ্যাধাম

কথায় আছে “বিশ্বাসে মিলে বস্তু তর্কে বহুদূর”।লোকধর্মের মূল ভিত্তি হল অন্তর্নিহিত আত্মার বিশ্বাস। সেই বিশ্বাস থেকেই জন্মায় ভয়, ভীতি ও ভক্তি। ভক্তি থেকে সৃষ্টি হয় নানাপ্রকার দেবদেবীর কল্পিত রূপ। সেই কল্পিত রূপই স্থান-কাল বিশেষে প্রতিষ্ঠা পায় থান, ধাম, মন্দির প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। বস্তুত সেই প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমশ লোকবিশ্বাসের অন্তরালে প্রতিষ্ঠিত হয়ে লোকধর্মের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।

উত্তরবঙ্গের জেলাগুলো সেইসবের পীঠস্থান অথবা লোকধর্মের মিলনক্ষেত্রে বলেও প্রচলিত। নবগঠিত আলিপুরদুয়ার জেলার কুমারগ্রাম ব্লকের অন্তর্গত মধ্য কামাখ্যাগুড়ি গ্রামে অবস্থিত ‘আদি কামাখ্যাধাম’ তারই একটি নিদর্শন। শতাব্দী প্রাচীন এই ধামটি কে বা কারা, কবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্যসূত্র নেই। তবে এলাকায় জনশ্রুতি রয়েছে ধামটি নাকি কোচবিহারের রাজবংশের কোনো এক রাজা শিকার করতে এসে ধামটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু কোন রাজা বা কোন রাজ-আমলে ধামটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার কোনো লিখিত সূত্র নেই। বস্তুত সেইসময় লিখিত তথ্যের অভাবে কোচবিহার মহারাজগণের বহু ইতিহাস অজানাই থেকে গেছে। তথাকথিত গবেষকগণও বিষয়গুলি এড়িয়ে গেছেন।

এই জনশ্রুতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক। এলাকার জনশ্রুতি অনুযায়ী প্রধানদের বক্তব্য থেকে জানা যায় আদি কামাখ্যধামটি নাকি বুড়া রাজার আমলে প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। কিন্তু কে বুড়া রাজা, তার নামই-বা কী ছিল, তার কোনোটাই বলতে পারেননি। তবে প্রত্যেক বক্তাই রাজা বাদ্য-বাজনা সহকারে শিকারের বিষয়টিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। সেই সূত্রে এটা অনুমান করা যায়, যে, খুব সম্ভবত মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের আমলেই ধামটির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। কারণ, কোচবিহার মহারাজগণের শিকার কাহিনি পর্যালোচনা করে জানা যায় সেই সময়কালে একমাত্র মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণই আধুনিক পদ্ধতিতে রুচিসম্মত সরঞ্জাম নিয়ে শিকার যাত্রায় যেতেন।

কোচ রাজবংশের মহারাজদের মধ্যে মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণই ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যে উচ্চশিক্ষিত এবং আধুনিক রুচিশীল। তাঁর রাজত্বকালেই কোচবিহার রাজপ্রাসাদসহ রাজনগর আধুনিক শহরে রূপান্তরিত হয়েছিল। ফলে ঐতিহাসিক পণ্ডিতগণ মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণকে কোচবিহার রাজবংশের আধুনিক রূপকার বলে বর্ণনা করেন। জানা যায় মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ এক থেকে তিন সপ্তাহ সময় হাতে নিয়ে শিকার যাত্রায় বেরোতেন। শিকার করার আধুনিক সরঞ্জাম-সহ মনোরঞ্জনের গান-বাজনা বাদ্যযন্ত্র সঙ্গে রাখতেন। বিশেষত সাময়িক অবকাশ যাপন ও অবসাদ কাটানোর জন্য গান-বাজনা এবং হাস্যকৌতুক ছিল মনোরঞ্জনের অন্যতম উপাদান। কোনো কোনো সময় ম্যাজিক শো-ও দেখানো হত। শিকার অভিযানে বেরিয়ে যেখানেই রাত্রিযাপন করত, সেখানেই গানবাজনা ও হাস্যরসে গমগম করত। ফলে স্থানটি এক জমকালো উৎসবে পরিণত হত।

কোচবিহার ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ ১৮৬৩-১৯১১ খ্রিঃ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। তার মধ্যে ১৮৭১ থেকে ১৯০৮ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৭ বছর শিকার করার রেকর্ড রয়েছে। এই ৩৭ বছরে তিনি ৩৬৩টি বড়ো বাঘ, ৩১১টি চিতা বাঘ, ২০৭টি গণ্ডার, ৪৮টি বাইসন, ৫৩৩টি হরিণ, ৮১২টি অন্যান্য জীবজন্তু মেরেছিলেন।

মহারানি সুনীতি দেবীও একজন দক্ষ শিকারি ছিলেন।সেই সময় তিনি টাকোয়ামারী (বর্তমান-আটিয়ামোচড়) জঙ্গলে ১১টি বাঘ শিকার করেছিলেন। উল্লিখিত ধামটি ছিল টাকোয়ামারী বনাঞ্চলেরই অন্তর্গত। বস্তুত বনাঞ্চলটি অতীতে ভুটান-সহ অসমের মানস অভয়ারণ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল। সেই সূত্রে এই অঞ্চলটি ছিল বন্য জীবজন্তুদের অবাধ বিচরণভূমি। ধাম অবস্থিত অঞ্চলটিও ছিল ঘন অরণ্যে ঢাকা। ফলে কোচবিহারের শিকার বিলাসী মহারাজগণ প্রায়শই আসত শিকার করতে এই অঞ্চলে।

জনশ্রুতিতে রয়েছে একসময় রাজা শিকার করতে এসে, বর্তমান ধাম অবস্থিত নিকট স্থানে নল, খাগড়াবেষ্টিত একটি কর্দমাক্ত নালা (ডোবা) পার হতে গিয়ে রাজার হাতির চারটি পা কাদায় ডেবে যায়। মাহুত অনেক চেষ্টা করেও হাতিটিকে তুলতে পারেননি। ফলে সেইসময় রাজা অত্যন্ত বিচলিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। বিশেষত তাঁর এই প্রিয় হাতির করুণ দশা দেখে রাজা একপ্রকার ভেঙেই পড়েছিলেন। সেই সময়েই জঙ্গলের পাশেই বস্তিতে বসবাসকারী একজন বৃদ্ধ ‘কোচা-হুজি’, অর্থাৎ, কোচ (রাজ্য) জনগোষ্ঠীর গুণিন কবিরাজ, জঙ্গলে হাতির চিৎকার এবং মানুষের গুঞ্জন শুনে কৌতূহলবশত ধীরে ধীরে ঘটনাস্থলে এগিয়ে আসেন। ‘হুজি’ দেখতে পান রাজার হাতি হাওদা সহ কাদায় ডেবে গেছে।

হাতির এই অবস্থা দেখে, হুজি ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গিয়ে রাজাকে বলেন— “মহারাজের অনুমতি হলে আমি একটা উপায় দেখতে পারি”।

বিচলিত রাজা হুজির কথা শুনে কিছু না ভেবেই একটু বিরক্তির সুরেই বলেন— “কী উপায় আছে তাড়াতাড়ি বলো”।

হুজি রাজার অনুমতি পেয়েই কাঠিতে গণনা করে বলে দেন, যে, এখানে কামাখ্যা মায়ের পুজো দিতে হবে। পুজো দিলেই হাতি উঠে দাঁড়াবে। বিচলিত ও উদ্বিগ্ন রাজা হুজির কথা শুনেই তৎক্ষণাৎ পূজার আয়োজন করার নির্দেশ দেন হুজিকেই। হুজি রাজার আদেশ পেয়ে আনুষঙ্গিক উপাচার জোগাড় করে তন্ত্রমতে ভক্তি ভরে কামাখ্যা মায়ের পুজো করেন। সেই সময় সূর্য প্রায় অস্তগত। অগত্যা রাজা পাশেই একটা উঁচু জায়গায় তাঁবু খাটিয়ে অস্থায়ী শিবির তৈরি করে প্রিয় হাতির ওঠার অপেক্ষায় রাত্রি যাপনের সিদ্ধান্ত নেন। নিশিরাতে কিছু একটা শব্দে রাজার ঘুম ভেঙে যায়। সেইসময় রাজার একজন প্রহরী (সেপাই) ছুটে এসে খবর দেন মহারাজের হাতি কাদা থেকে উঠে গাছের পাতা খাচ্ছে। রাজা তাঁবু থেকে বেরিয়েই দেখেন, তাঁর প্রিয় হাতিটি সত্যি সত্যিই কাদা থেকে উঠে গাছের পাতা খাচ্ছে।

রাজা এইরূপ অলৌকিক ঘটনা দেখে দেবীর প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে ভক্তিভরে প্রণাম করে ঘোষণা করেন— “এখন থেকে প্রতি বছর অম্বুবাচি তিথি নিবৃত্তে এই স্থানে কামাখ্যা মায়ের পূজা করা হবে। আর এই পূজার খরচ কোচবিহার রাজকোষ থেকে পাঠানো হবে”।

বস্তুত তখন থেকেই অদ্যাবধি ধামের পূজা প্রচলিত নিয়মেই চলে আসছে। তবে কোচবিহার রাজকোষ থেকে কত দিন ধামের পূজার খরচ বহন করা হয়েছিল, তা সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। মূলত এলাকার অধিবাসীরাই চাঁদা তুলে ধামের পূজা প্রচলন ধরে রেখেছেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আদি কামাখ্যা ধাম অবস্থিত অঞ্চলটি অতীতে প্রাচীন কামরূপ (রত্নপীঠ) এর অন্তর্গত ছিল। এই প্রাচীন কামরূপ বা রত্নপীঠকে বলা হত তন্ত্র প্রধান দেশ। সেই দেশের অধিবাসীগণ ছিলেন মাতৃতান্ত্রিক এবং তন্ত্রে মন্ত্রে প্রসিদ্ধ। কামাখ্যা ছিল তাদের উপাস্য দেবী। সেই সূত্রে আদ্যাশক্তি কামাখ্যাদেবীর প্রভাব ছিল কামরূপের সর্বত্র বিরাজমান। উল্লিখিত ধামটি বলা চলে তারই একটি নিদর্শন। কোচ মহারাজাগণ ছিলেন আদ্যাশক্তি কামাখ্যা দেবীর উপাসক ও পরমভক্ত। সেই সূত্রে উল্লিখিত ধামটি কোচবিহার মহারাজগণের দ্বারা প্রতিষ্ঠা হওয়া অসম্ভব কিছু নয়।

জনশ্রুতি রয়েছে কামাখ্যা দেবীর নামেই নাকি এই জনপদের নাম হয়েছে কামাখ্যাগুড়ি। ‘গুড়ি’ শব্দের অর্থ অবস্থান। কামাখ্যা এবং গুড়ি শব্দদু-টি মূলত মঙ্গোলীয় শব্দ বলে ভাষা তথা সমাজবিজ্ঞানীদের অভিমত। এখানে কামাখ্যা দেবীর অবস্থান ঘটেছিল বলেই জায়গার নাম হয় কামাখ্যাগুড়ি।

এই স্থানের নাম সম্পর্কে ঐতিহাসিক কোনো তথ্যসূত্র না থাকলেও ইংরেজ গবেষক ডি. এইচ. ই. সন্ডার্স ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে ওয়েস্টার্ন ডুয়ার্সের প্রথম সেটেলমেন্ট জরিপের রিপোর্টে ধামটির কথা উল্লেখ করে গেছেন।

তিনি বলেছেন— “There was an idol, kamakhya thakur under a palash tree here. The taluk thus obtained its name- it is entirely under jungle”

এই শব্দগুলি তর্জমা করলে দাঁড়ায়— এখানে একটি পলাধঃ গাছের নীচে কামাখ্যা ঠাকুরের মূর্তি (থান) ছিল। তাই অঞ্চলটি এই নাম লাভ করে।

সন্ডার্সের এই বক্তব্যের মধ্য দিয়েই প্রমান হয় স্থানটি অতি প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী ধাম। ধামের প্রধান দেবী কামাখ্যা হলেও পাশাপাশি আরও আঠারোটি অনুসারী লৌকিক দেবদেবী রয়েছে। তাদের মধ্যে শীতলী, পাগলী, জোকা-জুকি, বাগসুর, কালসুর, বোকাসুর, লোহাসুর, মুড়িয়া মাশান, (বাগসুর, কালসুর, বোকাসুর, লোহাসুর এরা প্রত্যেকেই মাশান) রাখাল ঠাকুর, বুড়াঠাকুর, ভোটমুনি, সত্যপীর, বাসুকি, মনসা-সহ শিব, গঙ্গা ও লক্ষ্মী নারায়ণ আছে। উল্লিখিত দেব-দেবী তন্ত্রমতে এবং হুজি, অর্থাৎ, তান্ত্রিক দ্বারা পূজিত হন।

ধামের পূজা নাকি এক-দু-বছর বন্ধ ছিল। তার ফলে গ্রামে এক মহামারী কলেরার প্রকোপ শুরু হয়। জানা যায় সেই সময় গ্রামের বহু শিশু ও বৃদ্ধ মারা যান। সে-সময় গ্রাম প্রায় জনশূন্য হয়েছিল। এই মহামারি কলেরার হাত থেকে রক্ষা পেতেই গ্রামের অধিবাসীগণ তৎকালীন গাঁতবুড়া রাজবর রাতার নেতৃত্বে গ্রামের অশুভ শক্তিকে বিদায় করতে ‘হাংসবায়’, অর্থাৎ, গ্রাম পূজার আয়োজন করেন। সেই সময়ই গ্রামের প্রধান দেবী কামাখ্যা-সহ গ্রামের লৌকিক দেব-দেবী ও উপ-দেবতাগণের পূজা করে নদীতে ভেলা ভাসানো হয়। ভেলা ভাসানোর উদ্দেশ্য অশুভ শক্তিকে বিদায় করা। সমস্ত দেব-দেবীর পুজো করে অপশক্তি এবং কু-দৃষ্টির প্রকোপ থেকে বাঁচতেই, অর্থাৎ,ৈ সামগ্রিক মঙ্গলকামনার্থে মায়ের ভেলা ভাসানো হয়। ফলত তখন থেকেই রীতি মেনে অম্বুবাচি তিথি নিবৃত্তে ১১ আষাঢ় প্রতি বছর এই ধামের পূজা হয়ে আসছে। লৌকিক নিয়মে অম্বুবাচি তিথিতে পূজা করা হয় বলেই এই পূজাকে আমোতি/আমতি পূজাও বলা হয়।

ধামের মহাপূজার ১৫-২০ দিন আগে থেকেই বিশেষ দিন দেখে লৌকিক নিয়মে প্রত্যেক দেবদেবীর নামে বাঁশ জাগানো হয়। বাঁশের বিশেষত্ব ১০-১৫ ফুট লম্বা চিকন (সরু) বাঁশ সুন্দর করে মাটিয়ে দেব-দেবীর চরিত্র অনুযায়ী লাল শালু ও সাদা শালু কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে বাঁশের মাথায় ত্রিশূল বা চামর (চঙর) লাগানো হয়। যেমন প্রধান দেবী কামাখ্যার বাঁশ লাল-শালু কাপড় ও ত্রিশূলযুক্ত। দেবীরই বিকল্প রূপ-মা কালীর বাঁশ হয় অনুরূপ কাপড়ে মোড়ানো মাথায় কালো চঙর (চামর) লাগানো। অনুরূপভাবে আরও অন্যান্য দেব-দেবীগণের নামেও বাঁশ সাজানো হয়। এই বাঁশগুলো তন্ত্রমতে মন্ত্রপুত জল ছিটিয়ে শুদ্ধিকরণ করে জাগিয়ে তোলা হয়। বাঁশ জাগানোর বিশেষত্ব এই বাঁশ জাগানোর পরে কোনো তুলা রাশি ব্যক্তি হাতে নিলে, সেই ব্যক্তিটির ভর জাগে। এইরূপ অলৌকিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করার জন্য ধামের পুজোর দিন বহু মানুষের সমাগম ঘটে। বাঁশগুলো জাগানোর পর প্রত্যেক দেব-দেবীর থানে রেখে দেওয়া হয়। অম্বুবাচির আগেরদিন পর্যন্ত বাঁশগুলো নিয়ে গ্রামের আবালবৃদ্ধ মিলে ঢোল-করকা (বাদ্যযন্ত্র) বাজিয়ে প্রতিদিন নগর পরিভ্রমণ করে মাগন তোলেন।

অনুরূপভাবে মা বোনেরাও প্রধান দেবী মা কামাখ্যার যোট নিয়ে নগর পরিভ্রমণ করে মাগন তোলেন। মায়ের যোট বহন করা হয় কোনো অকুমারী (?) মেয়ের দ্বারা। বিশেষত অকুমারী মেয়ের মাথায় যোটটি বসিয়ে নগর পরিভ্রমণ করেন এবং মাগন তোলেন। সেই মাগনের চাল বিক্রি করে মূল পূজার উপকরণ সামগ্রী ক্রয় করা হয়।

তেল, সিঁদুর, ধূপ-ধুনা, আতপচাল, কলার থাতি, ফুল, দূর্বা প্রভৃতি উপাচার সহ দেব-দেবীর চরিত্র অনুযায়ী হাঁস, মুরগি, কবুতর ও পাঁঠা বলি বা উৎসর্গ করে দেওয়া হয়। মহাপূজা হয় প্রতি বছর ১১ আষাঢ় অম্বুবাচি তিথি নিবৃত্তে। সেইদিন বহু দূর দূরান্ত থেকে ভক্তরা আসেন মায়ের কাছে মানত করতে। বিশেষত কেউ আসেন সন্তান লাভের জন্য, কেউ-বা আসেন পারিবারিক শান্তি বা রোগমুক্তির দিশা নেওয়ার জন্য। বস্তুত মহাপুজোর দিন একাধিক ভত্তরীয়া ভর জাগেন। সেই ভত্তরীয়ার মাধ্যমে দেব-দেবীগণ ভক্তদের নানা সমস্যা সমাধানের নির্দেশ দেন। সেই দিন ভত্তরীয়াগণ এক অদ্ভুত আকৃতি ধারণ করেন। প্রত্যেকেই স্বাভাবিক মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে এক অলৌকিক শক্তিতে ভর করেন। সে এক ভয়ংকর দৃশ্য! ভত্তরীয়াগণ অলৌকিক শক্তিতে ভর করে পাঁঠা, কবুতরের মুণ্ড ছিঁড়ে তাজা রক্ত পান করে থাকেন। এইরূপ দৃশ্য দেখে মনে হয় ধামের দেব-দেবী আজও অতি সক্রিয় এবং জাগ্রত।

বিশেষত এই মহাপূজার মধ্য দিয়েই ভেলা ভাসিয়ে ধামের পুজোর সমাপ্তি ঘটানো হয়। ভেলা ভাসানোর উদ্দেশ্য সমস্ত আপদ-বিপদ ও অশুভ শক্তিকে বিদায় দেওয়া।

ভেলার বিশেষত্ব, পাঁচটি কলাগাছ একত্রিত করে গেঁথে ভেলা তৈরি করা হয়। ভেলার বৈশিষ্ট্য মাঝের কলা গাছটি বাড়তি রেখে দুই সাইডের দু-টি করে কলাগাছের মাথা তেড়া করে দিয়ে ভেলার মাথা চোখা করা হয়। ভেলার মাঝখানে নৌকো ঘরের ন্যায় ছই টাঙিয়ে ঘর বানানো হয়। সেখানেই অশুভ শক্তির বিনাশক মহাকালীর পুজো সাজানো থাকে। পূজা করা হয় সম্পূর্ণ তন্ত্রমতে হুজি, অর্থাৎ, তন্ত্রসিদ্ধ পূজারী দ্বারা। এই পুজোয় পাঁঠা ও কবুতর উৎসর্গ করে বাদ্য বাজনাসহকারে ভেলাটি পালকির ন্যায় বহন করে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। সেইসঙ্গে পুজোর পনেরো-কুড়িদিন আগে জাগানো বাঁশগুলোও বিসর্জন দেওয়া হয়। সেই রীতি আজকের দিনেও প্রচলিত রয়েছে।

ভেলা সাজান এবং তন্ত্রমতে পূজা

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে তৎকালীন মাড়েয়া (ধামের প্রধান) ভগলু রাভার নেতৃত্বে ধামে প্রথম মূর্তি পূজার শুরু হয়। এর পূর্বে শুধু থান বা ঢিবির উপরেই পূজা করা হত।

দেবী সিংহবাহনের উপর শায়িত শিবের নাভিপদ্ম থেকে প্রস্ফুটিত পদ্মে আসন করে বসা দেবীর ৬টি মাথা, ১২টি হাত, ২টি পা এবং দশ হাতে বিভিন্ন অস্ত্রে সুসজ্জিত। দেবীর দুই পাশে ব্রহ্মা, বিষ্ণু দণ্ডায়মান। এইরূপ অদ্ভুত আকৃতির দেবীর পাশাপাশি আরও অনেক লৌকিক দেব-দেবী আছে। তার মধ্যে মুড়িয়া মাশান ও বাগসুর অন্যতম। এহেন লোকধর্মের ঐতিহ্যবাহী ধামের পুজোরীতি মেনে শতাধিক বৎসর ধরে চলে আসলেও সরকারিভাবে এখনও পর্যন্ত কোনোরকম দৃষ্টিপাত করা হয়নি। পায়নি কোনো সরকারি সুযোগ-সুবিধা, পায়নি কোনো সরকারি-অনুদান অথচ এই ধাম বা মন্দিরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে পারত পর্যটনকেন্দ্র বা সর্বধর্মের মিলনক্ষেত্র। বিষয়টির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সরকারের প্রতি আবেদন রইল।

Facebook Comments

পছন্দের বই