লেখক নয় , লেখাই মূলধন

কবিতা

তৈমুর খান

ভিখিরি

দুর্বোধ্যের দুয়ারে
আমার হেমন্তকাল ও আমি
নতুন ধানের ঘ্রাণ
শিশিরের ভেজানো আবেশ মেখে
দাঁড়ালাম

তোমার মুখের দিকে
কোন সূর্য চেয়ে আছে
আজ?

সেই তো হলুদ শাড়ি
গোলাপি কাঁচুলি
রজনীগন্ধার মতো ফিকে সাদা চুড়ি
বেজে ওঠে

ভাষা নেই আমার
আজও কিংবদন্তির পাড়ায়
আমি নৈঃশব্দ্যের ভিখিরি

আনন্দের খোঁজে

আনন্দরা কোথায় গেল?
ঘরদোর ফাঁকা পড়ে আছে
শোকেসে সাজানো আছে পুতুল
রঙিন বেলুন আর খেলনাপাতি
শেল্ফে সব বইগুলি গোছানো আছে
ওয়াল হুকে ঝুলছে পুরোনো শার্ট
জানালার কাচে জমে আছে ধুলো
ধুলোয় আঙুলের অজস্র দাগ…

সূর্য রোদ গুটিয়ে নিচ্ছে এখন
গোধূলির আবিররাঙা মেঘে
নীরবে ঝরে পড়ছে দিন বিদায়ের সুর

কাঠের চাকা লাগানো গোরুর গাড়িটি
এখন এখানে আর নেই
ধানমাড়া খড়গুলিও এখানে রাখে না কেউ
বিকেলের শীতে রোদপোহানো মানুষ বসে না এসে
গল্পগুলি সব হারিয়ে গেছে
দু-টান বিড়ি খেয়ে যেত তারা আগে…

আনন্দরা তখন ফিরে আসত রোজ
ধান সর্ষে গম অথবা ইক্ষুক্ষেত থেকে
আনন্দদের ছেলেমেয়েরা শিস দিত
পায়রা নামত হাঁস-মুরগির ভিড়ে

অবেলায় কালিমাখা ধানসেদ্ধ হাতে
আনন্দরা ভাত খেত একসাথে বসে
কুটুমেরা আসত দূর দূর থেকে
ধুলোমাখা পা ধুয়ে উঠে বসত খাটে

কখনো ভোর হত মুড়ি ভাজা ঘ্রাণে
কখনো খেজুর রসে জমত পাটালি
কখনো শুকনো মাছ আর পুঁইশাকে
রান্না হলে চেয়ে নিয়ে যেত প্রতিবেশী

আনন্দরা খড় বিছিয়ে তালাই পেতে
দিব্যি ঘুমাত শীতের রাতে
শিয়ালের ডাকে পার হত রাত
আনন্দরা স্বপ্ন পুষে ঘুমে কুপোকাত

আজ একা ফিরছি শুধু ওদের ডেকে ডেকে
কেউ আর জল তোলে না শান্ত দিঘির ঘাটে
কেউ আর সাঁতার কাটে না স্নানে এসে
শালুক ফুল তোলে নাকো প্রথম ভালোবেসে

আনন্দরা কোথায় গেল?
এক খাবলা মাটি তুলে শুঁকে শুঁকে দেখি
স্নেহের পরশ লেগে আছে
ঝরে পড়া শুকনো ঘাম আর ধুলো
হেঁটে যাওয়া খালি পায়ে…
হয়তো আর বাজে না বেল পুরোনো সাইকেলে!

একটি নিজস্ব কবিতা

তোমার কাজের মধ্যে আছি
তোমার আলোর মধ্যে আছি
আমার ক্ষতগুলি শুধু উপশম খোঁজে
বাইরের ভিড়ে যেতে চায় না কেউ আর
অনেক নষ্টের পর যেটুকু বেঁচে আছি
হৃদয় তাতেই বাঁধে ঘর

হয়তো বসন্ত নেই তবু তো কোথাও ঘ্রাণ আছে
স্মৃতির আয়নার পাশে হলুদ ডানার প্রজাপতি
শব্দে শব্দে গুঞ্জন ওঠে
চাক গড়ে উপলব্ধির মৌমাছি

মুখ দেখে নিই একান্ত নিজস্ব মুখখানি
হেসে ওঠো, যে-হাসি ভোরের দৃশ্যে মিশে যায়
শরতের নিভৃত উল্লাসে নীলাকাশ হয়
তোমাকেই খুঁজে খুঁজে পাই কাকলি-কূজনে

নিজেকে দেখেছি এবার

অসুখ থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছি
দ্রুত মোটরগুলি চলে যাচ্ছে
পতাকা নেই আমার
হে মানুষ, পতাকা নেই!

ঘৃণার জলে ভিজতে ভিজতে
একটাও চালা নেই
সাইকেল নির্ভর জীবন
খণ্ডেৎ ত বিহীন বলে
উৎসব এল না আর

দূরের নকশা দেখে দেখে
কত পদ্ম ফুটল
চৈতন্য জাগল কলরবে
হাওয়ায় উড়ল সিংহাসন

একটা ভ্রমরের পেছনে পেছনে মধু সংগ্রহের উড়ান শুধু আর কিছু নয়

সংশয়

সংশয় একজন বালক বলে
ওকেও মাঝে মাঝে ভিরু মনে হয়
ব্রিজের উপর দিয়ে আমাদের গাড়িটি ছুটছে
ব্রিজও ছুটছে না তো?

আমরা ঝুলে আছি অনন্ত গভীরে
এখানে ভাঙা আকাশের টুকরো আর নিসর্গের নাভি স্বয়ংক্রিয় মায়াবী নিশীথ পড়ে আছে

যেতে যেতে ভাবনারা নড়ে উঠছে
ক্রমশ যেতে যেতে কেঁপে উঠছে আলো
সংশয় কিছুই বোঝে না—

ঝুলন্ত মহুল বনেও নিশ্চুপ কোকিল
টুপটাপ ঝরছে তার শৈল্পিক হৃদয়…

প্রস্তুতি

তোমার আঁচলে কত নক্ষত্র ফুটেছে
বিচিত্র আলোর ঝিকিমিকি
আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখি!

ওখানে হৃদয় রাখব তোমার আলোয়
ওখানেই রেখে দেব আমার বাঁশির সুর
ওখানে কখনো হবে না অন্ধকার!

শুধু রাত্রির সন্তান হয়ে বেঁচে থাকা যায়?
মাইল মাইল রাস্তা হেঁটে জীবনের আয়ু হল ক্ষয়
অন্ধকারে নিজেকেও বিশ্বাসঘাতক মনে হয়

সারারাত যদিও জেগে থাকি
সারারাত যদিও নক্ষত্রফুল কুড়াই
তবু এক উজ্জীবনের ডাক আসে শুনি

দীর্ঘশ্বাসগুলি লুকিয়ে ফেলি
আর তৃষ্ণাগুলি অস্বীকার করি
গভীর নির্জনে একা চুপি চুপি যাই…

এই জন্ম

যে-শব্দ গান হয়নি
আমি সে-শব্দের কাছে যাইনি কোনোদিন;
যে-মেঘ বৃষ্টি দেয়নি
আমি কি সেই মেঘের কাছে গেছি?
আমার শস্যের খেতে শব্দ আর গান
আমার মাথার ওপর মেঘ আর বৃষ্টির সম্মোহন।

এই জন্ম শুধুই বাঁশি
এ-জীবন শুধুই ভেজা ভেজা অভিমান

দুপুর বিকেল হয়ে আসে
বিকেল রাত্রির ডাক পায়—
গেরুয়া আলোর পথে নামে রাঙাচেলি
রাত্রিতে হেসে উঠবে অদ্ভুত জ্যোৎস্নায়!

বিশ্বাসের ধ্বনিগুলি বেজে ওঠে
অলৌকিক সমুদ্রের নৌকাগুলি ছেড়ে যায়
একে একে সমস্ত নাবিকেরা সাদা পোশাক পরে
আমিও ধূসর গন্ধ মুছে ফেলি মনে মনে

উপলব্ধির সব জানালায়
আমার আসক্তি তীব্র হলে
আবার আবার মেঘ জমে
শব্দেরা গান হয়ে ফেরে।

পাটনি কথিত

ওগো নদী, আমি চলে যাচ্ছি
আর ফিরব না কোনোদিন
আমার নৌকা ভাসিয়ে দিলাম

এখন আমি বিপন্ন স্মৃতির ভেতর
বানিয়ে নিয়েছি ঘরবাড়ি
এখন কান্নার জলের পুকুরে স্নান সারি

বহুদিন দেবী আসে না আর
গাড়ি চেপে চলে যাচ্ছে সব দেবী
সেতুর বাঁধনে বন্দি সব নদী সভ্যতার

কার স্পর্শে কে-বা সোনা হয়
কার বরে কাদের সন্তান দুধ-ভাত খায়
কিছুরই হিসেব জানা নেই তার

শুধু পতাকা উড়ছে চারিদিকে
হানাহানি আর কুৎসার গানে হাততালি
সব রাস্তা জুড়ে নেমেছে বাহিনী

এই পথে কবে আসবে আবার
আমাদের নবজন্মের বিদ্যা ও সুন্দর?
ছেঁড়া অন্নদামঙ্গল হাতে দাঁড়িয়ে আছে রায়গুণাকর!

Facebook Comments

পছন্দের বই